আধুনিক কবিতার ইতিহাসে প্রেমেন্দ্র মিত্রের অবদান আলোচনা কর।
প্রেমেন্দ্র মিত্র
আধুনিক কবিতার পুরোভাগে যে সব কবিদের অবস্থান, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রেমেন্দ্র মিত্র। আপাতভাবে তাঁর কবিতায় আধুনিক কবিতার জটিলতা ও দুরূহতা হয়তো নেই, কিন্তু তাঁর কবিতা পাঠককে অনিদ্দেশ সুদূরতার দিকে ইশারা করে। রবীন্দ্রযুগ ও আধুনিক যুগের মধ্যে সেতুবন্ধনের দ্বারা আধুনিক বাংলা কাব্যের বিস্তৃত রাজপথ নির্মাণের কাজটি সার্থকভাবে নিষ্পন্ন করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁর কবিতায় বহিরঙ্গের চমক বা আতিশয্য নেই। তাঁর বর্ণনা সুমিত ও ব্যঞ্জনাময়। যুগ-জটিলতা ও যুগ-বাহিত নৈরাশ্যের হাত ধরে পথ হাঁটলেও শ্রমজীবী মানুষের মিছিলে এক সারিতে দাঁড়াবার মতো মানসিক দৃঢ়তা তাঁর মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখি। নৈরাজ্য নয়, বরং সংঘবদ্ধ সংগ্রামের পথে তাঁর অমোঘ আকর্ষণটি দুর্লক্ষ্য নয়।
কবি চিত্র নাট্যকার গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্র উত্তর রৈবিক বাংলা কবিতার এক অন্যতম পুরোধা, কল্লোলের বিখ্যাত ‘ট্রায়ো’র একজন’। কথাসাহিত্যে ও কাব্যের দ্বিমুখী ধারায় তাঁর অবগাহন। সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় চেকভের সঙ্গে তুলনা করে সকৌতুকে প্রশ্ন করেছিলেন— “সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র কবিতা ও ছোটগল্পের মধ্যে কোনটিকে বলবেন জীবন সঙ্গিনী আর কাকেই বা চিহ্নিত করবেন মম সঙ্গিনী? কে তাঁর বৈধীকে তাঁর রাগানুগা? তাঁর সাহিত্যিক সত্তা নিয়ে যদি কবি ও গল্পকারদের মধ্যে সন্ত কবীরের শবদেহের মতো বিরোধ বাঁধে তা হলে, কবীরের ভক্তদলের মত কোনো পক্ষই হতাশ হবেন না।”
মূলত কবিতায় তিনি প্রধানত সামাজিক, ঘাম ঝরা, খেটে খাওয়া মানুষের নিত্য সঙ্গী অনেক সময় তিনি রাজনীতি সচেতন। মার্কসবাদে প্রতিষ্ঠা না হয়েও মানবতার অভিজ্ঞতায় সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী। আবার নাগরিক জীবনের গ্লানি ও ক্লান্তি কাটাতে— প্রাকৃতিক নির্জনতার অভিলাষী অথবা ইতিহাস ও ভূগোলের ধূসর ও সুদূর পথে যাত্রা পিয়াসী।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের জন্ম ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৯১৮-তে ঝলক নামের কবিতার খাতায় তাঁর কাব্যচর্চার সূত্রপাত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ও অনিশ্চয়তা, সোভিয়েত রাশিয়ার নবজন্ম, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন বৈপ্লবিক দিগন্তের উন্মোচন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড, গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন, রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগ ইত্যাদি ঘটনাগুলি প্রেমেন্দ্র মিত্রের চেতনায় ছায়া ফেলেছিল। রাবীন্দ্রিক চিন্তায় মগ্ন কবির মধ্যে দেখা দিল সংশয় এবং যুক্তিবাহিত জিজ্ঞাসা। জীবনের বঞ্চিত যন্ত্রণামূর্তি তিনি দেখেছেন, তবু তাঁর মধ্যে রয়ে গেল এক অদ্ভুত নস্টালজিয়া। অন্নদাশংকর রায় তাই প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্বন্ধে লিখেছিলেন— ‘‘Premendra is a broken hearted dreamer, still hoping for the best from a revolution.’’
‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ থেকে এবং ‘কালিকলম’ পত্রিকায় ১৯২৬ থেকে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথমা’র প্রকাশকাল ১৯৩২। এর পর ‘সম্রাট’ (১৯৪০), ‘ফেরারী ফৌজ’ (১৯৪৮), ‘সাগর থেকে ফেরা’ (১৯৫৬), ‘কখনও মেঘ’ (১৯৬০), ‘হরিণ-চিতা-চিল’ (১৯৬১), অথবা ‘কিন্নর’ (১৯৬৫), ‘নদীর নিকটে’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। ‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যগ্রন্থটি ১৯৫৭-তে একাদেমী পুরস্কার ও ১৯৫৮তে রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেছিল।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম থেকেই তাঁর কবিস্বরূপের পরিচয় সুস্পষ্ট। আধুনিক কবিদের মতোই এখানে তাঁর সংশয়ী আত্মার উচ্চারণ প্রকাশিত। শোষণবঞ্চনা ও পীড়নে ভরা পৃথিবীতে কবি ঈশ্বরের অস্তিত্বেও সন্দিহান—
আবর্তে ঘুরিয়া মরে অন্ধ মোর বদ্ধ প্রাণধারা
বেদনায় সারা,
তাহারে দেখাও পথ
দ্বার খোল, দ্বার খোল রাত্রির প্রহরী।
তবু এই নৈরাশ্যের থেকেও প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবি-আত্মার উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সমবেদনা ও আস্থা। ‘প্রথমা’ কাব্যগ্রন্থেই আছে সেই বিখ্যাত কবিতা—
আমি কবি যত কামারের আর কাসারির আর ছুতােরের।
মুটে মজুরের,
আমি কবি যত ইতরের।
বিশ্বের সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কবি সাযুজ্য অনুভব করেন এই কবিতায়—
সারা দুনিয়ার বোঝা বই, আর খোয়া ভাঙি,
আর খাল কাটি ভাই, পথ বানাই
কর্মক্লান্ত মানুষের সঙ্গে পুরাতন জাহাজের ভাবনা একীকৃত হয়ে গেছে ‘বেনামী বন্দর’ কবিতাতেও—
কোমরের জোর কমে গেল যার ভাই,
ঘুণ ধরে গেল কাঠে, আর যার
কলজেটা গেল ফেটে
জনমের মত জখম হল যে যুঝে
‘কবি’ এবং ‘বেনামী বন্দর’ কবিতা দুটিতে কর্ম ও ঘর্মময় শ্রমজীবনের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করলেও ‘জ্যাফরী কাটানো’ জানলায় প্রিয়ার মুখচ্ছবি কিংবা ওই ধরনের কোনো রোমান্টিক বোধের আগ্রাসনকে প্রেমেন্দ্র এড়িয়ে যেতে পারেননি। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথের ‘ওরা কাজ করে’ কবিতার ছায়াও এখানে যেন দুর্লক্ষ্য নয়।
প্রেমেন্দ্র মিত্র নগর-জীবনের কবি, রবীন্দ্রনাথ ‘বধূ’ কবিতায় যেমন নগর-জীবনকে বর্ণনা করেছেন— ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট-হিসাবে; তেমনি প্রেমেন্দ্রও নগরের বুকে ভীড় করা মানুষের জীবনকে বর্ণনা করেছেন এইভাবে—
একটি ইটের ব্যবধান রেখে
পাশাপাশি থাকি শুয়ে;
এ ছাতের জল ও ছাতে গড়ায়
ভিৎ গাড়া একই ভুঁয়ে।
নাগরিক জীবনের বদ্ধতায় কবি অস্থিরতা বোধ করেন। এ শহর মাটিকে পাথর করে, অরণ্য রূপান্তরিত হয় আসবাবের কাঠে। এখানে আকাশ ছাদের অন্তরালে ঢাকা পড়ে যায়। ‘সম্রাট’ কাব্যগ্রন্থে কবি লিখলেন—
শুধু কাঠের সিঁড়ি
কোন দিন পৌছাবে না আকাশে।
এই কাব্যগ্রন্থের ‘বাঘের কপিশ চোখে’ কবিতায় কবি অরণ্য সভ্যতার ধ্বংসের বুকে গড়ে ওঠা নগর সভ্যতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন—
নগরের ছায়া গেছে নেমে,
নেমে গেছে অরণ্যে আরেক
সে অরণ্যে নব-মৃত্যু মোরা সৃজিয়াছি।
মনে রাখতে হবে প্রেমেন্দ্র মিত্র একাধারে কবি ও কথাসাহিত্যিক। কল্লোল যুগের কথাসাহিত্যিক হিসাবে তাঁর মধ্যেও ফ্রয়েডীয় মগ্নচৈতন্য তত্ত্বের প্রভাব পড়েছে। ‘সম্রাট’ কাব্যগ্রন্থে এই ফ্রয়েডীয় প্রভাবের স্বীকৃতি আছে—
কত যে সাগর আছে:/কতদূর পৃথিবীর তটে
আছাড়িয়া পড়ে কতদিন।
আমি জানি তার চেয়ে/উতল সাগর এক,
তার মাঝে চেতনা বিলীন।
নগর সভ্যতার ক্লান্তি, শ্রমজীবী মানুষের ক্লান্তি, আধুনিক সভ্যতার অন্তর্লীন নৈরাশ্য, মগ্নচৈতন্যের সর্পিল পথের বিরংসা কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেমেন্দ্র মিত্রকে নৈরাশ্যবাদী করে তোলে না। নগর সভ্যতার বিরুদ্ধে নালিশ থাকলেও তিনি তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে সুস্থ ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন দেখেছেন। শেষপর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন মানুষের সপক্ষে। ‘প্রথমা’ কাব্যগ্রন্থে নিঃস্ব-রিক্ত মানুষের বুকে তিনি ঈশ্বরকে দেখেছিলেন—
বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে বন্দি মোর ভগবান কাঁদে, কাঁদে
কোটি মার কোলে অন্নহীন ভগবান মোর।
অথবা বলেছেন—
তার সঙ্গে গান গাইব মানুষের
যে মানুষ পথ সৃষ্টি করেছে।
মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলাবার পথ।
মানুষের সঙ্গে মেলার জন্য তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলিতে একাধিকবার পথের গান উচ্চারিত। তাই তার বোধে মানুষকে পরিপূর্ণ অর্থে জানার ও পাবার আকাঙ্ক্ষা উচ্চারিত হয়—
মানুষের মানে চাই
গোটা মানুষের মানে!
রক্ত, মাংস, হাড়, মেদ, মজ্জা
ক্ষুধা, তৃষ্ণা, লোভ, কাম, হিংসা সমেত
গোটা মানুষের মানে চাই।
‘ফেরারী ফৌজ’ ও ‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যগ্রন্থে মানুষকে অন্ধকার অতিক্রম করে সূর্যস্নাত সকালে পৌছে দেবার বলিষ্ঠ আশাবাদ ধ্বনিত হয়েছে বারবার। হিংস সভ্যতার চক্রান্তে মানুষের ইতিহাস রক্তাক্ত ক্লেদাক্ত হয়, মনুষ্যত্বের সৈনিকেরা সংগ্রাম করেও হয়তো সাময়িকভাবে ব্যর্থ হয়, তবু সেই ব্যর্থ ফেরারী সৈনিকেরা আবার পুর্ণোদ্যমে ফিরে আসে প্রভাতের তপস্যাকে পূর্ণ করবে বলে। নীল নদীতট থেকে সিন্ধু উপত্যকা, সুমের, আক্কাদ, বা হোয়াংহোর তীরে প্রেমেন্দ্র দেখেছেন মানুষের গড়ে ওঠার ইতিহাস। মানুষের এই উদ্যম ও আকাঙক্ষাই বুকে নিয়ে কবি নৈরাশ্যের অন্ধকার পার হয়েছেন। কবির ‘সংশপ্তক সেনা’ প্রতি শতাব্দীতে অন্ধকারের যড়যন্ত্র ভেঙে দিয়ে কালের দিগন্তে সূর্য-কণা বয়ে নিয়ে আসে। মহাভারতের সংশপ্তক সেনাকে কবি সূর্যচেতনাসম্ভূত সংগ্রামশীল মানুষের প্রতীকে রূপান্তরিত করেছেন। ‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যগ্রন্থে কবি লিখেছেন—
সেই সুরে উদ্দীপিত
সংশপ্তক নারায়ণী সেনা
হাসিমুখে সব মৃত্যু হয়ে যায় পার,
অন্ধকার বন্দীপুর ভেঙে খোলে জ্যোতির দুয়ার।
কখনো এই সংশপ্তক সেনার দল হিংস্র প্রতি-আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে গেলেও সূর্য-কণা তো হারিয়ে যাবার নয়। ‘ফেরারী ফৌজ’ গ্রন্থে তাই কবি সেই দিকভ্রান্ত সৈনিকদের উদ্দীপ্ত করেছেন আবেগময় আহ্বানে—
এখনো ফেরারী কেন?
ফেরো সব পলাতক সেনা।…
এবার অজ্ঞাতবাস শেষ হলো ফেরারী ফৌজের।
উনিশ শতকের শেষার্ধে পুরাণের নবমূল্যায়ন শুরু করেছিলেন মধুসূদন। হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র রবীন্দ্রনাথও পুরাণ কাহিনীকে এনেছেন নব-দৃষ্টিভঙ্গিতে। আধুনিক কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রও স্বভাবতই নব আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন পুরাণ-বিষয়কে। ‘দশানন’ কবিতায় অমিতবীর্য রাবণকে তিনি দেখেছেন পৌরুষের প্রতীক রূপে। তার ব্যাখ্যায় নিজ হৃদয় ও বোধিকে দশদিকে প্রসারিত করেন বলেই তিনি দশানন—
দশ দিক হতে আলো অসঙ্কোচে কর অন্বেষণ
তুমি তাই সত্য দশানন।
‘হরিণ চিতা চিল’ কাব্যের ‘অধ্যাহার’ কবিতায় পাণ্ডবদের অক্ষত্রীড়ার সঙ্গে তিনি আধুনিক ‘জীবনের লাভালাভ’ মিলিয়ে দেন—
ছড়িয়ে পাশায় দান,
দূতক্রীড়া রাজ্য আর নির্বাসন সব
হলে আস্বাদিত,
সেই এক বিমূঢ় জলায়
পঞ্চপাণ্ডবের মত সবাই দাঁড়াই একদিন।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের মধ্যে সর্বদাই একটা উদ্দাম জীবনের ঝোড়ো সংকেত পাওয়া যায়। আসলে এই উদ্দাম বৈপ্লবিক জীবনভঙ্গীও তাঁর রোমান্টিক মনেরই ফসল। পথ, সমুদ্র, অরণ্য, বন্দর ইত্যাদি তাঁর কবিতায় তাই ঘুরে ঘুরে আসে। আধুনিক কবিদের মতো তাঁর কবিতা জটিল মানসক্রিয়ার পথ বেয়ে তৈরি হয় না। দুর্বোধ্যতার অভিযোগ তাঁর প্রতি নেই, তাই কোনো কোনো সমালোচক তাঁকে ঠিক আধুনিক বলতে প্রস্তুত নন। তবু যুক্তিনিষ্ঠ মানবতা ও সংগ্রাম চেতনার সঙ্গে অর্গলহীন উদ্দাম রোমান্টিসিজমের সমন্বয়ে, ফ্রয়েডীয় মগ্নচৈতন্যের সঙ্গে মার্কসীয় শ্রেণিসংগ্রামের প্রতি বিশ্বাসে, শব্দ রচনায়, প্রতীক নির্মাণে, ছন্দ ও অলংকারের অভিনবত্বে প্রেমেন্দ্র মিত্র আধুনিক কবি হিসেবেই স্বীকৃতি পাবেন।
Leave a Reply