ওড়িয়া সাহিত্যের বিকাশে কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর অবদান লেখ।
কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহী
প্রখ্যাত ওড়িয়া সাহিত্যিক কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহী পুরী জেলার বিশ্বনাথপুরে ২ রা জুলাই ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম স্বপ্নেশ্বর পাণিগ্রাহী। তিনি ছিলেন আইনজীবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁর মায়ের নাম সরস্বতী দেবী। কালিন্দীচরণ, পুরী জেলা স্কুলে পড়াশুনা সমাপ্ত করে, কটকের রাভেনশ কলেজে উচ্চশিক্ষার্থে যান। সেখানেই অন্নদাশঙ্কর রায়, বৈকুণ্ঠনাথ পট্টনায়ক প্রমুখের সঙ্গে মিলিত ভাবে ওড়িয়া সাহিত্যে তিনি সবুজ’ নামে এক নব সাহিত্য ভাবধারা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। তিনি ছিলেন ওড়িয়া ‘সবুজ’ সাহিত্যের অন্যতম প্রতিনিধি স্থানীয় লেখক। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, নাটক—সাহিত্যের বিবিধ শাখায় বিচরণ করেছিলেন। তিনি তাঁর সাহিত্যরচনার জন্য পদ্মবিভূষণ ও সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারও লাভ করেন। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে তাঁর মৃত্যু হয়।
ওড়িয়া সাহিত্যে ‘সবুজ’ শীর্ষক সাহিত্য আন্দোলনটি বাংলায় প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্রে’র নাম ও আদর্শ অনুসারে কল্পিত হয়েছিল। ১৯২০-২১ খ্রিস্টাব্দের দিকে তরুণ অন্নদাশঙ্কর রায় ও তাঁর রাভেনশ কলেজের কয়েকজন সহপাঠী মিলে ওড়িয়া সাহিত্যে এই আন্দোলন গড়ে তুলবেন বলে প্রত্যাশা করেন। তাঁরা যৌথভাবে যে সাহিত্য গড়ে তুললেন, তা ‘সবুজ সাহিত্য’ নামে পরিচিত হয়েছিল। ১৯৩০ সালের দিকে তারা ‘সবুজ কবিতা’ নামে একটি কাব্যসংগ্রহ প্রকাশ করেন। সেই কাব্যসংগ্রহ প্রকাশের সঙ্গে তাদের সাহিত্যভাবনা বিষয়ক কোনো মুখবন্ধ দৃষ্ট হয়নি। এমন কি, সেই কাব্যসংগ্রহে তাঁদের কাব্যদর্শনগত কোনো বিশিষ্টতাও নজরে পড়ে না। এইসময় তাঁরা এত অল্পবয়স্ক ও অনভিজ্ঞ ছিলেন যে, কোনো সাহিত্যাদর্শকে মূর্ত করে তুলবার প্রজ্ঞা তাদের গড়ে ওঠেনি, এমনটাই মনে করা শ্রেয়। তাদের প্রচেষ্টায় আবেগ যত ছিল, পরিকল্পনা সেই পরিমাণে লক্ষিত হয়নি। ওড়িয়া সাহিত্যের ইতিহাসকার মায়াধর মানসিংহ এই প্রসঙ্গে লিখেছেন— ‘‘The Oriya sabujities, however, had nothing of this spirit in them. As a matter of fact, they were too young and too immature to have any settled creed at all.’’ যাই হোক, ওড়িয়া সাহিত্যের ইতিহাসে তাদের প্রচেষ্টার ঐতিহাসিকতার উল্লেখ আছে। কালিন্দীচরণ পরবর্তীকালে ওড়িয়া সাহিত্যে তাঁর স্বতন্ত্র স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলি হল, কবিতা—জাদুঘর, পুরী মন্দির, মহাদীপ, মো কবিতা, মানেনাহি, চুরিতি লোডা; উপন্যাস—মাটিরা মানিষা, লুহারা মানিষা, আমারাচিতা, আজিরা মানিষা, মুক্ত গদর ক্ষুধা; ছোটগল্প—দেবদাসী, রাশিফল, শেষ রশ্মি, সাগরিকা, মনসার বিলাপ, বিজয় উৎসব; নাটক—প্রিয়দাসী; জীবনীমূলক ও আত্মজীবনীমূলক রচনা—ভক্তকবি মধুসূদন, কর্মবীর গৌরীশঙ্কর, যাহা অঙ্গে নিভাইছি; প্রবন্ধগ্রন্থ–সাহিত্য সমাচার, সাহিত্যিকা।
কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত উপন্যাস হল ‘মাটিরা মনিষা’। এটি ওড়িশার কৃষিজীবী জীবনের নৈমিত্তিকতার উপর গড়ে ওঠা একটি চমৎকার উপন্যাস। দুইভাই বরাজু ও চাকাদি, পিতৃবিয়োগের পর তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে কাহিনীটি আবর্তিত হয়েছে। বরাজু তার পিতাকে কথা দিয়েছিল যে, পৈত্রিক সম্পত্তি সে বিভক্ত হতে দেবে না। কিন্তু ছোটভাই চাকাদি এই মূল্যবোধে বিশ্বাসী নয়। সে পৈত্রিক সম্পত্তি ভাগ করে পৃথগন্ন হয়ে যেতে চায়। শেষ পর্যন্ত বরাজু সংসারকে অবিভক্ত রাখার উদ্দেশ্যে সম্পত্তি ভাইকে দান করে, গৃহত্যাগ করে। বরাজু গৃহত্যাগ করার পর, চাকাদির মনে অনুশোচনা হয়। অনুশোচনার বশে সে বরাজুকে ঘরে ফেরত আনতে যায়। কিন্তু বরাজু আর ঘরে ফেরত আসে না, বরং চাকাদিকে ঘরে ফিরে, ঘর–সংসার দেখবার পরামর্শ দেয়। কালিন্দীচরণ পানিগ্রাহীর আলোচ্য উপন্যাসটি গ্রামীণ জীবনের নৈমিত্তিক ইতিবৃত্ত নিয়ে, সহজ সরল ভঙ্গিতে উপস্থাপিত। সমালোচকেরা তাঁর এই রচনায় তাঁকে ফকিরমোহন সেনাপতির সাহিত্যভাবনার যোগ্য উত্তরাধিকারী রূপেই দেখেছেন—‘‘The novel has carried forward the tradition of Fakirmohana in being written in a fluent colloquial style, and in not giving an incorrect penpicture of Orissa’s society’’ কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর কবিতাগুলিও ওড়িয়া সাহিত্যে তার স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করে নিয়েছে। যদিও সমালোচকেরা তাঁর রচিত কবিতায় ছন্দগত দৌর্বল্য, ভাবগত ক্ষীণতা ইত্যাদি সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর রচিত কবিতাগুলির মধ্যে কয়েকটি প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতার অনূদিত রূপ উল্লেখ করা হল—
প্রাণহীন জড়ধাতু, তবু অতুলনীয় সুন্দর,
সভ্যতার কোন্ সে ঊষালগ্ন থেকে তোমার দীপ্তি হয়েছে মূল্যবান?
ধরিত্রীর বুকে কি আনন্দ তুমি ডেকে আনলে?
কোন্ সে বিষাদকেই বা তুমি বহন করছ?
হে স্বর্ণ! তুমি এই বিশ্বজগতের ঈর্ষা, এই বিশ্বের বিজয়বৈজয়ন্তী!
তুমিই তো বাধ্য করো এক সন্তানকে তার পিতাকে হত্যা করতে
তুমিই বপন করো ঈর্ষার বীজ রমণীহৃদয়ে
তোমার মূল্যেই তৌলন করা হয় জগতের সব চাওয়া–পাওয়া
মহাজগত তোমারি জয়গাথা গায় নিরবধি।
(‘স্বর্ণ’ কবিতার অংশ)
কাব্য বলতে অনুভূতির যে নিবিড়তা, কল্পনার যে ব্যাপ্তি প্রত্যাশিত, তাঁর কবিতায় সে গুলি অনুপস্থিত। পুরী মন্দির বিষয়ক তাঁর যে কবিতা, সেটি যে কোনো মন্দির বর্ণনার সমতুল। পুরীর মন্দিরের কোনো স্বাতন্ত্র, তাঁর বর্ণনায় মেলে না। তাঁর এই ধরনের কবিতাগুলিতে প্রজ্ঞা যতখানি ধরা দেয়, কাব্যভাবনা ততখানি ধরা পড়ে না, সমালোচকেরা এমন মতই পোষণ করেছেন।
তাঁর ছোটগল্পে বরং মানজীবনের, সমকালীন ওড়িশার বাস্তবজীবন ও জীবনসত্য শিল্পিত রূপ লাভ করেছে। ‘বিজয় উৎসব’ তাঁর একটি প্রতিনিধি স্থানীয় ছোটগল্প। বাংলা ১৩৫০ সনের মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে লেখা এই গল্পটিতে কালিন্দীচরণ মন্বন্তরের দুঃসহ জীবনছবি নিপুণভাবে অঙ্কন করেছেন। গল্পটি শেষ হয়েছে মন্বন্তরের বিরুদ্ধে মানুষের নিরন্তর বেঁচে থাকার চেষ্টা ও যুদ্ধবাজ মানুষদের প্রতি শ্লেষাত্মক উক্তির মাধ্যমে। তাঁর নাটক ‘প্রিয়দাসী’কেও সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন নাটক রূপে বিবেচনা করা হয়।
সামগ্রিক কৃতিত্ব বিচারে কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহী ওড়িয়া সাহিত্যে এক স্পৃহণীয় মর্যাদায় আসীন হয়েছেন।
Leave a Reply