জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল সম্পর্কে আলোচনা কর।
জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল
বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত রচনার কিছুকাল পরে জয়ানন্দ মিশ্র তাঁর ‘চৈতন্যমঙ্গল’ রচনা করেন। তাঁর কাব্য সম্পর্কে সর্বপ্রথম আলোচনা ১৩০৪-০৫ সালের সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তারপর নগেন্দ্রনাথ বসু ও কালিদাস নাথের সম্পাদনায় এই গ্রন্থ ১৩১২ বঙ্গাব্দে সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে অন্যান্য জীবনীকাব্যের থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে নতুনত্ব রয়েছে।
গ্রন্থমধ্যে জয়ানন্দ প্রদত্ত আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়—তার নিবাস ছিল বর্ধমানের আমাইপুরা গ্রামে। পিতার নাম সুবুদ্ধি মিশ্র, মাতা রোদনী। মাতা মৃতবৎসা ছিলেন বলে নবজাত শিশুর যমের অরুচিসুলভ নাম রেখেছিলেন ‘গুইঞা’। পরে চৈতন্য তাঁর নাম রাখেন ‘জয়ানন্দ’। তাঁর জন্ম—
শুক্লা দ্বাদশী তিথি বৈশাখ মাসে।
জয়ানন্দের জন্ম হইল সে দিবসে।।
চৈতন্যপুরী থেকে গৌড়ের পথে আসার সময় বর্ধমানের সুবুদ্ধি মিশ্রের গৃহে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। জয়ানন্দ গদাধরের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন বিমানবিহারী মজুমদার। কিন্তু কবি কোন কোন স্থানে অভিরাম গোস্বামীকে গুরু বলে নির্দেশ করেছেন।
জয়ানন্দের বর্ণনা অনুসারে ‘চৈতন্যমঙ্গল’ বৃন্দাবনদাসের ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’ রচনার পরে রচিত। আত্মপরিচয়ে কবির জন্মসময় ও কাব্য রচনার কোনো তারিখ নেই। আনুমানিক ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তিনি কাব্য রচনা করেন।
জয়ানন্দের কাব্য নয়টি খণ্ডে বিভক্ত—আদি, নদীয়া, বৈরাগ্য, সন্ন্যাস, উজ্জল, প্রকাশ, তীর্থ, বিজয় ও উত্তর। গ্রহের শ্লোকসংখ্যা তের হাজার।
জয়ানন্দের কবিত্বশক্তি উন্নতমানের। গ্রন্থটির সহজ, সরল ভাষা সাধারণ মানুষের বোধগম্য এবং ছন্দমাধুর্যের জন্য স্বল্প শিক্ষিত মানুষের পক্ষে কাব্যরস আস্বাদনের উপযোগী হয়েছে। সমসাময়িক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্র তাঁর কাব্যে রূপ পেয়েছে—
রাজা নাহি পালে প্রজা স্নেচ্ছের আচার।
দুই তিন চারি বর্ণে হইল একাকার।।
দেবতা ব্রাহ্মণ হিংসা করে ম্লেচ্ছ জাতি।
ক্ষেত্ৰী যুদ্ধে শক্তিহীন নাহি যতি সতী।।
কাব্যটি যে মঙ্গলকাব্যের রীতিতে রচিত তার দুটি প্রমাণ হল কাব্যটি গীতের আকারে রাত এবং বিষ্ণুপ্রিয়ার বারমাস্যার বর্ণনা।
জয়ানন্দ চৈত্য তিরোধানের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাকে বিশ্বাসযোগ্য বলে গ্রহণ করেছেন দীনেশচন্দ্র সেন। তাঁর মতে—“চৈতন্যদেবের তিরোধান সংক্রান্ত নানারূপ অলৌকিক গল্পে সত্যকাহিনী কুহকাচ্ছন্ন হইয়াছিল, জয়ানন্দের লেখায় সেই ঘনীভূত তিমিররাশি এখন অস্তহিত হইবে।” জয়ানন্দের বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায়, আষাঢ় মাসে রথযাত্রার দিন রথের আগে নাচতে নাচতে চৈতন্যের বাম পায়ে ইটের টুকরা বিদ্ধ হয়—
আষাঢ় বঞ্চিত রথ বিজয়া নাচিতে
ইটাল বাজিল বাম পাত্ৰ আচম্বিতে।।
এই অভিনব তথ্য অন্য কোন জীবনী কাব্যে নেই। তাছাড়া আর একটি নতুন তথ্য তার কাব্যে পাওয়া যায়। তা হল—চৈতন্যের পূর্বপুরুষ উড়িষ্যার অধিবাসী ছিলেন। পরে পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টে বসবাস শুরু করেন।
তাঁর কবিত্বশক্তি উঁচুমানের না হলেও তিনি কবিত্বশক্তি বর্জিত ছিলেন না। তিনি সাধারণ মানুষের জন্য চৈতন্যজীবনী কাব্য রচনা করেছিলেন, সেজন্য তাঁর কাব্য সহজ সরল ও স্বাভাবিকতায় পূর্ণ।
Leave a Reply