আবদুল হাকিমের ইউসুফ জোলেখা ও লালমতী সয়ফুলমুলুক ব্যাখ্যা কর।
কবি আবদুল হাকিম: ইউসুফ জোলেখা ও লালমতী সয়ফুলমুলুক
কবি আবদুল হাকিম প্রণয়োপাখ্যান রচনার নিদর্শন রেখেছেন ‘ইউসুফ জোলেখা’ ও ‘লালমতী সয়ফুলমুলুক’ কাব্য রচনা করে। সতের শতকের এই কবি প্রণয়োপাখ্যান ছাড়াও তত্ত্বমূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেগুলো হল—নুরনামা, নসিয়তনামা, সভাৱমূখতা, চারিমোকামভেদ, দোররে মজলিস ইত্যাদি। ফারসি কবি জামীর ইউসুফ জোলেখা কাব্য অনুবাদ করেছিলেন আবদুল হাকিম কিন্তু তাকে জামীর কাব্যের শ্রেষ্ঠ ও সুষ্ঠ অনুবাদক মনে করা হয় না। তবে তার কাব্যে কবিত্বের নিদর্শন রয়েছে। কবির রচনারীতি ছিল বিবৃতিধর্মী, ভাষা প্রাঞ্জল হলেও ব্যঞ্জনাময় নয়। আবদুল হাকিমের অপর প্রণয়োপাখ্যান ‘লালমতী সয়ফুলমুলুক’ কোনো ফারসি উপাখ্যানের অনুসরণে রচিত। আবদুল হাকিমের সময়ে শাস্ত্রকথা বাংলা ভাষায় লেখা দূষণীয় বলে বিবেচিত হত। কবি হয়ত এ কারণে নিন্দিত হয়েছিলেন। তাই বিক্ষুব্ধ কবি ‘নুরনামা’ কাব্যে লিখেছিলেন—
যেই দেশে যেই বাক্য করে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন॥
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানি।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যথ ইতি বাণী॥…
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি॥
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়াএ।
নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশ ন যাএ॥
মাতাপিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি॥
বৈচিত্র্যপূর্ণ কাব্যসৃষ্টির মাধ্যমে কবি আবদুল হাকিম নিজের কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে গেছেন। তবে বাংলা ভাষার তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি মাতৃভাষার প্রতি মর্যাদা দানের জন্য যে প্রগাঢ় আবেদন জানিয়েছিলেন তা ভাষাপ্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আজকের দিনে কবি আবদুল হাকিমের বক্তব্যের উপযোগিতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সে কারণে কবি এখনও স্মরণীয় হয়ে আছেন।
ড. মুহম্মদ এনামুল হক ‘মুসলমান কবি রচিত রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানগুলোকে সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুসলিম ললিতকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন’ বলে মন্তব্য করেছেন। রোমান্টিক কাব্যধারার সীমারেখা আরাকান রাজসভার কবিগণের অবদান পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। মধ্যযুগের কবিগণ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক অবলম্বনে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ইসলামি শরাশরিয়ত, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক কাহিনি, মুসলিম সৃষ্টিতত্ত্ব, ইসলামি দর্শন বা সুফিতত্ত্ব, মর্সিয়া, রূপক ইত্যাদি বিষয়ে অসংখ্য কাব্যের রচয়িতা হিসেবে মুসলমান কবিরা খ্যাতিমান। কিন্তু রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান জাতীয় কাব্যের ক্ষেত্রে তারা যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তার নিদর্শন অন্যত্র নেই। বিশেষত, মধ্য যুগের ধর্মশাসিত বাংলা সাহিত্যে মানবীয় প্রণয়কাহিনি ব্যতিক্রম অবদান হিসেবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
Leave a Reply