উত্তর-আধুনিকতাবাদ সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর-আধুনিকতাবাদ (Post-Modernism)
উত্তরাধুনিক বা Post-modern শব্দবন্ধটির উৎপত্তি নিয়ে নানা রকমের মতানৈক্য রয়েছে। তবে য়ুর্গেন হাবারমস তার এক লেখনিতে জানান যে, মডার্ন শব্দটি ল্যাটিন modernus রূপে সেই ১৫শ খ্রিস্টাব্দে প্যাগান অতীত থেকে বর্তমান খ্রিস্টানকে আলাদা করে দেখার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। ফরাসি ইমপ্রেসনিস্ট চিত্র অপেক্ষা আরো আধুনিক, আরাো আভাঁ-গার্দ (Avant-Grade) টাইপের চিত্রকে বোঝাতে গিয়ে জন ওয়াটকিনস নামক একজন পেইন্টার এবং চিত্র সমালোচক ১৯১৭ সালের দিকে পোস্টমডার্ন অভিধাটিকে ব্যবহার করেন। ১৯১৭ সালে রুডলফ প্যানউইজ একটি বইতে নিৎসে’র নায়ালিজম (Nihilism) এবং সে সময়কার ইউরোপের মূল্যবোধের ভাঙ্গন সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। নিৎসেকে অনুসরণ করে তিনি নতুন Post-modern মানুষের কথা বলেন, যার দেখা পাওয়া যায় ১৯৫০ এর দশকে। এতে পয়তাল্লিশোত্তর উত্তরাধুনিকতার বৈশিষ্ট্যাবলি স্পষ্ট হতে শুরু করে। ইতিমধ্যে দাদাবাদ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট মানুষের সমগ্র অর্জন এবং মূল্যবোধসমূহকে তাচ্ছিল্য করতে থাকে এবং সমকালীন চিত্রশিল্প, স্থাপত্য ও শিল্পকলায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে যা উস্কে দেয় উত্তর-আধুনিক চেতনার বীজ।
শব্দবন্ধটির সুনির্দিষ্ট ব্যবহার আরো অনেক পরের ঘটনা। ১৯৩৫ সালে স্পেনের ফেদরিকো দে ওনলি ‘আধুনিক কবিতার প্রতি কাব্যিক প্রতিক্রিয়া’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাহিত্যে এর ব্যবহার ঘটান। ৫০ দশকের শেষের দিকে রাইট এবং মিলস্ এমন একটি কথা বলেন যে, আধুনিক কালের মার্ক্সবাদ, উদারনীতিবাদ, কিংবা পুঁজিবাদ কোনোটিই আর বিশ্ব প্রত্যয়টিকে উৎপাদন করতে পারছে না, কারণ এ তত্ত্বগুলি যুক্তি বা বুদ্ধি স্বাধীনতার মধ্যকার অন্তর্যোগে বিশ্বাস করত এবং মনে করত যে, বর্তমান যুক্তিবাদীরা বর্তমান স্বাধীনতার জন্ম দেয়। ষাটের দশকে ভাবনাটি আরো শক্ত হয় এবং সত্তরের দশকে এসেই এখনকার উত্তরাধুনিক বলতে যা বোঝানো হয়, তা স্পষ্ট হতে শুরু করে। লি কর্বোসিয়ার রচিত Villa Savoye আখ্যানটিতে আধুনিক ইশতেহারের একটি অংশে তিনি একটি নতুন স্থাপত্যের দিকে তাকিয়ে থাকার কথা বলেছিলেন।
উত্তরাধুনিকতা আন্দোলনটির শুরু হয়েছিল আধুনিক আন্দোলনের মধ্যে উপস্থিত হিংস্রতা আর শক্রতার বিপরীতে একটি প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন হিসেবে। ওয়াল্টার শ্রোপিয়াস এবং ফিলিপ জনসনের মত বিদ্বান আর মেধাবী লোকদের হাত ধরে আধুনিক স্থাপত্য প্রতিষ্ঠিত এবং বিকশিত হয়েছিল যার কেন্দ্রীয় লক্ষ ছিল একটি আদর্শ পারফেকশন, ফর্মের সংহতি ও ক্রিয়া, এবং ভারিক্কি অলংকরণের অগ্রাহ্যকরণ। আধুনিকতাবাদের সমালোচনা এই রকম যুক্তি-তর্ক উপস্থিত করে যে, উপযুক্ততা বা পারফেকশনের যে গুণারোপ করা হচ্ছে এবং তাদের যে সীমাবদ্ধকরণ নীতি তা নিজ থেকেই সাবজেক্টিভ। সমালোচনার ভাষ্যে বলা হতে থাকে যে, আধুনিক চিন্তা-চেতনার মধ্যে বিশৃঙ্খলবাদিতা সুস্পষ্ট এবং এর দার্শনিক উপকারিতাগুলো সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা হয়। ডেফিনিটিভ উত্তরাধুনিক স্থাপত্য যেমন, মিশেল গ্রাভস-এর কাজ একটি পারফেক্ট আর্কিটেকটনিক ফর্মের ধারণাকে পরিত্যক্ত করে দেয়। এর বদলে বরং সব ধরনের পদ্ধতি থেকেই বিস্তর রকমের কাজ লুফে নেয়া হতে থাকে। স্থপতিদের কাছে সহজলভ্য উপাদান, ফর্ম এবং রঙকেও কাজে লাগানো হতে থাকে। আধুনিক চিন্তা-চেতনার প্রায় সামগ্রিকতাবাদী গুণাবলির বিপরীতে একটি ব্যাপকতর প্রতিক্রিয়া হিসেবে উত্তরাধুনিক স্থাপত্য তার যাত্রা শুরু করে। এতে ব্যক্তিগত বিষয়াদীকে অগ্রাধিকার দেয়া হতে থাকে এবং নৈব্যক্তিক বিচিত্রতার দিকে ও সর্বোন্নত শর্তাবলি কিংবা নীতিসমূহের দিকে সুনজর দিতে থাকে। এটাই হচ্ছে সমালোচনা, সংশয়বাদিতা এবং সাবজেক্টিভিটির সেই আবহাওয়া (Atmosphere) যা উত্তরাধুনিক দর্শনকে সংজ্ঞায়িত করে। ১৯৭২ সালে বিখ্যাত স্থাপত্য সমালোচক চার্লস জেঙ্কস্ একটি বক্তৃতায় বলেন যে, ‘আধুনিক স্থাপত্যের মৃত্যু ঘটেছে’ যদিও বাস্তবে তা কিন্তু কখনোই ঘটেনি। বরঞ্চ বক্তব্যটি ছিল পুরোপুরিই ফেইক যা আয়রনির মধ্য দিয়ে নির্মিত । ইহাব হাসান (Hassan 1985:2:123-4) তার দ্য পোস্টমডার্ন টার্ন প্রবন্ধে প্রথম সাহিত্যদর্শন ও শিল্পকলায় বিশেষভাবে পোস্টমডার্ন প্রবণতাকে শনাক্তকরণের চেষ্টা চালান। ১৯৭৫ সালে ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি ‘বহুত্ববাদ ও অ-পশ্চিমা সংস্কৃতিসমূহের উত্থান’ বর্ণনা করতে গিয়ে এর প্রয়োগ করেন।
আধুনিকতাবাদ ও আধুনিকতার নিগ্রহ থেকে মুক্তির পথ হিসেবে উত্তরাধুনিকতাকে একটি সদর্থক বিকাশ ও একটি ডিসকোর্স হিসেবে দেখা শুরু হয়। কিন্তু কোনো সংহত ধারণা গড়ে ওঠে না। নানাজনের কাছে উত্তরাধুনিকতা নানাভাবে আসে। কেউ আধুনিকের সঙ্গে এর ধারাবাহিকতা দেখেন, কেউ বা জোর দেন এদের মধ্যকার বিচ্ছেদ বা বিচ্যুতির ওপর। ফ্রেডরিক জেমসনের মতো কারো কারো কাছে এটি নিতান্তই সাময়িক একটি ব্যাপার। লিওতার তার দ্যা পোস্টমডার্ন কন্ডিশন প্রবন্ধে দেখান যে, একজন উত্তর-আধুনিক আধুনিকের ঐক্য ও সংহতির অন্বেষণকে বাতিল করে যে বিচ্ছিন্নতা-দীর্ণতা অন্বেষণের কথা বলেন তারও উদ্দেশ্য হচ্ছে সংযোগ-সংহতি আর অন্বেষণকেই খুঁজে পাওয়া। তিনি আরো দেখান যে, উত্তর-আধুনিক এসব মায়া-কুহক কিংবা ঐন্দ্রজাল থেকে মুক্ত। পেরি এন্ডারসন উত্তরাধুনিককে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশেষ পরিস্থিতিজাত বলেই মনে করেন। এ সময়ের পর থেকেই পশ্চিমা ধনতন্ত্র স্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণী তাতে অঙ্গীভূত হয়ে যায়, সমসাময়িক চিত্রশিল্পীদের কাছে জগৎ হয়ে ওঠে শূন্য, যেন এক বীভৎস উট (‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ যেন এরকমই একটি প্রতিক্রিয়া)। যুদ্ধত্তোরকালে অর্থাৎ ষাটের দশকে অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ সংকটে পড়ে যায় ধনতান্ত্রিক উদারনীতি। অথচ, শ্রেণী সংগ্রাম নেই, মন্দা প্রলম্বিত হয়, আর সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন হয়ে যায় উধাও। তখনই আসে পোস্টমডার্নের ডিসকোর্স, মুহূর্তের প্লুরালিজম বা বহুত্ববাদ–একই সঙ্গে র্যাডিক্যাল, ইতিহাস সম্পর্কে সংশয় আর ‘কাউন্টার-এনলাইটমেন্টের’ শেষ পর্যায় পোস্টমডার্নিজম।
ঠিক ওই সময়েই এটিকে সাহিত্যিক তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস লক্ষ করা যায় যুদ্ধবিরোধী চেতনা, দাদা এবং স্যুররিয়েলিজমের অনুপ্রেরণায়। ইউরোপে যে হিপ্পি আর আমেরিকায় যে বিট প্রজন্মের উদ্ভব হয়েছিল তা মূল জায়গাটি থেকে সরে এসে এক সময় পপ কালচারের রূপ নেয়। জ্যাক দেরিদা, মিশেল ফুকো, রোলা বার্থ, জুলিয়া ক্রিস্টোভা, জাঁ বদ্রিয়ার, জাক লাকাঁ প্রমুখ এটিকে ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। উত্তর-কাঠামোবাদ থেকেই দর্শন আর সাহিত্যের একটি গভীরতর দর্শন হিসেবে উঠে আসে উত্তর-আধুনিকতাবাদ। ফলে এই ব্যাখ্যা এতদিনে একাডেমিক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছালো, নজর কাড়লো বুদ্ধিজীবী ব্যাখ্যান সম্প্রদায়দের। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক আর উৎসাহীরা নড়েচড়ে বসলেন। যে সব তাত্ত্বিকরা ভাবনাটিকে রীতিমত কুলীন পর্যায়ে তুলে আনলেন, তাদেরকে এর সূচনা পর্বের ভুল ব্যাখ্যাকারী’ বলা বোধহয় ঠিক হবে না, যদিও তারা নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে মতানৈক্য এতটাই প্রকট হয়ে পড়ল যে, এটি একটি সুনির্দিষ্ট তাত্ত্বিক কাঠামো থেকে বহুদূরে অবস্থান নিলো। ফলে সমস্যাটি অতি তাত্ত্বিক আর দুর্ভেদ্য রকমের জটিল হয়ে পড়ে।
উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফ্রাঙ্ক কারমোডের বয়ানটি খেয়াল করুন, “অনেক ব্যাখ্যানের জন্যই ব্যাপারটা এমনই দাড়িয়েছে যে, আধুনিক দশাটি ফুরিয়ে গিয়েছে বলেই যেন তারা খালাস (একটা টাইম ফ্রেমের ভেতর তকমা লাগিয়ে দিলেই কি সব কিছু শেষ হয়ে যায়!)। এর বিপরীতে উপযুক্ত উপস্থাপন করতে হলে আমাদেরকেও একটি শক্তিশালী ভাষা চাই যেন রেনেসাঁর চেতনাটিকেও সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়। সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছু বদলায়, আবার অনেক কিছুই কিন্তু বদলায় না; কেবল বৈচিত্র্যকেই বরং সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। আধুনিকের একটি প্রতিবেদনমূলক ইতিহাস কুড়ি বছর আগে ঠিক যেমনটি থাকে, আরো কুড়ি বছর পরেও নিশ্চয় ঠিক তেমনটি থাকবে না।”(Sarantakos 1998: 28)। কারমোডের এই বয়ানটির মধ্যে আমেরিকার যে ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘটেছিল তার উপাদানগুলোকেও চিহ্নিত করা যায়। আমেরিকা একটি মাস কালচারে রূপ নিচ্ছিল। ফলে এটিকে ব্যাখ্যা করতে একটি নতুন কাউন্টার আদিকল্প বা প্যারাডাইমের দরকার হয়ে পড়েছিল। ইদানিংকার সামাজিক গবেষণাগুলোতে উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আদিকল্প (Paradigm) আকারে দেখার চেষ্টা হচ্ছে (Sarantakos 1998: 28 দ্রষ্টব্য)।
উত্তরাধুনিক এবং উত্তরাধুনিকতাবাদ টার্মগুলো চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকে হাল্কা-পাতলা ব্যবহৃত হতে দেখা গেলেও পরের দশক থেকেই এর ব্যবহার বেশ ভারিক্কি হয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বা ভ্যালুর আন্তক্ষরণকে শনাক্ত করতে গিয়ে টার্মগুলো ক্রিটিক্যাল লেখালেখিগুলোতেও স্থান করে নিতে থাকে। উত্তরাধুনিকতাবাদকে অনেকটা এভাবে দেখা যায় যে, ‘বিল্ডিং এন্ড আনবিল্ডিং অব অর্থডক্স’ (Broomer 1992: 4) অর্থাৎ ‘সনাতনের নির্মাণ এবং অনির্মাণ’। এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে ক্রমারের ভাষ্য হল, “There is no absolute single cultural entity or absolute historical break, therefore, and no absolute inside or outside part from the ideological constructions requiring them” (Broomer 1992: 4)। এ ক্ষেত্রে ফ্রেডরিক জেমসনের ভাষ্যটির কথা বলা যেতে পারে, “We can not view postmodernism as an historical situation and present a critique of it from a position on the outside, for how can we be outside history? It follows that we can not view modernism from outside postmodernism either”।
আধুনিকতা এবং উত্তরাধুনিকতার একটি কালানুক্রম টানতে গেলে তাতে নানা রকমের শিল্প আন্দোলন, ডিসকাশন মিটিং, ব্যক্তি পর্যায়ের কর্মকাণ্ড কিংবা ঘটনাবলিও চলে আসে যার মধ্য দিয়ে এই আজকের বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এসে আমরা বিশেষ করে ইউরোপে এসে দাঁড়িয়েছি যার রাজনীতির বাইরেও আমাদের অবস্থানটি শুধু নিষ্ক্রিয় নয়। এর যথোপযুক্ত বর্ণনা এভাবে হতে পারে যে, এটি প্রান্তিক আকারগুলোকে হেজিমনিগত কাঠামোগুলোর ভেতর থেকে বের করে আনে এবং এক ঝাঁক অভিঘাতমূলক প্রতিক্রিয়াশীল প্রশ্নের বাণ ছুড়ে দেয়। এবং একটি ভয়ংকর রকমের আন্দোলন হিসেবে প্রচলিত সাংস্কৃতিক স্কুলগুলোর সমালোচনার মধ্য দিয়ে যুক্তি-তর্কের রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হয়। অনেকে এটিকে সদর্থক ত্রাস বলতেও পিছপা হন না।
ইহাব হাসান একটি বিকল্প জ্ঞানভাষ্য এবং সমালোচনার মাধ্যম হিসেবে এটিকে মানতে চান। তিনি যে উত্তরাধুনিকতাবাদের কথা বলতে চান তাতে উইলিয়াম ব্লেক, ডি সাদ; একটা সময়ের পাউন্ড, জয়েস, দাদা, স্যুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ, নব্য ফরাসি উপন্যাসের ধারা, জেনেট, দি বিটস, জনপ্রিয় সাহিত্য এবং নব্য সাংবাদিকতা এমনকি একটি উত্তর কাঠামোবাদী চিন্তক দলের চিন্তাকল্পের আত্তীকরণ অনেকটা এ্যামিবার মত করে ঘটে । তিনি আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর আধুনিকতাবাদের মধ্যে তুলনা দেখাতে গিয়ে দ্যা কালচার অব পোস্টমডার্ননিজম (১৯৮৫) প্রবন্ধেও কিছু বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। স্টুয়ার্ট হল এটিকে বলছেন ‘সেই স্বপ্নের আমেরিকা যেমনটি হতে পারত বা হওয়ার চেষ্টা ছিল’ (Bird et al.1980:46)। পল ব্রোমারের (১৯৯২) ভাষ্যে বিষয়টি এমনই দাঁড়ায় যে, এটি আমেরিকাকে প্রথম বিশ্বের পশ্চিমা আধিপত্যের একটি কেন্দ্র হিসেবে দেখে। একটি ঐতিহাসিক অবস্থা হিসেবে আমেরিকার ক্ষেত্রে এটিকে দেখলে ব্যাপারটা এমনই দাঁড়াবে যে, এটি অর্থনীতি, রাজনীতি, মিলিটারি ক্ষমতা তথা আমেরিকা ও পশ্চিমের সাংস্কৃতিক প্রভাবের বা আধিপত্যের যে নিয়ন্ত্রণমূলক মনস্তত্ত্ব, ‘সত্যের মিথের’ প্রতি আকর্ষণ তথা সাংস্কৃতিক-ভৌগোলিক যোগযোগ ব্যবস্থার ওপর পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের শেয়ালীপনার বিরুদ্ধে কথা বলে বা বলতে চায়। সে অর্থে এটি যখন WTO কনফারেন্স হয় তখনও এই কূ-কৌশলী বিশ্বায়নের বিরোধিতা করে তার অবস্থানটিকে প্রকাশ করতে চায়।
সংক্ষেপে উত্তরাধুনিকতার দার্শনিক এবং সাহিত্যিক তথা ভাষাতাত্ত্বিক বিকাশকে দেখানো যায়—
- ১৯১৬—দাদা আন্দোলন:-ডিসকোর্স এবং অবজেক্টের ফ্রেমিং এর ওপর এমনই গুরুত্ব পেয়েছে যে নিজের কাজের তীব্রতা দেখে নিজেই অস্থির…
- ১৯৩০— কার্ল বার্থ:-ঈশ্বরতত্ত্বে সংশয় প্রকাশের মাধ্যমে সাব্জেক্টিভিটির উদ্ভাস ঘটায়…
- ১৯৩০— মার্টিন হাইডেগার:-সাব্জেক্টিভিটি এবং অবজেক্টিভিটি উভয় ধারণাকেই দর্শনের ভিত্তি থেকে প্রত্যাখ্যান করেন।
- ১৯৫০— লুডভিদ ভিনগেনস্টাইন:-নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে (On certainty) এন্টি-ফাউন্ডেশনালিজম ভাষার একটি দর্শন…
- ১৯৬২— থমাস স্যামুয়েল কুন:-বিজ্ঞানীদের সাময়িক সচেতনতা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের র্যাপিড পরিবর্তন ঘটছে। এটাকে তিনি ‘প্যারাডাইম শিফট’ হিসেবে দেখেছেন…
- ১৯৬২— ডব্লিউ. ভি. ও. কুইন:-অনুবাদ এবং তত্ত্ববিদ্যাগত আপেক্ষিকতার অনির্ধারণত্বের থিসিজ নির্মাণ করেন (the theses of indeterminacy of translation and ontological relativity)
- ১৯৭০— জ্যাক দেরিদা:-লেখনীর (writing) দার্শনিক ভিত্তিগুলোকে পুননিরীক্ষা এবং পশ্চিমা অধিবিদ্যার ভাষাগত দুর্বলতা অনুসন্ধান করেন… জন্ম দেন ‘বিনির্মান তত্ত্বের’…
- ১৯৭৫— মিশেল ফুকো:-শৃঙ্খলা এবং শাস্তির ক্ষেত্রে ডিসকার্সিভ ক্ষমতার নিরীক্ষা চালান এবং বলেন যে, ‘ভাষা হচ্ছে নির্যাতন’ (এই অর্থে যে, ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যে অপ্রেসিভ হতে চায় ন্না সে এক ধরণের ক্ষমতা প্রয়োগ করে। যারা সে ভাষায় কথা বলবে না তারা দুর্বল হয়ে পড়বে)…
- ১৯৭৯— জাঁ-ফ্রাসোয়া লিওতার:-সর্বজনীনতা, গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ এবং সাধারণীকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন…
- ১৯৭৯— রিচার্ড রোর্টি:-দর্শন ভুলক্রমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলোর অনুসরণ করছে এমন কথা বলে তিনি ট্রেডিশনাল দার্শনিক সমস্যাগুলোর (anti-foundationalism and anti-essentialism) সমাধানের ইঙ্গিত দেন…
- ১৯৮১— জ্যাঁ বদ্রিয়ার:-বলেন্ম যে, প্রতিরূপায়ন (simulacrum) ও অনুসরণ কিংবা ভান (simulation) হচ্ছে মাধ্যম বা মিডিয়া নির্মিত বাস্তবতা…
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে অর্থাৎ ১৯৫০-৬০ এর দশকে উন্নয়নের একটি প্রক্রিয়া, ভাবনা, নীতি নির্ধারক ও রাষ্ট্র পলিসি হিসেবে, পুঁজিবাদী ব্লকগুলো সদ্য-স্বাধীন উত্তর-উপনিবেশিক দেশসমূহের বাজার দখল ও সমাজতান্ত্রিক প্রতিরোধের প্রকল্প হিসেবে উন্নত, অনুন্নত, এবং উন্নয়নশীল স্তরায়নের ভিত্তিতে একটি এজেন্ডা নিয়ে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াটি চালু হয়। অনেকে এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে বলতে থাকেন, তৃতীয় বিশ্বে ঐতিহ্য-সংরক্ষণশীলতাকে আধুনিক হয়ে ওঠার অন্তরায় হিসেবে দেখানো হচ্ছে, জনগণের ঐতিহ্যশীল সংস্কৃতি ও জীবনক্রিয়ার বাধাকে বা এক ধরনের প্রতিরোধকে ভেঙে নিশ্চিহ্ন করার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর সুচারুভাবে পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে, আর এর মধ্য দিয়ে আমজনতাকে বোঝানো হচ্ছে যে, এইতো আপনি আধুনিক হয়ে উঠছেন।… তারা দেখান, আলোকময়তার ঔরসে যে নৃ-বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছিল তাকেও বেশ পক্ষপাতমূলক রাজনীতির মধ্য দিয়েই নির্মাণ করা হয়েছিল। আধুনিকীকরণের ডিসকোর্সটি যেহেতু প্রভাবের বলয় নির্মাণ করেছিল তাই এর নিরীক্ষণও হয়ে পড়ে অতি জরুরি। ইভান্স প্রিচার্ডকে (Pritchard, 1902-73) একজন ক্ল্যাসিক্যাল এথনোগ্রাফার হিসেবে দেখতে পাওয়া গেলেও দেখা যায় যে একটা সময় পর্যন্ত তার পাণ্ডিত্য ছিল কলোনিয়াল বলয়যুক্ত। যদিও পরবর্তীতে তিনি তা স্বীকার করে নিয়ে বলয়টিকে ভেঙে বেরিয়ে আসেন এবং পরবর্তীতে সামাজিক নৃ-বিজ্ঞানের একজন অন্যতম রূপকারে পরিণত হন।
মূলত ১৯৬০ এর দশকের সংকটই আধুনিকতা সম্পর্কে তীব্র সংশয় ও প্রতিবাদকে সামনে নিয়ে আসতে সাহায্য করে। ১৯৬৮ সালে প্রায় আন্তঃইউরোপীয় আন্দোলন এবং সংঘাত ও ব্যর্থতা উত্তরাধুনিক ভাবনাটিকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে সাহায্য করে। মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা, জ্যা ফ্রাসোয়া লিওতার্দ, রোলা বার্থ, জ্যা বদ্রিয়ার প্রমুখের মত উত্তর-কাঠামোবাদীরা এর ক্ষেত্রটিকে আরো উস্কে দেন। তারা চিহ্নিতের আগে স্থান দেন চিহ্নিকারীর। তারা ভাষার এক গতিময় উৎপাদনশীলতার কথা বলেন, অর্থের অস্থিতিশীলতা এবং প্রচলিত অর্থের কাঠামো ভাঙনের ওপর জোর দেন। দেরিদার বয়ানটি খেয়াল করুন— “The meaning of meaning is infinite implication, the indefinite referent of signifier to signified… it always signifies and differs.’’ এই Signification আরোপিত যেকোনো কাঠামোগত বাধা ও অবরোধকে প্রতিহত করে কিংবা ভেঙে দেয়। দেরিদার ভাষ্যমতে এটি হচ্ছে Dissemination। একই জিনিস লক্ষ করা যায় দেলুজের ইচ্ছা বা বাসনার ধারণায়, লিওতারের ‘ইনটেনসিটি’ তত্ত্বে, ফুকোর ‘ক্ষমতা’, কিংবা বদ্রিয়ারের Semi urge ভাবনায়। এ সূত্রেই দর্শনের জ্ঞান ভিত্তি পাবার ‘অসার’ কল্পনাকে আক্রমণ করা হয়। দর্শনকে দেখা হয় একটি অসম্পূর্ণতা হিসেবে। নিৎসে, মার্টিন হাইডেগার, সরেন কিয়েৎগার্ড, লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন প্রমুখ দার্শনিকদের দর্শন দ্বারা এটি প্রভাবিত বলা যায় (এরা অস্তিত্ববাদী)। বিশেষত, নিৎসের সত্য, কার্য-কারণ, মূল্যবোধ (যেমন দ্যা গড ইজ নো মোর এলাইভ, সত্য হচ্ছে অজাচার) ইত্যাদিকে যে ভয়াল মাত্রায় আক্রমণ করা হয়, তা এক নতুন শক্তি নিয়ে হাজির হয়। অবজেক্টিভ সত্য বলে কিছু নেই, বুদ্ধি বা যুক্তির ভানকে নিৎসে মারাত্নকভাবে আহত করেছিলেন। সামগ্রিকভাবে মানবিকতাবাদী, যুক্তিবাদী আলোকময়তার প্রকল্পটি এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকেই একজন বুর্জোয়া শক্তির বিস্তারক হিসেবে নিৎসেকে দেখিয়েছেন, কিন্তু এই মানব মুক্তির চিন্তাধারায় নিৎসের গুরুত্ব অনেক। নিৎসে মানুষের সীমাবদ্ধতা এবং ইচ্ছাশক্তির ওপর অতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, ফুকো মানুষের মৃত্যু ঘোষণা করে বসলেন। তিনি তার পাগলামির ইতিহাস গ্রন্থে মানুষের সৃষ্ট সভ্যতার জোড়াতালি দেয়া চেহারার নগ্ন দিকগুলোকে মুন্সিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, পাগলের সংজ্ঞাটি আসলে আমাদের সমাজে কেমন হয়? ফুকো বর্ণিত পাগল (যেমন আমাদের লালন) আর কয়েদি কিংবা পাগলাগারদের পাগল এ দুয়ের ফারাকটি শনাক্ত করতে গিয়ে একটি দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। লিওতার উত্তরাধুনিক পরিস্থিতিকে দেখেন যখন গ্র্যান্ড-ন্যারেটিভ (ঐতিহ্য, ধর্মমত ইত্যাদি) এবং আধুনিকতার আশা শেষ হয়ে যায়, আর প্রচলিত ইতিহাসের অবলুপ্তি ঘটে। ফলে মানুষ ইতিহাস থেকে উত্তর-ঐতিহাসিকে অর্থাৎ এক বিশেষ ধরনের বিল্ডিং আতিশয্যের কিনারায় এসে দাঁড়ায়। কারণ, সে দাঁড়াতেই বাধ্য হয়, তাকে বাধ্য করা হয়।
আধুনিকতার মূল সত্তাটি ছিল ইতিহাস ও উদ্ভাবন-পরিবর্তন-প্রগতি আর বিকাশের এক বিশেষ প্রক্রিয়া। বিপ্লব, গণতন্ত্র, আর সমাজতন্ত্রও ছিল এই আধুনিকতারই সফর সঙ্গী। উত্তরাধুনিকতাবাদীরা বলে বসলেন যে, এসব এখন গুরুত্বহীন। এখন ইতিহাস একটি খেলনা মাত্র যা একটি বিশেষ এফেক্ট হিসেবে শুধুই সিমুলেশন। এই ইতিহাসচ্যুতি, কেন্দ্রচ্যুতি, অর্থের বেসামাল অবস্থা এসবই উত্তরাধুনিক চিন্তার অন্যতম সমগ্র এবং সমগ্রতার ধারণা (totality) এখানে প্রত্যাখ্যাত। আধুনিক উৎস জ্ঞানতত্ত্বকে তারা বাতিল করে দিতে চাইলেন। রেনেসাঁত্তোর দু’টি পর্যায়ের কথা বলেন ফুকো ১৬৬০-১৮০০ এবং ১৮০০-১৮৫০ সাল। প্রথমটি হচ্ছে ধ্রুপদী এবং একই সঙ্গে আধিপত্যের যুগ যা মানুষের ওপর সরাসরি আধিপত্য বিস্তারের একটি শক্তিশালী পদ্ধতি গড়ে তুলেছিল, এটি আধুনিক যুগে এসে চূড়ান্ত রূপ নেয়। ঐতিহাসিক প্রগতির জ্ঞানতত্ত্বকে ফুকো নস্যাৎ করে দেন। এই চিন্তা-চেতনার ধারাবাহিকতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শিল্প-সাহিত্য, স্থাপন বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব এবং দর্শনসহ জীবনযাত্রার নানা ম্যাক্রো আর মাইক্রো স্তরে।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply