চন্দ্রাবতীর রামায়ণ সম্পর্কে আলোচনা কর।
চন্দ্রাবতীর রামায়ণ
বাংলাদেশের কৃষিসমাজের নিম্নবর্গীয় প্রান্তিকতাকে ভেদ করে হাতে গোনা যে গুটিকয় নারীর স্বর শিক্ষিত-সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে শোনা গেছে, এ দেশের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী তাঁদের অন্যতম। সপ্তদশ শতকের লোককবি এই চন্দ্রাবতী, যিনি মৈমনসিংহ গীতিকা সংশ্লিষ্ট একজন সফল লোকগীতিকা-পালাকারই শুধু নন, ব্যতিক্রমধর্মী এক ‘রামায়ণ’ রচনাকারও।
ষোড়শ শতকের মনসামঙ্গল-এর কবি দ্বিজ বংশীদাস আর সুলোচনা দেবীর ঘরে জন্মেছিলেন তিনি। জন্মস্থান কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারি গ্রাম। কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য-লোকসাহিত্য তথা লোকমানসে কবি চন্দ্রাবতী এক উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে প্রতিভাত। যে যুগে নারীর জন্য বিদ্যাচর্চা কিংবা কাব্যকলাচর্চা খুব সহজ-সাধারণ ঘটনা ছিল না, সে যুগে তিনি স্বীয় প্রতিভা আর সৃজনশীল শক্তিতে রচনা করে গেছেন চমৎকার সব লোকগীতিকা, পালাকাব্য, গান ও রামায়ণ কাহিনি। খানিক আগেই বলা হয়েছে যে এ দেশের নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম, যিনি তৎকালীন বিরুদ্ধ সামাজিক বাস্তবতায় কাব্যরচনা করার মতো ‘সাহস’ দেখিয়েছিলেন।
কবি চন্দ্রাবতীর সৃজনপ্রতিভার বাইরে ব্যক্তি চন্দ্রাবতীর জীবন এবং তাঁর প্রেমশোকগাথা লোকসমাজ-সাহিত্যে বেশি প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত। আজও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের স্মৃতি আর শ্রুতিতে কিংবদন্তি চরিত্ররূপে চন্দ্রাবতীর করুণ কাহিনি বহমান। এর পেছনে অবশ্য মৈমনসিংহ গীতিকায় অর্ন্তভুক্ত ‘চন্দ্রাবতী’ পালাটির বিস্তর ভূমিকা রয়েছে। কবির মৃত্যুর পর পালাটি রচনা করেছিলেন নয়নচাঁদ ঘোষ।
‘চন্দ্রাবতী’ পালা থেকে জানা যায়, চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দ ছেলেবেলা থেকেই একত্রে বেড়ে ওঠেন, বড় হয়ে তাঁরা একে অপরের প্রেমের সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের অভিভাবকদের সম্মতিতে যেদিন তাঁদের বিবাহ ধার্য করা হয়, সেদিনই ঘটে নাটকীয়তা—সংবাদ আসে, আশমানী নামের অপর এক নারীর প্রতি আসক্ত জয়ানন্দ। তাই ওই সমাজের কাজি সাহেব আশমানী ও জয়ানন্দকে বিয়ে দেন। এই বিয়ের জন্য ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে জয়নাল নাম নিতে হয় জয়ানন্দকে। ঘটনার আকস্মিকতায় চন্দ্রাবতী নিদারুণ আঘাত পান। আর এরপর থেকে বাকি জীবন তিনি অতিবাহিত করেন একেবারে একা। তাঁর পিতা দ্বিজ বংশীদাস মেয়েকে শিবপূজা আর ‘রামায়ণ’ রচনার উপদেশ দেন। কবি চন্দ্রাবতী পরবর্তীকালে শিবপূজায় ব্রতী হন আর জীবনের শেষ দিকে এসে এক অনন্যসাধারণ ‘রামায়ণ’ রচনায় আত্মনিবেশ করেন।
তিনি প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত কৃত্তিবাসী বা বাল্মীকির ‘রামায়ণ’–কাহিনিকে অনুসরণ করেননি, বরং এ বিষয়ে গ্রাম্যগল্পকে প্রাধান্য দিয়ে এক ব্যতিক্রমী ‘রামায়ণ’ পালা রচনা করেন। চন্দ্রাবতী তাঁর ‘রামায়ণ’ পালাগানে কোনো প্রকার ভক্তিরস, বীররস, শৃঙ্গাররস তুলে ধরেননি। কেবল মধুর আর করুণরসকে উপজীব্য করে গড়ে তুলেছেন কাহিনি। কবি তাঁর রচনায় সীতাকে দেখিয়েছেন মুখ্যরূপে। প্রচলিত রামায়ণকারদের পথে না হেঁটে সীতার জীবনকেই পাঠককুলের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন চন্দ্রাবতী। তাই রামকে তিনি কোনো কোনো স্থানে সমালোচনা করতেও পিছপা হননি। সেদিক থেকে বঙ্গদেশের কবি চন্দ্রাবতীই রামকাহিনি রচনায় স্বতন্ত্র মনীষার পরিচয় দিয়েছেন। পরিশীলিত ‘রামায়ণ’-এ সাতটি কাণ্ড রয়েছে, যার মধ্যে উত্তরকাণ্ড একটি। এই উত্তরকাণ্ডেই সীতার বনবাস ও পরিশেষে তার ধরিত্রী-প্রবেশ ঘটে থাকে। এই কাণ্ডটিকেই চন্দ্রাবতী অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন নিজের ‘রামায়ণ’-এ। চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ তিন খণ্ডে বিভক্ত। এ রীতিটিও ধ্রুপদি রামায়ণ ধারা-বিরোধী। প্রথম পরিচ্ছেদ শুরু করেছেন তিনি লঙ্কার বৈভব ও রাবণরাজের বীরত্ব-বিজয় মহিমা দিয়ে। এ পরিচ্ছেদ তিনি রামের আগে সীতার জন্মকাহিনির মধ্য দিয়ে শেষ করেছেন, যেখানে সীতার পৌরাণিক জন্মকাহিনিকেও তিনি অনুসরণ করেননি, উপরন্তু এখানে লোকমুখে প্রচলিত গল্পকে বর্ণনা করেছেন চমৎকারভাবে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে দেখা যায়, ‘সীতার বারমাসী’, যেখানে সীতা সখীদের নিয়ে বসে আছেন, নিজের জীবনের সুখ–দুঃখ সখীদের কাছে গল্পচ্ছলে বলে চলেছেন তিনি—তাঁর বাল্যের কথা, বিয়ের কথা, রাবণ কর্তৃক তাঁর হরণের কথা, অশোকবনে বন্দিদশার কথা, রামের জন্য নিজের বিরহকাতরতার কথা এবং রাম কর্তৃক উদ্ধার ও অযোধ্যায় তাঁর প্রত্যাবর্তনের কথা।
তৃতীয় পরিচ্ছেদে চন্দ্রাবতী ও সীতা উভয়েই নিয়েছেন কথকের ভূমিকা। এ পরিচ্ছেদে চন্দ্রাবতী নিজের অনুভূতি দিয়ে ‘রামায়ণ’-এর ঘটনা প্রবাহকে উপলব্ধি করেছেন। এমনকি রামের বোনের কথায় বিশ্বাস করে রাম যখন সীতাকে সন্দেহ করে চরম ক্রোধে ফেটে পড়েন, তখন চন্দ্রাবতী রামকে তিরস্কার করতেও দ্বিধা করেন না। এরূপ চিত্রণ পরিশীলিত ‘রামায়ণ’-এর কোথাও নেই। চন্দ্রাবতীকৃত ‘রামায়ণ’-এর ভাষা, উপস্থাপনা আর রীতিনীতিতে কবি পরিশীলিত সাহিত্যরীতিকে নয়, লোকসাহিত্য-সংস্কৃতিকে আশ্রয় করেছেন বেশি মাত্রায়। এসব দিক বিবেচনায় চন্দ্রাবতী রচিত এই ‘রামায়ণ’ একেবারেই ভিন্ন চিন্তনের ছাপ রেখেছে। এ রামায়ণ গানের মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজ, বিশেষত নারীরা ঘরোয়া আসরে সীতার জীবনের নানা সুখ–দুঃখের সঙ্গে সামষ্টিক-সংহতিতে একাত্ম হতেন। এমনকি ক্ষিতিষ চন্দ্র মৌলিকের সংগৃহীত চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’-এর শেষ পরিচ্ছেদে সীতার বনবাস, তাঁর সন্তানপ্রসব এবং তাঁদের লালনপালন করার আটপৌরে আবহমান চিত্রটি ফুটে উঠেছে। এখানে এসেছে সীতার অপমানকর অগ্নিপরীক্ষার কথাও। আর পরিশেষে অগ্নিপরীক্ষা থেকে সীতার বসুমতি-মা কর্তৃক পাতালে আশ্রয়ের বিষয়টির মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছে এ করুণ কাহিনি। চন্দ্রাবতী এর সমাপ্তি টেনেছেন বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক নির্মমতা থেকে নিপীড়িত-অপমানিত সীতাকে পৃথিবী-প্রকৃতির বুকে টেনে নেওয়ার দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে। কবি চন্দ্রাবতীর ভাষায়—
দুষ্ট লোকের কথা শুইনাগো কী কাম করিলা
জন্মের মতন রামগো সীতারে হারাইলা
চন্দ্রাবতী কাইন্দা কয়গো কাহারো দোষ নাই
কর্মফল সুখ–দুঃখগো দাতা
বিধাতা গোঁসাই
সীতার দুঃখ-কষ্টকে চন্দ্রাবতী তাঁর নারী মনোভাব দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই স্বতন্ত্র ধারার এ রামায়ণপালাটি রচনা করতে পেরেছিলেন। পরিশীলিত সাহিত্য-দরবারে চন্দ্রাবতীর এ স্বতন্ত্র রামায়ণপালাটি স্থান পায়নি কখনো, কিন্তু সমাজের বৃহত্তর নিম্নবর্গের পরিসরে, বিশেষত পল্লিসমাজের নারীর ঘরোয়া রামায়ণী আচার-অনুষ্ঠানে কোথাও কোথাও আজও এই লোকরামায়ণ পালাগান পরিবেশিত হয়ে থাকে। আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত এ ‘রামায়ণ’ পালাগানে চন্দ্রাবতী সীতার কাহিনিকে নারীজীবনের আনন্দ–বেদনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত করে একে নারীর রামায়ণী গানে পরিণত করেন। ফলে এ রামায়ণপালাটি নারী-লোকসমাজ–সংস্কৃতির সঙ্গে পরম্পরাক্রমে যুক্ত ছিল একদা। এমনকি আজও কোথাও কোথাও নারী কর্তৃক এ রামায়ণগানের কিঞ্চিত লোকপরিবেশনা চলে।
Leave a Reply