চর্যাপদের সাধনতত্ত্ব বিষয়ে আলোচনা কর।

চর্যাপদের সাধনতত্ত্ব

চর্যাগীতিগুলিতে ধর্মীয় সাধনপ্রণালী অধিক প্রাধান্য লাভ করেছে। কারণ চর্যাকারদের ধর্মচিন্তা বহুলাংশে তন্ত্রপ্রভাবিত ছিল। তন্ত্র ধর্ম সম্পর্কে কোনো নতুন তত্ত্ব প্রতিপাদন অপেক্ষা সত্যলাভের কার্যকরী সাধন পদ্ধতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে তন্ত্রসাধনার অনেক বহিরাঙ্গিক দিক আছে। চর্যাগীতির সহজ সাধকেরা এই বহিরাঙ্গিক দিকগুলি বাদ দিয়ে মূল সাধনার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তন্ত্রের মূল সাধনা কায়া সাধনা। অর্থাৎ দেহের মধ্যেই পরমসত্যের অবস্থান এবং সাধনায় দেহকে অবলম্বন করলেই এই সত্যের উপলব্ধি ঘটে।

সহজ সাধকেরা তাদের ধর্মের মূলতত্ত্বগুলিকে দেহের ভিত্তিতেই প্রতিপাদন করেছেন। তাঁদের ধর্মমতে বোধিচিত্ত বা মহাসুখই হচ্ছে পরমসত্য ও সাধকের পরম কামনার বিষয়। প্রজ্ঞারূপিণী শূন্যতা এবং উপায়রূপিণী করুণাকে সাধনার দ্বারা মিলিত করলেই এই মহাসুখ লাভ হয়। এই মহাসুখ, শূন্যতা এবং করুণার তত্ত্বকে সাধকেরা দেহের বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার উপর স্থাপন করেছেন।

এজন্য দেহের মধ্যে তাঁরা চারটি চক্র বা পদ্মের অস্তিত্ব কল্পনা করেছেন। প্রথম চক্র নাভিতে অবস্থিত-নাম নির্মাণচক্র। দ্বিতীয় চক্র হৃদয়ে অবস্থিত-নাম ধর্মচক্র। তৃতীয় চক্র কণ্ঠে অবস্থিত-নাম সম্ভোগচক্র। এবং চতুর্থ চক্র মস্তকে অবস্থিত-নাম সহজচক্র বা মহাসুখচক্র। এই সহজচক্রই বোধিচিত্তের স্বস্থান। দেহের চক্রাবস্থান ছাড়াও সাধকেরা দেহের অভ্যন্তরের তিনটি প্রধান নাড়ীকে সাধনার সহায় হিসাবে গ্রহণ করেছেন।

যে প্রজ্ঞা ও করুণার মিলনে অদ্বয় সহজানন্দের অনুভব, দেহের নাড়ীতে তাঁরা সেই প্রজ্ঞা ও করুণার সারূপ্য খুঁজে পেয়েছেন। বাম নাসারন্ধ্র থেকে প্রবাহিত বামগা নাড়ী প্রজ্ঞারূপিণী এবং দক্ষিণ নাসারন্ধ্র থেকে প্রবাহিত দক্ষিণগা নাড়ী উপায়রূপিণী, এবং এই দুই নাড়ীর মাঝখান দিয়ে যে নাড়ী প্রবাহিত সেই অবধূতী বা অবধূতিকা-এই মধ্যগা নাড়ীপথেই অদ্বয় বোধিচিত্তের সাধনা করতে হয়। সাধারণভাবে বামগা এবং দক্ষিণগা নাড়ীর গতি নিম্নমুখী। এদের একটি ধারায় সংসারের সৃষ্টি (ভব) অন্য একটি ধারায় সংসারের সংহার (নির্বাণ)। সাধক কোনো একটি বিশেষ ধারার পক্ষপাতী নন।

তাই তাঁর কাছে বামগা ও দক্ষিণগা নাড়ীর স্বাভাবিক ক্রিয়া ও ধারার কোনো মূল্য নেই। শূন্যতা ও করুণার মিলনই যখন কাম্য তখন তিনি যোগবলে নাড়ীদ্বয়ের নিম্নগতিকে রুদ্ধ করেন এবং তারপর দুই নাড়ীর ধারাকে মধ্যমার্গে একত্র করে ঊর্ধ্বগামী করেন। মধ্যমার্গে বা অবধূতী নাড়ীতে বাম ও দক্ষিণ নাড়ীর ক্রিয়াধারাকে একত্রিত করলে নাভিদেশের নির্মাণ চক্রে বোধিচিত্ত উৎপন্ন হয়।

এরপর নির্মাণচক্র থেকে বোধিচিত্তকে ঊর্ধ্বমুখী করে হৃদয়স্থিত ধর্মচক্রে, সেখান থেকে কণ্ঠস্থিত সম্ভোগচক্রে এবং শেষে মস্তকস্থিত মহাসুখচক্রে প্রেরণ করলেই ক্রমোন্নতিশীল বোধিচিত্ত তার প্রাথমিক সাংবৃত্তিক রূপ থেকে পারমার্থিক রূপলাভ করে এবং সাধকের কাছে মহাসুখস্বরূপ বা সহজানন্দরূপে ধরা দেয়। মধ্যমার্গে বোধিচিত্তের ধারাকে ঊর্ধ্বগা করতে পারলেই সাধকের কাছে আনন্দানুভূতি শুরু হয়।

বোধিচিত্তের চতুর্বিধ চক্রাবস্থিতি অনুযায়ী এই আনন্দেরও চতুর্বিধ স্তরভেদ আছে। বোধিচিত্ত যখন নাভিস্থিত নির্মাণচক্রে উৎপন্ন হয় তখন যে অনুভূতি তাকে বলা হয় ‘আনন্দ’, বোধিচিত্তের ধর্মচক্রে অবস্থানকালীন অনুভূতির নাম ‘পরমানন্দ’, বোধিচিত্তের সম্ভোগচক্রে অবস্থানকালীন অনুভূতির নাম ‘বিরমানন্দ’ এবং মহাসুখচক্রে অবস্থানকালীন অনুভূতির নাম ‘সহজানন্দ’।

চর্যাকারগণ তাঁদের এই সাধনপ্রণালীকে নানা রূপকের সাহায্যে ব্যক্ত করেছেন। সাধনপ্রণালীর অবলম্বন কোথাও দেহনগরী, কোথাও মায়াজাল, কোথাও বীণা ইত্যাদি। দেহের প্রধান তিনটি নাড়ীকে কোথাও নদীতট-সাঁকো, চন্দ্র-সূর্য, নৌকা-দাঁড় ইত্যাদির রূপকে ব্যবহার করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র:

১. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়—

২. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

৩. বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা: ভূদেব চৌধুরী

৪. বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা: গোপাল হালদার

৫. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন

৬. চর্যাগীতির ঐতিহাসিক ভূমিকা: জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী

৭. চর্যাগীতি পরিক্রমা: নির্মল দাশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!