//
//

গাথাকাব্যের সংজ্ঞা, স্বরূপ ও একটি সার্থক গাথাকাব্য আলোচনা কর।

গাথাকাব্য

প্রাচীন ও মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের অনেকটাই লোকপর্যায়ে পড়ে। এই অল্প শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকেরা নানা গল্প কাহিনি, নীতি, উপদেশ, প্রণয়ানুরাগ প্রভৃতি উপাদান নিয়ে গান বাঁধতো, পরবর্তীকালে এই সমস্ত লোকসাহিত্য ছড়া, গাথা, গীতিকা, পাঁচালী, ব্রতকথা, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি রূপে জনসমাজে রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ রচয়িতারা থেকে গেছে অজ্ঞাত। এদের মধ্যে গাথাকাব্য এমন এক শ্রেণির কাহিনিকাব্য যা বাদ্যযন্ত্র সহকারে গাওয়া হতো। M.H. Abram-এর ভাষায় বলা যায়— “A ballad is a song, transmitted orally which tells a story.”

ইতালিয়ান ‘Ballaree’ থেকে ‘Ballad’ শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে, যার অর্থ—to dance. কাজেই উৎপত্তির সময় থেকেই ব্যালাডের সঙ্গে নৃত্যের একটি সংযোগ ছিলই একথা বলা যায়। অর্থাৎ নৃত্যসহকারে গীত হতো এমন জনপ্রিয় কোনো উপকথাকে নাটলীয় ভঙ্গীতে পরিবেশন করা হলেই তাকে বলা হতো গাথা কবিতা। সরল স্বতঃস্ফূর্ত বর্ণনা ও সজীব সংলাপের মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে মুখে মুখে গীত হতো গাথা কবিতা। তবে সাহিত্যরূপ বিচারে Shortion Oxford Dictionary-তে ব্যালাডকে এইভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে— “A simple spirited poem in short stanzas narrating some popular story.”

গাথাকাব্যের বৈশিষ্ট্য

  • নাটকীয়তা, চরিত্রসৃজন ও উপস্থাপনার নৈর্ব্যক্তিকতা গাথাকাব্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
  • গাথাকাব্যে একটি গল্প বা কাহিনি থাকে। গল্প সাধারণভাবে Action-নির্ভর হয়।
  • গাথাকাব্যের ভাষা সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল হয়।
  • গাথাকাব্যের কাহিনিতে নাটকীয় উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে থাকে।
  • অপ্রত্যাশিতের অভিঘাতজনিত চমক দিয়ে গাথাকাব্যের শুরু হয়।
  • গাথাকাব্যে হাস্যরসের আবির্ভাব যেমন ঘটতে পারে, তেমনি করুণ রসেরও প্রকাশ ঘটে।
  • ছোটগল্পের মতো একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গাথাকাব্যের কাহিনি আবর্তিত হয়।
  • ব্যালাড ছোটছোট স্তবকে বিভক্ত হয়, তাতে ছন্দের স্পন্দন থাকে।
  • চরিত্র বাহুল্য ব্যালাডে থাকে না। নির্দিষ্ট সংখ্যক চরিত্রকে কেন্দ্র করেই ব্যালাডের মূল কাহিনি আবর্তিত হয়।

গাথাকাব্যের শ্রেণিবিভাগ

গাথাকাব্যকে সাধারণত তিনভাবে ভাগ করা যায়—

ঐতিহ্যবাহী গাথাকাব্য

লোকগাথা বা Folk Ballad গুলো ঐতিহ্যবাহী গাথাকাব্যের অন্তর্ভুক্ত। এই শ্রেণির গাথাকাব্যের কবিরা বেশিরভাগক্ষেত্রে অজ্ঞাত। একগায়কের মুখ থেকে অন্য গায়কে, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে ঐতিহ্যবাহী গাথা। গ্রীসে এই ধরনের গাথাকাব্যের প্রচলন আছে।

সাহিত্যিক গাথাকাব্য

এই ধরনের গাথাকাব্যে সমষ্টিচেতনা ও গীতি চেতনার সুর বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় এবং কবিদের নাম জানা যায়। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘স্পর্শমণি’, ‘পণরক্ষা’; সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ইনসাফ’ প্রভৃতি।

জনপ্রিয় গাথাকাব্য

এই শ্রেণির গাথাকাব্য শহরাঞ্চলে অধিক পরিমাণে শ্রুত হয়। এগুলি জনজীবন থেকে উঠে এসেছে। এই শ্রেণির গাথাকাব্যের বিষয় যুদ্ধ, প্রেম। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘বন্দী বীর’ এই শ্রেণির গাথাকাব্য।

একটি সার্থক গাথাকাব্য

বাংলা সাহিত্যে গাথাকাব্যের সার্থক উদাহরণ হলো—‘মৈমনসিংহগীতিকা’। এই গীতিকার অন্তর্গত মহুয়া ও চন্দ্রাবতী পালাদুটিতে গাথাকাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলি সুন্দরভাবে পরিষ্ফুট হয়েছে—

  • ‘মহুয়া’ এবং ‘চন্দ্রাবতী’ পালাদুটিতে একটি মাত্র কাহিনি নাটকীয়ভাবে পরিপুষ্ট হয়েছে। মহুয়া পালায় মহুয়া ও নদ্যারচাঁদ এবং চন্দ্রাবতী পালায় চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দের মধ্যে যে প্রেম তাকেই নাটকীয় ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিত করা হয়েছে।
  • ‘মহুয়া’ এবং ‘চন্দ্রাবতী’ দুটি পালায় কাহিনির বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে ব্যক্তিচেতনা গুরুত্ব পায়নি। এরভিত্তিভুমি হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে সমগ্র সমাজ।
  • ‘মহুয়া’ এবং ‘চন্দ্রাবতী’ পালাদুটিতে চরিত্র তেমন প্রাধান্য পায়নি, কয়েকটি টাইপ চরিত্রের মাধ্যমে বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
  • বিষয়বস্তুর লক্ষ্য এখানে স্থির। ‘মহুয়া’ এবং ‘চন্দ্রাবতী’ দুটি পালাতেই দুটি ভিন্ন সমাজের প্রতিনিধিস্থানীয় ছবি ভিন্ন চরিত্রের মধ্যে প্রেম এবং বিয়োগান্ত পরিণতি সংকটময় মুহূর্তে নাটকীয় ভঙ্গীতে তুলে ধরা হয়েছে।
  • ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়া দুটি পালারই বৈশিষ্ট্য।
  • ‘মহুয়া’ এবং ‘চন্দ্রাবতী’ দুটি পালারই পরিণতি মিলনান্তক নয়। কাহিনির শেষে দুটি প্রেমই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। পালাদুটির মাঝামাঝি অংশে পৌঁছালে একটি ব্যর্থপ্রেমের জন্য সহমর্মিতা ও সহানুভূতি সমস্ত হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তোলে। বিয়োগান্ত পরিণতি দেখানো যে গাথাকাব্যের প্রধান শর্ত তা এক্ষেত্রে বিদ্যমান।
  • ‘মহুয়া’ এবং ‘চন্দ্রাবতী’ দুটি পালাই একটি বিশেষ ছন্দে রচিত। এগুলি সুদূর অতীতে গ্রাম বাংলার পল্লী কবিদের দ্বারা রচিত এবং গীতের মাধ্যমে পালা করে অনুষ্ঠিত হতো। বিশেষ ছন্দই তার প্রমাণ।
  • ছোটগল্প ও একাঙ্ক নাটকের মতো পারস্পরিক সংলাপ ও ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে ঘটনা এড়িয়ে পালাদুটির কাহিনি দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।

সামগ্রিক বিচারে তাই বলা যায় এই পালা দুটির কাব্যগুণ সহজ, সরল, আন্তরিক। পল্লীর মেঠোসুর ও প্রেমের মাধুর্য্যমণ্ডিত রূপায়ণে যুগে যুগে মাটি-মানুষের মন জয় করে এসেছে। আলোচ্য ‘মহুয়া’ এবং ‘চন্দ্রাবতী’ পালাদুটি গাথাকাব্যের বৈশিষ্ট্যগুণে সমন্বিত। তাই বলা যায় গাথাকাব্য হিসেবে ‘মৈমনসিংহগীতিকা’ সার্থক।

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদারDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!