//
//

নব্য-ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।

নব্য-ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্ব

নব্য ক্লাসিক (Neo Classic) ক্লাসিকাল সাহিত্য বিচারের মূলসূত্রগুলি উত্তরকালে ব্যবহৃত হয়ে গড়ে তুলেছিল নব্য ক্লাসিক সাহিত্যাদর্শ। ইংরেজি সাহিত্যে বেন জনসন, ড্রাইডেন, পোপ, এডিসন, স্যামুয়েল জনসন প্রমুখ নিও-ক্লাসিক রূপে পরিচিত। এঁদের কিছু বৈশিষ্ট্য হল—

  • Traditionalism বা ঐতিহ্যবাদে বিশ্বাস, নতুন কিছু আবিষ্কার অনাস্থা এবং ক্লাসিকাল (বিশেষত রোমান) লেখকদের আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা।
  • ‘সাহিত্য’ শিল্পকলার একটি অংশ। যদিও সৃষ্টির জন্য অন্তর্গত একান্ত প্রয়োজন। তথাপি দীর্ঘ পঠন-পাঠন ও অভ্যাসের ওপর যেমন এর নির্ভরতা তেমনি পূর্ব দৃষ্ট সাফল্যের নিরিখেই সাহিত্যবিচার্য। কারিগরি দক্ষতা, শুদ্ধি ও বিস্তারের দিকে মনোযোগ প্রভৃতি ব্যাপারে নব্য ক্লাসিকের আদর্শ ছিলেন হোরেস। তবে তাঁরা প্রতিভার স্বাভাবিক দান এবং শৈল্পিক সামর্থ্যক আবিষ্কার করেননি। নব্য ক্লাসিকেরা মনে করতেন যে, মহাকালের বিচারে যে সব সাহিত্যস্রষ্টার রচনা স্বীকৃতি লাভ করেছে বা উত্তীর্ণ হয়েছে তাঁদের রচনারীতির নিয়মাবলি (যদি কিছু থাকে) তবে তা অনুকরণ করতে হবে। মনে রাখতে অ্যারিস্টটলের ট্রাজেডি তত্ত্বের মধ্যে যাঁরা ত্রয়ী ঐক্যের সন্দান পেয়েছিলেন তাঁরাও মতাদর্শের প্রচারক।
  • সামাজিক সংগঠনের মধ্যে একমাত্র মানুষই, নব্য-ক্লাসিকদের কাছে কাব্যিক বিষয়ের প্রাথমিক উপাদান। এঁদের মতে, সাহিত্যে অনুকরণের বিষয়বস্তু হল মানুষ। নিও-ক্লাসিক মানবিকতার আদর্শ অনুযায়ী, শিল্পের সার্থকতা শিল্পে নয়, মানুষে অনুসন্ধেয়।
  • বিষয়বস্তুকে এবং শিল্পের আবেদন সৃষ্টির ব্যাপারে মানুষের সাধারণ-ধর্মের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘যথার্থ বুদ্ধি মানুষের চিন্তায় এসেছে, কখনও প্রকাশিত হয়নি’—বলেছেন পোপ। কাব্য-সাহিত্যের উদ্দেশ্য হল, মানুষের সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধিকে নতুন এবং যথাযথ রূপে প্রকাশিত করা। মানুষের সাধারণ বোধ ও বুদ্ধিকে নতুন এবং নিখুঁতভবে প্রকাশ করার মধ্যেই তাদের গুরুত্ব ও স্থায়িত্ব প্রমাণ হবে। উদাহরণ স্বরূপ এঁরা বলেছেন যে, শেক্সপীয়রের নাটকের বিষয়বস্তু ইতিহাসের প্রাচীন কাহিনী থেকে সংগৃহীত হয়েছে, অথচ শেক্সপীয়রের তাঁর নাটকে প্রাচীন বিষয়বস্তুকে এমন রূপ দান করেছেন যার ফলে তা কালোত্তীর্ণ মহিমা অর্জন করেছে।
  • নিও-ক্লাসিক দর্শনে ও সাহিত্যে, মানুষের অহমিকা, নৈসর্গিক ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার বাসনা প্রভৃতির সমালোচনা করে মধ্যপন্থায় মানবিক ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার দিকে আকর্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। মানুষের শিল্প-সাহিত্যকর্মকে একটি সীমার মধ্যে শাসন করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। নিও-ক্লাসিক যুগের কবিরা মহাকাব্য এবং ট্রাজেডির প্রশংসা করেছেন ঠিকই। কিন্তু তাঁরা নিজেরা লিখেছেন—‘প্রবন্ধ’, ‘কমেডি অব ম্যানার্স’ এবং বিশেষত Satire বা শ্লেষ। দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা বিষয়, রূপ ও ভাষার কাছে তাঁরা আত্মসমর্পণ করেছেন।

নিসর্গ প্রকৃতি বা আদর্শকে অনুকরণ করাই নব্য-ক্লাসিকদের মূল কথা। জনসন বলেছেন, কোনো সেরা কবির শ্রেষ্ঠ সম্পদকে অনুকরণ করাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। মৌমাছি যেমন ভাবে মধুসংগ্রহ করে মৌচাক গঠন করে, পূর্বাদশ থেকে সাহিত্যের উপাদান সেইভাবেই সংগ্রহ করবেন উত্তরকালের লেখকরা। নিও-ক্লাসিক সেইজন্য গুরুত্ব দিয়েছিলেন ‘মেমারি’ বা ‘স্মৃতিশক্তি’র ওপর। অনুকরণ, অভ্যাস, পাঠ এবং অতঃপর শিল্প সৃষ্টি—এই ছিল এঁদের মতে মূল কর্ম। জনসনই ইংরেজ সাহিত্যে প্রথম নব্য-ক্লাসিক আদর্শের প্রতিষ্ঠা করেন, পরে এসেছিলেন ড্রাইডেন। সপ্তদশ শতকে ফ্রান্সে কর্ণেই ছিলেন নব্য-ক্লাসিক; যিনি আ্যারিস্টটল কথিত সম্ভাব্যতা বা Probablity-কে ব্যাখ্যা করেছিলেন সাদৃশ্যের সম্ভাব্যতা বলে এবং Necessity-কে নাটকীয় প্রয়োজনীয়তার আবশ্যিকতা বলে। সপ্তদশ শতকে ড্রাইডেন বলেছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ কোনো নাটক, আসলে নিসর্গকে আদর্শায়িত করে অতঃপর তার রূপায়ণ। নাটক কতকগুলি মানুষের বিচ্ছিন্ন সংলাপ নয়—একটি সম্পূর্ণাবয়ব শিল্পকর্ম। অ্যারিস্টটলের ‘প্লট’-আলোচনায় যে ঐক্যের কথা আছে ড্রাইডেন, কর্ণেই এবং একইসময় রাসিন তা উত্থাপন করেন। হোরেসের ‘আর্স পোয়োতিকার’ ঢঙে আলেকজান্ডার পোপ লেখেন ‘Essay on Criticism’ কবিতার ছন্দে পোপ কাব্য-সাহিত্যে নিসর্গের ভূমিকা ব্যাখ্যা করলেন। অষ্টাদশ শতকে যোসেফ এডিসন দার্শনিক লকের পন্থায় অগ্রসর হয়ে ‘Imagination’ শব্দটির ব্যাখ্যা করেন। এডিসন প্রকৃতির সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক বিষয়ে অ্যারিষ্টটলীয় তত্ত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন আনন্দাদায়ক বস্তুর অনুকরণ অতৃপ্তির বস্তুর অনুকরণের থেকে অধিকতর আনন্দাদায়ক। এডিসন, সাহিত্যের আনন্দের কারণ হিসেবে বলেছিলেন, অভিজ্ঞতা-নির্ভর বস্তুর নতুন রূপ দর্শন এবং তাকে সুন্দর মূর্তিতে দর্শন এই দুটির কারণে সাহিত্য হয়ে ওঠে আনন্দময়। অ্যারিষ্টটল যেমন সাহিত্যকে তুলনা করেছিলেন ছবির সঙ্গে, নিও-ক্লাসিক হোরেস এবং সপ্তদশ শতকের ড্রাইডেন ও ফ্রেসিংও তাই করেছিলেন। ড্রাইডেন লিখেছিলেন এমন প্রবন্ধ যার শিরোনাম ছিল—“Parallel between Poetry and Painting”। ছবি ও কবিতা উভয়েরই অনুকরণের বিষয়বস্তু ‘মানুষ’। অষ্টাদশ শতকের ইংরেজি কবিতার উপর অনেকে লক্ষ করেছেন চিত্রের প্রভাব। অষ্টাদশ শতকের লেসিং এর অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল সাহিত্য ও চিত্রের সম্পর্ক। সপ্তদশ শতকের শেষভাগ থেকে সাহিত্যের সঙ্গে সংগীতের সম্পর্ক আলোচনা শুরু হল। এইসময় কাব্য ও সংগীতের সম্পর্ক তিনদিক থেকে নির্ণীত হয়ে থাকে—১) টেকনিক্যাল এবং ফর্মাল (কাব্যের প্রধান হল ভাষা এবং সংগীতের সুর) ২) অনুকরণ ৩) প্রকাশ। বস্তুত সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্পের মধ্যে সম্পর্ক, সাহিত্যের সঙ্গে নিসর্গের সম্পর্ক, সাহিত্যের উদ্দেশ্য প্রভৃতি নিয়ে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে প্রাচীন ক্লাসিকাল আদর্শকে তুলে ধরেছিলেন নব্য-ক্লাসিকেরা। নব্য-ক্লাসিকেরা উই (বুদ্ধি), জাজমেন্ট (বিচার) ও রিজন (যুক্তি)—এই তিনকে সর্বদাই শিল্প সাহিত্যে সৃষ্টি ও বিচারের নিরিখ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!