//
//

অব্যয় কাকে বলে? অব্যয়ের শ্রেণিবিভাগসহ প্রতিটি ভাগের পরিচয় দাও।

অব্যয়

লিঙ্গ, বিভক্তি, পুরুষ বা বচন-ভেদে বাক্যের মধ্যে যে সকল পদের রূপের কোন পরিবর্তন হয় না, তাদের অব্যয় পদ বলা হয়। যেমন— ও, এবং, বাবা, ছিঃ, মরি, কিন্তু, তবু, তথাপি ইত্যাদি। ‘অব্যয়’ অর্থাৎ যার ব্যয় বা পরিবর্তন নেই— যে সমস্ত পদ সব অবস্থায় একই রূপ থাকে, তারা অব্যয় পদ। অব্যয় পদগুলি বাক্যস্থ শব্দগুলির স্থান, কাল, পাত্রের সম্বন্ধ-নির্দেশক এবং ভাব-প্রকাশক পদ।

সংস্কৃত বা তৎসম অব্যয়

বাংলায় প্রচুর সংস্কৃত [তৎসম] অব্যয় স্থান লাভ করেছে। যেমন— অকস্মাৎ অচিরাৎ, অতএব, অতঃপর, অতীব, অত্র, অথবা, অর্থাৎ, অদ্য, অধুনা, অনন্তর, অন্যত্র, অপি, অপিচ, অবশ্য, অয়ি, অরে, অহহ, আঃ, আশু, ইদানীং, একত্র, একদা, এবং, এবম্বিধ, কথঞ্চিৎ, কদাচ, কদাচিৎ, কদাপি, কল্য, কিংবা, কিঞ্চিৎ, কিন্তু, কুত্র, কুত্রাপি, কেবল, কচিৎ, চমৎকার, ঝটিতি, তত্র, তত্রাপি, তথৈব, তদানীং, ধিক্‌, নচেৎ, নতুবা, নিতান্ত, পশ্চাৎ, পরন্তু, পরশ, পুনঃ, পুনশ্চ, পৃথ, প্রত্যহ, প্রত্যুত, প্রভৃতি, প্রাক, প্রাতঃ, প্রায়, প্রায়শঃ, বরং, বরঞ্চ, বা, বিনা, বৃথা, যত্র, যথা, যদি, যদ্যপি, যাবৎ, যুগপৎ, রে, সদা, সদ্য, সম্প্রতি, সম্যক্‌, সর্বত্র, সর্বদা, সহসা, সাক্ষাৎ, সুতরাং, সুষ্ঠু, স্বয়ং, হা, হস্ত, হে। এগুলি বাংলার সাধুরীতিতেই সমধিক ব্যবহৃত হয়।

খাটি বাংলা অব্যয়

বাংলা ভাষার নিজস্ব অব্যয়ের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। সেগুলি খাটি বাংলা অব্যয়। যেমন— অথচ, আচ্ছা, আর, আবার, আ মরি, আ মরে যাই, আরে, আহারে, ইঃ, ইস্, উঃ, উহু, এ রাম, ওঃ, ওগো, ওরে, ওরে বাবা, ওলো, ও হরি, ওহে, ওহহ, কি, কেন, কখন, তখন, তবে, তবেই, তবু, তারপর, তেমনি, তো, দূর, ধুৎ, ধেৎ, ছি ছি, ছ্যা ছ্যা, না, নাকি, বাঃ, বাপরে, বাপস, বাহবা, বুঝি, বেশ, মরি মরি, মতো, মতন, যখন, যেমন, রাম রাম, শারাস, হায় হায়, হায়রে ইত্যাদি।

অব্যয়ের শ্রেণীবিভাগ

অব্যয় পদগুলি প্রধানত দু’প্রকার— এক. সংযোগবাচক বা সম্বন্ধবাচক এবং দুই. ভাববাচক। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, একই অব্যয় সংযোগবাচক বা ভাববাচক হতে পারে। কাজেই, প্রয়োগ এবং অর্থের ভিত্তিতে এদের শ্রেণীবিন্যাস হওয়া উচিত।

এক. সংযোগবাচক বা সম্বন্ধবাচক অব্যয়ের মধ্যে পড়ে— পদান্বয়ী অব্যয় এবং সমুচ্চয়ী বা বাক্যাম্বয়ী অব্যয়; দুই. ভাববাচক অব্যয়ের মধ্যে পড়ে— অনন্বয়ী অব্যয়। কাজেই, অব্যয় প্রকৃতপক্ষে তিন প্রকার— এক. পদান্বয়ী অব্যয়, দুই. সমুচ্চয়ী বা বাক্যান্বয়ী অব্যয় এবং তিন. অনন্বয়ী অব্যয়।

এক. পদান্বয়ী অব্যয়

বাক্যের বিভিন্ন পদের মধ্যে যে সমস্ত অব্যয় অন্বয় বা সম্বন্ধ প্রকাশ করে, তাদের বলা হয় পদান্বয়ী অব্যয়। স্মরণীয় যে, পদান্বয়ী অব্যয় বাক্যের অন্তর্গত পদসমূহের মধ্যে অন্বয় বা সম্বন্ধ প্রকাশ করে, বাক্যসমূহের মধ্যে নয়। যেমন— অন্তর, অবধি, বিনা, ব্যতীত, ছাড়া, সঙ্গে, সহিত। সহ, সনে, সম, মত, মতন, ন্যায়, সদৃশ, তুল্য, যেন, পশ্চাতে, সম্মুখে, পাশে, বামে, নিকটে কাছে, মধ্যে, মাঝে, মাঝখানে, ভিতর, ভিতরে, বাহিরে, সামনে, পিছনে, কাছে, নিমিত্ত, জন। তরে, পর্যন্ত, হইতে, হতে, থেকে, চেয়ে, পানে, প্রতি ইত্যাদি। এই অব্যয়গুলিকে আবার অনুসর্গ অব্যয়ও বলা হয়। এরা বিশেষ্য বা সর্বনামের পরে বসে বিভক্তির কাজ করে; অর্থাৎ বাক্যস্থিত পদগুলির সঙ্গে ক্রিয়ার সম্বন্ধ প্রকাশ করে।

দৃষ্টান্ত: “অশান্তির ‘অন্তরে’ যেথায় শান্তি সুমহান।” “আমি পরানের ‘সাথে’ খেলিব আজিকে মরণ-খেলা।” “আমার সকল ‘দিয়া’ সাজাব তোমারে।” “নদী জলে-পড়া আলোর ‘মতন’ ছুটে যা ঝলকে ঝলকে।” “হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের ‘মত’ নাচে রে।” “মোড়লের কাছে পত্র দেয় পাঁচ হাজার টাকা দাবি করে ব্রাহ্মণের ‘জন্যে’।” “দুঃখ ‘বিনা’ সুখ লাভ হয় কি মহীতে?” “ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব-‘পানে’।” “বাংলার মুখ ভুলে খাচার নষ্ট শুকের ‘মতন’ কাটাইনি দিনমাস।” “গাংশালিখের ঝাঁক মনে হয়, ‘যেন’ সেই কালীদহে ভাসে।” বনের ‘মাঝ’ দিয়ে আঁকাবাকা সরু পথ। “ইহার ‘চেয়ে’ হতেম যদি আরব বেদুয়িন।” “শিখর ‘হইতে’ শিখরে ছুটিব।” “ওপাড়া ‘হইতে’ আয় মায়ে-ঝিয়ে।” “বাঘের ‘সঙ্গে’ যুদ্ধ করিয়া আমরা বাচিয়া আছি।” “তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিড়ি নদীটির ‘পাশে’।”

দুই. সমুচ্চয়ী বা বাক্যান্বয়ী অব্যয়

যে সমস্ত অব্যয় একাধিক পদ বা একাধিক বাক্যের মধ্যে সংযোগ অথবা বিয়োগ সাধন করে, তাদের বলে সমুচ্চয়ী বা বাক্যাম্বয়ী অব্যয়। এই অব্যয় আবার বহু রকমের হয়ে থাকে। যেমন—

ক. সংযোজক অব্যয়

যে সমস্ত অব্যয় একাধিক পদ বা একাধিক বাক্যের মধ্যে সংযোগ সাধন করে, তাদের বলা হয় সংযোজক অব্যয়। যেমন— ও, এবং, আর, আরও, অপিচ, অধিকন্তু। ‘ও’, ‘এবং’ সাধু ও চলিত উভয় ভাষাতেই চলে; ‘আর’ চলে শুধু চলিত ভাষায়। যেমন— “তাহার কোমরে তরবারি এবং পিস্তল ‘এবং’ হস্তে বর্শা।” “উই ‘আর’ ইদুরের দেখ ব্যবহার।”

খ. বিয়োজক অব্যয়

যে সমস্ত অব্যয় একাধিক পদ বা একাধিক বাক্যের মধ্যে বিয়োগ সাধন করে, তাদের বিয়োজক অব্যয় বলা হয়। যেমন— না, কিংবা, অথবা, হয়, না-হয়। “এই জীবনটা ভালো ‘কিম্বা’ মন্দ ‘কিম্বা’ যা-হোক একটা কিছু।” “শূলের উপরে মরিবে সে জনা ‘অথবা’ নির্বাসনে।”

গ. সংকোচক অব্যয়

কিন্তু, তথাপি, তবে। “নিতান্ত অতিরিক্ত সুদে একজন বাকি টাকাটা ধার দিতে স্বীকার করিয়াছিল ‘কিন্তু’ সময় কালে সে উপস্থিত হইল না। অনেক অনুরোধ-উপরোধ জানানো হল, তথাপি তাহাকে টলানো গেল না। “তবে’ তাই হোক, ক্ষমাতেই আনো দাহ।

ঘ. হেতুবোধক অব্যয়

কারণ, যেহেতু, ব’লে, কেননা, জন্য। তোমার ‘জন্য’ আমরা অনেক মাশুল দিয়েছি। “কিছু বলব ‘ব’লে’ এসেছিলেম।” “তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে, তা ‘ব’লে’ ভাবনা করা চলবে না।

ঙ. নিত্য-সম্বন্ধী অব্যয়

যদি— তবে, যেই না— অমনি, যদিও— তবু, বরং তবুও, যে— সেই, যদিও— তথাপি। “টাকা ‘যদি’ দাও ‘তবেই’ ‘অপমান।” ‘যেই না’ পা দিয়েছ, ‘অমনি’ সব আলো নিবে গেল। “আমায় ‘যদি’ দেয় তারা নৌকাটি আমি ‘তবে’ একশোট দাড় আট।” ‘বরং’ মৃত্যু বরণ করব, ‘তবুও’ অন্যায়কে স্বীকার করব না। ‘যদিও’ মা তোর দিব্য আলোকে ঘিরে আছে আজ আধার ঘোর, কেটে যাবে মেঘ নবীন গরিমা ভাতিবে আবার ললাটে তোর।”

চ. সিদ্ধান্ত-মূলক অব্যয়

অতএব, সুতরাং, কাজেই, তাই। বিপদ কেটে গেছে; কাজেই, এখন তোমার ওখানে না গেলেও চলবে। তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা— আমার সরের অপূর্ণতা।”

ছ. ক্রিয়া-বিশেষণবাচক অব্যয়

সদ্যঃ, আপাততঃ, হঠাৎ, অকস্মাৎ, তৎক্ষণাৎ, দৈবাৎ। “সম্পাদকের পত্র পেলাম ‘সদ্য’, লিখতে হবে মধুর কিছু গদ্য।” “আপাততঃ’, দেশে কোন মারী-ভয় নেই।” “পূবে বাতাস এল ‘হঠাৎ’ ধেয়ে।” পথিমধ্যে তাহার সহিত আমার ‘দৈবাৎ’ দেখা হইয়া গেল। “অকস্মাৎ’ আসিবেক কোন অভিপ্রায়ে।” “সে আহত হইয়া ভূতলে পড়িয়া ‘তৎক্ষণাৎ’ প্রাণত্যাগ করিল।”

জ. ব্যতিরেকাত্মক অব্যয়

নচেৎ, নতুবা, নইলে। মন দিয়া লেখাপড়া কর, ‘নচেৎ’ জীবনে কষ্ট পাইবে। “খাইতে দাও—‘নইলে’ চুরি করিব।” “বন্ধু, তোমার বুকভরা লোভ দুচোখে স্বার্থ-তুলি/‘নতুবা’ দেখিতে তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।”

তিন. অনন্বয়ী বা ভাববাচক অব্যয়

বাক্যের সঙ্গে যে সমস্ত অব্যয়ের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকে না, কিন্তু মনের উচ্ছ্বাস বা কোনো বিশেষ ভাব প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়, তাদের অনন্বয়ী বা ভাববাচক অব্যয় বলা হয়। যেমন—

ক. বিস্ময়বোধক অব্যয়

আহা, অ্যাঁ, ওমা, ওরে বাবা, বাহবা। “আহা’, এ কি আনন্দ !” “ওরে ‘বাবারে’, মেরে ফেললে রে!” “অ্যাঁ’, তাই নাকি? ‘ওমা’, কোথায় যাব ? “বাহবা’! ‘বাহবা’! বাহা!”

খ. প্রশংসাবোধক অব্যয়

বাঃ, মরি মরি, চমৎকার, খাসা, বেশ! ‘বাঃ’! কী সুন্দর ছবি একেছে। “পূর্ব-হাওয়াতে দেয় দোলা আজ ‘মরি মরি’!” “মরি লো ‘মরি’ আমায় বাশিতে ডেকেছে কে।”

গ. ঘৃণাবোধক অব্যয়

ছিঃ, ছি-ছি, থু, ধিক। “ছি ছি’! তোরা কাপুরুষ!” “ছি ছি’, কুৎসিত কুরূপ সে।” “ধিক্ ধিক্’ ওরে, শতধিক তোরে।” “ধিক’ ধনুঃশর, ‘ধিক’ বাহুবল।”

ঘ. সম্মতিবোধক অব্যয়

আচ্ছা, আজ্ঞে হ্যাঁ। “আচ্ছা’, সে দেখা যাবে।” আজ্ঞে ‘হ্যাঁ’, তাই হবে।

ঙ. অসম্মতিবোধক অব্যয়

না, উঁহু, কিছুতেই না, কখনো না। “না’, আমি তোমাদের কোন কথাই শুনব না।”

চ. আহ্বানবোধক অব্যয়

ওহে, ওরে, ওগো, ও। “ও’ চাপা, ‘ও’ করবী।” “ওরে’ বকুল, পারুল, ‘ওরে’ শালপিয়ালের বন।” “ওহে’ নবীন অতিথি, তুমি নূতন কি তুমি চিরন্তন।” “ওগো, প্রাসাদের শিখরে আজিকে কে দিয়েছে কেশ এলায়ে?”

ছ. বিরক্তিবোধক অব্যয়

‘ধেৎ, ধুত্তোরি, কি জ্বালা! ‘কি মুস্কিল’, তোমরা যে সবাই বেড়াতে চললো কাজ করবে কে?

জ. কাতরতাবোধক বা শোকজ্ঞাপক অব্যয়

হায়-হায়, হায়, ও হো-হো। “হায়’ সূর্পণখা, কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই রে অভাগী, কাল পঞ্চবটীবনে কালকূটে ভরা এ ভুজগে ?” “হা’ পুত্র, ‘হা’ বীরবাহু, বীরচূড়ামণি।”

ঝ. প্রশ্নবোধক অব্যয়

প্রশ্ন বোঝাবার জন্যে বাক্যের মধ্যে যে সব অব্যয় ব্যবহার করা হয়, তাদের প্রশ্নবোধক অব্যয় বলা হয়। যেমন— নাকি, কেমন, তেতা, না, নারে, বটে ইত্যাদি। “তোমার ‘নাকি মেয়ের বিয়ে?” “কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল রক্ষঃপুরে?” “আমিও নেই, দিদিও নেই, কেমন মজা হবে?”

ঞ. তুলনাবাচক অব্যয়

তুলনা বোঝাতে যে অব্যয়গুলি ব্যবহৃত হয়, তাদের তুলনাবাচক অব্যয় বলা হয়। যেমন— মত, মতন, ন্যায়, যেন, সদৃশ, সম, যেমন, যথা ইত্যাদি। সোনার থালার মতো আকাশে উঠলো পূর্ণিমার চাদ। “নদী-জলে-পড়া আলোর ‘মতন’ ছুটে যা ঝলকে ঝলকে।” তাহার ‘ন্যায়’ নির্বোধ আমি দেখি। নাই। “নিশার স্বপন ‘সম’ তোর এ বারতা।” ইস্পাত-‘সদৃশ’ দুই বাহু।

ট. বাক্যালংকার অব্যয়

যে সমস্ত অব্যয় বাক্যের অলংকরণের জন্যে অর্থাৎ সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে ব্যবহৃত হয়, তাছাড়া অন্য কোনরূপ অর্থপ্রকাশে সাহায্য করে না, তাদের বাক্যালংকার অব্যয় বলা হয়। যেমন— না, তো, বা, গে, আর, কি। “সে ‘তো’ আর ফিরবে না রে।” “তুমি ‘যে’ সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে।” যাও ‘না’ একবার দেখ না। “শ্যামল ছায়া নাই ‘বা’ গেলে।

ঠ. ধ্বন্যাত্মক অব্যয় বা অনুকারবোধক অব্যয়

যে সমস্ত অব্যয় ধ্বনির অনুকরণে গঠিত, তাদের ধ্বন্যাত্মক অব্যয় বা অনুকারবোধক অব্যয় বলে। যেমন— ঝর ঝর, শন শন, টাপুর টুপুর, টিপ টিপ, ঠক্ ঠক্‌, রি রি, হি হি, হো হো, গো গো।

ড. উপসর্গ অব্যয়

এই অব্যয়গুলি ধাতুর পূর্বে বসে নতুন নতুন শব্দ গঠন করে কিংবা শব্দকে নতুন নতুন অর্থ দান করে। যেমন— [আ-হৃ=] আহার, [বি-হৃ= ] বিহার, [বি-অব-হৃ= ] ব্যবহার।

*খাটি বাংলা উপসর্গ অব্যয়

[‘অ’-ঘোর] অঘোর, [‘অনা’-ছিষ্টি] অনাছিষ্টি, [‘হা’-ভাতে] হাভাতে, [‘হা’-ঘরে] হাঘরে, [‘আ’ কাঁড়া] আকাড়া।

অনুকার অব্যয়

যে সব অব্যয় ধ্বনির অনুকরণে গঠিত, তাদের অনুকার অব্যয় বলা হয়। এই অব্যয়গুলিকে বাদ দিলে বাংলা ভাষার বর্ণনার শক্তি একেবারে পঙ্গু হয়ে যায়। অথচ এদের মধ্যস্থতায় ভাবের প্রকাশ এমন নিখুঁত হয়, যা অন্য কোন ভাবে সম্ভব নয়। যেমন— ‘টকটক’ শব্দটি। ‘টকটক’ ঘোর লাল রঙের দ্যোতক। কিন্তু সেই লাল রং যখন ঈষৎ ফিকে হয়ে আসে, তখন তা আর ‘টকটক’ না থেকে হয়ে যায় ‘টুকটুক’। কাজেই, আমাদের অনুভূতির জগতে অনুকার অব্যয়গুলি হুবহু ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে ভাবকে নিখুঁত ভাবে পরিবেশন করে। সেদিক থেকে অনুকার অব্যয় ভাবের নিখুত পরিবেশনার নিপুণ এবং বিশ্ব রূপকার। বাংলায় এরূপ অনুকার অব্যয় আছে বিস্তর। তাদের কয়েকটি এখানে প্রদত্ত হল—

আইঢাই, আঁকুপাকু, আকুবাকু, আঁটসাট, আনচান, আমতা-আমতা, ইঃ, ইকড়ি-মিকড়ি, ইড়িংবিড়িং, ইলিবিলি, উসখুস।

কচ, কচাৎ, কচকচ, কচাক, কচরকচর, কচমচ, কট, কটাৎ, কটাস, কটকট, কটাকট, কড়কড়, কড়াৎ, কড়মড়, কনকন, কপ, কপাৎ, কপকপ, কপাকপ, করকর, কলকল, কসকস, কিচকিচ, কিচিমিচি, কিচির মিচির, কিড়মিড়, কিরকির, কিলবিল, কুচ, কুচকুচ, কুট, কুটকুট, কুটুর কুটুর, কুটুস, কুপ, কুপকুপ, কুরকুর, কুলকুল, কুঁই কুঁই, কেঁই-কেঁই, কেউমেউ, ক্যা, ক্যাক্যা, কোকো, কো-কোৎ, ক্যাচ, ক্যাচক্যাচ, কেঁচর কেঁচর, ক্যাটক্যাট, খক, খক খক, খচখচ, খচাখচ, খচমচ, খট, খটখট, খটমট, খটাখট, খটাৎ, খটাস, খটর-খটর, খটমট, খটর মটর, খড়খড়, খড়মড়, খনখন, খপ, খপাৎ, খপাস, খরখর, খলখল, খস, খসখস, খাখা, খিক, খিকখিক, খিটখিট, খিটিমিটি, খিলখিল, খুক, খুকখুক, খুট, খুটখুট, খুটখাট, খুটুস, খুঁৎখুৎ, খুসখুস, খ্যাক-খ্যাক, খেঁচাখেঁচি, খ্যাচাখ্যাচ, খ্যান-খ্যান, গজগজ, গটগট, গটমট, গড়গড়, গদগদ, গমগম, গপগপ, গবগব, গব, গবাগব, গমগম, গরগর, গলগল, গাগা, গাইগুই, গ্যাকগ্যাক, গিজগিজ, গিসগিস, গুরুগুরু, গড়গড়, গুনগুন, গুবগাব, গুম, গুমগুম, গোগো, ঘটঘট, ঘড় ঘড়, ঘড়াং ঘড়াং, ঘাউ-ঘাড, ঘিনঘিন, ঘুটঘুট, ঘুরঘুর, ঘুস, ঘস-ঘস, ঘেউ, ঘেউ-ঘেউ, ঘোঘোৎ, গ্র্যাচর গ্র্যাচর, ঘ্যানঘ্যান, ঘ্যানর-ঘ্যানর।

চকচক, চকমক, চট, চটচট, চটাচট, চচ্চড, চড়াৎ, চডাস, চনচন, চপচপ, চিঁ চি, চিকচিক, চিকমিক, চিটচিট, চিডিক-চিড়িক, চিড়চিড়, চিনচিন, চকচক, ঠো, চ্যাটাং-চ্যাটাং, চোচো, চ্যাঁচ্যাঁ, চ্যাভ্যাঁ, ছটপট, ছপছপ, ছপাৎ, ছপাস, ছমছম, ছলছল, ছো, ছোছো, ছোকছেক, ছ্যাক, ছাকাক, জরজর, জ্যারজ্যার, জ্যালজ্যাল, জুলজুল, ঝক, ঝকঝক ঝকমক, ঝট, ঝটপট, ঝন, ঝনঝন, ঝপঝপ, ঝপাঝপ, ঝমর, ঝর-ঝমর, ঝমাঝম, ঝর, ঝরঝর, ঝলমল, ঝা, ঝাঝা, ঝিনঝিন, ঝিকমিক, ঝিকিমিকি, ঝিমঝিম, ঝিরঝির, ঝিলমিল, ঝিলিমিলি, ঝুনঝুন, ঝুপঝুপ, ঝুমঝুম, ঝুরঝুর, কুরুকুরু।

টক, টকটক, টকাটক, টং, টংটং, টনটন, টপ, টপটপ, টপাটপ, টলটল, টলমল, টসটস, টিকটিক, টিংটিং, টিপটিপ, টিমটিম, টুকটুক, টুকুস টুকুস, টুং, টুংটুং, টুংটাং, টুনটুন, টুপটুপ, টুপুস, টুপুস টুপুস, টুপটাপ, টো, টো-ট্যা, ট্যাঙস, ঠক, ঠকঠক, ঠকর ঠকর, ঠুংঠং, ঠনঠন, টুনটুন, ঠাই-ঠাই, ঠ্যাং ঠ্যাং, ঠাস, ঠাসঠাস, ডগডগ, ডগমগ, ড্যাব ড্যাব, ড্যাং ড্যাং, ড্যাড্যাং ড্যাং।

ঢক, ঢকঢক, ঢাকাঢক, ঢনঢ়ন, ঢপ, ঢপটপ, ঢলঢল, ঢিপ, ঢিপঢিপ, টুকটুক, ঢুকুটুকু, ঢুলুঢুলু।

তকতক, তড়তড়, তড়বড়, তড়াক, তড়াক-তড়াক, তরতর, তলতল, তুলতুল, তিড়িং, তিড়িং-তিড়িং, তড়াং, তড়াং-তড়াং, থক, থকথক, থপথপ, থমথম, থরথর, থলথল, থমথম, থপ থপাস, থিকথিক, থইথই, দগদগ, দপদপ, দবদব, দমাদম, দমাদ্দম, দরদর, দড়াম, দাউদাউ, দুদুড়, দুদ্দাড়, দুপদুপ, দুপদাপ, দুমদুম, দুমদাম, ধক, ধকধক, ধড়ধড়, ধড়াস, ধড়াসধড়াস, ধড়াদ্ধড়, ধড়ফড়, ধড়মড়, ধপ, ধপধপ, ধপাধপ, ধপাস, ধবধব, ধম, ধমাস, ধমধম, ধমাদ্ধম, ধস, ধসধস, ধাঁ, ধাঁই ধাঁধাঁ, ধিকিধিকি, ধিনধিন, ধুপধুপ, ধুম, ধুম-ধুম, ধুমাধুম, ধুপধাপ, ধূ ধূ, ধেইধেই, নড়নড়, নড়বড়, নিসপিস, নিড়বিড়।

পট, পটপট, পটাপট, পটাৎ, পটাস, পটাস-পটাস, পচপচ, পড়পড়, পড়াস, পড়াৎ, পড়াং, পড়াং-পড়াং, পিটপিট, পিলপিল, পিপি, পুট, পুটপুট, পেঁ, প্যা, প্যাঁক-প্যাঁক, প্যাঁচপ্যাঁচ, প্যানপ্যান, প্যাট প্যাট, পটাং, পটাং-পটাং, ফট, ফটফট, ফটাফট, ফড়ফড়, ফটাৎ ফটাস, ফড়াৎ, ফড়াস, ফনফন, ফরফর, ফস, ফসফস, ফিক, ফিকফিক, ফিটফাট, ফিনফিন, ফিসফিস, ফিসফাস, ফুটফুট, ফুটফাট, ফুরফুর, ফুড়ুৎ, ফুড়ুৎ-ফুড়ুৎ, ফুস, ফুসফুস, ফুসফাস, ফোঁ-ফোঁ, ফোঁফোঁ, ফোসঁ, ফোঁস-ফাঁস, ফ্যাঁ, ফ্যাঁ-ফ্যাঁ, ফ্যাঁকফ্যাঁক, ফ্যাঁচ, ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ, ফ্যাল ফ্যাল, বকবক, বকর বকর, বাইবাই, বনবন, বিজবিজ, বিড়বিড়, বোঁ, বোঁবোঁ, ব্যাজর ব্যাজর, ভক, ভক ভক, ভড়ভড়, ভরভর, ভনভন, ভুটভাট, ভুরভুর, ভুড়ুক ভুড়ুক, ভো, ভে-ভো, ভ্যা, ভ্যানভ্যান, ভিনভিন, মচমচ, মট, মটমট, মড়মড়, মড়াৎ, মসমস, মিউমিউ, মিটমিট, মিনমিন, মুচ, মচমচ, ম্যাড়ম্যাড়, ম্যাজম্যাজ।

রি-রি, রীরী, রিন রিন, রিম রিম, রিনি রিনি, রিনি ঝিনি, রুনু রুনু, রুনুঝুনু, রৈ রৈ, লকলক, লটপট, লিক লিক, শোঁ, শোঁ-শোঁ, সট, সট সট, সটাসট, সনসন, সড়সড়, সপসপ, সপাসপ, সপাং সপাং, সরসর, সিরসির, সঁ, সার্সা, সাইসাই, সুটসুট, সুরসুর, সুড়ৎ, সেঁ সেঁ, স্যাৎ স্যাৎ হট, হটহট, হটর হটর, হড়হড়, হড়বড়, হড়াৎ, হড়মড়, হড়র হড়র, হনহন, হলহল, হাউ-মাউ, হা, হাহা, হানটান, হাউহাউ, হাঁহ, হাঁস-হাস, হিহি, হিড়হিড়, হুহু, হুটহাট, হুড়হুড়, হুড়মুড়, হুপহাপ, হুস, হুসহুস, হুমহাম, হৈহৈ, হৈচৈ, হোহো, হেট হেট, হাপুস হুপুস।

এই অনুকার শব্দগুলির বৈশিষ্ট্য হল, একক ভাবে শব্দটি যে অর্থ দ্যোতিত করে, যুগ্মভাবে তার দ্যোতনা সেরূপ নয়— ভিন্নতর। যেমন: খিক— সে ‘খিক’ করে হেসে ফেললো। খিকখিক— সে ‘খিকখিক’ করে হাসতে লাগলো। দুটি অনুকার অব্যয়ের অর্থদ্যোতনা ভিন্নতর। তেমনি, সে ‘গপ’ করে খেয়ে ফেললো। এবং সে ‘গপাগপ’ করে খেতে লাগলো। শব্দ দুটির অর্থদ্যোতনা ভিন্ন ভিন্ন রূপ। আবার, সে ‘ঢকঢক’ করে জল খেতে লাগলো। এবং ছেলেটি ‘টুকটুক’ করে সবটুকু দুধ খেয়ে ফেললো। শব্দ দুটির অর্থদ্যোতনার মধ্যে পার্থক্য লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন— অনুকার অব্যয়গুলির ‘‘ধ্বনি-বৈচিত্র্য এত সহজে এত বর্ণনা-বৈচিত্র্যের অবতারণা করিতে পারে যে, তাহা অর্থবদ্ধ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা দুঃসাধ্য।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!