বাংলাদেশের কবি আবুল হোসেনের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
কবি আবুল হোসেন
চল্লিশের অন্যতম কবি আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪) প্রধানত মধ্যবিত্ত মনের রূপকার। তাঁর কাব্যচর্চায় বরাবর প্রাধান্য পেয়েছে শোষণ-বঞ্চনা ও সংগ্রামমুখর জীবনের চালচিত্র। বিশ শতকের তিনের দশকেই তিনি কাব্যরচনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল—নববসন্ত (১৯৪০), বিরস সংলাপ (১৯৬৯), তোমার কি দুঃসাহস (১৯৮২), দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে (১৯৮৫), এখনও সময় আছে (১৯৮৬) প্রভৃতি। প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি ত্রিশের দশকে রচিত। অবিভক্ত ভারতে সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরোধিতাই অধিকাংশ কবিতার উপজীব্য। তাঁর কবিচেতনার স্বকীয়তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বিরস সংলাপ’ থেকে। এই কাব্যের কবিতাগুলি ১৯৪০ থেকে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত। আলোচ্য কাব্যের কবিতাগুলিতে দৈনন্দিন জীবনের গ্লানি, হতাশা ও প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার আকাঙ্খা ব্যক্ত হয়েছে। ব্যক্তিমনের সংকট প্রবল আকার ধারণ করেছে এই সময়ের কবিতাগুলিতে। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের ব্যবহৃত ভাষা দিয়েই তিনি সাধারণ মানুষের সংকটকে প্রকাশ করেছেন। তাঁর সহজ স্বীকারোক্তি—‘‘প্রায় প্রথম যৌবনে, স্থির করেছিলাম যাকে আমরা সাধারণত মানুষ কথা বলে, কাজকর্ম সারে, কবিতায় সেই আটপৌরে মুখের কথা ও বাকভঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা করব। সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার সংকল্পে চিরকাল অবিচল থেকেছি, ক্লান্তি বোধ করিনি, তা থেকে ক্ষান্তও হইনি।’’ তবে সাধারণ মানুষের কথা বলতে গিয়ে তিনি আবেগে ভাসেন নি, তাঁর রুচিশীলতা, মনন, বৈদগ্ধ্য আবেগকে ছাপিয়ে গিয়েছে। ব্যক্তিগত জীবন সংকটকে নগরজীবনের সঙ্গে আত্মস্থ করে তিনি নির্মাণ করেছেন তাঁর কবিতার জগৎ। কাব্যের নামকরণেই তিনি হতাশাকে ব্যক্ত করেছে। লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে এক নতুন আশাতেই পাকিস্তান রাষ্টের স্বপ্ন দেখেছিল বাঙালি মুসলমান। কিন্তু পাকিস্তান আমলেই তাঁদের এই মোহমুক্তি ঘটে। আগ্রাসন, শোষণ, লুণ্ঠন, দাঙ্গা, হত্যা সবকিছুতেই রক্তাক্ত হয়েছে পাকিস্তান আলম। এই বিমুখ, প্রতিকূল পরিবেশের কারণেই কবির সংলাপ আজ ‘বিরস’। সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানের মতো ব্যক্তিগত সংসার জীবনেও কবি একাকীত্বের বেদনায় ক্লীষ্ট। সেই বেদনার বর্ণনায় কবি বলেছেন—
শুধু জানি আর যারই থাক
তোর দোষ ছিলনা কিছুই। তবু তো তোকেই তার
দিতে হল দাম। এ বিশুদ্ধ অবিচার যে বিচার
তারই নাম বাঁচা-মরা।
নিজের মেয়ের মৃত্যুযন্ত্রণা আর অসহায় পিতার কাতরোক্তি কবিতাটি মিলেমিশে ব্যক্ত হয়েছে। নিজের চোখের সামনে তিনি প্রতিদিন তাঁর মেয়েকে মরতে দেখেছেন কিন্তু তাঁকে বাঁচাতে পারেন নি। একইভাবে আমরা দেখেছি যে স্বদেশ লাভের আশায় পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলমানরা দেশভাগে উৎসাহী হয়ে উঠেছিল তারাই নতুন দেশে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হয়েছে নতুন রাষ্ট্রে। তাদের চোখ দিয়েই কবি অসহায় মাতৃভূমিকে প্রতিনিয়ত শোষিত, বঞ্চিত হতে দেখেছেন। কবির কন্যা আর পূর্ব-পাকিস্তান এক হয়ে গেছে। জীবনপ্রেমিক আবুল হোসেন প্রধানত মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন সমস্যার রূপকার হলেও বৃহত্তর দেশ এবং সমাজ-জীবনের সংকট ও সমস্যার চিত্র তাঁর চোখে ধরা পড়েছে।
জীবনের চলার পথে তিনি বারবার লক্ষ করেছেন আমাদের স্বপ্ন দেখার আবেগ ও স্বপ্নভঙ্গের বাস্তবতাকে। নিজেদের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য লড়তে লড়তে, অত্যাচারিত হতে হতে, শোষিত হতে হতে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষগুলো আজ নির্জীব, নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। কবি জানেন দৈনন্দিন জিনিসের দাম বাড়ে, কিন্তু মানুষের দাম বৃদ্ধি পায় না। কারণ মানুষতো আর বস্তু নয় তার প্রাণ আছে, ভাবার মস্তিষ্ক আছে। কিন্তু অত্যাচারিত হতে হতে মানুষ আজ নিস্প্রাণ, তার ভাবনাশক্তি আজ লুপ্ত, সে বস্তুরই সমতুল্য। এই সংকট সবচেয়ে বেশি কবি লক্ষ করেছেন মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর মধ্যে। জীবনের, সংসারের দায় বহনের ভারে মধ্যবিত্তের বিষন্ন চোখ কবিকে পীড়িত করে। চোখের সামনে কবি দেখেছেন ভারতের স্বাধীনতা, দেশভাগ, পাকিস্তান রাষ্টের জন্ম, মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে লড়াই। এর সঙ্গেই অর্থনীতির দিকে চোখ ফিরিয়ে কবি লক্ষ করেছেন এই সময়কালে সমস্ত দ্রব্যের বাজার দর বেড়েই চলেছে কিন্তু শ্রেষ্ঠ দ্রব্য মানুষের কোনো দাম বাড়ে নি। সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়ায় দিন দিন মানুষের মূল্য তলানিতে নেমেছে। মানবতার চরম লাঞ্ছনা দেখে কবির আর্তি—
চাহিদা নাই মানুষ গুলার
কেবলি তার পড়ছে বাজার।
বারবার কবি-আত্মা তাল মিলিয়ে সমাজ-সংসার পরিভ্রমণ করে চলেছে। সমাজ-বিশ্ব থেকে নিজের অজান্তেই কবি প্রবেশ করছেন নিজের ভাবনার জগতে। মেপে নিতে চাইছেন নিজের জীবনযন্ত্রণা, চাওয়া পাওয়ার প্রাপ্তিটুকুকে। বইয়ের তাকে সাজানো বই বা রৌদ্রে শুকানো শাড়ির মতো কবি নিজের চিন্তাভাবনাকে একত্রিত করতে চান। কিন্তু না পাওয়ার অপ্রাপ্তি, হৃদয়ের বেদনা তাঁর মনকে বিচলিত করে তোলে, এলোমেলো হয়ে পড়ে তাঁর ভাবনাচিন্তাগুলি। তাই কবির আক্ষেপ—
যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম
যেমন ক’রে টবের গাছগুলিকে পানি ঢেলে
নিড়েন দিয়ে রোদ লাগিয়ে চাঙ্গা ক’রে তোল তুমি,
নিজের সংসার যাপনের সঙ্গীর পারদর্শিতা কবির অক্ষমতাকে যেন বেশি করে প্রকট করে তোলে। জীবনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে নিজের মুদ্রা দোষেই কবি ক্রমশ বিছিন্ন হয়ে পড়েন। কবির অতৃপ্ত আত্মা এখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণির রূপকে প্রকাশ পেয়েছে। সমাজের অবক্ষয়কে স্বীকার করে, নৈরাজ্য, বিপর্যয়কে অঙ্গীকার করেও কবি মুক্তির স্বপ্ন দেখার সাহস রাখেন। ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে এই অবিরত স্থান পরিবর্তনই দেশ-কালের কাছে কবির প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। তাঁর ব্যক্তিচেতনা সমষ্টিভাবনা থেকেই উৎসারিত। এ-প্রসঙ্গে মাসুদুজ্জামান বলেছেন— ‘‘আবুল হোসেনের কবিতাতেও ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ প্রাধান্য পায়। কিন্তু কবি তাঁর কবিতাকে আত্মপ্রসঙ্গের সীমাবদ্ধ গণ্ডিতেই আবদ্ধ রাখেন না, এর মর্মে প্রবিষ্ট করিয়ে দেন আধুনিক ব্যক্তি মানুষের নৈসঃঙ্গবোধ, প্রেম, জীবনপ্রীতি প্রভৃতি অনুষঙ্গ। নিজেকে নিয়ে বিদ্রুপ করতেও দ্বিধা করেন না তিনি। অর্থাৎ ব্যক্তিগত অনুভব বা উৎস থেকে শুরু হলেও কবিতার উপজীব্য প্রসঙ্গকে তিনি ছড়িয়ে দেন আরো বৃহত্তর এক পটভূমিতে।’’
Leave a Reply