ইংরেজি সাহিত্যে কবি স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের কৃতিত্ব লেখ।
স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ (১৭৭২-১৮৩৪)
ওয়ার্ডসওয়ার্থের সহযোগিতায় ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস্’ প্রকাশ করে ওয়ার্ডসওয়ার্থের সঙ্গে কোলরিজও (১৭৭২-১৮৩৪) কবিখ্যাতি লাভ করেন। বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদনের মতো রোমান্টিক যুগের ‘লেক পোয়েট’দের অন্যতম কোলরিজের কাব্য রচনাকাল সীমিত হলেও তা ফলে-ফুলে সমৃদ্ধ। তাঁর এই স্বল্পস্থায়ী (১৭৯৭-১৮০৩) সাহিত্য রচনাকালকে কেউ কেউ নিদাঘ রাত্রির সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর কারণ হয়ও তার শাস্ত্রহীনতা, অহিফেন আসক্তি, পারিবারিক অশান্তি এবং প্রকৃতিগত নিস্পৃহতা। কিন্তু অল্পসময়ে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তা যে কোন মহৎ কবির কাছে গর্বের বিষয় হতে পারে।
ব্যক্তিগত জীবনে দারিদ্র্য ও যন্ত্রণার মধ্যে জীবন কাটিয়েও কোলরিজ যে সৃষ্টির নতুন পথ খুলে দিয়েছিলেন, তাতে মনে হয় তিনিও নজরুলের মতো বলতে পারতেন— ‘হে দরিদ্র, তুমি মোরে করেছ মহান!’ কারণ তিনি জন্মেছিলেন প্যারিস চার্চের ভিকার ও গ্রামের স্কুল শিক্ষক জন কোলরিজের ত্রয়োদশ ও সর্বকনিষ্ঠ সন্তান রূপে। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী। স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানেও পাঠ্যাবস্থায় ঋণের জ্বালায় পালিয়ে গেলেন, ড্রাগনদের দলে যোগ দিলেন। তারপর আবার ফিরে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই সময় কবি ‘সাদে’র সঙ্গে আলাপ হওয়ায়, দুজনে ফরাসী বিপ্লবের সমর্থক হওয়ায়, বিপ্লবের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। সেজন্য সাদে ও কোলরিজ মিলে কবিতা লিখলেন ‘The Fall of Robespierre’ —যা বিপ্লবের বাণী সমৃদ্ধ।
প্রথম জীবনে কোলরিজ কয়েকটি গীতিকবিতা রচনা করেছিলেন। সেগুলি হল ‘This Lime-tree Bower my prison’, ‘Frost at Midnight’, ‘Fears in Solicitude’ ইত্যাদি কবিতাগুলিতে ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রকৃতিপ্রীতির প্রভাব রয়েছে। তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন এবং নাগরিক জীবনের প্রতি ছিলেন বীতশ্রদ্ধ।
কবি ব্লেকের (Blake) স্বপ্নময় পরিবেশ রচনার সাদৃশ্য রয়েছে তার প্রথম দিককার কবিতায়। ‘A day dream’, ‘The Devil’s Thoughts’, ‘The Suicide’s Argument’, ‘The Wandering of cain’ প্রভৃতি কবিতায় প্রকৃতিপ্রীতি, স্বপ্নময় রঙিন পরিবেশ সৃষ্টি ও মানব মমতায় সমৃদ্ধ। কবিতার ভাষায়ও রয়েছে কথ্যভাষার সুনিপুণ বিন্যাস।
বিভিন্ন সময়ে রচিত তার গীতিকবিতাগুলি হল— ‘Ode on the Departing year’, ‘France, an ode’, ‘The pains of sleep’, ‘Love’, ‘Dejection’, ‘Lines written in the Hearts Forest’ প্রভৃতি। ‘লাভ’ কবিতায় কোলরিজের প্রেমবঞ্চিত জীবনের করুণ আবেগোচ্ছ্বাস বর্ণিত হয়েছে। ‘The pains of sleep’ দুঃস্বপ্নপীড়িত তিনরাত্রির অনুভূতি দিয়ে রচিত গীতিকবিতা। তিনি এই কবিতায় পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরকের ধারণার প্রেক্ষিতে নরক-যন্ত্রণা ভোগের কারণ উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। ‘Ode on the Departing year’ কবিতায় ফরাসী বিপ্লবের উন্মাদনা ও স্বাধীনতার আর্তি প্রকাশিত। ‘France, an ode’ কবিতায় সাম্রাজ্যবাদী নেপোলিয়নের অভিযানকে ধিক্কার জানিয়েছেন। ‘Dejection: an ode’ কবিতায় জীবনের হতাশা ও যন্ত্রণার স্বরূপ ব্যক্ত হয়েছে।
তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনা হল— ‘দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার’, (‘The Ancient Mariner’), ‘কুবলা খান’ (‘Kubla Khan’), ‘ক্রিস্টাবেল’, (‘Cristable’), ‘বায়োগ্রাফিয়া লিটারারিয়া’ (‘Biographia Literaria’) প্রভৃতি।
‘দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার’ (‘The Ancient Mariner’) অতিপ্রাকৃত পরিবেশে রচিত এক উল্লেখযোগ্য কবিতা। কবিতাটি ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস’-এর অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটির বিষয় একজন প্রাচীন নাবিকের জীবন। এই নাবিক-ই এই গল্পের কথক। নাবিক এক বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে একজন অতিথিকে এই কাহিনি শুনিয়েছে। কাহিনিটি হল, এক নাবিক দুশো জন সহনাবিক নিয়ে সমুদ্র যাত্রা করেছিল, কিন্তু ঝড়ের প্রকোপে জাহাজ গিয়ে পৌঁছালে দক্ষিণ মেরুতে। সেইস্থানে এল অ্যালবাট্রস পাখি। পাখি আসার পর জাহাজ চললেও আর এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটল। কারণ লোভের বশবর্তী হয়ে প্রাচীন নাবিক একদিন পাখিটিকে মেরে ফেলল। পাখিটি যেহেতু প্রকৃতির দূত, তাই নাবিক একে হত্যা করে প্রকৃতির কাছে দস্যু হয়ে গেল। তাই প্রকৃতির অভিশাপ নেমে এল নাবিকের উপর। প্রকৃতির সেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া অতিপ্রাকৃত আবহ সৃষ্টি করে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। শেষপর্যন্ত নাবিক দলের মৃত্যু হল, একমাত্র বেঁচে রইল প্রাচীন নাবিক। জাহাজ বন্দরের কাছে এসে ডুবে গেল। একাকী প্রাচীন নাবিক উঠে এল তীরে। এখানেই কাহিনির সমাপ্তি।
অতিপ্রাকৃত পরিবেশ রচনায়, রোমান্টিক কল্পসৌন্দর্য সৃষ্টিতে, ঘটনা বিন্যাসে, আঙ্গিকের অভিনবত্বে, চিত্রকল্প রচনায় অতিপ্রাকৃত পরিবেশে যাদুকরী প্রভাবের বর্ণনায় এই কবিতা অসাধারণ শিল্পরূপ। এর চিত্ররূপ ও গীতিরূপের সমন্বয় চমকপ্রদ। যেমন—
Within the shadows of the ship
I watched the water snakes;
They moved in tracks of shinning white
And when they reared, the elfish light
Fell off in hoary flakes.
পরিবেশ রচনায়ও কবির কৃতিত্ব অতুলনীয়। যেমন, অনন্ত প্রসারিত লবণ সমুদ্রের মধ্যে অপ্রশমিত তৃষ্ণার যন্ত্রণা, চারদিকে জল থাকা সত্ত্বেও তৃষ্ণা মেটানোর এক ফোঁটা জল নেই, তার বর্ণনা—
Water water everywhere
And all the boards did shrink;
Water water everywhere
Not any drop to drink.
কোলরিজের এই কবিতা আমাদের এক বিশেষ উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায়। যেমন, নিঃসঙ্গতার মধ্যে মানুষ ও জলজন্তুর সৌন্দর্যের অভিনব উপলব্ধি, প্রেতানুভূতির শিহরণ, মোহজাল ছিন্ন হওয়ার পর পরিচিত দৃশ্যের অপরূপ আকর্ষণ প্রভৃতি। এই কবিতা বাস্তবধর্মী কবিতা। কারণ তিনি যে অতিপ্রাকৃত পরিবেশ রচনা করেছেন, তা বাস্তব পরিবেশে। এজন্য তা পাঠকের কাছে এত আকর্ষণীয়।
‘কুবলা খান’ (‘Kubla Khan’) কোলরিজের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। যদিও তা অসম্পূর্ণ রচনা। স্বপ্নলোকের মায়াময় সৌন্দর্য ও নিগূঢ় রূপ এই কবিতায় চিত্রিত হয়েছে। এটি কবির স্বপ্নলব্ধ কবিতা। কবিতাটি বায়রণের অনুরোধে রচিত। ভূমিকায় তিনি কবিতাটিকে বলেছেন— ‘Mere Psychological curiosity than on the ground of any supposed poetic merits.’ কবিতাটির উৎস সম্বন্ধে কবি নিজেই জানিয়েছেন, ১৭৯৭ সালে তিনি যখন ডিভোনশায়ারে অবকাশ যাপন করছিলেন, তখন তিনি ‘Purchas His Pilgrimage’ নামে একটি বই-র ‘কুবলা খান’ অংশ পড়ছিলেন। পড়তে পড়তে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। তারপর যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার কথা এই কবিতায় রয়েছে। তিনি ঘুমের মধ্যে কুবলা খানের রাজকীয় উদ্যান ও প্রাসাদের দু’তিনশ’ পঙক্তি রচনা করে ফেলেছেন। কিন্তু নিদ্রাভঙ্গের পর সেই স্মৃতি অবলম্বনে চুয়ান্নটি পঙক্তি রচনা করার পর এক আগন্তুকের আগমনে পূর্বস্মৃতি বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় তা আর উদ্ধার করতে পারেন নি।
‘ক্রিস্টাবেল’ (‘Cristable’) কবিতাটি মধ্যযুগীয় পটভূমিতে রচিত ও অতিপ্রাকৃত উপাদানে বিন্যস্ত একটি বিশিষ্ট কবিতা, যদিও তা অসম্পূর্ণ। এই কবিতা সম্পর্কে কবি নিজেই বলেছেন— ‘nothing more than a Common fairy tale’. এই কবিতার মূল বিষয় হল ভাল ও মন্দের মধ্যে দ্বন্দ্ব-ক্রিস্টাবেল ও জেরাল্ডাইন যথাক্রমে এই ভাল ও মন্দের প্রতীক। মধ্য যুগের দুর্গে, তার পাশে ঘন অরণ্যে, নির্জন বনে, নিশীথ রাতে প্রবাসী প্রণয়ীর কল্যাণে প্রার্থনাপরায়ণা ও ভক্তিবিশ্বাসে উদ্বেলিত এক তরুণীর চোখের সামনে যে হঠাৎ অলৌকিক জগতের পথ খুলে গিয়েছিল, তা-ই এই কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে।
অতিপ্রাকৃত পরিবেশ সৃষ্টিতে লেখকের কৃতিত্ব প্রশংসনীয়। কবিতার শুরু হয়েছে রহস্যময়তা দিয়ে। বিশে করে মোরগের নিদ্রালণ ডাক, কুকুরের চাপা গর্জন, মন্ত্রোচ্চারণের গূঢ়ার্থ, প্রেতলোকের অফুট গুঞ্জনধ্বনি প্রভৃতি চমৎকার প্রকাশিত হয়েছে। ভাষামাধুর্য ও ধ্বনিময়তা রাত্রির অতিপ্রাকৃত পরিবেশকে দিয়েছে মোহময়তা—
The thin grey cloud is spread on high
It covers but not hides the sky
The Moon is behind and at the full
And yet she looks both small and dull.
দুর্গে ঢোকার আগে জেরাল্ডাইনের আকস্মিক মূর্চ্ছা ও ক্রিস্টাবেলের সাহায্যে দুর্গদ্বার অতিক্রম, অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে তার শক্তি পরীক্ষা, তার উদভ্রান্ত রহস্যময় ব্যবহার প্রভৃতির মধ্যে প্রাকৃতিক চিত্রের সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে। এর মূলে রয়েছে কবির অসাধারণ কল্পনাশক্তি বা রোমান্টিক কবির প্রাণধর্ম।
কোলরিজের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য
- অতিপ্রাকৃত রসের শিল্পী হিসেবে কোলরিজ ইংরেজি রোমান্টিক কাব্যে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। পরিদৃশ্যমান জগৎ-ই একমাত্র সত্য নয়, তার অন্তরালে আর একটি জগৎ আছে তা উন্মোচন করার জন্য কবি অতিপ্রাকৃতের আশ্রয় নিয়েছেন। এই অতিপ্রাকৃত পরিবেশ সৃষ্টির দ্বারা পাঠককে কবি নিয়ে যেতে চান কোন এক রহস্যলোকে—যেখানে যন্ত্রণা নেই, নেই দারিদ্র। পাঠকও কিছুক্ষণের জন্য কবির সহযাত্রী হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি একান্তভাবেই রোমান্টিক কবির নিজস্ব মানসিকতা।
- পরিবেশ রচনার অসামান্য নৈপুণ্য পাঠককে একটি কল্পস্বর্গের সৌন্দর্যধ্যানে নিমগ্ন করে। প্রকৃতির সাধারণ রূপের মধ্যে বাস্তবের কাঠামোতেও যে অলৌকিক পরিবেশ রচনা করা যায়, এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বরূপ উন্মোচিত করা যায়— কোলরিজের কবিতাগুলি তার অসামান্য নিদর্শন।
- জার্মান রহস্যবাদ ও অতীন্দ্রিয় চেতনাকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে আনয়ন করে এই ধারার সাহিত্যসৃষ্টির পথকে উন্মোচিত করেন।
- কবিতার রসরূপ দানে তিনি মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাই তার কবিতাগুলি ভয় ও বীভৎস রসের কাছাকাছি কোন এক রসের সৃষ্টি করে। পাঠকও সেই অভিনব বসে রসাপ্লুত হয়।
- তাঁর কবিতায় রূপক-প্রতীক-সংকেত-এর পরিচয় যথেষ্ট। যেমন, ‘দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার’-এ প্রাচীন নাবিকের মৃত্যুকালীন যন্ত্রণার ছবি—
Alone, Alone all, all alone,
Alone on a wide wide sca!
And never a Saint took pity on
My soul in agony
- আঙ্গিকের অভিনবত্বে তার কবিতাগুলি অনুপম। ছন্দ ব্যবহারে দক্ষতা, পরিচিতের মধ্যে অপরিচিতকে চিত্রণের ওন্য উপযোগী ‘মুড’ ও ‘টোন’ নির্মাণ, অতিপ্রাকৃতের মধ্যে যাদুকরী রূপ এনে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার পদ্ধতি, গীতিময়তার সঙ্গে চিত্রময়তার সমন্বয় প্রভৃতি তার কবিতার আঙ্গিকের সাফল্যকে সূচিত করে।
- কোলরিজ শুধু কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সমালোচকও। অসাধারণ কল্পনাশক্তি, তীক্ষ্ণ বিচারশক্তি, গভীর পাণ্ডিত্য, সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি—একজন সমালোচকের এ সব গুণ কোলরিজ-এর ছিল। তাই ‘বায়োগ্রাফিয়া লিটারারিয়া’-তে সমালোচনার এক বিশিষ্ট রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। এটি আত্মচরিত জাতীয় রচনা হলেও এতে দর্শন, রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম, সাহিত্য, কাব্যানুভূতি স্পষ্ট রেখায় ধরা পড়েছে। যেমন, তার মতে কবিতা হল সেকেন্ডারি ইমাজিনেসানের বিষয়। কারণ কবিতা পরস্পর বিরোধী উপাদানের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করে। তিনি এই গ্রন্থে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার সমালোচনা করেছেন, যা গুরুত্বপূর্ণ বটে।
- ‘নোটস অ্যান্ড লেকচারস আপন শেক্সপীয়ার অ্যান্ড আদার এসেজ’ গ্রন্থে ও সমালোচনার রূপ সম্বন্ধে তিনি বিভিন্ন আলোচনা করেছেন। শেক্সপীয়ার-এর নাটক সম্বন্ধে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্যকবিতা সম্পর্কে তিনি এই গ্রন্থে আলোচনা করেছেন।
কোলরিজ ও বাংলা সাহিত্য
কোলরিজের অতিপ্রাকৃত জগৎ নির্মাণ বাংলা সাহিত্যে বিশেষ একটা নেই বললেই চলে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশ কয়েকটি ছোটগল্পে অতিপ্রাকৃত পরিবেশ নির্মাণ করেছেন চরিত্রের মনস্তত্ত্বের উদঘাটনের জন্য। কোলরিজ যেখানে অতিপ্রাকৃত পরিবেশ সৃষ্টি করে পাঠককে এক রোমান্টিক সৌন্দর্যস্বর্গে উপনীত করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সেখানে চরিত্রের মনস্তত্ত্বকে উন্মোচন করে বাস্তব রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন। ‘কঙ্কাল’, ‘নিশীথে’, ‘মণিহারা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ প্রভৃতি গল্পে অতিপ্রাকৃত রসের সন্ধান মেলে। ‘নিশীথে’ গল্পে অবচেতন মনের স্বরূপ উদঘাটনে, ‘মণিহারা’ গল্পে ফণিভূষণের মানসিক দ্বন্দ্ব প্রকাশে অতিপ্রাকৃত সহায়ক হয়েছে। যেমন, ফণিভূষণ মণিমালিকার জন্য গঙ্গার ঘাটে অপেক্ষায় থেকে নূপুরের শব্দে বলে উঠেছিল ‘মণি’। সেই বর্ণনা— “তাহার রুদ্ধ আবেগে এক মুহূর্তে প্রবলবেগে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল; সে বিদ্যুদবেগে চৌকি হইতে উঠিয়া কাঁদিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘মণি’।” ‘দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার’ কবিতায়ও নাবিকের মধ্যে এ ধরনের আবেগ থেকে অনুশোচনা ও তারপর তার আত্মজাগরণ চরিত্রটিকে মহনীয়তা দান করেছে। তাই প্রাচীন নাবিক ও ফণিভূষণের সাদৃশ্য লক্ষণীয়।
শরৎচন্দ্রও ‘শ্রীকান্ত’ (১ম পর্ব) উপন্যাসে ইন্দ্রনাথের নৈশ অভিযান প্রসঙ্গে কিম্বা শ্রীকান্তের শ্মশানযাত্রা প্রসঙ্গে অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে কোলরিজ-এর ‘ক্রিস্টাবেল’ কবিতার প্রভাব থাকতে পারে। কেননা, শরৎচন্দ্র প্রকৃতির বর্ণনার মধ্যে অতিপ্রাকৃত পরিবেশ সৃষ্টি করে ভয়াবহতার মধ্যেও মানবমনের স্বরূপকে উন্মোচন করেছেন। শ্রীকান্তের শ্মশানযাত্রা অংশে শ্মশানের ভৌতিক পরিবেশ আসলে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্তকে কাছে আনার পরিবেশ বা পটভূমি রচনায় সাহায্য করেছে। মনে রাখতে হবে, অলৌকিক পরিবেশ যেহেতু দেশভেদে পৃথক হয়, তাই কোলরিজও বাংলা সাহিত্যের লেখকদের ক্ষেত্রেও তা ভিন্নতা পেয়েছে, সাদৃশ্য সত্ত্বেও।
তথ্যসূত্র:
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস | Download |
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দার | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকার | Download |
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্য | Download |
Leave a Reply