//
//

বাংলাদেশের কবি ফরহাদ মজহারের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

ফরহাদ মজহার

ষাটের দশকের অন্যতম কবি ফরহাদ মজহার (১৯৪৭-) যিনি তাঁর কবিতায় একটি গোষ্ঠীর বেড়ে ওঠার সংগ্রাম, রাষ্ট্রের ইতিহাসকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন ফলে রাজনীতি ও ইতিহাসের যুগ্মসম্মেলনেই তিনি কবিতার নির্মাণ ঘটিয়েছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে একটি জাতির সংকট, চাওয়া-পাওয়াকে কবিতার মধ্যে দিয়ে ধরতে চেয়েছেন। তিনি মনে করেন কল্পনা ছাড়া বিপ্লব হয়না। কারণ আমরা যাকে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড বলি কবির মতে তা আসলে বনবাসী মানুষের সামাজিক হওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ (১৯৭২), ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি (১৯৭৭), আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছো বিপ্লবের সামনে (১৯৮৩), বৃক্ষ (১৯৮৫), সুভাকুসুম দুই ফর্মা (১৯৮৫),অকস্মাৎ রপ্তানীমুখী নারী মেশিন (১৯৮৫), খসড়া গদ্য (১৯৮৭), মেঘ মেশিনের সঙ্গীত (১৯৮৮), এবাদতনামা (১৯৯০), অসমের নোটবই (১৯৯৪), দরদী বকুল (১৯৯৪) প্রভৃতি। প্রথম থেকেই কবি রাজনীতি সচেতন। তাই খোকনের স্বরূপে তিনি নিজের কবিসত্তার পাশাপাশি পূর্ব-পাকিস্তানের সেদিনের লক্ষ লক্ষ যুবকের কথা বলতে চেয়েছেন। প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে লড়াই করে কবি ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতিগুলোকে কাব্যে রূপ দিয়েছেন, তেমনি সেদিনের বাংলার লক্ষ লক্ষ যুবক তাদের প্রতিপুরুষ পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনির সঙ্গে লড়াই করেছে দেশ ফিয়ে পাওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের এই লড়াইয়ের পথ খুব মসৃণ ছিল না। কারণ মুক্তিযুদ্ধের এই লড়াই শুরু হয়েছিল আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী সামরিক শাসনকালে। এই সময় পাকিস্তান সরকার খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিদ্রোহ দমন করেছিল, এমনকি মানুষের দৈনন্দিন চাওয়া-পাওয়া সেদিন কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। মানুষের এই অসহায় অবস্থার পাশাপাশি সরকারের দমননীতির কথা তুলে ধরলেন কবি—

বাইরে এখন মৃত্যু, বাইরে পা বাড়ালেই মৃতদেহ

হেলাফেলায় বাড়তে দাও নি, তুমি এখন বন্দী নিজেই

যাও নি কোথাও কারো সঙ্গে নেই সবিশেষ জানাশোনা

বাইরে শ্লোগান বাইরে যুদ্ধ—তুমি ঘরে ব্দী আছো।

আমি তোমায় খুন করবো খুন ক’রে ঘুম পাড়িয়ে রাখবো

যে আমাকে মুখ বেঁধে হাত বেঁধে তুমি পঁচিশ বছর

বিচারবিহীন অন্ধকারে রক্তমাংসে গুম করেছো—

সেই আমি খুন করবো, করে জেগে উঠবো জেগে থাকবো।

সাতচল্লিশে পাকিস্তান ভারত থেকে পৃথক হলেও একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে নতুন স্বাধীনতা পাওয়ার আগে পর্যন্ত কার্যত পঁচিশ বছর পরাধীন ছিল। এই পঁচিশ বছর বাঙালির সত্তাকে যেন ঘুম পাড়িয়েই বন্দি রাখা হয়েছিল। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নতুন করে বাঁচার আস্বাদ লাভ করেছিল। কবিও সেই আনন্দের অংশীদার হতে চান। তাই তিনিও আজ বাইরে পা বাড়াতে চান, বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে দিতে চান নিজের প্রতিবাদী সত্তাকে। ষাটের দশকের অন্যতম স্পর্ধিত, উদ্যত কবি হুমায়ুন কবির আততায়ীর হাতে নিহত হন। এমন প্রতিভাকে অকালে ঝরে পড়তে দেখে চুপ থাকতে পারেন না কবি। তাই প্রতিবাদের পাশাপাশি হুমায়ুনকে সাবধান না করার দায়ভার কাঁধে নিয়ে অপরাধবোধেও ভোগেন কবি—

জানিয়ে দিতে পারতাম ইস্পাতের-সঙ্গে-কুসুমের-ভালোবাসা ভালো নয়

ভালো নয় সেতুর উপর দাঁড়িয়ে খেয়ার জন্য অপেক্ষা করা

ভালো নয় ইন্দিরা রোডে রেবুকে ফেলে লেখক শিবিরে মেতে থাকা

বলতে পারতাম অতো ‘দ্রুত নয় হুমায়ুন, আস্তে আস্তে যা’

সবকিছুই তো বলতে পারতাম সবকিছুই কি বলা যায়!

সবসময় কি সবকিছু করা যায়? সংগঠন বা সংসার

এই যে এখন তুই দাঁড়িয়ে আছিস সামনে, মাথায় গুলি

রক্তে তোর শরীর ভিজে যাচ্ছে ভিজুক, আমি কি করব?

কবির আক্ষেপোক্তির মধ্যে ধরা পড়েছে সামরিক শাসনের ভয়াল অত্যাচারের চিত্র। কেবল সাধারণ মানুষ নয় কোনো কবি-সাহিত্যিকদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি সেসময়ে। সংগঠন করতে গিয়ে তাই হুমায়ুনদের মরতে হয়। কবি জানেন তিনি বাধা দিলে হয়তো হুমায়ুনকে আজ মরতে হোতনা কিন্তু কবি জানেন হুমায়ুন কোনো অন্যায় কাজ করে নি। তাই তিনি চান হুমায়ুনের শরীর রক্তে ভেসে যাক কারণ এই রক্তই নতুন বিপ্লবের জন্ম দেবে, নিয়ে আসবে স্বাধীনতা, শোধ করবে হুমায়ুনদের প্রতিটি রক্ত বিন্দুর ঋণ। একাত্তরের স্বাধীনতা লাভের দিনেও কবি ভুলতে পারেন না বাহান্নোর রক্তমাখা স্মৃতি। বাঙালির দুদশকের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম বৃথা যায়নি। সাতচল্লিশের পূর্ব-পাকিস্তান উনিশশো বাহাত্তর সালে দাঁড়িয়ে পঁচিশ বছরের নবযৌবনা বাংলাদেশ। আজ সে স্বাধীন, আজ তার সার্বিক উন্নয়নের রাস্তা প্রশস্ত। তাই আজকের বাংলাদেশের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে কবি লিখলেন—

যুদ্ধক্ষেত্রে থাকুক পতিত আবাদ করলে তোমরা করো

আমার তো চোখমুখ ফুটেছে আমি সবের অর্থ বুঝি।

বাহাত্তুরের এই অগাস্টে আমার পঁচিশ বছর পুরবে

পঁচিশ বছর অনেক বয়েস আমার তো চোখমুখ ফুটেছে।

কিন্তু সদ্য স্বাধীনতা লাভের সুখস্মৃতি স্থায়ী হয় না। কবি দেখছেন দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু দেশের মানুষ স্বাধীন হয়নি। আজও বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুধা, দারিদ্রের কবলে বন্দি। কবি তো এই বাংলাদেশ চাননি। তিনি চেয়েছিলেন শান্তিকামী সোনার বাংলা। কিন্তু অশান্তির এই কারাগারে কবি বন্দি থাকতে চান না। তাই তিনি প্রার্থনা করেছেন এই স্বদেশের পতন। প্রসঙ্গক্রমে কবি খ্রিস্ট্রীয় পুরাণকে অবলম্বন করেছেন। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান পাপের বৃদ্ধি লক্ষ করে ঈশ্বর পৃথিবীর সমগ্র জীবজগৎ ধ্বংস করে পুনরায় নতুন জগৎ গড়তে চেয়েছিলেন। এর জন্য তিনি নিষ্পাপ ব্যক্তি নূহকে পৃথিবীর সমস্ত জীবজন্তুর একটি করে জোড়াকে নিয়ে একটি জাহাজে আশ্রয় নিতে বলেন। এর পর ঈশ্বেরর কৃপায় একমাস সমস্ত পৃথিবীতে একমাস প্রলয় ঘটে কেবল বেঁচে যায় নূহের জাহাজে থাকা একজোড়া করে প্রাণী। তাদের দিয়েই পাপমুক্ত পৃথিবী রচনা করার অঙ্গীকার করেন ঈশ্বর। কবি ফরহাদ মজহারও চেয়েছেন পাপের বাংলাদেশ যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তিনি নতুন বাংলাদেশেই নূহের মতো ফিরে আসতে চান। কবির সেই কামনা ব্যক্ত হয়েছে নিম্নোক্ত কবিতায়—

প্লাবনের আগে থাকে ঘটনা পরম্পরা, তারো আগে তুমি

পরিণামদর্শী ছিলে, ইতিহাসে ছিলে, ছিলে সমস্ত বিশ্বাসে

ছিলে শূন্যে শূন্যতায় বিশ্বলোকে নয়, ওকে বিশ্ব বলে না,

যেখানে থাকো না কেন ও আমাকে তুলে নাও

আমি তো বিশ্বাসী।

যেন আরেকবার আমি পৃথিবীতে ফিরে আসি। ভালবাসি বলে

ভালবেসে ফিরে আসি। তৃতীয় যুদ্ধের স্মৃতি আরেকবার ভুলে

ক্রোধ ভুলে যাবো। যে প্রেমে যে হাতে তুমি বীজ

তুলেছো জাহাজে, আমি সেই প্রেমে সেই হাতে প্রেম

বপন করবো ভস্মে, অন্ধকারে, প্লাবনের পরে।

যাদের জন্য বাংলাদেশ আজ ধ্বংসের মুখে তাদের কবি ক্ষমা করতে পারেন না। কবি না চাইলেও কবির সত্তা যেন কবিকে নতুন করে বিপ্লবের সামনে দাঁড় করাতে চান। নিজ হৃদয়ের ডাক কবি ফেরাতে পারেন না। তাই মিস্ত্রির মতো কবি নিজেকে ধারালো করে গড়ে নিচ্ছেন, নিজের দ্বিধা-সংশয়কে নিষ্ঠুর অস্ত্রোপচারের মতো খসিয়ে ফেলছেন, পিছুটানকে পেরেকবিদ্ধ করে পিছনে ফেলে এসেছেন। দীর্ঘকাল কবি চুপ করে থাকলেও আজ আর কবি চুপ করে ঘরে বসে থাকার পক্ষপাতী নন। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান কবিকে রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কবি ফিরে গেছেন ইতিহাসের স্মরণীতে। কবির চেতনায় কৃষক বিদ্রোহ, পলাশীর যুদ্ধ, তীতুমিরের বাঁসের কেল্লা, ওয়াহাবী আন্দোলন একত্রিত হয়েছে ফলে নতুন অনুপ্রেরণা নিয়ে কবি যুদ্ধের রাস্তায় নেমেছেন—

আমার গন্তব্য ফুটে উঠেছে প্রতিটি রাস্তায়

প্রতিটি রাজপথে

প্রতিটি আয়ল্যান্ডে

মোড়ে মোড়ে টগবগ করে উঠছে লালঝাণ্ডা

তারা আমাকে ট্রাফিকনির্দেশ দিচ্ছে

আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে

এখন আমার আর ফেরার উপায় নেই।

কবি সমকালীন সমাজের এইসব অসঙ্গতিকে তুলে ধরার জন্য সমাজের চেনা শব্দগুলোকেই আহরণ করেছেন। কবিতাকে তিনি অনবরত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়েই গ্রহণ করতে চেয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাব্যভ্যবনায় পরিবর্তন হয়েছে। প্রেম-প্রকৃতি তাঁর কবিতার বিষয় নয়, মানুষ, মানবতা, রাজনীতি থেকে সুনিশ্চিত প্রত্যয়ে পৌঁছানোই কবির লক্ষ্য। তাই তাঁর কবিতায় পাঠক এক শোষণমুক্ত সমাজের পাশাপাশি কাঙ্খিত মানসিক আশ্রয় খোঁজে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!