অনুকরণ তত্ত্ব বা মাইমেসিস সম্পর্কে আলোচনা কর।
অনুকরণ তত্ত্ব (Mimesis)
প্লেটো, অ্যারিস্টটল—উভয়ের মতানুসারে শিল্প অনুকরণ। অ্যারিস্টটল তাঁর পোয়েটিকস্ গ্রন্থের সূচনায় কাব্যের স্বরূপ, শ্রেণিবিভাগ, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি দেখতে চেয়েছেন। সেই সঙ্গে কাব্যের সার্থকতা বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য, প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন মহাকাব্য, ট্রাজেডি, কমেডি এসব কিছুকেই সাধারণভাবে বলা চলে অনুকরণ।
বাংলায় যাকে ‘অনুকরণ’ বলা হয় ইংরেজিতে তাকে বলা হয় ‘ইমিটেশান’। ইমিটেশান শব্দটি ল্যাটিন ‘Imitation’ শব্দটি থেকে এসেছে। এর মূল গ্রীক শব্দ মাইমেসিস (Mimesis)। অনুকরণ কথাটি শুনলে মনে হয় সেখানে স্বাধীন কল্পনার অবসর নেই। তবে অ্যারিস্টটল একথা বলেননি। অনুকরণকে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা যতে পারে— (ক) আক্ষরিক অনুকরণ (খ) সৃজনাত্মক অনুকরণ।
অ্যারিস্টটল কাব্যতত্ত্ব গ্রন্থে ট্রাজেডি প্রসঙ্গ সূত্রে অনুকরণ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে সমালোচনার পরিভাষায় ইমিটেশন শব্দটি দুটি ভাগে প্রযুক্ত হয়েছে। একই অর্থ—সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্প প্রকৃতির নিরুপণের সঙ্গে যুক্ত। এবং অন্য অর্থ ইমিটে শন দুটি রচনার মধ্যে যে অনুকারী রচনা তাঁর সঙ্গে পূর্বজ আদর্শ রচনাটির সম্পর্ক বোঝানোর জন্য প্রযুক্ত রয়েছে।
প্লেটোর ধারণা অনুযায়ী শিল্পের অনুকরণ হলো ‘আক্ষরিক অনুকরণ’। আর অ্যারিস্টটল শিল্পের অনুকরণ বলতে সৃজনাত্মক অনুকরণকেই বুঝিয়ে ছেন। অ্যারিস্টটলের মতে Intimation বা ‘অনুকরণ’ হল—‘A Creative Act’ অর্থাৎ শিল্প হল সৃজনাত্মক কাজ।
অ্যারিস্টটল তাঁর পেয়োটিকস্ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে সংগীতকে অনুকরণাত্মক শিল্প বলে অভিহিত করেছেন। প্লেটোর ধারণা অনুযায়ী অনুকরণ যদি আক্ষরিক হত তবে সঙ্গীতের মধ্যে কোন উৎসাহ খুঁজে পাওয়া যেত না। তাই অ্যারিস্টটলের ধারণা অনুযায়ী সঙ্গীতের সুরই প্রধান। এই সুর শিল্পীয় একান্ত নিজন্ব এবং তা সৃজনাত্মক। অ্যারিস্টটল তাঁর আলোচনায় মানব জীবনের শৈল্পিক অনুকরণকেই মুখ্য বা প্রধান হিসাবে ধরেছেন। তবে অ্যারিস্টটলের মতানুসারে মানবজীবন যেমন তেমনটি শিল্পে কখনই তুলে ধরা উচিত নয়। সেই মানুষের একটি নতুনতর রূপ ফুটিয়ে তোলা শিল্পীর কাজ। সেটা ভালো হতে পারে আবার মন্দ ও হতে পারে অর্থাৎ বাস্তব জীবনের কোন ঘটনা শিল্পী তাঁর মনের ভিতরে আগে গ্রহণ করেন। তাঁরপর শিল্পী আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অর্থাৎ সত্যকে বা মিথ্যা বা কল্পনা যোগ করে নতুনতর প্রতীকের মাধ্যমে তা আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেন। সেই উপস্থাপিত বিষয়-শিল্পী বস্তুজগতের বিষয় বস্তুকে ঝাড়াই বাছাই করে স্বতন্ত্র রূপ দেন । অ্যারিস্টটল যাকে ‘Organic Structure’ বলেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে ব্যক্তি গত আবেগ উচ্ছ্বাস, সুখ-দুঃখকে কখনই অনুকরণ করা যায় না। নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে তা সর্বজনীন হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গ ক্রমে আ্যারিস্টটল ইতিহাসের কথা তুলে ধরেছেন, তবে ইতিহাস ও কাব্য বস্তুজগতকে অনুসরণ করে। তবে ইতিহাসের সত্য বিশেষ দেশ কাল ও পাত্রের সীমায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু কাব্যের সত্য সর্বজনীন। কাব্য সামান্যের মধ্যে অসামান্যর ধারণার জন্ম দেয়। কাব্যে ভাব বা কল্পনার বিশেষ স্থান আছে। ইতিহাসের অনুকরণ হুবহু। তাই ইতিহাস নির্দিষ্ট তথ্যের কথা বলে। দিন কাল সময় পাত্র পাত্রীর নির্দিষ্ট থাকে সেখানে কল্পনার জায়গা নেই বললেই চলে। আর কাব্যে কল্পনা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তাই কবির মনোভূমি সেখানে বড় কথা। কাব্য বলে সর্বজনীন সত্যের কথা। অনুকরণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—“যা ঘটে তা সত্য নয়।’’ কারণ কবির মনোভূমি ক্রিয়াশীল বাস্তবভূমির থেকে অনেক বেশি সত্য। যদিও অ্যারিস্টটলের অনুকরণ তত্ত্ব এবং অনুকরণ তত্ত্ব সম্পর্কিত ধারণা থেকে কিছুটা পৃথক।
অ্যারিস্টটল ট্রাজেডির তত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়ে অনুকরণের ধারণায় ট্রাজেডি সম্পর্কে বলেছেন—ট্রাজেডি হলো গভীর পূর্ণাঙ্গ কোনো ক্রিয়াশীল বিষয়ের অনুকরণ। এ প্রসঙ্গে তিনি অনেক গ্রীক কাব্য নাটকের কথা তুলে এনেছেন। ট্রাজেডিতে এমন অনেক ঘটনা বা চরিত্রের উল্লেখ আছে যার কোন অস্তিত্ব বাস্তব জগতে নেই বললেই চলে। অথচ শিল্প রসিকরা সেই সকল কাব্য নাটক পড়ে আনন্দ লাভ করেন বা রস গ্রহণ করতে সমর্থ হন। অর্থাৎ বস্তুজগতে না থেকে ও তা কবিকল্পনার সৃষ্টি ঘটনা বা চরিত্রাবলী আনন্দদায়ক হতে পারে। প্রসঙ্গ ক্রমে তিনি ‘আনথেউস’ নাটকের উল্লেখ করেছেন। এবং সেখানে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে এই নাটকে এমন ঘটনাবলী ও চরিত্রাবলী আছে যার সাথে বাস্তবের ঘটনা ধারার কোন মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই নাটকের ঘটনা ও চরিত্র সবই কল্পিত। অথচ অ্যারিস্টটল এগুলিকেও অনুকরণ বলেছেন। যা পাঠককে ‘কাব্য সত্যের বোধে’ পৌঁছে দেয়৷
প্লেটো অনুকরণকে শিল্পরস সৃষ্টির ‘মূল লক্ষ্য’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু অ্যারিস্টটল এর সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে বলেছেন, অনুকরণ শিল্প সৃষ্টির ‘উপায়মাত্র’। শিল্প সৃষ্টির মূল লক্ষ্য হল অভিনব রূপের নির্মাণ। বস্তু জগতে যে অপূর্ণতা আছে শিল্পের জগৎ তা পূর্ণ করে। অর্থাৎ প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ধনের একটি উপায় শিল্পসৃজন।
‘পোয়েটিকস্’ গ্রন্থে অ্যারিস্টটল অনুকরণের তিনটি শ্রেণিবিভাগ করেছেন—
(১) বাস্তবের থেকে উৎকৃষ্ট— যা ট্রাজেডিতে লক্ষ করা যায়।
(২) বাস্তবের থেকে নিকৃষ্ট— যা কমেডিতে দেখা যায়।
(৩) বাস্তবের হুবহু অনুকরণ।
অ্যারিস্টটল বাস্তবজীবন সত্যের সচল, সজীব, প্রত্যক্ষতায় আস্থা রেখেছিলেন। ফলে এই গভীর জীবন চেতনা থেকেই তাঁর কাব্যতত্ত্বের মতামত উঠে এসেছে। তাই অ্যারিস্টটলের মতানুসারে—কবির অনুকরণের বিষয় মানুষের “কর্মবৃত্তই’’। যা পোয়েটিকস্ গ্রন্থে বারবার ধরা পড়েছে। ফলে অ্যারিস্টটলের কাছে অনুকরণ যান্ত্রিক দাসত্ব নয়; মানবিক সৃজনশীলতার নামান্তর। অনেক সময় বিষয় বা মাধ্যম এক হয়েও শিল্পীর নিজস্বতার কারণে তা স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। অ্যারিস্টটলের মতে অনুকরণরীতিই শিল্পীকে স্বতন্ত্র করে। জীবনের মহত্তম দিক যখন ফুটিয়ে তোলা হয় এবং তাঁর সাথে যদি জাতীয়তার যোগ থাকে তখন তা হয়ে ওঠে মহাকাব্য। মানবজীবনের রূপবৈচিত্ত্র্যকে সংলাপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুললে তা হয় নাটক। আর মানব জীবনের অনুভূতি বা উপলব্ধি যখন ছন্দময় ভাষায় প্রতিফলিত হয় তখন তা কাব্য হয়ে ওঠে। অর্থাৎ বলা যায় বিষয় বা মাধ্যম এক হলেও তা অনুকরণে প্রকৃতির জন্যই আলাদা শিল্প হয়ে ওঠে। ‘পোয়োটিকস্’ গ্রন্থে অনুকরণ তত্ত্বটি এভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন অ্যারিস্টটল।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply