ট্র্যাজেডি তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।
ট্রাজেডি তত্ত্ব
পোয়েটিকস্ গ্রন্থের প্রায় তিন চতুর্থাংশ স্থান অধিকার করে আছে ট্রাজেডির আলোচনা। পোয়েটিকস্ গ্রন্থ অনুসারে ট্রাজেডির আলোচনাকে নিম্নলিখিত ভাবে উপস্থাপনা করা যেতে পারে—
- গ্রীক ট্র্যাজেডির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ।
- ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা।
- ট্র্যাজেডির বিষয়বস্তু বা উপাদান।
- ট্র্যাজেডির নায়ক।
- ট্র্যাজেডির রস।
- ট্র্যাজেডির পরিণতি।
- ট্রাজেডির শ্রেণিবিভাগ
- ট্রাজেডি ও মেলোড্রামা।
গ্রীক ট্র্যাজেডির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
গ্রীকে ‘ডাওনিসান’ উৎসবে ‘ডিথিরাম’ গীতি থেকে ট্র্যাজেডির উদ্ভব হয়েছে বলে অ্যারিস্টটল মনে করেন। অ্যারিস্টটলের সিদ্ধান্ত ট্র্যাজেডি—“Originated with the authors of the Dithyrumb”। গ্রীক ট্র্যাজেডির আলোচনা করতে গিয়ে এই ইস্কাইলাস পাত্রের সাথে সংলাপের প্রাধান্য দান করেন। সফোক্লিস পাত্রের সংখ্যা বাড়িয়ে কাহিনী বা বৃত্তের আকার বড় করেন। তবে ট্র্যাজেডির উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে অ্যারিস্টটল যে তথ্য দিয়েছেন তা আজও সর্বজনস্বীকৃত।
ট্রাজেডির সংজ্ঞা
পোয়েটিকস্ গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ট্র্যাজেডির সংজ্ঞায় আ্যারিস্টটল বলেছেন— “Tragedy, then is an imitation of an action that is serious and complete in itself, having certain magnitude, hot in a narrative form but in action, with pleasurable accessories, arousing pity and fear, and here with it accomplishes to catharsis.” অর্থাৎ ট্রাজেডি হল একটি গণ্ডির সম্পূর্ণ ও বিশেষ আয়তন বিশিষ্ট ক্রিয়ার অনুকরণ ভাষার সৌন্দর্যে তা প্রতিটি অঙ্গ স্বতন্ত্র, এই ক্রিয়াটির প্রকাশ রীতি বর্ণনাত্মক নয়, নাটকীয়, আর এই ক্রিয়া ভীতি ও করুনার উদ্রেক করে এবং তাঁর মধ্যে দিয়ে অনুরূপ অনুভূতিগুলির পরিশুদ্ধি ঘটায়”
ট্র্যাজেডির উক্ত সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে যে সূত্রগুলি উঠে আসে, তা হল—
- গুরুগন্তীর অর্থাৎ গাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয়কে নিয়েই ট্র্যাজেডির রচিত হবে। লঘু বা হালকাকে বিষয় ট্র্যাজেডিতে থাকে না।
- ট্র্যাজেডির কাহিনী আদি-মধ্য-অন্ত্য যুক্ত পূর্ণাঙ্গ ও পরিমিত আয়তন বিশিষ্ট হবে।
- ট্র্যাজেডি ঘটনা রচিত হয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বর্ণনামূলক নয়।
- ট্র্যাজেডি ভাষা গাম্ভীর্যপূর্ণ হবে। ছন্দ, অলঙ্কার, শব্দ, যোজন, সঙ্গীত প্রভৃতির সুললিত প্রয়োগ থাকবে।
- ট্র্যাজোডি পাঠক বা দর্শকের মনে করুণা ও ভয় (Pity and fear) সঞ্চারিত করে।
জাগিয়ে তুলে আবার তাঁর “ভাবমোক্ষণ” (Catharsis) বা “চিত্ত পরিশুদ্ধি” ঘটান।
ট্র্যাজেডির বিষয়বস্তু বা উপাদান
‘পেয়োটিকস’ গ্রন্থানুসারে ট্র্যাজেডির উপাদান হল ছয়টি, যথা— কাহিনী বা বৃত্ত (Plot); চরিত্র (Character); রচনারীতি (Diction); অভিপ্রায় বা ভাবনা (Thought), দৃশ্যসজ্জা (Spectacle), ও সঙ্গীত (Melody)। এই জন্য ট্র্যাজেডিকে অনেকে ষড়ঙ্গ শিল্প বলেছেন।
কাহিনী বা বৃত্ত (Plot)
অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডির আলোচনায় কাহিনিকে সবথেকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। গ্রিক “মুখোস’’ শব্দের বাংলা হল কাহিনী বা বৃত্ত। কাহিনী মধ্যে দিয়েই মানবজীবনের ঘটনা ধারা তুলে ধরেন শিল্পী। অ্যারিস্টটলের মতে ট্র্যাজেডি মানুষের অনুকরণ নয়, মানবজীবনের কোন ক্রিয়ার অনুকরণ। জীবনের সুখ বা দুঃখ বহু ঘটনার (Serious action) অনুকরণ। কাহিনির মধ্যে আয়তন, সমগ্রতা, ঐক্য, বিপ্রতাপতর, গ্রন্থমোচন, উপকাহিনী সবই থাকে। তাই ট্র্যাজেডির আলোচনায় কাহিনীই হল সবথেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
চরিত্র (Charecter)
ঘটনাকে যথাযথ রূপ দিতে গেলে প্রয়োজন হয় চরিত্রের। তবে কাহিনীর সাথে চরিত্র ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তাই চরিত্রকে বাদ দিয়ে ট্র্যাজেডি সম্ভব নয়। তবে চরিত্র হবে সূক্ষ্ম আর ট্র্যাজেডির নায়ক হবেন, উচ্চবংশ জাত, বীর, মহান, ওজস্বী ও ক্ষমতা সম্পন্ন। তবে তিনি অত্যন্ত ধার্মীক ব্যক্তি হবেন না।
রচনারীতি (Diction)
অ্যারিস্টটলের মতে রচনারাতর বিন্যাসে শৈল্পিক দক্ষতা প্রয়োজন। ঘটনা ধারার যথাযথ উপস্থাপনায় চমৎকারিত্ব দরকার। ব্যাকরণের যথাযথ নিয়মনীতি, ছন্দের ব্যবহার অলংকার প্রয়োগের দক্ষতা প্রণয়ন, উপমার সৌকর্ষ ইত্যাদির যথাযথ প্রয়োগে রচনা গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
অভিপ্রায় বা ভাবনা (Thought)
ট্র্যাজেডির আলোচনায় অভিপ্রায় বা ভাবনা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ ট্র্যাজেডির কাহিনির মধ্যেই দিয়ে রচয়িতা আসলে কী বলতে চাইছেন; সেটাই হল অভিপ্রায়; এই অভিপ্রায় বা ভাবনা ট্র্যাজেডিকে শিল্পের চরম শিখরে পৌঁছে দেন।
দৃশ্যসজ্জা (Spectacle)
দৃশ্যসজ্জা ট্র্যাজেডির কাহিনীকে আকর্ষণীয় করে তোলে নাটকীয় ক্ষেত্রে দৃশ্যের পরম্পরা কাহিনিকে অভিনব রূপে গড়ে তোলে। তবে ট্র্যাজেডির ক্ষেত্রে দৃশ্যসজ্জার গুরুত্ব তুলনামূলক ভাবে কম বললেই চলে।
সঙ্গীত (Melody)
অ্যারিস্টটলের মতে— “অন্যান্য উপাদানের মধ্যে ট্র্যাজেডির সবচেয়ে প্রীতিকর উপাদান হল সঙ্গীত।” তবে সঙ্গীত বলতে অ্যারিস্টটল “নাটকে ব্যবহৃত ধ্বনিসমূহের নিয়ন্ত্রিত বিন্যাস”কে বুঝিয়েছেন। যার মধ্যে সুর থাকবে। আমাদের ধারণা অনুযায়ী সঙ্গীত হল “গান”। অ্যারিস্টটল সঙ্গীতকে ‘গান’ অর্থে বোঝাতে চাননি।
অ্যারিস্টটলের মতে ট্র্যাজেডি হবে অভিনীত। যা দেখে দর্শকরা সহজের ট্র্যাজেডির রস গ্রহণ করতে পারবে। সেইসঙ্গে চোখের সামনে ঘটা দৃশ্য দেখে দর্শকের শ্রুতিতে melody ধরা পড়বে। ফলে ট্র্যাজেডি রচনা সার্থক হবে।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply