আরাকান রাজসভার দরবারি সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা কর।

আরাকান রাজসভার দরবারি সাহিত্য

আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যের যে বিকাশ সাধিত হয়েছিল তা এদেশের সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাঙালি মুসলমান কবিরা ধর্মসংস্কারমুক্ত মানবীয় প্রণয়কাহিনি অবলম্বনে কাব্যধারার প্রথম প্রবর্তন করে এ পর্যায়ের সাহিত্যসাধনাকে স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী করেছেন। ধর্মীয় ভাবভাবনায় সমাচ্ছন্ন কাব্যজগতের পাশাপাশি মুক্ত মানবজীবনের আলেখ্য অঙ্কনের মাধ্যমে মুসলমান কবিগণ সূচনা করেছেন স্বতন্ত্র ধারার। সুদূর আরাকানে বিজাতীয় ও ভিন্ন ভাষাভাষী রাজার অনুগ্রহ লাভ করে বঙ্গভাষাভাষী যে সকল প্রতিভাশালী কবির আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁরা তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান অবদানে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন এবং মধ্য যুগের ধর্মনির্ভর সাহিত্যের পাশে মানবীয় প্রণয়কাহিনি স্থান দিয়ে অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। আরাকান রাজসভার মুসলমান কবিগণকর্তৃক সৃষ্ট কাব্যরসাস্বাদনের নতুন ধারাটি বাংলা সাহিত্যের মূল প্রবাহ থেকে স্বতন্ত্র এবং ভৌগোলিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও তা সর্বজনীন বাংলা সাহিত্যের অভ্যুদয় ক্ষেত্রে এক অবিস্মরণীয় প্রভাব বিস্তার করেছিল।

মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিগণের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের বিষয়টি পণ্ডিতদের দৃষ্টিতে আসতে বিলম্বিত হয়েছে। মুসলমান কবিরা ইসলামি বিষয় অবলম্বনে কাব্যরচনা করায় বৃহত্তর হিন্দুসমাজ তার প্রতি সমাদর দেখায়নি। ফলে হিন্দুসমাজে এসব কবির নাম অজানা ছিল। উনিশ শতকের শেষ দিকে ড. দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখের উদ্যোগে হাতে লেখা পুঁথি সংগ্রহের ব্যাপক প্রচেষ্টা শুরু হলেও মুসলমান কবিদের রচনা উপেক্ষিত থেকেছে। পরবর্তীকালে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মুসলমান কবিগণের পুঁথি আবিষ্কার করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের বিস্ময়কর অবদানের বিশাল ভাণ্ডার উদ্‌ঘাটন করেন। বাংলাদেশের গবেষকগণের ঐকান্তিক চেষ্টায় মধ্যযুগের মুসলমান কবিগণ স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কারণে আরাকানের মুসলিম সংস্কৃতি বাংলাদেশের ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র হয়ে পড়লেও তার মানবিক চেতনাসমৃদ্ধ নতুন সাহিত্যসৃষ্টি যে স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের উজ্জ্বলতম প্রকাশ হিসেবে দেখা দিয়েছিল তা বাংলাদেশের গবেষকগণের ঐকান্তিকতায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

রোসাঙ্গের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। এই সময় থেকে তারা নিজেদের বৌদ্ধ নামের সঙ্গে এক একটি মুসলমানি নাম ব্যবহার করতেন। তাদের প্রচলিত মুদ্রার একপীঠে ফারসি অক্ষরে কলেমা ও মুসলমানি নাম লেখার রীতি প্রচলিত হয়েছিল। যে সব ইসলামি নাম তারা ব্যবহার করেছেন সেগুলো হল—কলিমা শাহ্, সুলতান, সিকান্দার শাহ্, সলীম শাহ, হুসেন শাহ প্রভৃতি। ১৪৩৪ থেকে ১৬৪৫ সাল পর্যন্ত দুই শতাধিক বৎসর ধরে আরাকান রাজগণ মুসলমানদের ব্যাপক প্রভাব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এই সময়ের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ড. মুহম্মদ এনামুল হক ‘মুসলিম বাঙ্গলা সাহিত্য’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন—‘‘এই শত বৎসর ধরিয়া বঙ্গের (মোগল-পাঠান) মুসলিম রাজশক্তির সহিত স্বাধীন আরাকান-রাজগণের মোটেই সদ্ভাব ছিল না, অথচ তাহারা দেশে মুসলিম রীতি ও আচার মানিয়া আসিতেছিলেন। ইহার কারণ খুঁজিতে গেলে মনে হয়, আরাকানি মঘসভ্যতা, রাষ্ট্রনীতি ও আচার ব্যবহার হইতে বঙ্গের মুসলিম-সভ্যতা, রাষ্ট্রনীতি ও আচারব্যবহার অনেকাংশে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত ছিল বলিয়া আরাকানি রাজগণ বঙ্গের মুসলিম প্রভাব হইতে মুক্ত হইতে পারেন নাই।’’

বাঙালি মুসলমানরা আরাকান রাজাদের সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন রাজপদে নিযুক্তি লাভ করতেন। তাই দেখা যায়, সৈন্যবিভাগের প্রধান কর্মচারী থেকে বিভিন্ন শাসনবিভাগীয় শাখার প্রধান প্রধান পদে মুসলমানেরাই অধিষ্ঠিত হয়েছেন। রাজাদের প্রধানমন্ত্রী (মহাপাত্র, মুখপাত্র বা মহামাত্য), অমাত্য (পাত্র), সমরসচিব (লস্কর উজির), কাজী বা বিচারক প্ৰভতি উচ্চপদে মুসলমানরাই দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজারা বৌদ্ধ হলেও তাঁদের অভিষেক মুসলিম প্রধান মন্ত্রীর দ্বারাই সম্পন্ন হত। মুসলমানদের এই প্রভাব ক্রমান্বয়ে ব্যাপকাকার ধারণ করে সতের শতকে তা চরমে ওঠে। আরাকানের রাজাদের মধ্যে মেঙৎ-চৌ-মৌন, খিরী-থু-ধুম্মা (শ্রীসুধর্মা), নরপদিগ্যি (নৃপতিগিরি বা নৃপগিরি), সান্দ থুধম্মা (চন্দ্র সুধর্মা), থদো মিন্তার (সাদ উমাদার) প্রতি রাজার সভায় মুসলমানরা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কখনও বাংলার মুসলমান শাসকের ছত্রচ্ছায়ায় শাসনকার্য পরিচালনার ফলে, কখনও মুসলমান অমাত্য ও কর্মচারীদের সহায়তায় প্রশাসনযন্ত্র সংগঠনের পরিপেক্ষিতে আরাকানে বিপুল সংখ্যক জ্ঞানীগুণী মুসলমানের মর্যাদাপূর্ণ আসন লাভ সম্ভব হয়েছিল। আরাকানে মুসলমান প্রভাব সম্পর্কে লস্কর উজির আশরফ খানের প্রসঙ্গে দৌলত কাজীর মন্তব্য স্মরণযোগ্য—

মসজিদ পুষ্কর্ণী ছিল বহুবিদ দান।

মক্কা মদিনাতে গেল প্রতিষ্ঠা বাখান।।

সৈয়দ, কাজী, সেক, মোল্লা, আলিম, ফকীর।

পূজেন্তু সে সবে যেন আপন শরীর।।

বৈদেশী, আরবী, রুমী, মোগল পাঠান।

পালেন্তু সে সবে যেন শরীর সমান।।

আরাকানে আরবীয় বণিকদের মাধ্যমে ইসলামি প্রভাবের সূত্রপাত হলেও পূর্ববঙ্গে মুসলমানরাই এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। চট্টগ্রাম ও আরাকানের নৈকট্য এবং একই রাজ্যভুক্ত থাকায় বৃহত্তর বঙ্গদেশ থেকে তার স্বাতন্ত্র্য ছিল। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গের সীমান্তবর্তী বার্মার নিম্নাঞ্চলের একটি বিভাগ হিসেবে আরাকান বৃহত্তর ব্রহ্মদেশ থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। এ জন্য এখানে বঙ্গীয় মুসলমানদের প্রভাবে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার পরিবেশ গড়ে ওঠে। আরাকানের মগরাজারা বাংলা ভাষায় কতটুকু ব্যুৎপন্ন ছিলেন তা নিশ্চিত জানা না গেলেও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমান কবিগণ কাব্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন এবং তাদের এই উদার পৃষ্ঠপোষকতার পরিণামে বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয়েছে এক অনন্য নিদর্শন।

ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, রাজনীতি ইত্যাদি কারণে রোসাঙ্গে বসবাসরত বাঙালিদের একটি প্রবাসী সমাজ গড়ে উঠেছিল। সামাজিক কারণে বাঙালি সমাজে স্বাভাবিক সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল বলে মনে করা চলে। ড. আহমদ শরীফ মন্তব্য করেছেন—‘‘তাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রয়োজন পূর্তির জন্য, মানসচাহিদা পূরণের জন্য, মনের রসতৃষ্ণা মিটানোর জন্য সেখানে গুণীজন দিয়ে গান-গাথা-রূপকতা-প্রেমকথা জানানোর, রসকথা শুনানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছে, সৃজনশীল কেউ কেউ নতুন সৃষ্টি দিয়ে তাদের রসতৃষ্ণা নিবৃত্ত করেছে।’’

মুসলমান প্রভাবকে আরাকানরাজারা সহজে গ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁদের সভাসদকর্তৃক বাংলা সাহিত্যচর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা দান সম্ভব হয়েছিল। সতের শতকে শ্রীসুধর্মা রাজার আমলে তাঁর সচিব আশরফ খানের আদেশে দৌলত কাজী ‘সতীময়না’ কাব্য রচনা করেন। এ সময়ে কবি মরদন রচনা করেন ‘নসীরানামা’। রাজা সাদ উমাদারের রাজত্বকালে প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় আলাওল তাঁর ‘পদ্মাবতী’ কাব্য রচনা করেন। রাজা চন্দ্র সুধর্মার সমর সচিব সৈয়দ মুহম্মদের আদেশে আলাওল ‘সপ্তপয়কর’, নবরাজ মজলিসের আদেশে ‘সেকান্দর নামা’, মন্ত্রী সৈয়দ মুসার আদেশে ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ কাব্য রচনা করে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে স্বীয় কৃতিত্বের পরিচয় দেন। প্রকৃতপক্ষে, আরাকান রাজসভাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যচর্চা কোন না কোন সংসদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলেই সম্ভব হয়েছিল।

এ সময়ের কবিগণ তাঁদের পৃষ্ঠপোষক সভাসদ বা তৎকালীন আরাকানের শাসকবৃন্দ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। সমৃদ্ধ সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাদের অনুরাগ ও সহানুভূতি কবিগণের জন্য অপরিসীম প্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কবি দৌলত কাজী শ্রীসুধর্মা রাজার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লিখেছেন—

কর্ণফুলী নদী পূর্বে আছে এক পুরী।

রোসাঙ্গ নগরী নাম স্বর্গ-অবতরী।

তাহাতে মগধ বংশ ক্রমে বুদ্ধাচার।

নাম শ্রীসুধর্মা রাজা ধর্ম অবতার।।

প্রতাপে প্রভাত ভানু বিখ্যাত ভুবন।

পুত্রের সমান করে প্রজার পালন।।

দেবগুরু পূজএ ধর্মেত তার মন।

সে পদ দর্শনে হএ পাপের মোচন।।

পুণ্য ফলে দেখে যদি রাজার বদন।

নারকিহ স্বর্গ পাএ সাফল্য জীবন।।

এ ধরনের প্রশংসা অপরাপর কবিগণের লেখনীতেও রূপায়িত হয়েছে।

আরাকান রাজসভার কবিগণ কাব্যরচনায় বিবিধ বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছিলেন। ড. সুকুমার সেনের মতে এই কবিরা ছিলেন—‘‘ফারসি সাহিত্যের মধুকর এবং ভারতীয় সাহিত্যের রঙ্গ সন্ধানী।’’ তাঁরা ফারসি সাহিত্যের সৌন্দর্য-মাধুর্যের সঙ্গে ভারতীয় সাহিত্যের জীবন উৎসকে অনুধাবন করেছিলেন। ফলে তাদের রচনায় এই ধারার যথার্থ সম্মিলন ঘটেছে। তারা ফারসি ও হিন্দি উৎস থেকে কাব্য রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। বাংলা, সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষায়ও তারা অধিকার স্থাপন করেছিলেন; হিন্দু যোগদর্শন সম্পর্কেও তারা অবহিত ছিলেন বলে মনে হয়। এ সব কারণে এই পর্যায়ে কবিগণের ব্যবহৃত ভাষায় আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহার ব্যাপক নয়। ইসলাম ধর্ম ও রীতিনীতি সংক্রান্ত্র কাব্যে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার বেশি প্রয়োগ পরিদৃষ্ট হয়, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা বিশুদ্ধ সংস্কৃতগন্ধী বাকরীতির প্রয়োগ করেছেন। এই পর্যায়ের কবিগণের সাহিত্যসৃষ্টি প্রধানত অনুবাদভিত্তিক, কিন্তু তাতে তাদের অম্লান কবিপ্রতিভার যথার্থ পরিচয় ব্যাহত হয়নি। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে মানবীয় প্রণয়কাব্য রচনা করে আরাকান রাজসভার কবিগণ বিশিষ্টতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বাংলাদেশে মোগল পাঠানের সংঘর্ষের ফলে অনেক অভিজাত মুসলমান আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাদের অধিকাংশই সুফি মতাবলম্বী ছিলেন। তাদের সহযোগিতায় আরাকান রাজসভায় আরবি-ফারসি বিদগ্ধ ও সুফিমতবাদে অনুরক্ত কবিগণের আবির্ভাব ঘটে। আরাকান রাজসভার কবিগণের মধ্যে দৌলত কাজী, মরদন, কোরেশী মাগন ঠাকুর, আলাওল, আবদুল করীম খোন্দকার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

আরাকানের বাংলা সাহিত্যে দুটি ধারা লক্ষণীয়। একটি ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কিত এবং অপরটি ধর্মনিরপেক্ষ রোমান্টিক প্রণয়কাব্যের ধারা। ইসলাম ধর্মের ব্যাপক সম্প্রসারণ ও উপলব্ধির যথার্থ উপকরণ নিয়ে ধর্মীয় কাব্য রূপ লাভ করেছে। অপরদিকে প্রণয় কাব্যে আছে অনাবিল মানবিক প্রণয়ের উচ্ছ্বাসপূর্ণ রোমান্টিক গাথা ও মর্মস্পর্শী গীতিসাহিত্য। তবে হিন্দি প্রণয়কাব্যের মধ্যে নিহিত সুফি মতাদর্শের প্রভাবে প্রণয়কাব্যের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ লাভ সম্ভব হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!