//
//

বাংলা গদ্যের বিকাশে অক্ষয়কুমার দত্তের অবদান আলোচনা কর।

অক্ষয়কুমার দত্ত

(১৮২০-১৮৯১)

অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৯১) বিদ্যাসাগরের মতোই বাংলা গদ্যে ও বাঙালির চিন্তার ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা ও শক্তির সঞ্চার করে দিয়েছেন। তিনি নিরাবেগ বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির বিশুদ্ধ ঐতিহ্য রেখে গেছেন আমাদের কাছে। অক্ষয়কুমারের সম্পাদনাতেই ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ‘তত্ত্ববোধিনী’র প্রথম প্রকাশ ঘটে। তিনি ছিলেন আবেগপ্রবণ বাঙালি সমাজের ব্যতিক্রম। সারাজীবন তিনি শুদ্ধ জ্ঞানের সাধনা করেছেন, বিশুদ্ধ ও নির্মোহ বুদ্ধির চর্চা কয়েক পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় মগ্ন থেকে এই জ্ঞান বুদ্ধিজীবী বাঙালি মানসের কাছে এক বিশেষ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

সাহিত্যজগতে তাঁর আবির্ভাব কবি হিসাবে। ‘অনঙ্গমোহন’ নামে একটি পদ্য ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তাঁর গদ্য রচনার সূত্রপাত হয় ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় আকস্মিকভাবে। তিনি গুপ্ত কবির সাহায্যে প্রভাকরের প্রয়োজনে নানাবিধ লেখা লিখে দিয়েছেন। এরপর তিনি তত্ত্ববোধিনীর সম্পাদক পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু সেকালের আরও বহু রচনার মও তাঁর তখনকার গদ্যের ভাষা সমান সাবলীল ছিল না। তত্ত্ববোধিনী সভা ও পত্রিকাকে কেন্দ্র করে অক্ষয়কুমার সেদিনকার নাগরিক বাংলার শ্রেষ্ঠ জ্ঞান মনীষার সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তাতে ভাবের সাযুজ্য যেমন ঘটেছে। তেমনি ভাব বিরূপতারও সম্মুখীন তাঁকে হতে হয়েছে। এই সংযোগ ও সংঘাতের মধ্যে দিয়ে অক্ষয়কুমারের ব্যক্তিত্ব স্পষ্টতা অর্জন করতে পেরেছিল। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, ব্রাহ্মসমাজে দেবেন্দ্রনাথের ভক্তিনত ভাবাদর্শ তিনি সব সময়ে মেনে চলতেন না। দেবেন্দ্রনাথের বেদ-উপনিষদের গভীর নিষ্ঠা তিনি মানতে পারেননি, বৈদিক সাহিত্য মানুষের রচিত, সুতরাং অভ্রান্ত নয়, সর্বৰ্থা গ্রহণীয়ও নয়—এরকম কথাও তিনি বলেছিলেন। অন্যদিকে পাশ্চাত্য পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং প্রমাণমূলক বাস্তব দর্শনবিদ্যার প্রতি তিনি গভীরভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন। তাই সব দিক থেকে তিনি ছিলেন জ্ঞানবিজ্ঞানবাদী উনবিংশ শতাব্দীর সার্থক প্রতীক পুরুষ।

অক্ষয়কুমারের গদ্যরচনা— ‘ভূগোল’ (১৮৪১), ‘পদার্থবিদ্যা’ (১৮৫৬), ‘চারুপাঠ’—তিন খণ্ড (১৮৫৩, ১৮৫৪, ১৮৫৯), ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’—[প্রথম ভাগ (১৮৫১), দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৩)], ‘ধর্মনীতি’ (১৮৫৬), ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ [প্রথম ভাগ (১৮৭০), দ্বিতীয় ভাগ (১৮৮৩)]।

অক্ষয়কুমার দত্তের রচিত গ্রন্থাবলী মূলত বুদ্ধি নির্ভর এবং মননাশ্রয়ী। তিনি কিছু স্কুলপাঠ্য জাতীয় গ্রন্থ রচনা করে শিক্ষার্থীর মনে বুদ্ধি ও যুক্তির পারম্পর্যকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি যেহেতু তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার শিক্ষক, নর্মাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, সেজন্য স্কুলপাঠ্য শ্রেণির পুস্তক রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁর ‘ভূগোল’ গটি তত্ত্ববোধিনী সভার আনুকূল্যে প্রকাশিত এবং তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার জন্য পাঠ্যগ্রন্থ হিসাবে রচিত এই গ্রন্থ রচনার সঙ্গে অক্ষয়কুমারের বিপুল জ্ঞানস্পৃহা, তথ্যানুসন্ধান ও বৈচিত্রানুসন্ধানী মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

‘পদার্থবিদ্যা’ গ্রন্থে বিজ্ঞানবিষয়ক তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন লেখক। বিজ্ঞানের গূঢ় বস্তুজ্ঞান ও তাত্ত্বিকজ্ঞানকে নতুনভাবে পরিবেশন করে, পরিভাষার প্রণালীবদ্ধ প্রকরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে গ্রন্থটিকে সজ্জিত করেছেন। বিজ্ঞানের বস্তুতন্মাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করেছে। বিজ্ঞানের অনুসরণে প্রাকৃতিক নিয়মের অনুবর্তনকেই অক্ষয়কুমার যথার্থ ধর্ম বলে মনে করেছিলেন। অক্ষয়কুমারের ধর্মানুভবের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক মননের স্বরূপ ছিল উল্লেখ্য।

‘ধর্মনীতি’ গ্রন্থটি রচনায় জর্জ কুম্বেরের Moral Philosophy নামক গ্রন্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে কুম্বেরের বস্তুতন্ময় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ এবং মধ্যযুগীয় বিশ্বাসকে তিনি একইসঙ্গে গ্রহণ করেননি। প্রাকৃতিক বিধান-ই যে ভগবত ভক্তির ভিত্তি—তা তিনি এই গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন।

‘চারুপাঠ’ গ্রন্থের তিন খণ্ডে স্বপ্নদর্শন বিষয়ক প্রবন্ধ এবং স্বদেশানুরাগ প্রকাশের উপযোগী কিছু প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে।

‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ গ্রন্থটি জর্জ কুম্বের-এর ‘The Constitution of Man Considered in Relation to eternal objects’’ অবলম্বনে রচিত। প্রকৃতির সঙ্গে বাহ্যজগতের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ নিয়ে জর্জ কুম্বেরের বক্তব্য অক্ষয়কুমার যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছেন। তাই গ্রন্থটিতে লেখকের মৌলিকতা যথেষ্ট। কেননা তিনি তার রচনায় মূল গ্রন্থ বহির্ভূত বহু উদাহরণ ও নির্দেশ দিয়েছেন, যা এদেশীয় জনগণের পক্ষে স্বাভাবিক ও কল্যাণকর। গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে মদ্যপানের অবৈধতা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তাছাড়া ধর্ম ও সামাজিক নিয়ম পালনের ফল, নানা প্রাকৃতিক নিয়মের সমবেত কার্য, ব্যক্তির পক্ষে তার ফলাফল প্রভৃতি আলোচনা করেছেন।

‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ অক্ষয়কুমারের শ্রেষ্ঠ গদ্যরচনা। উইলসনের ‘‘Essays and lectures on the Religion of the Hindus’’ অবলম্বনে রচিত হলেও লেখক এতে অনেক নতুন বিষয় যোগ করেছে। এটি বাঙালির গবেষণামূলক সাহিত্যের এক প্রধান নিদর্শন। সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন—“বিষয়গৌরবে ও লিপিকুশলতায় সত্যই তা ‘‘Masterpiece” (বাংলা সাহিত্যে গদ্য, পৃষ্ঠা-৭৮)। এই গ্রন্থে লেখকের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা, সত্যনিষ্ঠা, বিচারভঙ্গি, অসামান্য শাস্ত্রজ্ঞান এবং গভীর স্বদেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের দুটি উপক্রমণিকা। মৌলিক প্রবন্ধের পরিচয় বহন করে। এতে আপেক্ষিক শব্দবিদ্যা, প্রাচীন হিন্দুদের মধ্যে বেদিক ধর্মের প্রচলন, বৈদিক ধর্মের পর হিন্দু সম্প্রদায়ে পৌরাণিক ও তান্ত্রিক ধর্মের অসার, বিভিন্ন ধর্মের উপাসনাপ্রণালী স্থান পেয়েছে।

তাঁর মৃত্যুর পর ‘প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্য বিস্তার’ (১৯০১), গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এছাড়া ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত অথচ গ্রন্থাকারে অক্ষয়কুমারের কয়েকটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্যামূলক প্রবন্ধের পরিচয় যায়। ভাষার গাম্ভীর্য, ওজস্বিতা অথচ সহজবোধ্য গুণে এই প্রবন্ধগুলি সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। যেমন—‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদিগের দুরবস্থা বর্ণন’, ‘কলিকাতার বর্ত্তমান দুরাবস্থা’, ‘বিধবা বিবাহের যৌক্তিকতা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অক্ষয়কুমারের নির্ভীক ব্যক্তিত ন্যায়বুদ্ধি ও সত্যনিষ্ঠাই এই প্রবন্ধরচনায় উৎসাহিত করেছিল।

অক্ষয়কুমারের গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য

  • ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা গদ্যকে দিয়েছিলেন মাধুর্য ও শিল্পসুষমা—ভাবীকালের সার্থক সাহিত্যকর্মের যা বাহন। অক্ষয়কুমার দত্ত দিলেন যুক্তি বিচার সমৃদ্ধ ভারবহনের ক্ষমতা—যে দুর্লভ শক্তিবলে বাংলা গদ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাহন হতে পারে সহজে। সে ভাষা কেবল ঋজু নয়, মসৃণ এবং সাবলীলও। (ভূদেব চৌধুরী)
  • তিনি ইউরোপীয় ভাবপ্রচারের মিশনারী। তথ্যনিষ্ঠ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন ও প্রচার তিনিই প্রথম বাংলায় আরম্ভ করেন। তাঁর যুক্তিবাদে ও আলোচনায় দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ ব্রাহ্মধর্মকে অনেকটা যুক্তিবাদী করে তোলে। তাই তাঁর গদ্যও যুক্তিধর্মী।
  • হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন—“তিনিই বাঙালীর সর্বপ্রথম নীতি শিক্ষক”। শুধু বিষয় মাহাত্ম্য, গবেষণা প্রয়াস ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ছাড়াও অক্ষয়কুমার এদিক থেকেও স্মরণীয়।
  • বাংলা গদ্যে বহুবিধ কঠিন তথ্যের ও ভাবের প্রকাশ তিনি ঘটিয়েছেন দক্ষ লেখক রূপেই। প্রকৃতপক্ষে গদ্যের যা প্রথম উপযোগিতা তা হচ্ছে সাধারণ কাজ চালানো। “গদ্য হচ্ছে age of reason-এর স্বভাষা। সেই কাজের কথায় গদ্য ও যুক্তির আশ্রয় গদ্যভাষায় রচনার প্রথম চেষ্টা করেন অক্ষয়কুমার”। (গোপাল হালদার)
  • অনেকে তার গদ্যে সরসতার অভাব লক্ষ করেছেন, সত্যই তাঁর গদ্যের ভাষা বিশুষ্ক যুক্তিবাদের

ভাষা, তবে বাংলা গদ্যে তিনি যে সৃজনী শক্তির দিকটি প্রকাশ করেছেন তার মূল্য কম নয়।  প্রাবন্ধিক হিসাবে অক্ষয়কুমারের কৃতিত্ব হল—

  • অক্ষয়কুমারের সময় থেকেই প্রবন্ধে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয়।
  • তাঁর সময় থেকেই প্রবন্ধ বাদ-প্রতিবাদের পথ ত্যাগ করে একোক্তিমূলক প্রবন্ধরীতির সূত্রপাত।
  • পূর্ববর্তী লেখকদের গদ্যভাষা ও রীতিতে যে অনাবশ্যক সমসবাহুল্য ও জড়তাদোষ দেখা যায় তা অক্ষয়কুমারের গদ্যে নেই।
  • বিশুদ্ধ গদ্য যে বুদ্ধিপ্রধান তা অক্ষয়কুমার প্রথম দেখালেন। তাঁর এই ধারা পরবর্তীকালের প্রাবন্ধিকদের প্রভাবিত করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!