বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
কাজী নজরুল ইসলাম
রবীন্দ্রযুগে যে কয়েকজন কবি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাঁদের অন্যতম। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে তাঁর খ্যাতি ও গুরুত্ব। প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তি এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূত্রপাতের মধ্যবর্তী সময়টুকু কাজী নজরুল ইসলামের কবিপ্রতিভার বিকাশকাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন বলাকা-পূরবী কাব্যের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে। সংখ্যায় বৈচিত্র্যে ও উৎকর্ষের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তখন রবীন্দ্রযুগের প্রতিষ্ঠা করেছেন। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের মত ও পথ অস্বীকার করার উপযুক্ত ক্ষমতা কারও ছিল না। রবীন্দ্রকাব্য সাধনার এই মধ্যাহ্ন লগ্নে নজরুলকাব্য এক পরম বিম্ময়কর সৃষ্টি। এই বিস্ময়ের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে। কারণ, তাঁর প্রতিভা বিকাশের প্রথম পর্যায়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আবহাওয়ার পর্যালোচনায় দেখা যায় এক অনিশ্চিত বিশৃঙ্খল অবস্থায় শাসনযন্ত্রর কাঠামোর মধ্যে এসেছে জীর্ণতা, প্রতিটি স্তরে নিপীড়িত জনগণের দীর্ঘশ্বাস দেশের বাতাস বিষাক্ত করছে; জাতীয় জীবনে ঘনান্ধকারের সমাবেশ। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন সুর সংযোজন করলেন—উৎপীড়িত জনগণের প্রতি সহানুভূতির মাধ্যমে। অকৃত্রিম সহমর্মিতা তাঁর কাব্যে ও অপরাপর সাহিত্যসৃষ্টিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল; সেই সঙ্গে বলিষ্ঠ কণ্ঠম্বরের নির্ভয় উচ্চারণ বক্তব্যকে করেছে ব্যতিক্রমধর্মী ও শক্তিশালী। তাঁর জীবন ও সাহিত্য একসূত্রে গাথা। তাঁর অধিকাংশ কাব্যে স্বতন্ত্র কণ্ঠের বাণী প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
আজহারউদ্দিন খানের মন্তব্য থেকে কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিভার স্বরূপ অবহিত হওয়া যাবে। তিনি লিখেছেন— “বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব বাংলার স্যাঁৎসেতে মাটি জলো বাতাস, ছায়াঘন নিকুঞ্জে দোয়েল শ্যামার কলতানের মধ্যে দৃপ্ত সিংহের ন্যায় গর্জনমদগর্বিত গজেন্দ্রের ন্যায় বিচরণ অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর। রবীন্দ্রযুগে শক্তিমান কবির সংখ্যা কম নয়—প্রকৃত প্রতিভার কবিও রয়েছেন অনেক, কিন্তু নজরুল ঠিক তাদের জাতের নয়। শীতলতার চেয়ে গ্রীষ্মের প্রখরতায় তিনি বেশি পক্ষপাতী। বাংলাদেশের জ্যৈষ্ঠ মাসে যেরূপ গুমোট-গরম, সূর্যের উত্তপ্ত কিরণে যেমন চারদিকে ঝলসিয়ে ওঠে সেইরূপের সম্পূর্ণতা নজরুল-সাহিত্যে প্রতিভাসিত। আবার দারুণ শীতের মধ্যে যেমন মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়ে ধরণীকে শীতল করে তারও সুর তাঁর মধ্যে পাওয়া যাবে। তাঁর প্রতিভাকে সমগ্রভাবে বুঝতে হলে তাঁর কঠোর ও কোমলের, রৌদ্র ও জ্যোৎস্নার যথার্থ সমবেত রূপ আমাদের বুঝতে হবে। তাঁর মানসে শক্তি ও সৌন্দর্যের যথার্থ মিলন ঘটেছিল বলেই তার পৌরুষ ছিল রুক্ষ্মতাহীন এবং লাবণ্য হয়েছিল দুর্বলতাহীন।”
কাজী নজরুল ইসলামের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল— ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২), ‘দোলন-চাঁপা’ (১৯২৩), ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪), ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪), ‘ছায়ানট’ (১৯২৫), ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫), ‘সর্বহারা’ (১৯২৬), ‘ফণিমনসা’ (১৯২৭), ‘সিন্ধুহিন্দোল’ (১৯২৮), ‘চক্রবাক’ (১৯২৯) ইত্যাদি।
কাজী নজরুল ইসলাম উপলব্ধি করেছিলেন—“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই—নহে কিছু মহীয়ান।’’ মানবের মঙ্গলসাধনের জন্য তিনি লেখনী ধারণ করেছিলেন। তাই সমাজসেবা ও সাহিত্যসেবা তিনি একই সঙ্গে করতে সক্ষম হন। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর অতর্কিত আবির্ভাব ধূমকেতুর মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর্যায়ভুক্ত। তাঁর আগমনে সৌন্দর্য তটভূমিতে সুরক্ষিত, শান্ত নিয়ন্ত্রিত ছন্দপ্রবাহে মৃদু সঞ্চারী, পরিশ্রুত জীবনাবেগবাহী বাংলা কাব্যদেহের ওপর যেন একটা প্রলয়প্রাবন বয়ে গেল। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নজরুল ইসলাম বলিষ্ঠ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। কবিহৃদয়ের অনির্বাণ বহিজ্বালাই তার প্রধান অনুভূতি। তার গভীরতম চেতনায় যে ক্ষোভ, তা প্রকাশ করার তীব্র আকুতিই তাঁর কাব্যপ্রেরণার মূল উৎস। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি ঘোষণা করেন—
বল বীর
বল উন্নত মম
শির নেহারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছিল চির-বিষ্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর৷
নজরুল ইসলাম যে মনোভাব তীর কাব্যে প্রকাশ করেছেন তাতে প্রমাণিত হয়, তিনি প্রথমে সৈনিক, পরে কবি। এক সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন তার চোখে ছিল, লেখনীতে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের সাধনা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কাব্যকে অবলম্বন করেছিলেন সংগ্রামের মাধ্যম হিসেবে। সে কারণে তাঁর রচনায় সংগ্রামী মানসিকতারই বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর সর্বস্বপণ ছিল দেশপ্রেম ও শোষণ-বিরোধিতা। কবির এই সংগ্রামী মনোভাবের অবসান ঘটবে সমস্ত শোষণের সমাপ্তিতে। তাই তিনি বলেছেন—
মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ত্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না—
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত!
বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিয়েছেন তা অন্যদের মধ্যে অনুপস্থিত। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও অন্যায়ের প্রতিবাদ আছে, অসত্যের প্রতি তিনিও ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু নজরুল ইসলাম যত বলিষ্ঠতা সহকারে তাঁর এই মনোভাব প্রকাশ করতে পেরেছেন তা অন্য কারও মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। ১৯২২ সালে ‘অগ্নিবীণা’ কাব্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতিভার ব্যাপক পরিচিতি ঘটে এবং বাংলা কাব্যের চিরাচরিত ধারার মধ্যে এক ব্যতিক্রমের সৃষ্টি হয়। কাজী নজরুল ইসলাম সম্প্রদায় বিশেষের জন্য সাহিত্যসাধনা করেননি। সকল সম্প্রদায়—তথা সকল মানুষের জন্য তাঁর উদার অন্তরের অপরিসীম সহানুভূতি উৎসারিত হয়ে উঠেছিল। সাম্যবাদের অনুপ্রেরণা ও মানবতাবোধ তাঁর সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য। বিশেষ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল ইসলামের বলিষ্ঠ মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছিল। সাময়িক প্রয়োজন মেটানোর দিকে তিনি সচেতন ছিলেন। তাঁর মধ্যে চিরন্তন আবেদন কম বলে কারও কারও অভিযোগ রয়েছে। বাঙালির নিস্তরঙ্গ জীবনে আলোড়ন আনাতেই তাঁর সার্থকতা বলে তিনি মনে করে বলেছিলেন—“বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবী।’’ ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় কবি স্পষ্ট করে তাঁর বৈশিষ্ট্যের কথা ব্যক্ত করেছেন—
বন্ধু গো আর বলিতে পারি না, বড়ো বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,
রক্ত ঝরাতে পারিনা তো একা
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় বড় কথা আসে নাক মাথায়, বন্ধু, বড় দুঃখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা করো—যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটী মুখের গ্রাস
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ!
কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহভাবমূলক কবিতা লিখে খ্যাতিলাভ করলেও অপরাপর ক্ষেত্রে, বিশেষত প্রেমের কবিতা রচনায় তিনি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছেন। কবির বিদ্রোহভাবমূলক ও প্রেমানুভূতিমূলক কবিতা একই সময়ে রচিত। তার প্রেমের কবিতায় প্রেমিক হৃদয়ের বেদনার্ত হাহাকার রূপায়িত হয়েছে। বিদ্রোহ ভাবের কবিতায় যে বলিষ্ঠতা আছে, প্রেমের কবিতায় তা নেই। বরং এখানে অশ্রুর মাধ্যমে তার প্রেমের আবেদন প্রকাশমান। যেমন ‘চোখের চাতকে’ লিখেছেন—
পরজনমে দেখা হবে প্রিয়!
ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও॥
এ জনমে যাহা বলা হল না,
আমি বলিব না, তুমিও বলো না।
জানাইলে প্রেম করিও ছলনা,
যদি আসি ফিরে, বেদনা দিও॥
‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’ প্রভৃতি বিদ্রোহভাবমূলক কাব্যের পাশে ‘দোলন চাপা’, ‘ছায়ানট’, ‘সিন্ধুহিন্দোল’, ‘চক্রবাক’ প্রভৃতি প্রেমানুভৃতিমূলক কাব্যগ্রন্থের নাম উল্লেখযোগ্য। বিদ্রোহভাবমূলক কবিতাগুলোর মধ্যে সাময়িকতার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যে পরিবেশে সেগুলো রচিত হয়েছিল তা পরিবর্তিত হয়েছে বলে হয়ত এই কবিতাগুলোর আবেদন তত প্রকটভাবে অনুভূত নাও হতে পারে; কিন্তু প্রেমানুভূতিমূলক কবিতার আবেদন চিরন্তন।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন ঐতিহ্য-সচেতন কবি। একদিকে ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল, অন্যদিকে হিন্দু ঐতিহ্যের পরিবেশের মধ্যে তাঁর জীবন বিকশিত হয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামের অতীত গৌরবের কথা স্মরণ করিয়েছেন এবং সমকালীন জীবনের গ্লানি মোচনের জন্য ইসলামি চেতনার আলোকে নবচেতনা সঞ্চারের প্রয়াস পেয়েছেন। এজন্য অনেকে তাঁকে মুসলিম রেনেসার কবি বলেও বিবেচনা করেন। মুসলমান সমাজ গতানুগতিকতায় বাধা পড়ে তার অন্তর্নিহিত শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছিল, প্রগতির ধ্বজাবহ না হয়ে, হয়ে পড়েছিল প্রতিক্রিয়াহীন শিবির—সে সত্য কবির রচনায় ভাস্বর হয়ে উঠেছিল। এইসব সংকীর্ণতা ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে উদ্যত হয়ে উঠেছিল কবির ব্যঙ্গবিদ্রপের সুতীক্ষ্ণ তরবারি।
শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে নজরুল ইসলাম বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী। আরবি-ফারসি শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগ তাঁর কবিতায় যত বেশি সার্থকতা সহকারে রূপায়িত হয়েছে তা অন্যদের মধ্যে দেখা যায় না। যেমন ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ-দহম’ কবিতায়—
নাই তা-জ
তাই লা-জ?
ওরে মুসলিম, খর্জুর-শীষে তোরা সাজ!
করে তস্লিম হর্ কুর্নিশে শোর্ আওয়াজ
শোন কোন্ মুঝদা সে উচ্চারে ‘হেরা’ আজ
ধরা-মাঝ!
উর্জ্ য়্যামেন্ নজদ হেজাজ, তাহামা ইরাক্ শাম
মেসের ওমান্ তিহারান—স্মরি কাহার বিরাট নাম,
পড়ে সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্লাম।
কবি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের সার্থক প্রকাশের জন্য উপযুক্ত ভাষার সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। যেখানে কণ্ঠস্বর উদাত্ত ও বলিষ্ঠ হওয়ার প্রয়োজন ছিল সেখানে তার নির্বাচিত শব্দাবলী উপযুক্ত ভূমিকা পালন করেছে। হৃদয়ের কোমলতা প্রকাশের ভাষার মধ্যে আছে নম্রতা। তাঁর ভাষায় আছে তৎসম শব্দ ও বিদেশি শব্দের সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগ। তাঁর কবিতায় মুসলিম ইতিহাস, ইসলাম ধর্ম বা ঐতিহ্যচেতনা রূপায়ণের অনুষঙ্গ হিসেবে আরবি-ফারসি শব্দের প্রাচূযপূর্ণ ব্যবহার হয়েছে। তৎসম শব্দের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের যে ঐতিহ্য বিধৃত তা-ও কবি অস্বীকার করেননি।
নজরুল ইসলাম সময়ের প্রয়োজন সাধন করেছিলেন বলে কাব্যের পরিণতির দিকে তার তত লক্ষ ছিল না। তাঁর অদম্য প্রাণপ্রবাহ, তার বিক্ষুব্ধতা ভাবের ক্ষেত্রে বিশিষ্টতা আনলেও ভাবপ্রকাশের ভাষায় অসচেতনতার পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। মনের ক্ষোভ ব্যথা-বেদনা দ্বিধাহীন চিত্তে কাব্যে রূপায়িত করতে গিয়ে কোথাও কোথাও কাব্যিক সৌন্দর্য হয়তো ক্ষুণ্ন হয়েছে। কিন্তু মানুষের মাহাত্ম্যের অকুণ্ঠ প্রকাশেই তাঁর কবিকৃতি সার্থকতর।
কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য
- বুদ্ধদেব বসুর মতে নজরুল হলেন রবীন্দ্রনাথের পর ‘প্রথম মৌলিক কবি’ (রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক)। একথা সত্য, কারণ কবিতার বিষয় নির্বাচনে এবং তা প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি উচ্চকিত।
- নজরুলের কবিসত্তা ছিল যুগসচেতন। সেজন্য তিনি বিদ্রোহী। এই বিদ্রোহ অন্যায়, অসাম্য ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে।
- নজরুলের এই বিদ্রোহী চেতনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন পরবর্তী কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা। প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রভৃতি কবিগণ নজরুলের চিন্তীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।
- নজরুলের কবিসত্তার মূলে ছিল মানবপ্রীতি ও স্বদেশপ্রেম। মানুষকে ও দেশকে তিনি ভালোবেসেছিলেন বলেই সেই ভালোবাসার উৎস থেকে রচিত হয়েছে তাঁর কবিতা।
- ভারতীয় ঐতিহ্য ও উদার ধর্মমতের পথিক ছিলেন বলেই তাঁর কবিতায় ও সঙ্গীতে উঠে এসেছে সর্বধর্মের উপর মনুষ্য ধর্মের কথা।
- রবীন্দ্রনাথের মতো নজরুলের প্রেমচেতনা আদর্শায়িত নয়, বরং তার প্রেমাকাঙ্ক্ষা সাধারণ মানুষের গোত্রভুক্ত। তাই প্রেম ও প্রকৃতির রহস্যময় রাজ্যে তিনি বারবার বেদনায় কাতর ও বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেছেন— “প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র, সে বুঝি চিরন্তন নয়।”
- নজরুলের কবিতার আঙ্গিক যেমন সহজ তেমন বলিষ্ঠ। সেই বলিষ্ঠতা নানা রকমের শবদচয়নে, ছন্দের দোলায়, অলংকারের কারকার্যে ও চিত্রের অভিনব রূপসজ্জায়।
- কবির সাম্যবাদ সমাজ জীবনে আরোপিত হয়েছে। পাপী বলে কাউকে ঘৃণা করার অধিকার আমাদের নেই। নিপীড়িত, উপদ্রত মানুষের জন্য নজরুলের কবিকণ্ঠে আমরা যেন প্রচারকের সুর শুনতে পাই, অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় দেশে দেশে মানুষ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন—একথা মনে করেন নজরুল। ভারতের সর্বহারাশ্রেণি কবিকে বিপ্লব-ধর্মে দীক্ষা দিয়েছে। শোষিত শ্রমিকশ্রেণির দিকে তাকিয়ে তিনি লেখেন—
হীরা মাণিক চাসনিক তুই
চাসনি তো সাত ক্রোড়
একটি ক্ষুদ্র মৃৎ পাত্র
ভরা অভাব তোর।
- ‘ছায়ানট’, ‘দোলন চাঁপা’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘চক্রবাক’— এইসব কাব্যগ্রন্থের মূল সুর হল প্রেম ও নিসর্গ চেতনা। ‘সিন্ধু-হিন্দোল’-এর কবিতাসমূহ ভাব সম্পদের বর্ণনা বৈচিত্র্যে, আনন্দের সংহতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ‘চক্রবাক’ কবিতার মূল সুর হন প্রেম ও প্রকৃতি নিয়ে। চক্রবাকীর উদ্দেশে ‘নাম’ কবিতায় কবি লিখেছেন যে, যখন তিনি প্রভাতে নদীর ধারে থাকবেন না, ক্লান্ত পাখায় ‘উড়ে যাব দূর বিস্মরণীর তীরে’ তখন সে হয়ত তার অনুসন্ধান করবে।
- বিদ্রোহের উচ্চকঠে নজরুল ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’ প্রভৃতি কাব্য লিখেছেন। নজরুলের বিদ্রোহ কোন বিশিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদের রূপ নয়, এর মূলে আছে তার গভীর মানবপ্রেম, মানবিক গুণ-সম্পন্ন কবিচিত্ত মানুষের উপর নির্যাতন,শোষণ ও অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন। আবার তিনি মানুষের মনে পৌরুষকে বিরুদ্ধে বাণীরূপ লাভ করেছে। তার ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ধুমকেতু’ এই দুটি কবিতা একসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্যে আছে এক অভূতপূর্ব উন্মাদনার প্রকাশ,— এই উন্মাদনা সমকালীন জগৎ ও জীবনের প্রেক্ষিতে।
- নজরুল সামাজিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কামনা করেছিলেন। কিন্তু জাতীয় জীবনের ঐহিক দুর্গতিতে, নিরন্ন হাহাকারে ব্যথিত কবিপ্রাণে যে তীব্র বেদনাবোধের সঞ্চার হয়েছিল তা যেন অসহ্য আবেগে বিক্ষোভের অবর্ণনীয় ভাষায় ফেটে পড়ে ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতার উপসংহারে—
বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা।
- নজরুলের কাব্যের ভাষা বেগবান, শাণিত, নিশ্চিত ও অব্যর্থ। এ জাতীয় ভাব-ভাষা যে কত বলিষ্ঠ হতে পারে, কত বৈপ্লবিক হতে পারে, তার প্রমাণ নজরুলের কাব্য। তাঁর কাব্যের ভাণ্ডার একদিকে সংস্কৃত, অন্যদিকে আরবি, ফারসি শব্দের দ্বারা পূর্ণ হয়েছে। তিনি তাঁর কাব্যে গ্রাম্য শব্দ ও প্রচলিত শব্দ সমূহকে নতুন অর্থে সমৃদ্ধ করে প্রকাশ করেছেন।
- ছন্দের ক্ষেত্রে নজরুলের কৃতিত্ব প্রশংসনীয়। কলাবৃত্ত, দলবৃত্ত, মিশ্রকলাবৃত্ত সব রীতিকে অনুসরণ করলেও তাঁর কলাবৃত্ত, দলবৃত্ত রীতির ছন্দে মিলবিন্যাসে অভূতপূর্ব। যেমন— কলাবৃত্ত ছন্দ: ‘ক্ষুধাতুর শিশু/চায়না স্বরাজ/চায় দুটো ভাত/একটু নুন। (৬।৬।৬।৫)।
Leave a Reply