বাংলাদেশের কবি হুমায়ুন আজাদের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
হুমায়ুন আজাদ
ষাটের দশকের প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রতিবাদী কবি হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪)। সমগ্র জীবন ধরেই তিনি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে তাঁর শাণিত কলমকে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছেন। তবে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসাবে তিনি কবিতা লেখেন নি, তাঁর কাছে কবিতা সৌন্দর্যসৃষ্টির প্রয়াসমাত্র। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন—‘‘কবিতা কেনো লিখলাম? খ্যাতি, সমাজবদল, এবং এমন আরো বহু মহৎ উদ্দেশ্যে কবিতা আমি লিখি নি ব’লেই মনে হয়; লিখেছি সৌন্দর্যসৃষ্টির জন্যে, আমার ভেতরের চোখ যে-শোভা দেখে, তা আঁকার জন্যে; আমার মন যেভাবে কেঁপে ওঠে, সে কম্পন ধ’রে রাখার জন্যে।’’ চিত্রশিল্পী যেমন রঙ, তুলির সাহচর্যে নিজের কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দান করে তেমনি হুমায়ুন আজাদও সমাজ-রাষ্ট্র–পরিবার আর ব্যক্তিজীবনের সংস্পর্শে নির্মাণ করেছেন কবিতার জগৎ। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— অলৌকিক স্টীমার (১৯৭৩), জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০), সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৭), যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল (১৯৮৭), আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮)। প্রথম কাব্যেই কবি বাল্যকালের তন্ময়তা, প্রেম-প্রকৃতি, সমাজ-রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। কবি প্রকৃতির মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রের অত্যাচারকে বর্ণনা করেছেন। যে চাঁদ কবিদের কাব্যচেতনায় ফুল ফোটায় সেই চাঁদের মধ্যে কবি হিংস্রতা লক্ষ করেছেন। চাঁদকে বাঘিনীর সঙ্গে তুলনা করে কবি বললেন—
বাঘিনীর মতো ওৎ পেতে আছে চাঁদ
ঝাউয়ের মসৃণ ডালে বটের পাতায়
ধ’সে পড়া দালানের ছাদে রাস্তায়
ধাবমান টেলিফোনের তারে
ডাস্টবিনে
জ্বলজ্বলে নর্দমায়। ব্যাগ্র হয়ে ধরা দেয়
ফড়িং, হরিণ, সাপ, মাকড়সা, কাঠবিড়ালি
নিওন পেরিয়ে ওড়ে চন্দ্রগ্রস্ত পোকা। এমন ছোবল দিতে জানে
লক্ষবর্ষ পুরাতন নির্মম বাঘিনী।
ষাটের দশকের সামরিক শাসনের দমবন্ধ পরিস্থিতির একটা আঁচ পাওয়া যায় উপরোক্ত পংক্তিগুলিতে। চাঁদের আলো যেমন গাছপালা ভেদ করে সমগ্র পরিবেশে চারিয়ে যায় তেমনি রাষ্ট্রের শোষণও সেদিন বাঙালির পরিবারের কোণায় কোণায় প্রবেশ করেছিল। ভয়াল মৃত্যুর থাবা প্রতিমুহূর্তে ওৎ পেতে ছিল যে কোনো রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবাদকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার জন্যে। সামরিক শাসনের এক দশকে মানুষ সর্বক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে বাস করেছে। যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাদের প্রিয়জনদের এমন আতঙ্কে তারা নিদ্রাহীন রাত্রিযাপন করেছে। তাদের সেই আতঙ্ককে তুলে ধরেছেন কবি—
আসে রাত্রি জল্লাদের মতো, আমি ভয় পাই
যেমন ভয় পায় দণ্ডিত লোকেরা।
রাত্রি এলেই ঘুমোতে হয় শরীর রাখতে হয় খাটে
চোখ বন্ধ করতে হয়
রাত্রি এলে চিরকাল প্রাসাদ বস্তি সব ঘুমোতে যায়
ঘুমোতে হবে ভাবতেই আমি ভয় পাই
হুমায়ুন আজাদের কবিতার রাজনীতি এসেছে সামাজিক বিবেক থেকে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাওয়ার স্বপ্ন থেকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সেদিনের বাংলার লক্ষ লক্ষ যুবক প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য বহু পিতামাতাকে তাদের সন্তান খোয়াতে হয়েছিল। এমনই এক খোকনের কথা কবি তুলে ধরেছেন কোনো এক পিতার জবানিতে। পিতামাতার প্রথম সন্তান খোকন চোখের সানগ্লাস দিয়েই চারপাশের রঙিন জগৎকে পর্যবেক্ষণ করেছে। দিন দিন বেড়ে উঠেছে বিদ্রোহী বৃক্ষের মতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোতে প্রতিবাদী খোকনও অংশগ্রহণ করেছে। কবির লেখনীতে ধরা পড়েছে খোকনের বিদ্রোহী রূপ—
২৯ মার্চ ১৯৭১, খোকন এলো ঘরে সারা গায়ে বিদ্রোহী বাতাস,
দাউ দাউ জ্বলছে চোখ খোকনের। অগ্নিকুণ্ডে পরিপূর্ণ ঢাকার আকাশ,
বললো, ‘তোমাকে দিলাম এই সানগ্লাস, আমি যাচ্ছি রক্ত আর অগ্নিময়
সেই দিকে সারা বাংলা যেই দিকে আজ। সানগ্লাসে আর নয়
খালি চোখে সুশ্রী আমি দেখবো বাঙলাকে।’ খোকন তো চ’লে গেলো,
খোকন, আমার খোকন।
খোকনের মতো তরুণ তুর্কিরা সেদিন চোখে সানগ্লাস পরে রঙিন জগৎকে দেখতে চায়নি। কোনো মায়ায় আটকে থাকেনি। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে তারা অনুভব করেছে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা। তাই স্বপ্নের জগৎকে বাস্তবায়িত করতে তারা তাদের জীবনের রঙিন স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। খোকন আর ঘরে ফেরেনি। কবি দেখেছেন সারা বাংলা খোকনদের রক্তে ভিজে যেতে। এরপর স্বাধীনতা এসেছে বন্যার মতো, ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সেদিনের বর্বর জন্তুদের। আজ স্বপ্ন দেখার দিন কিন্তু খোকন আজ নেই রয়েছে তার স্বপ্নের প্রতিমূর্তি সানগ্লাস। কিন্তু আজ আর সানগ্লাস পরতে হয় না। খোলা চোখেই দেখা যায় স্বাধীন বাংলার সৌন্দর্য। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের চোখেই কবি খোকনের সানগ্লাসের উপস্থিতি লক্ষ করেছেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ যে জনগণের সব প্রত্যাশা পূরণ করেছে এমন নয় বরং কবি লক্ষ করেছেন বাংলাদেশের স্বর্ণভূমিতে প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে শিশু, শ্রমজীবী, কৃষক, ছাত্রছাত্রীর রক্ত। কবি আশঙ্কা করেছেন পদ্মার প্রাণধারাও একদিন শুকিয়ে যেতে পারে, ঝরে পড়তে পারে বাংলার নিসর্গ। কিন্তু প্রকৃতির এই সম্ভাবনাময় অবক্ষয়ে কবি বিচলিত নন কারণ কবি জানেন ব্ল্যাডব্যাঙ্কের সাদা বোতলে রাখা রক্ত বেদনায় ঘোলা হয়ে যেতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের রক্তভেজা মাটিতে তা হবেনা বরং এই রক্তভেজা মাটি থেকেই জন্ম নেবে নতুন নিসর্গ কারণ কবি বিশ্বাস করেন ‘বাংলার সব রক্ত তীব্রভাবে মাটি অভিমুখী’। রক্তমাখা মাটি, শহরের কোলাহল, কারফিউ, স্বাধীনতা সবকিছু পেরিয়ে কবি গ্রামের মাটিতে ফিরে যেতে চান, আশ্রয় নিতে চান প্রেমিকার কাছে, মগ্ন হতে চান শিল্প সাধনায়—
আমার কবিতা, তোমার জন্য লেখা, ধাতব লাল
নগ্ন, এবং নিদ্রাহীন
সামনে এগোয়, পাথর ভেঙে আর তুষার ঠেলে
দুরপাল্লার সাবমেরিন;
কেউ ব’সে আছে ভেতরে মগ্নলোকে, চোখের মণি
স্বপ্ন খাচ্ছে ভীষণ নীল,
গোপন কবিতা তোমার বক্ষে উঠে-উত্তেজিত
বিবস্ত্র, আর অশ্লীল!
কবি চাইলেও নিভৃত সাধনায় মগ্ন হতে পারেন না। সমাজ-পরিবেশ কবির চিন্তা-চেতনাকে প্রতিমুহূর্তে স্থানচ্যুত করে চলেছে। কবি দেখছেন স্বাধীন বাংলাদেশ আজ শ্মশানভূমি। মানুষের চোখ থেকে সুখস্বপ্ন আজ তিরোহিত, সেখানে কেবল গাঢ় অন্ধকারময় বিভীষিকার উপস্থিতি। লোকদেখানো গণতন্ত্রে মানুষ আজ মানুষেরই সবচেয়ে বড়ো শত্রু, মুখে গ্রগতিশীলতার বার্তা দিয়ে, সমাজতন্ত্র গঠনের স্বপ্ন যারা দেখায়, প্রকাশ্যে জনগণের স্তুতি করে রাতের অন্ধকারে তারাই নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। তাদের কাছে মানব-সভ্যতার একমাত্র ভবিষ্যত স্বৈরতন্ত্র। তাই সুবিধাবাদী নেতাদের ব্যঙ্গ করে কবি বললেন—
যতবার জন্ম নিই ঠিক করি থাকবো ঠিকঠাক—
ঠিক করি হবো রাজনীতিবিদ : জনতার নামে জমাবো সম্পদ।
জাতির দুযোর্গে পালাবো নিরাপদ স্থানে, সুসময়ে ফিরে এসে
পায়রার মতো খুঁটে খাবো পাকা ধান। কোন্দলে ভাঙবো ঘর, হবো
বিদেশী এজেন্ট-সারা দেশ বেচে দেবো শস্তায় বিদেশি বাজারে।
স্বাধীনতার পর যে সমস্ত দেশনেতারা দেশের অগ্রগতির ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, তাদের অদূরদর্শিতার জন্য দেশের ভবিষ্যত আজ অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাদের অভিনয়বৃত্তিতে মোড়া সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে কবির ভাবনার শৈল্পিক দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে পড়ে। চোখের সামনে থেকে শিশু-নারী-নিসর্গ মুছে যায়। সমাজে নামে অরাজকতা। তাই দেশনেতাদের সরাসরি ব্যঙ্গ করে কবি বললেন—
যখন তাদের দেখি হঠাৎ আগুন লাগে চাষীদের মেয়েদের
বিব্রত আঁচলে; সমস্ত শহর জুড়ে শুরু হয় খুন, লুঠ, সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ,
ভেঙে পড়ে শিল্পকলা, গদ্যপদ্য; দাউদাউ পোড়ে পৃষ্ঠা সমস্ত গ্রন্থের;
ডাল থেকে গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল,
আর্তনাদ করে বাশি যখন ওঠেন মঞ্চে রাজনীতিবিদগণ।
হুমায়ুন আজাদ রাজনীতি সচেতন কবি। সুবিধাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান বরাবর প্রখর ছিল। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন গঠনমূলক রাজনীতির আবেষ্টনে গঠিত সমাজব্যবস্থা, কবিতার মাধ্যমে সাজাতে চেয়েছেন মানুষের জীবনের রঙিন স্বপ্নগুলোকে। আলোকোজ্জ্বল মানবসভ্যতা গঠনের ইচ্ছাকে তিনি আজীবন লালন করেছেন নিজের মনে। তারই শিল্পিত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়।
Leave a Reply