//
//

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিক গীতিকবিতার ধারাটির প্রবর্তন করেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন গীতিকবিতার বেলায় ভোরের পাখির মত—তাঁর অস্ফুট বাণীতে গীতিকবিতার সূচনার ইঙ্গিত ফুটে উঠেছিল। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) হাতে এই ধারাটি বিশেষভাবে সমৃদ্ধি লাভ করে এবং একমাত্র তারই বিস্ময়কর প্রতিভার অনুপম স্পর্শে বাংলা গীতিকবিতার একটি পূর্ণ পরিণতি ঘটে। শুধু গীতিকবিতার এই বিশেষ ক্ষেত্রটির মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের অতুলনীয় প্রতিভা সীমাবদ্ধ ছিল না, সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগেও তিনি চরম সার্থকতা লাভ করেছিলেন। কবিতা, গান, নাটক, প্রহসন, উপন্যাস, ছোটগল্প, পত্রসাহিত্য, ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ সাহিত্য প্রভৃতি সকল দিকেই তাঁর প্রতিভা বিকশিত হয়েছে। এই সমস্ত শ্রেণিবিভাগের প্রতিটি পর্যায়ে তাঁর অবদান তুলনারহিভ। সুদীর্ঘ জীবনের পরিসীমায় অক্লান্ত সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যে যে সীমাহীন অবদান রেখে গেছেন তা বৈচিত্র্যে উৎকর্ষে ব্যাপকতায় সারা পৃথিবীর কবিসাহিত্যিকগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক।

রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের উন্মেষকাল থেকে আরন্ত করে সমাপ্তিকাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথরেখায় যে কাব্যসাহিত্য বিকশিত হয়ে উঠেছে তার মধ্যে স্পষ্টত কয়টি পর্ববিভাগ নির্দেশ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ (১৮৮২) কাব্য থেকে রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনার প্রকৃষ্ট নিদর্শন ফুটে উঠেছিল। অবশ্য এই কাব্যের পূর্ববর্তী সময়ের কিছু কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলোকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসেবে বিবেচনা করেননি। প্রাচীনতম রবীন্দ্র-পদ্য রচিত হয়েছিল সাত-আট বছর বয়সে। তা ‘করুণাময়ী বিলুপ্তি দেবী’ গ্রাস করেছিল। বার বছর পূর্ণ হওয়ার মুখে লেখা ‘পৃথিরাজ পরাজয়’ কাব্যটিরও একই অবস্থা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের স্বনামাঙ্কিত প্রথম মুদ্রিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ ১৮৭৫ সালে হিন্দু মেলায় পঠিত এবং ২৫  ফেব্রুয়ারি তারিখের দ্বিভাষিক ‘অমৃতবাজার পত্রিকায়’ প্রকাশিত হয়। কবির লেখা প্রথম মুদ্রিত কাহিনিকাব্য ‘বনফুল’। তারপর ক্রমান্বয়ে হয় গীতিকাব্য সংকলন ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’, গাথাকাব্য ‘ভগ্নহৃদয়’, ‘বালীকি প্রতিভা’ ও ‘কালমৃগয়া’ এবং নাটক ‘রুদ্রচণ্ড’ । এসবই কবির পরিণত রচনা এবং কুড়ি-একুশ বছরের বয়ঃসীমায় রচিত। ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ থেকে রবীন্দ্র কাব্যসাধনার প্রথম পর্বের সূত্রপাত এবং ‘প্রভাতসঙ্গীত’, ‘ছবি ও গান’, ‘কড়ি ও কোমল’—এই কয়টি কাব্যের মাধ্যমে তা বিকাশ লাভ করে। প্রাথমিক কাব্যসাধনার অনিশ্চয়তা, অস্পষ্টতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য এই পর্বের কাব্যের মধ্যে প্রকাশমান। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন—‘‘সন্ধ্যাসংগীতেই আমার কাব্যের প্রথম পরিচয়। সে উৎকৃষ্ট নয়, কিন্তু আমারই বটে।’’ এ সময়টাই অপরিণতির অঙ্কুর অবস্থা থেকে কবির প্রতিভা শতদলের প্রথম উন্মেষকাল। ‘সন্ধ্যাসঙ্গীতে’ ‘গোধূলির বিষাদ’, ‘প্রভাতসঙ্গীতে’ নব-জাগরণের আনন্দকাকলি, ‘ছবি ও গানে’ গভীর অনুভূতির সঙ্গে রং ও সুরের খেলা এবং ‘কড়ি ও কোমলে’ প্রধানত রূপবিহ্বলতার মধ্যে দিয়ে সূক্ষ্মতর অনুভূতির উন্মেষ কবিমানসের অগ্রগতির স্তরগুলো সূচিত করে। ‘প্রভাত সঙ্গীতের’ ‘নির্রের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটিতে কবি প্রতিভার প্রথম নিদ্রাভঙ্গ—

আজি এ প্রভাতে রবির কর

কেমনে পশিল প্রাণের ’পর,

কেমনে পশিল গুহার আধারে প্রভাত পাখির গান!

না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ

জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,

ওরে উথলি উঠেছে বারি,

ওরে প্রাণের বেদনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।

‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যে জগৎ ও জীবনের প্রতি কবি নিবিড় আকর্ষণের পরিচয় দিলেন—

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,

মানবের মাঝে আমি বাচিবারে চাই

‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিজীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূত্রপাত। সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, কল্পনা, ক্ষণিকা প্রভৃতি কাব্য অবলম্বনে এই পর্বের বিকাশ। রবীন্দ্রমানসের নিঃসন্দিগ্ধ স্বরূপবিকাশই এই পর্যায়ের বিশেষত্ব। কবির মনের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে এই পর্যায়ে কবিহৃদয়ের রোমান্টিক কল্পনা ও বিশিষ্ট জীবনদর্শন, বিশ্বসত্তার সঙ্গে মিলনাকুতি, জীবনদেবতার লীলাচেতন, প্রেমভাবনার অতীন্দ্রিয়তার উন্নয়ন প্রভৃতি বহু বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটেছে। এই পর্বে কবিমনের বিভ্রান্তি বিদূরিত হয়েছে; কবি জগৎ ও জীবনের প্রতি আত্মিক আকর্ষণ উপলব্ধি করেছেন। ‘মানসী’ প্রেমের কাব্য। রবীন্দ্রনাথের দেহাতীত প্রেমের স্বরূপ উপলব্ধি করা যায় ‘মানসী’ কাব্যের ‘নিষ্ফল কামনা’ কবিতায়—

ক্ষুধা মিটাইবার খাদ্য নহে যে মানব,

কেহ নহে তোমার আমার।

অতি সযতনে

অতি সংগোপনে,

সুখে দুঃখে নিশীথে, দিবসে

বিপদে সম্পদে

জীবনে মরণে

শত ঋতু-আবর্তনে

শতদল উঠিতেছে ফুটি

মানসী কাব্য থেকেই ছন্দের ক্ষেত্রে রবীন্দ্র প্রতিভার বৈচিত্র্য প্রকাশ পেয়েছে। কবি লিখেছেন— ‘‘মানসীতেই ছন্দের নানা খেয়াল দেখা দিতে আরন্তু করেছে।’’ এ পর্যায়ে কবি যুক্তাক্ষরকে পূর্ণ মূল্য তথা দুই মাত্রার ধরে ছন্দকে নতুন শক্তি দান করলেন। ড. ক্ষুদিরাম দাস এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন— “খাঁটি বাংলায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দের অনায়াস স্ফূরণের যে প্রাথমিক চপলতা তা ‘মানসী’র কতকগুলো কবিতায় প্রাপ্তব্য।’’

‘সোনার তরী’র কবিতায় অসীম অভিসারী মগ্নচেতন কবিমনের উন্মোচন-আকাঙ্ক্ষাই রসরূপ লাভ করেছে। ‘সোনার তরী’ই কবির প্রথম কাব্য যেখানে একটিমাত্র সামগ্রিক কবিমনোঋতু সংহত অখণ্ড ধারায় অভিব্যক্তি লাভ করেছে। ‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় জগতের সৌন্দর্যপিপাসু কবিমানসের পরিচয় প্রকাশ করে কবি জানিয়েছেন—

ইচ্ছা করে, বার বার মিটাইতে সাধ

পান করি বিশ্বের সকল পাত্র হতে

আনন্দমদিরা ধারা নব নব প্রোতে।

আর মর্ত্যপ্রীতির বৈশিষ্ট্য ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ কবিতায়—

স্বর্গে তব বহুক অমৃত

মর্ত্যে থাক্‌ সুখে-দুখে-অন্ত

প্রেমধারা অশ্রুজলে চিরশ্যাম করি

ভূতলের স্বর্গ খণ্ডগুলি।

চিত্রায় জীবনদেবতার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথ কবিহদয়ের বিচিত্র পরিচয় দান করেছেন। ‘কল্পনা’ কাব্যে কবি অতীতের সৌন্দর্যপ্রীতি ও মানসিক দ্বন্দের পরিচয় এবং ‘ক্ষণিকা’য় শেষবারের মত জীবনের তুচ্ছ দিকের প্রতি আকর্ষণ দেখিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনার পরবর্তী পর্যায় অধ্যাত্মিক ভাবনাযুক্ত। কবির জীবনদেবতার কল্পনা এই পূর্ব প্রকাশমান। তাছাড়া, জগৎ ও জীবনের মাধ্যমে ভগবৎ উপলব্ধির বৈশিষ্ট্যও এই পর্বের কাব্যে ফুটে উঠেছে। কবি ভগবানকে কোন সম্প্রদায় নির্দিষ্ট পূজানুষ্ঠান বা ধূপধ্যানের মাধ্যমে অনুভব করেননি, বরং উপলব্ধি করেছেন প্রকৃতির পরিবর্তনশীল রূপের মধ্যে তার চকিত প্রকাশে, এক ক্রীড়াশীল অদৃশ্য সত্তার মুহূর্মুহূ আবির্ভাব-অন্তর্ধানলীলার লুকোচুরিতে, কখনও কখনও একান্ত বিহ্বল আত্মনিবেদনের মাধ্যমে৷ ভগবদভক্তি, প্রকৃতিপ্রীতি প্রভৃতি বিচিত্র বৈশিষ্ট্য এই সমস্ত কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে। তার মুক্তি সংসার পরিত্যাগ করে নয় বলে ‘নৈবেদ্য’ কাব্যের ‘মুক্তি’ কবিতায় কবি বলেছেন—‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।’ নৈবেদ্য কাব্যের কবিতার মধ্যে অধ্যাত্-জীবনের জন্য কবির প্রবল আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল। তিনি ভগবৎ উলব্ধির জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। কবিকে সত্যে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ দুঃখে-দৈন্যে অবিচলিত, ন্যায়ে কর্তব্যে কঠোর করার জন্য কবিস্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিজেকে নিবেদন করেছেন। ‘খেয়া’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথের মিস্টিক কবিতার শুরু। বিচিত্র রস-প্লাবনের মধ্য দিয়ে অসীমের লীলা চঞ্চল অনুভূতির প্রকাশ মিস্টিক কবিতার এই লক্ষণ খেয়া কাব্যে রূপ লাভ করেছে। গীতাঞ্জলি কাব্য রচনা করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভগবৎ প্রেমের স্বরূপ প্রকাশ করেছেন। গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের জন্য কবি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরঙ্কার লাভ করার গৌরব অর্জন করেন। গীতাঞ্জলি কাব্যে কবি দেখিয়েছেন যে, বিধাতা বিচিত্র রূপে প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করছেন। কবি তার আনন্দময় লীলার স্পর্শ লাভ করেন। কখনও ‘দুঃখের বেশে’, কখনও শরৎ প্রভাতে ‘নয়ন-ভুলানো রূপে’, ‘ঝড়ের রাতে পরাণসখা বন্ধু’ রূপে, কখনও ‘সাপ খেলানো বাশি’ হাতে বিদেশী রূপে—কত না বিচিত্র ভাবে কবি জীবনে তার প্রকাশ ঘটেছে।

‘বলাকা’, ‘পূরবী’, ‘মহুয়া’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে কবির কাব্যজীবনের চতুর্থ পর্ব বিকাশ পেয়েছে। কবির নতুন জীবনদর্শনের পরিচায়ক এই কাব্যগ্রন্থগুলোর মাধ্যমে জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের উচ্ছলতা অতিবাহিত হয়ে পরিণত বয়সের স্থৈর্য ফুটে উঠেছে। ‘বলাকা’ কাব্যে কবি প্রথম মহাযুদ্ধের ভাবালোড়ন, এর জীবন সমীক্ষার নতুন প্রেরণা, এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশে মানবমনের দুরূহতর প্রয়াস ও আদর্শনিষ্ঠার কথা গভীরভাবে অনুভব করেছেন এবং তার ছন্দরীতির পরিবর্তনে এই ভাবান্তর প্রতিবিম্বিত হয়েছে। এ কাব্যে কবি গতিবাদের কথা ব্যক্ত করেছেন। কবি উপলব্ধি করেছেন, তার মধ্যে দিয়ে নিরন্তর পরিবর্তনের স্রোত বয়ে চলেছে। এই গতিই সৃষ্টির মর্মবাণী। ‘বলাকা’ কবিতায় হংসবলাকার পাখার চাঞ্চল্যে সে বাণী রূপান্তরিত হয়েছে—

মনে হল, এ পাখার বাণী

দিল আনি

শুধু পলকের তরে

পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে

বেগের আবেগ

পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;

তরুশ্রেণী চাহে পাখা মেলি

মাটির বন্ধন ফেলি

ওই শব্দরেখা ধরে চকিত হইতে দিশেহারা,

আকাশের খুঁজিতে কিনারা।

‘মহুয়া’ কাব্যটি রচিত হয়েছিল বিয়ে উপলক্ষে উপহার দেওয়ার বিশেষ উদ্দেশ্যে ৷ কিন্তু এতে সে উদ্দেশ্য ছাড়িয়ে কবির প্রেমানুভূতির স্বরূপ ব্যক্ত হয়েছে। মহুয়ার প্রেম দেহমনের উর্ধ্বস্তরের এবং মানব জীবনে তার মাহাত্ম্য সম্পর্কে ইঙ্গিতময় হয়ে উঠেছে। তবে কোথাও কোথাও রক্তমাংসের নরনারীর হৃদয়ের উত্তাপও অনুভব করা যায়।

পঞ্চম পর্ব কবির গদ্যছন্দে রচিত কাব্যগুলোর সমন্বয়ে গঠিত। কবি এই পর্যায়ে তার চিরাচরিত পন্থা অনুসরণ না করে কাব্যে একটি নতুন পথের অভিযাত্রী হলেন। কাব্যের অন্ত্যমিলের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য উপেক্ষা করে গদ্যছন্দে কবি কাব্য রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ‘লিপিকা’ গদ্যগ্রন্থে এই জাতীয় নতুন ছন্দের পরীক্ষাকার্য চালিয়েছিলেন এবং পরবর্তী কাব্য ‘পুনশ্চ’, ‘শেষ সপ্তক’, ‘পত্রপুট’ ও ‘শ্যামলী’—এই চারটি গ্রন্থে এই ছন্দে রচিত কবিতা বিধৃত। বাংলা ছন্দের মুক্তি সাধনার্থে রবীন্দ্রনাথ যে সব ছন্দের সৃষ্টি করেছিলেন তার মধ্যে এই শ্রেণির গদ্যছন্দ গুরুতৃপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এই পর্বের কবিতাগুচ্ছের মধ্যে কোন দার্শনিক তত্ত্ব, জীবনবীক্ষণের কোন বিশেষ রকমের মৌলিকতা কাব্যসৌন্দর্যের মুখাপেক্ষী না হয়েই নিজ ভাবগরিমা বলে পাঠকহদয় স্পর্শ করে। এগুলোর মধ্যে কাব্যকলার বিশেষ পরিচয় না থাকলেও এদের বিষয়গৌরব ও কল্পনার মোহনীয়তা সে অভাব পূরণ করেছে। গদ্যছন্দে রচিত কাব্যগুলোতে ভাষা ও ছন্দের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন এসেছে। এতদিন কাব্য প্রাত্যহিক সংসারের অপরিমার্জিত বাস্তবতা থেকে যতখানি দূরে ছিল এখন তা আর রইল না। ‘পুনশ্চ’ কাব্যের কবিতায় এর সমর্থন মেলে—

কোপাই আজ কবির ছন্দকে আপন সাথি করে নিলে,

সেই ছন্দের আপোস হয়ে গেল ভাষার স্থলে জলে।৷

যেখানে ভাষার গান আর যেখানে ভাষার গৃহস্থালি ।

তার ভাঙা তালে হেঁটে চলে যাবে ধনুক হাতে সাঁওতাল ছেলে;

পার হয়ে যাবে গোরুর গাড়ি

আটি আটি খড় বোঝাই করে;

হাটে যাবে কুমোর

বাঁকে করে হাড়ি নিয়ে;

পিছন পিছন যাবে গায়ের কুকুরটা ;

আর, মাসিক তিন টাকা মাইনের গুরু

ছেঁড়া ছাতি মাথায়।

কবির পরবর্তী কাব্যগুলো শেষ পর্বের নিদর্শন। ‘প্রান্তিক’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘সেঁজুতি’, ‘নবজাতক’, ‘সানাই’, ‘রোগশয্যায়’, ‘আরোগ্য’, ‘জন্মদিনে’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ এই শ্রেণিভুক্ত। এদের কতকগুলোর মধ্যে শৈথিল্যপূর্ণ কবিকল্পনা সহজ সরল ছন্দ সহকারে প্রকাশ পেয়েছে। এইসব কাব্যে মরণের উপকূলে দাঁড়িয়েও কবি নতুন চিন্তা ও অনুভূতিকে আত্মসাৎ এবং তা রূপায়িত করেছেন। শেষ পর্বের কাব্যে কবি পূর্ববর্তী কাব্যসমূহের ধাবধারাকে অভিনবত্ব দান করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে আবু সাঈয়িদ আইয়ুব বলেছেন—‘‘পূবোর্ক্ত ভাবগুলোকে মাত্রায় ও গুণে, অনুর্তব ও অভিব্যঞ্জনায় রবীন্দ্রনাথ তার শেষ পর্বের কাব্যে এমন এক স্তরে তুলে দিয়েছেন যাকে নতুন বলে অভ্যর্থনা করতেই হয়।’’

‘শেষ লেখা’ রবীন্দ্রনাথের শেষ রচনা। কাব্যটি কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছিল। জীবন-মৃত্যুর স্বরূপ সম্বন্ধে কবির অনুভূতি এ কাব্যে চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল। জীবনের সত্য দ্রষ্টা ঋষির মত কবি এখানে হ্রস্ব, কঠিন ও তেজোগর্ভ বক্তব্য প্রকাশ করেছেন।

উপরোক্ত পর্ববিভাগ প্রধানভাবে উল্লেখযোগ্য হলেও রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক কাব্যসাধনার মধ্যে পর্ববহির্ভূত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থও রয়েছে। ব্যাপক প্রতিভার বহুমুখী বিকাশের জন্য রবীন্দ্রকাব্যে বিচিত্র বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে যা সাধারণ শ্রেণিনির্ণয়ের ব্যাপারে বিবেচ্য হতে পারে না; পৃথকভাবেই এদের বৈশিষ্ট্য প্রকাশমান। প্রসঙ্গক্রমে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য—“বিষয়ের নানামুখীনতায়, রচনার বিষয়োপযোগী পরিবর্তনে, কাব্যের আঙ্গিকের বিচিত্র রূপে, কল্পনা ও মনোভঙ্গির নব নব প্রকাশে, মননসূত্রের দৃঢ়তায়, ভাব ও রূপের নিবিড় একাত্মতায় রবীন্দ্রকাব্য বিপুল বিরাট বিস্ময়কর ও বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়। গীতিকবিতা, গান, আখ্যানকাব্য, জীবনব্যাখ্যান ও অধ্যাত্ম অনুভূতিমূলক কাব্য, নাট্যরসপ্রধান কাব্য, লঘু কল্পনা ও হাস্যরসিকতা আশ্রয়ী কাব্য ইত্যাদি কবিতার প্রায় সব রকম প্রকরণেই তিনি সমান কুশলী৷

রবীন্দ্রকাব্যে জগৎ ও জীবনের কথাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কবিজীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই আদর্শই প্রতিফলিত হয়েছে। রবীন্দ্রকাব্যের এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে আবু সয়ীদ আইয়ুব লিখেছেন—‘‘শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথের শারীরিক ও মানসিক ক্লেশ যেমন অত্যধিক ছিল, জাগতিক দুঃখ ও পাপের মাত্রাও তেমনি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তার পক্ষে। তখন যদিও তার মন বহু নিরুত্তর প্রশ্নে বিক্ষুব্ধ ও হতাশায় ভারাক্রান্ত ছিল তবু তিনি তার সহজাত মানসিক স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিত্বের ভারসাম্য হারাননি। নটরাজের ধ্যান তাকে একপ্রকার বৈরাগ্যমাখা স্থিত প্রজ্ঞ প্রশান্তি দিয়েছিল; অন্যদিকে মানুষের অপরাজেয় শক্তি ও অনন্ত সম্ভাবনায় বিশ্বাস তাকে তিক্ত নৈরাশ্যের কবল থেকে রক্ষা করেছিল মৃত্যুদিন অবধি। ‘নির্বাচিত নক্ষত্রের নেপথ্যপাঙ্গণে’ যেমন তিনি দেখতে পেয়েছিলেন ‘নটরাজ নিস্তব্ধ একাকী’, তেমনি দুই মহাযুদ্ধে নির্বাপিত-পরায় মনুষ্যত্বের ভগ্নস্তূপে দেখতে পেয়েছিলেন চিরমানসে।’’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের সুদীর্ঘ সময় কাব্য রচনা করেছেন। তার সৃষ্টিসন্তার ছিল বৈচিত্র্যে ও উৎকর্ষে অনন্য। নানা রূপে নানা রসে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন। সৃষ্টির নিরন্তর প্রবহমান গতিবেগে কবি নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। জীবন ও জগতের বিচিত্র রূপ তাঁর কাব্যের উপজীব্য হয়েছে। তাঁর কবিপ্রতিভার বিকাশ ছিল বহুমুখী এবং সৃষ্টিতে ছিল বৈচিত্র্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!