//
//

কথাসাহিত্যিক সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালার কৃতিত্ব আলোচনা কর।

কথাসাহিত্যিক সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালা

‘নিরালা’ যখন কবি রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত তখন তিনি উপন্যাস লেখার কথা চিন্তা করতে থাকেন। বিনোদ শঙ্কর ব্যাস তাকে প্রায়ই বলতেন—“নিরালাজী, আপ উপন্যাস লিখিয়ে”। নিরালা তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিতে নিজেও একটা প্রেরণা বোধ করছিলেন। ফলে উপন্যাস লিখতে সচেষ্ট হলেন। আত্মপ্রকাশ করলেন একজন কথাসাহিত্যিক হিসাবে।

ঔপন্যাসিক নিরালা

অপ্সরা

নিরালার প্রথম উপন্যাস ‘অপ্সরা’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। নায়িকা কনক বেশ্যার মেয়ে হলেও মায়ের ব্যবসার পথ ত্যাগ করে। সে শিক্ষিকা-গায়িকা, উপন্যাসটির নায়ক রাজকুমার উচ্চশিক্ষিত ও দেশভক্ত যুবক। এই দুই যুবক-যুবতীর প্রেম ও মিলনের কাহিনী নিয়ে এই উপন্যাসটি রচিত। দেশসেবা ও ত্যাগের প্রতীক রূপে নায়কের বন্ধু চন্দন চরিত্রটিও খুবই উল্লেখযোগ্য। কাহিনীতে জটিলতা এসেছে খলনায়ক কুঁবের সাহেবের কার্যকলাপে।

‘অপ্সরা’ উপন্যাসের ভূমিকায় নিরালা যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব প্রকাশ করেন। তাঁর মতে এই উপন্যাসটি একটি অদ্বিতীয় সৃষ্টি এবং হিন্দি সাহিত্যের এযাবৎ সৃষ্ট নায়িকাদের মধ্যে অনন্য। পতিতা কন্যার এই সামাজিক পুনর্বাসনের কাহিনীকে তিনি অবিস্মরণীয় করতে এ নায়িকা কবির কল্পনা মানসের এক অপূর্ব সৃষ্টি।

অলকা

নিরালার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অলকা’ লক্ষ্ণৌর গঙ্গা পুস্তকমালা কার্যালয় থেকে ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের ঘটনাস্থল প্রধানত একটি গ্রাম। ২৬টি পরিচ্ছেদে সমাপ্ত এই উপন্যাসে নায়ক নায়িকা বিজয়-অলকার মিলন-বিচ্ছেদ বর্ণনার চেয়ে গ্রামীণ জীবন ও কৃষক সংগঠনের বর্ণনাই গুরুত্ব পেয়েছে। তাই উপন্যাসটির শেষে শহরে প্রস্থানোদ্যত বিজয়ের উদ্দেশে প্রভাকরের ডাক শোনা যায়—“তুম্ভে ওয়হী কিষাণ ফির বুলা রহে হৈ ভাই!”

অলকার সূচনায় আছে প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধের শেষে ভারতবর্ষে মহাব্যাধি ও মড়কের বর্ণনা।  মহামারীতে গ্রামের দুর্দশা বর্ণনাই লেখকের উদ্দেশ্য। বিজয় তার শ্বশুরবাড়ি আসার পথে খবর পায়, যে মহামারীতে তার শ্বশুর পরিবারের সকলেই মৃত। স্ত্রী অলকা বেঁচে থাকলেও নিরুদ্দেশ। আসলে অলকা ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার স্নেহশঙ্করের গৃহে আশ্রয় পায়। নায়ক বিজয় এবং তার বন্ধু অজিত কৃষক সংগঠক।

প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধের পরবর্তীকালের পটভূমিতে ‘অলকা’ রচিত হলেও এই সময়ের কিষান আন্দোলন সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণা লেখক এই উপন্যাসে দিতে পারেননি। ঠিকই, কিন্তু যথার্থবাদী পরিবেশ রচনায় তার লক্ষ্য ছিল। তাই রোমান্সের পরিবেশ থাকা। সত্ত্বেও সমাজ বাস্তবকে ধরবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ঔপন্যাসিক প্রতিভা ক্রমশই স্ফূর্তি পেয়েছে। ‘অলকা’ উপন্যাসে গ্রামের মানুষের প্রগতিশীল চেতনার বিস্তার দেখা যায়। দেশকালের পটভূমি রচনায় নিরালা যথেষ্ট সফল। কৃষক শশাষণের ছবি যেমন আছে, তেমনি কষত আন্দোলনের সংগঠন প্রচেষ্টার ছবিও সমান গুরুত্ব পেয়েছে।

প্রভাবতী

১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় নিরালার রোমান্টিক উপন্যাস ‘প্রভাবতী’ ভাব ও ভাষার বিচারে উপন্যাসটি যে উচ্চকোটির রচনা রূপে বিবেচনার যোগ্য । সত্য ও কল্পনার মিশ্রণে উপন্যাসটি রচিত। নায়ক নায়িকা কান্যকুজেশ্বর জয়চন্দ্রের আমলের কান্যকুব্জের দুটি চরিত্র। পৃথ্বীরাজ-জয়চন্দ্রের আমলে রাজা ও সামন্তবর্গের সংঘর্ষই এর কেন্দ্রীয় বিষয়। বিবাহ ও কন্যাদানই এই সংঘর্ষের কারণ। ‘প্রভাবতী’ দুর্গেশনন্দিনী-দুর্গেশ্বরের মেয়ে। প্রভাবতীকে কেন্দ্র করে জমে ওঠা সংঘর্ষের ছবি এঁকেছেন লেখক। এই ঐতিহাসিক কাহিনী বর্ণনায় কবি নিরালার কল্পনা ও ইতিহাসবোধ একত্র মিশে আছে। ভারতীয় নারী জীবনে সংঘর্ষ চেতনা মাধুর্যময় হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে।

নিরুপমা

১৯৩৬ সালে প্রকাশিত ‘নিরুপমা’ উপন্যাসেও জাতিবর্ণভেদ পীড়িত সমাজের ছবি পাওয়া যায়। উপন্যাসটির নায়ক কৃষ্ণকুমার এই সমাজব্যবস্থার শিকার। কৃষ্ণকুমার উচ্চশিক্ষিত, লণ্ডন থেকে পি. এইচ. ডি ডিগ্রি প্রাপ্ত, কলকাতায় জন্ম হওয়ার সুবাদে কৃষ্ণ রাক্কন্দ্রিক গায়কী দ্বারা প্রভাবিত। তাই গ্রামের বাড়ির দরজায় খাটিয়ায় শুয়ে থাকা কৃষ্ণকুমারের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শােনা যায়—“তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।’’ কিন্তু ঐ গ্রামেই তার মা এবং ভাই রামচন্দ্র জাতিচ্যুত। গ্রামের গুরুদীণ তেওয়ারী, শীতল পাঠক প্রভৃতি উচ্চবর্ণের লোক ধর্মরক্ষার নামে কৃষ্ণকুমারের পরিবারকে একঘরে ও জাতিচ্যুত করে দেয়। গ্রামের জমিদার নিরুপমা আর জমিদারী দেখাশোনা করে নিরুপমার দাদা সুরেশবাবু। তবে শিক্ষা ও সুসংস্কৃতির সূত্রে নিরুপমার পূর্বরাগ সঞ্চার হয়। একদিকে বুট পালিশের কাজ করলেও কৃষ্ণকুমার মজুর হতে পারে না। কেননা, চর্মকারদের মজদুর সংঘ মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত কৃষ্ণকুমারের কাজে ক্ষুব্ধ হয়। বিশেষত সে কম পয়সায় বুট পালিশের কাজ করায় তাদের রুটি রোজগারে টান পড়ে। প্রণয়মূলক উপাখ্যান হলেও নিরুপমা’ সমাজসচেতন রচনা। নিরালার সমাজভাবনা যথেষ্ট পরিচয় এই উপন্যাসে পাওয়া যায়।

কুল্লীভাট

‘কুল্লীভাট’ উপন্যাসটি লক্ষৌ এর গঙ্গা পুস্তকমলা কার্যালয় থেকে ১৯৩৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি প্রগতিশীল নিরালার চিন্তাচেতনার ফসল। ভারতীয় সাহিত্যে রচনাটি অভিনবও বটে। ষোলটি পরিচ্ছেদে সম্পূর্ণ এই ‘কুল্পীভাট’-এর পরিচয় লেখা হয়েছে ‘হাস্যরসপূর্ণ জীবনী’। জীবনচরিত লেখার মত মানুষ কুল্লী ছিল না সেকথা কুল্লীর মৃত্যুর পর তার জীবনচরিত লিখতে বসে প্রথমেই লেখকের মনে হয়েছে। কুল্লী মহাপুরুষ ছিল না, নিতান্ত মানবীয় দুর্বলতায় ভরা। কুল্লী লেখকের নিতান্ত পরিচিত-শ্বশুরালয়ে অঞ্চলের এক বন্ধ। কুল্লীভাটের ভূগোলে স্থল ছিল রায়বরিলী, আর বাকি সব জল। এই অঞ্চলের বাইরে সে কিছুই জানত না। এই গ্রন্থে নিরালা নিজের জীবনের ঘটনারও কমবেশি উল্লেখ করেছেন। তখন কলকাতায় ‘বিল্বমঙ্গল’ নাটক দেখেছেন। ধুতি, শার্ট, জুতো পরে ছাতা হাতে সম্পূর্ণ বাঙালি বেশে কাটিয়েছেন কলকাতায়। তারপর ফিরে এসেছেন শ্বশুরালয়ে। গাঁয়ে কুল্লী একা চলে আসার জন্য তাকে হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কুল্লীর পরিচয় বড় বিচিত্র। সে সংস্কার মুক্ত, উদার, কিন্তু সমাজের উদারতা সে পায়নি। পরিবর্তে অবজ্ঞা ও ঘৃণার শিকার হয় সে। কুল্লী যৌনবিকারের রোগী বলে লোকের ঘৃণা পেয়েছে। মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে সমাজে অচ্ছুত হয়েছে। এহেন লোকের সঙ্গে লেখকের বন্ধুত্ব কেউই ভাল চোখে দেখেনি। কুল্লী কংগ্রেসের কাজ করত। নিজে অবস্থা জানিয়ে সে জওহরলালকে চিঠি দেয় দু দুবার। উত্তর আসে না। অথচ সঙ্গীত ও সাহিত্যে তার প্রচুর দখল ছিল। ক্রমেই বোঝা যায়, এ সমাজে কুল্লী প্রসন্ন  মূর্তি, সাক্ষাৎ আচার্য—যাকে দেখে শেখা যায়। অথচ সমাজ বঞ্চিত কুল্লীর মৃতদেহ দাহ করার লোক নেই। সে কার্য লেখক নিজেই সমাধা করেছেন। এক বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত মহামানবত্মার অকরুণ ছবি এইভাবেই ফুটে ওঠে কবি নিরালার কলমে।

বিশ্লেসুর বকরিহা

‘বিশ্লেসুর বকরিহা’ উপন্যাসটি ১৯৪২ সালে উন্নাও থেকে যুগমন্দির, প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত হয়। প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদ সম্পূর্ণ এই নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটির সহনাম ‘এক বৃহৎ কথা’, ‘কুল্লীভাটে’র মতে এই রচনায় নিরালা স্বয়ং চরিত্ররূপে উপস্থিত হন। এটি কোনো কৃষকের জীবন সংগ্রামের রেখাচিত্র। নিরালার প্রগতিশীল সমাজভাবনার মরমী চিত্ররূপ।

চোটী কী পকড়

১৯৪৬ সালে এলাহাবাদের কিতাব মহল থেকে নিরালার ‘চোটী কী পকড়’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হল। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসে ইতিহাসের গুঞ্জন শোনা যায়। ঐতিহাসিক উপন্যাস না হলেও ইতিহাসের পাত্রপাত্রী আর উপাদান এখানে পাওয়া যায়। সে ইতিহাস স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস। উপন্যাসটির ভূমিকায় নিরালা লিখেছেন— “যুগ কী চীজ বনায়ী গয়ী হৈ। জিতনা হিসখা ইসমে হৈ কথাকা হিসাব উসমে সমঝ মে আ জায়গা।” তবে এই উপন্যাসটি চার খণ্ডে প্রকাশের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন। এই বড় উপন্যাস পড়লে জ্ঞান ও আনন্দ বৃদ্ধি পাবে—একথাও বলেছেন। তবে শেষপর্যন্ত অন্যান্য খণ্ডগুলো লেখক আর লিখে যেতে পারেননি।

উপন্যাসের শুরু হয়েছে মহিষদলের সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশের বর্ণনায়। জায়গীরদার রাজা রাজেন্দ্রপ্রতাপের প্রাসাদের বর্ণনা করার পর লেখক বিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্ণনাও করেছেন। কেননা রাজেন্দ্রপ্রতাপ কলকাতাতে থাকেন বেশি। কলকাতায় রাজার বিলাসী জীবন, উচ্চবর্গের সঙ্গে মেলামেশা, জলবিহার প্রভৃতি বর্ণনা আছে। এইসব বর্ণনা উপন্যাসটি রচনার উদ্দেশ্য নয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে স্বদেশ প্রেমের প্রসার ও প্রক্রিয়া এখানে ভাষা রূপ পেয়েছে। ‘চোটী কী পকড়’ খুব শক্তিশালী উপন্যাস নয় কিন্তু নানা কারণে নিরালার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস।

নিরালার উপন্যাসের সংখ্যা মোট দশটি। অবশ্য ‘চামেলী’ ও ‘ইন্দুলেখা’ উপন্যাস দুটি অসম্পূর্ণ রচনা রূপেই বিবেচ্য। ১৯৫০ সালে প্রথম থেকে প্রকাশিত ‘কালে কারনামে’ উপন্যাসটিই তার শেষ উপন্যাস ধরা যায়। প্রধানত গ্রামের ছবি হলেও এই উপন্যাসটি ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ রচনায় নিরালা বিশেষ মনোযোগী। মনোহরের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কাহিনীসূত্রে পরিবেশ বর্ণনায় লেখক যতটা মনোযোগী শিল্পসম্মত পরিণতি দানে ততটা নয়।

গল্পকার নিরালা

‘নিরালা গল্প সংগ্রহ’ মাত্র চারটি খণ্ডে গঙ্গা পুস্তকমালা কার্যালয় লক্ষ্ণৌ থেকে ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয়। ‘সখী’ সরস্বতী পুস্তক ভাণ্ডার লক্ষ্ণৌ থেকে ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়। অন্য দুটি গল্পসংগ্রহ এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়। মুকুল কী বিবি’ ১৯৪১ সালে ও ‘চতুরী চমার’ ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয়।

‘নিরালা’র গল্প পাঠ করলে এক আদর্শবাদী প্রগতিবাদী ও স্বপ্নদ্রষ্টা লেখককে চিনে নেওয়া যায়। ভারতীয় সমাজের পরিবর্তন ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির কথা তিনি নানাভাবে রূপায়িত করেছেন তাঁর গল্পে ও উপন্যাসে। তাঁর গল্পে কোথাও রাজেন্দ্রর মত বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার পিতার অনিচ্ছার বিরুদ্ধে বিধবা বিবাহ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়। এবং দ্বিধাসংশয় কাটিয়ে উঠতেও সময় লেগে যায়। সামাজিক সংস্কারের কারণে বিধবা বিবাহ অসম্ভব হয়ে ওঠে। বিধবার জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা ‘আভা’ গল্পে যথেষ্ট পরিস্ফূট। ‘চতুরী চমার’ গল্পে সামাজিক বর্ণসংঘাত ও ভেদবুদ্ধির বাস্তবসম্মত চিত্র উপস্থিত। সামাজিক সংস্কারের এই তামসিক মানসিকতার করুণ শিকার। ‘অর্থ’ গল্পের নায়ক রাজকুমার। ‘চতুরী চমার’ গল্পে অবশ্য সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা আছে, তবে আন্দোলন চতুরীকে আরও দূরে সরিয়ে দেয়।

নিরালার কথাসাহিত্য ‘চতুরী চমার’ কুল্লীভাট, বিশ্লেসুর বকারিহা প্রভৃতি সমাজের অজ্ঞাত ও অবহেলিত চরিত্রের বাস্তবসম্মত ছবি পাওয়া যায়। বস্তুত, এই ধরনের চরিত্র চিত্ৰণ হিন্দি সাহিত্যে খুব সুলভ নয়। নিরালার শক্তিশালী কলমে তা আশ্চর্য ভাষারূপে পেয়েছে। কৃষক আন্দোলন, জাতপাতের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি সাহিত্যে নতুনমাত্রা যোগ করেছে। কথা-সাহিত্যিক নিরালা পরিবর্তমান সমাজের মরমী রূপকার।

কথাসাহিত্যের নির্মাণের ক্ষেত্রেও নিরালার অবদান স্মরণীয়। কুল্লীভাট-এর মত উপন্যাস বা ‘চতুরী চমার’-এর মত গল্প পড়লেই তা বোঝা যায়। এই সব নতুন শ্রেণী রচনার মূলে আছে স্মৃতিকথা রচনার প্রবন্ধ ও রেখাচিত্র রচনার মেজাজ ও মন্তব্যপ্রধান গল্প রচনার কৌশল। অথচ এই সব গল্পে গল্প, স্মৃতিকথা, রেখাচিত্র বা প্রবন্ধের বিশ্লেষণ একাকার হয়ে আছে। নিরালার গল্পে একদিকে আছে আদর্শবাদ অন্যদিকে আছে সামাজিক ভণ্ডামী ও কদাচারের ব্যঙ্গার্থক ছবি। দেবী, চতুরী চমার প্রভৃতি গল্পকে শেষোক্ত শ্রেণীভুক্ত করা যায়। নিরালার উপন্যাসগুলোর দিকে তাকালে তার ঔপন্যাসিক বৈশিষ্ট্যর স্বরূপ বোঝা যায়। তার নায়ক নায়িকারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের ও শ্রেণীর মানুষ।

নিরালার কবি পরিচয় অপেক্ষা তার কথাকারের পরিচয় কোনো অংশে কম নয়। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি বর্ণোজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমী শিল্পী। হিন্দি তথা ভারতীয় সাহিত্যের অনন্য স্রষ্টা।

কথাসাহিত্যিক নিরালার রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্য

নিরালা যে সব উপন্যাস ও গল্প রচনা করেছেন তা পাঠ করলে কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনুভব করা যায়—

  • নিরালা এমন এক পরিবর্তনশীল সমাজকে রূপ দিয়েছে। যেখালে পগত ৫ পরম্পরা, বিশ্বাস ও স্বপ্ন পাশাপাশি মিশে আছে।
  • সামাজিক প্রগতির লক্ষ্যে নিরালা বর্ণভেদহীন, জাতপাত বিভেদশূন্য এক সাম্যভরা জগতের স্বপ্নের কথা নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন।
  • স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে সামাজিক অন্যায় ও অবিচার দূরীকরণের জন্য সমাজের শোষিত তথা পীড়িতবর্গের মানুষ ক্রমাগত সংগ্রাম করছে এবং এই লড়াই ছাড়া যে এক ইঞ্চিও এগােনাে যাবে না তা কথাকার নিরালার রচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
  • স্বপ্ন ও বিশ্বাসের জগৎ এবং কঠোর সংগ্রামের জগৎ যে এক নয় এবং তাদের মেলবন্ধন যে কষ্ট ও যথাসাধ্য তা নিরালার গল্প তথা উপন্যাসে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
  • নিম্নবর্গ তথা শোষিত ও লাঞ্ছিত মানুষের মর্মপীড়া ও মুক্তির স্বপ্ন নিরালার কথাসাহিত্যে ভাষারূপ পেয়েছে।
  • আদর্শবাদী চরিত্র চিত্রণে নিরালার আগ্রহ ও দক্ষতা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে।
  • চতুরী চমার, বিল্লেসুর বকারিহা, কুল্লীভাট প্রভৃতি অমর চরিত্র সৃজনে নিরালা লাঞ্ছিত ও অবজ্ঞাত মানুষের মর্মদাহকেই ভাষারূপ দান করেছেন।
  • উপন্যাসগুলি মিতায়তন হলেও গভীর অর্থ বিস্তারী ও ব্যঞ্জনাময়।
  • নিরালার ভাষা টানটান গদ্যে ভরা, সজীব ও প্রাণবন্ত।
  • কথাসাহিত্যের নবনির্মাণে নিরালার অবদান গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!