//
//

বাংলাদেশের কবি মহাদেব সাহার কৃতিত্ব আলোচনা কর।

মহাদেব সাহা

ষাটের দশকের অন্যতম কবি মহাদেব সাহা (১৯৪৪-)। তাঁর কবিতার পরিসর ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময় বলে তাকে কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় ধরে রাখা কঠিন। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে গ্রাম, শস্যক্ষেত্র, ফেলে আসা জীবন, তাতে মিশে আছে মাটির গন্ধ, জীবনের নির্যাস। অসামান্য শিল্পকুশলতায় তিনি প্রেম-সৌন্দর্যকে জীবন্ত করে তোলেন তাঁর কবিতায়। তবে সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায় তাঁর অর্ন্তলীন বেদনাবোধ। ষাটের দশকের দুঃখ, ক্রোধ, হতাশায় আক্রান্ত মহাদেব সাহার কবি চৈতন্য কখনো দার্শনিক উপলব্ধির মধ্যে  আশ্রয় খুঁজেছেন কখনো আবার নিত্যদিনের ক্লেদাক্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে আত্মহননের নেশায় ধাবিত হয়েছে, কখনো আবার সংসার থেকে পালাতে চেয়েছে। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— এই গৃহ এই সন্ন্যাস (১৯৭২), মানব এসেছি কাছে (১৯৭৩), চাই বিষ অমরতা (১৯৭৫), কী সুন্দর অন্ধ (১৯৭৮), তোমার পায়ের শব্দ (১৯৮২), ধুলোমাটির মানুষ (১৯৮২), আমি ছিন্ন ভিন্ন (১৯৮৬) মানুষ বড়ো ক্রন্দন জানে না (১৯৮৯), প্রথম পয়ার (১৯৯০), কোথা সেই প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ (১৯৯০), একা হয়ে যাও (১৯৯৩), যদুবংশ ধ্বংসের আগে (১৯৯৪) প্রভৃতি। সত্তরের দশকে প্রথম কাব্য প্রকাশিত হলেও কবির কাব্যরচনার সূত্রপাত ষাটের দশকে। প্রথম দিকে কবি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা নির্লিপ্ত। সামরিক শাসনের দমবন্ধ দিনগুলিতে কবি সদ্য যুবক। কিন্তু যৌবনের বিকাশ ঘটে নি সামরিক শাসনের বেড়াজালে। বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে কবির আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো। এর ফলে কবি ক্রমশ নিসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। চারপাশের অবিশ্বাসের হাওয়ায় কবি নিজের বলে কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। তাই ব্যাকুল হয়ে বন্ধুর সন্ধান করেছেন যার থেকে কবি নিজের চাওয়াপাওয়াগুলিকে মিটিয়ে নিতে পারবেন—

এখানে ওখানে সর্বত্র আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম

যে আমাকে নিয়ে যাবে সুন্দরবনে হরিণ শিকারে, হরিণের শিং থেকে

তার স্বচ্ছ খুর খুঁটে নেবে দামী অংশগুলি যেন ও গাভীর

খুর থেকে বানাবে বোতাম, সে

আমাকে প্রতিদিন ধার দেবে লোভ, এখানে

সেখানে শহরের পরিচিত অঞ্চলগুলিতে আমি সেই সরল সাঙাতটিকে

খুঁজি, আমি শুধু সারাজীবন একটি বন্ধুর জন্য প্রত্যহ বিজ্ঞাপন দিই

কিন্তু হায়, আমার ব্ল্যাডগ্রুপের সাথে

কারো রক্ত মেলে না কখনো।

শুধু কবি একা নন ষাটের সামরিক শাসনের বেড়াজালে বহু কিশোরের কৈশোর ব্যহত হয়েছে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়েছিল ষাটের দশকে। অনাবৃষ্টিতে ফাটছে মাঠ, বোমায় শহর ধ্বংস হচ্ছে, লোকালয় উচ্ছন্ন হচ্ছে, মহামারীতে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে। প্রাণধারণের জন্য প্রকৃতির থেকে নিঃশ্বাস কিংবা অরণ্যে আশ্রয় নেওয়ার উপায় পর্যন্ত নেই। তাই মহাদেব সাহার সেদিনের যুবকরা সাহিত্যের মধ্যে জীবনের আশা খুঁজেছিলেন, তাঁদের অবলম্বন হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যেই কবি জীবনের নতুন তাৎপর্য সন্ধান করেছেন—

এখন ভীষণ রুগ্ন আমরা, সারা গায়ে কালোশিরা, চোখ বর্তি

নিঃশব্দ আঁধার, যেখানে যাই আমরা কজন যুবা

যেন বড়ো বেশি ম্লান ফ্যাকাশে বৃদ্ধ, চোখমুখে

স্পষ্ট হয়ে লেগে থাকে যাবতীয় অনাচার, নিজের কাছেও

আজ নিজেদের লিকাবার রাস্তা খোলা নেই, এ যুগে আমরা

বড়ো অসহায় কজন যুবক; শুনুন রবীন্দ্রনাথ তবু আমরা

কজন যুবা আজো ভালোবাসি গান, তবু

আজো কজন যুবক

বড়ো ভালোবাসি মাধবীকে, ভালোবাসি মাধবীর বাংলাদেশ

তার নিজস্ব বর্ণমালা রবীন্দ্রসঙ্গীত।

ষাটের দশকের রক্তাক্ত সময়েও কবি ভুলতে পারেন না বাহান্নোর সেই একুশে ফেব্রুয়ারির কথা। তাই মৌনমিছিলে শহরের পরিবেশ যখন হঠাৎ ভারী অশ্রুসিক্ত হয়ে, বয়ে যায় শোকার্ত মেঘ আর থোকা থোকা শিশির বিন্দু তখন কবির চেতনায় ভেসে ওঠে সেই সব রক্তমাখা দিনের স্মৃতি। আজকের পাঠক দেখেনি সেদিনের হত্যাকাণ্ড কিন্তু কবি জানেন। তাই পাঠকের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন কবি—

আমি জানি এতো

মেঘ নয়, নয় শীতের শিশির; প্রিয়হারা এ যে

বোনের কান্না, মায়ের চোখের তপ্ত অশ্রু। এই যে

একুশে রাজপথ জুড়ে এতো রঙিন আল্পনা আঁকা।

তোমরা কি জানো সে তো নয় রঙ ও তুলির ব্যঞ্জনা কিছু

এই আল্পনা, পথের শিল্প শহীদেরই তাজা রক্তের রঙ মাখা!

সমাজ-সচেতন কবি ষাটের অস্থির সময়কে মেনে নিতে পারেন না। চোখের সামনে কবি প্রত্যক্ষ করছে মানুষের স্বার্থপরতার রূপ। স্বার্থের জন্য মানুষ নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছে শাসকের কাছে, নতজানু হতে হতে মানুষের মেরুদণ্ডই যেন আজ ভেঙে পড়েছে। তাই তাদের ব্যঙ্গ করে কবি বললেন—

আমি তাই জন্ম নতজানু, নতমুখ

মাথা তুলে বুক খাড়া করে কোনোদিন দাঁড়ানো হলো না

বুকভাঙা বাঁকানো কোমর আমি নতজানু লোক

কতো আর নতজানু হবো কতো দাঁতে ছোঁবো মাটি!

পূর্ব-পাকিস্তানের অন্যান্য কবিদের মতো মহাদেব সাহাও প্রতিবাদী কবিতার বিষয় হিসাবে মুক্তিযুদ্ধকে বেছে নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রাক-বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পটভূমি তাঁর কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের লড়াইয়ে বাংলাদেশের বহু পরিবার সন্তানশূন্য হয়েছে। কিন্তু মৃত সন্তানই স্বাধীন বাংলাদেশের রূপ ধরে ফিরে এসেছে। সেই রক্তমাখা স্বদেশের কাহিনি পাঠককে শুনিয়েছেন কবি—

চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন

একজন বললো দেখো ভিতরে নবীন

হাতের আঙুলগুলি আরক্ত করবী

রক্তমাখা বুক জুড়ে স্বদেশের ছবি।

স্বাধীনতা এসেছে, উন্নতির পথে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। সোনার বাংলার গ্রাম ছেড়ে মানুষ শহরে পাড়ি দিয়েছে ভোগবাদী সভ্যতার আস্বাদ গ্রহণ করার জন্য। চারিদিকে যন্ত্রের প্রাধান্য। কবি এসবের মধ্যে শান্তি খুঁজে পান না। তাই শপিংমল, মোটরগাড়ি, কলিংবেল ছাড়িয়ে কবির দৃষ্টি প্রসারিত হয় পথে, প্রান্তরে, বটবৃক্ষের তলে। বিজ্ঞানের অধিপত্যের কাছে কবি হার মানেননি। তাই জীবনের শেষ পর্বে এসেও কবি সেই প্রকৃতির আশ্রয়প্রার্থী—

যতোই বলো আমি কীভাবে মুখস্থ করি মোবাইল, এসএমএস,

আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে ফড়িং, জোনাকি, কালো পিপড়ে

দ্যাখো না আমার দুচোখ-ভরা উতল বর্ষাকাল,

আমি এই মাটির মেঝেতে মেঘের সাথে শুয়ে থাকি,

যতোই বলো আমি আজো সেই শৈশবের অথই ধ্বনিপুঞ্জের মধ্যে

ডুবে আছি।

মহাদেব সাহার কবিতায় যেমন দার্শনিকতা আছে তেমনই আছে প্রেম-প্রকৃতি-মুক্তিযুদ্ধের কথা। কিন্তু এতকিছুর মাঝে কখনোই তিনি নিজের জন্মভূমিকে ভুলে থাকতে পারেননি। তাই স্বদেশ, মাতৃভূমি ও স্বাধীনতা মিলেমিশেই গঠন করেছে তাঁর কবিতার শরীর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!