//
//

ইংরেজি সাহিত্যে কবি সুইনবার্নের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

সুইনবার্ন (১৮৩৭-১৯০৯)

ইংরেজি সাহিত্যে ভিক্টোরীয় যুগের প্রতিনিধিস্থানীয় লেখক ছিলেন সুইনবার্ন (১৮৩৭-১৯০৯)। তিনি ছিলেন প্রি-র‍্যাফেলাইট গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ও রোমান্টিক গোষ্ঠীর শেষ উত্তরাধিকারী। তিনি স্বভাবে ছিলেন বায়রণের মত বিদ্রোহী। তবে এই বিদ্রোহী সত্তার মধ্যে রয়েছে ক্লাসিক ও রোমান্টিক উভয় চেতনা। তিনি ছিলেন যেমন গ্রীক সাহিত্যের ভক্ত তেমনি ফরাসী সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক। তিনি ভিক্টর হিউগো, গতিয়ে এবং বদলেয়ারের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল যেমন প্রখর, অনুভূতি ছিল যেমন তীব্র, তেমনি তাঁর কল্পনাশক্তি ছিল সুদূরপ্রসারী। তিনি ছিলেন একাধারে কবি ও নাট্যকার।

কবি হিসেবে সুইনবার্ণ ছিলেন মৌলিক প্রতিভার অধিকারী। তাঁর কবিতা ও ব্যালাড প্রথম পর্ব (১৮৬৬)তে সেই মৌলিক কল্পনার পরিচয় রয়েছে। তাঁর কবিপ্রকৃতিতে একই অতিসূক্ষ্ম সংবেদনশীলতার সঙ্গে মিশ্রিত ছিল পূর্ব-ঐতিহ্যানুগত ভাবসংস্কার। তাঁর ‘Hymn to Prospering’ কবিতায় কামনার অসংযত উচ্ছ্বাস ও নৈরাশ্যবাদের সুর প্রবল। যেমন— And all The wings of the Loves, and all the joy before death; all the feet of the hours and sound as a single lyre, Dropped and deep in the flowers, with strings that flicker like fire.

তাঁর কাব্যের সূক্ষ্মতার ব্যঞ্জনার অতিপ্রাচুর্যের জন্য তাঁর কবিতা পরবর্তীযুগের সিম্বলিক ও ইমপ্রেশনিষ্টিক কবিতার পথিকৃৎ। কবির স্বাধীনতাপ্রীতি ছিল যথেষ্ট। সেজন্য ইতালির মুক্তি কামনা তাঁর কাব্যে রূপ পেয়েছে। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘সঙ্গস্ বিফোর সানরাইজ’ (Songs before Sunrise) কাব্যে ইতালির মুক্তিবাসনা রূপায়িত হয়েছে। আবার আর্থারীয় কাহিনীর বর্ণোজ্জ্বল শিল্পরূপ পাই ‘Tristram of Lionesses’ (১৮৮২) কাব্যে।

তাঁর কবিতার আপাত অর্থহীনতার কথা স্বীকার করে নিলেও তার নিসর্গ কবিতার একটা নিগূঢ়তর বোধ, সুগভীর অনুভূতি, জীবনের বিচিত্র ইঙ্গিতময়তা পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে। কবি সমুদ্রের মধ্যে উপলব্ধি করেছেন আনন্দস্রোত, ঝড়ের মধ্যে দেখেছেন দুর্দমনীয় প্রবাহ, প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন রুক্ষ্মতা—যা ইংলণ্ডের অতীত ইতিহাসকেই স্মরণ করায়। তাছাড়া সুইনবার্নের মধ্যে ছিল গীতিকবি সুলভ সুরতন্ময়তা ও কলাসংযম— যা তাকে ভিক্টোরিয় যুগের ইংরেজী সাহিত্যে অন্যতম গীতিকবিরূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।

আলোকার্থীকে আলোক পেতে গেলে যেমন প্রদীপের সলতে নির্মাণ করতে হয় তেমনি কবিকেও কাব্যের দেহরূপ নির্মাণ করতে হয় উপযুক্ত শব্দের দ্বারা—যার মাধ্যমে পাঠকচিত্তে কাব্যরসের আস্বাদ লাভ ঘটে। সুইনবার্ন তাঁর কাব্যের কথাশরীর নির্মাণ করেছেন সুনিপুণ শব্দচয়নের মাধ্যমে। শুধু শব্দচয়ন নয় ভাব ও ভাষার হরপার্বতী। মিলন ঘটেছে তার কাব্যে। ফলে তাঁর কাব্যপাঠে পাঠকের মন সুরের পাখায় ভর করে সৌন্দর্যাভিসারী হয়। সেইসঙ্গে শব্দের ধ্বনিস্পন্দন যেমন ছন্দোরীতিকে দিয়েছে অসামান্যতা তেমনি তা পাঠককে নিয়ে যায় অনির্বচনীয় আনন্দনিকেতনে। যেখানে ভাব ও ভাষা বনলতা সেনের মতো মুখোমুখি বসার সুযোগ পেয়ে যায়। তবে একথাও ঠিক যে সুইনবার্নের কবিতা যেমন দৃষ্টিনন্দন, শ্রুতিসুখকর তেমন করে তা পাঠকচিত্তকে আন্দোলিত করে না। আঙ্গিকের চমৎকারিত্ব সরিয়ে নিলে সুইনবার্নের কবিতার মধ্যে শাশ্বত উপাদান অনেকক্ষেত্রেই খুঁজে পাওয়া যায় না। সত্যেন্দ্রনাথ যেমন ছন্দের বন্ধনে কাব্যের গভীর ভাবদ্যোতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছেন, সুইনবার্নও, তাই করেছেন।

সুইনবার্ন মূলত কবি হলেও তিনি কয়েকটি গীতিপ্রধান নাটক লিখেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযযোগ্য হল— ‘আটলান্টা ইন ক্যালিডন’ (Atlanta in Calydon)। এটি ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। নাটকটি গ্রীক নাট্যরীতিতে রচিত। সুইনবার্ন যে উন্নত উদ্দাম কল্পনাশক্তির অধিকারী ছিলেন তার পরিচয় মেলে এই নাটকে। এই নাটকে প্রাচীন গ্রীসের জীবনযাত্রা ও প্রাণোন্মাদনা নাট্যসংঘাতের মাধ্যমে চিত্রিত হয়েছে।

এই নাটকের কাহিনী বেশ জীবন্ত। ক্যালিডন এর রাণী অ্যালিথিয়ানের দুই ভাই ও এক পুত্র ছিল। দেবী অর্টেমিস রাণীকে ধ্বংসের জন্য এক ভয়াবহ বন্য শূকরকে পাঠান। কিন্তু রাণীর পুত্র মেলিজার (Meleager) শূকরকে হত্যা করে সেটি সুন্দরী তরুণী আটলান্টাকে উপহারস্বরূপ পাঠায়। মেলিজারের দুজন মামার দ্বারা মেলিজার আক্রান্ত হলে, মেলিজার সুকৌশলে তাদের হত্যা করে এবং শোকগ্রস্ত রাণী তার ভাইদের শোকে মেলিজারের জীবনের প্রতীক দগ্ধ করেন। এর পরবর্তী ঘটনা হল মেলিজার ও রাণীর উভয়ের মৃত্যুবরণ।

এই নাটকে ট্রাজেডির গভীরতা লক্ষণীয়। পুত্রের বেদনায়, মাতার কান্নায় ট্রাজিক সংবেদন জাগ্রত হয়— “My life’s shall not unfasten till I die’’।

তাছাড়া গ্রীক নাটকের ত্রি ঐক্যবিধি (Unity of Time, Unity of Place, Unity of Action), কোরাস, দীর্ঘবিলম্বিত ভাষণযুক্ত সংলাপ, নাটকের মধ্যে কাব্যময়তার সংমিশ্রণ, গীতিকবিসুলভ সুরতন্ময়তা প্রভৃতি এই নাটকে লক্ষ করা যায়।

সুইনবার্নের প্রতিভা ছিল মূলত আবেগপ্রধান গীতিকবির। গীতিকবিতার ভাবোচ্ছ্বাস, উদ্দাম কল্পনা যেমন কবির ছিল, তেমনি ছিল গভীর ছন্দচেতনা। যে ছন্দচেতনার জন্য তিনি ইংরাজি সাহিত্যে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সুইনবার্নের আশ্চর্য ধ্বনি-বর্ণসুষমা ও সুন্দর ভাবনা কবি রবীন্দ্রনাথকে অনুপ্রেরণা দান করেছিল। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় বৈষ্ণব সাহিত্য, বাউল সঙ্গীত ও সংস্কৃত সাহিত্যের শব্দ চয়ন করেছেন। আবার সুইনবানের ভেনাস কল্পনার মত। রবীন্দ্রনাথের উর্বশী ভাবনার সাদৃশ্য রয়েছে । এমনকি ‘সোনার তরী’ কাব্যে রূপকথা জাতীয় কবিতাগুলির ক্ষেত্রে সুইনবার্নের প্রভাব রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সুইনবার্নের একটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যে। সুইনবার্নের অ্যাফ্রোদিতির সঙ্গে উর্বশীর সাদৃশ্য লক্ষণীয়। সুইনবার্নের ছন্দচেতনা সত্যেন্দ্রনাথের ছন্দচেতনাকেও প্রভাবিত করেছিল।

তথ্যসূত্র:

ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসDownload
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়Download
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দারDownload
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকারDownload
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্যDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!