//
//

বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান আলোচনা কর।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও বাংলা গদ্য

বাংলা সাহিত্যে ধারাবাহিক গদ্য রচনার সূত্রপাত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠীর লেখকদের মাধ্যমে। বাংলা ভাষায় গদ্য ব্যবহারের আধুনিক প্রবণতার প্রথম সার্থক পথিকৃৎ উনিশ শতকের নবপ্রবুদ্ধ শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষালয়। বাংলা ভাষায় গদ্য রচনার যে প্রাচীন নিদর্শন প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষ করা যায়, তাতে আদর্শ লেখ্য ভাষার উপযোগী শৃঙ্খলার অভাব ছিল স্পষ্ট। পর্তুগীজদের রচিত বাংলা ব্যাকরণ আসলে ছিল তাদের স্বজাতীয় বাংলা লেখকদের কাছে বাংলা ভাষার রূপ-রীতি সম্পর্কে এক সাধারণ জ্ঞান পরিবেশনের চেষ্টা। পরবর্তীকালের ইংরেজ বৈয়াকরণদের প্রয়াস ছিল ঠিক একই। তাই বাংলা গদ্যের জগৎ রূপরীতির শৃঙ্খলাহীন বৈচিত্র্যে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল। এই বিচ্ছিন্ন বিচিত্র রচনাধারার বিশৃঙ্খল জগতে রূপরীতির শৃঙ্খলাবদ্ধ সামঞ্জস্য বিধানে পরোক্ষভাবে হলেও প্রথম গৌরব ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের।

১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা মে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। (আসলে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্ট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেইদিনই নিয়মাবলী গৃহীত হয়। কিন্তু তখন লর্ড ওয়েলেসলি টিপু সুলতানকে পরাজিত করে ফিরে এসেছে। সেই গৌরবের স্মৃতিকে ধরে রাখতে যদিও ১৮ আগস্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা দিবস তবুও টিপু সুলতানের পরাজয়ের তারিখ ৪ মে ১৭৯৯ কে কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়।) কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ প্রোভোস্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন রেভা. ডেভিড ব্রাউন। পরে ১৮০১-এ বিভাগীয় প্রধান হন রেভা, উইলিয়াম কেরী এবং ১৮৩৪ পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাংলা ও সংস্কৃত বিষয়ের প্রধান পণ্ডিত নিযুক্ত (১৮০১) হন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার। এছাড়া অন্যান্য পণ্ডিত ও মুনশিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রামরাম বসু, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, চণ্ডীচরণ মুনশি প্রমুখ।

এই কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে গভর্নর জেনারেল-এর প্রচারিত নির্দেশ থেকে জানা যায় যে, স্বদেশ থেকে আগত সিভিলিয়ানদের এদেশের ভাষা ও সাহিত্যে শিক্ষিত করা বিদেশী শাসকদের এদেশীয় ভাষা, ইতিহাস ও আচার-আচরণাদির জ্ঞানার্জন করা বাধ্যতামূলক ছিল। তাই এই কলেজের শিক্ষণ ব্যবস্থাকে উপলক্ষ করে বাংলা গদ্য ভাষা গতিশীলতা লাভ করেছিল। আর তা প্রধানত সম্ভব হয়েছিল এই কলেজের বাংলা। সংস্কৃত ভাষার অধ্যক্ষ উইলিয়াম কেরীর ক্লান্তিহীন মৌলিক চেষ্টার ফলে। কেরী নিজে শুধু অনুবাদ কর্মে আত্মনিয়োগ করেননি, পণ্ডিত ও মুনশিদের দিয়ে তিনি গদ্য রচনায় ব্ৰতী হয়েছিলেন। নিম্নে কেরী ও পণ্ডিত-মুনশিদের অনুবাদ কর্মের বৈশিষ্ট্য আলোচিত হল।

উইলিয়াম কেরী (১৭৬১-১৮৩৪)

কেরী কলেজে যোগ দিয়েই উপলব্ধি করেছিলেন পাঠযোগ্য পুস্তকের অভাব সম্বন্ধে। কেরী একজন বিচক্ষণ ভাষাভিজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন এবং বাঙালির মতো অনর্গল বাংলা বলতে ও লিখতে পারতেন। তিনি একজন তন্তুবায়ের সন্তান ছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি বিদ্যার্জন করে স্থানীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গির্জায় কেরানির কাজ করতেন। দারিদ্র্যের জন্য কৃষিকাজ থেকে জুতো সেলাই পর্যন্ত সব কাজ করতেন। কিন্তু এত দারিদ্র্যের মধ্যেও তিনি পণ্ডিতের কাছ থেকে লাতিন ও গ্রীক শিখে নিয়েছিলেন। এরপর সংসারী হয়ে সাধারণ কাজ করেও ফরাসি, ইতালিয়ান, ডাচ প্রভৃতি ভাষা শিখেছিলেন। এ থেকে অনুমান করা যায় ভাষাশিক্ষার প্রতি তার একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ ছিল। নিষ্ঠা ও পরিশ্রম তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। ১৭৮৯-তে পাদ্রী হওয়ার পর তিনি ১৭৯৯-তে কলকাতায় আসেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য। জীবনের বাকি ৪১ বৎসর তিনি ভারতেই কাটিয়েছেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কাজে তিনি প্রথমে পাঁচশত টাকা মাসিক বেতন পেয়েছেন। স্ত্রীবিয়োগ ও পুত্র বিয়োগের দুঃখও তাকে পেতে হয়েছে। ১৩টি প্রধান ভাষার সর্বশব্দকোষ আগুনে পুড়ে গেছে। তবুও খ্রিস্টধর্ম প্রচারে ও বাংলা গদ্যের পথ নির্মাণে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। গোপাল হালদার বলেছেন—“কেরির অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ঐকান্তিক নিষ্ঠার লক্ষ্য যদিও ধর্ম প্রচার, কিন্তু তার ভিত্তি এই বৈজ্ঞানিক চেতনা, বাস্তববুদ্ধি, মানুষ ও পৃথিবীকে জানবার ও চেনবার আগ্রহ।”

ইংরেজি ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ রচনা ছাড়াও কেরীর উল্লেখযোগ্য গদ্য রচনা হল— কথোপকথন (১৮০১) ও ইতিহাসমালা (১৮১২)।

কথোপকথন

কেরীর ‘কথোপকথন’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে। কথোপকথন ইংরেজিতে ‘Dialogues’ বা ‘Colloquies’ নামেও প্রসিদ্ধ। এমনও প্রশ্ন উঠেছে, গ্রন্থটি কেরীর নিজের রচনা কিনা। কারণ কেরীর পক্ষে এ ধরনের বিষয় আয়ত্ত করা সম্ভব ছিল না। তাই কেউ কেউ অনুমান করেন, গ্রন্থটি মৃত্যুঞ্জয়ের রচনা। সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠেছে ইংলন্ডের যে সব বিষয় এই গ্রন্থে আছে তা মৃত্যুঞ্জয়ের জানার কথা নয়। তাহলে মৃত্যুঞ্জয় যদি গ্রন্থটি লিখেও থাকেন, তাহলে তা কেরীর নির্দেশে লিখেছে এবং কেরী শেষপর্যন্ত গ্রন্থটিতে সংশোধন করেছে। তবে এসব অনুমান মাত্র।

‘কথোপকথন’ বাংলা ভাষার কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সমাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য মোট একত্রিশটি অধ্যায়ে রচিত। বিষয়গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—চাকর ভাড়াকরণ, সাহেবের হুকুম, ভোজনের কথা, খাতক মহাজনি, হাটের বিষয়, স্ত্রীলোকের কথোপকথন, স্ত্রীলোকের হাটকরণ, যাজক ও যজমান, জমিদার রাইয়ত ইত্যাদি। গ্রন্থটি একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ—(ক) বাঙালি সমাজ ও পরিবারের অনেক তথ্য এই প্রথম গদ্যে উপস্থাপিত হল। (খ) বিষয় নির্বাচনের দিক থেকে এই গ্রন্থের গুরুত্ব সর্বাধিক। (গ) বাংলা গদ্যকে যোগাযোগ ও যুক্তি-চিন্তার বাহন করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গ্রন্থটির তাৎপর্য যথেষ্ট। (ঘ) সমকালীন সমাজের প্রতিফলনে আলোচ্য গ্রন্থটির একটি সামাজিক তাৎপর্য আছে। (ঙ) সুকুমার সেন এই গ্রন্থের গুরুত্ব সম্বন্ধে বলেছেন—“দেশের নানা অঞ্চলে নানা রকম সামাজিক ও বৈষয়িক ব্যাপারের উপযুক্ত কথনভঙ্গির সহিত বিদেশী শাসকদের পরিচিত করাইবার উদ্দেশ্যে এই সংকলন।” (চ) এই গ্রন্থের ভাষা পরবর্তীকালের প্যারীচাঁদ ও কালীপ্রসন্ন সিংহকে প্রভাবিত করেছিল।

ইতিহাসমালা

কেরীর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ইতিহাসমালা’ প্রকাশিত হয় ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে। ইতিহাস বলতে ‘হিস্টরি’ নয়, গল্প হিসাবে বুঝিয়েছেন কেরী। তাই ইতিহাসমালা’ গল্পের অনুবাদমূলক গ্রন্থ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নানান গল্প এতে স্থান পেয়েছে। এই সংকলনের আখ্যাপত্রে লেখা হয়েছে—“A collection of stories in the Bengali Language collected from various sources.”

গোপাল হালদারের মতে— “ইতিহাসমালা হচ্ছে তাই বাঙলা সাহিত্যের প্রথম গল্প সংকলন, তবে সে সব গল্প মৌলিক সৃষ্টি নয়।’’ এই গ্রন্থের উৎস হল—সংস্কৃত গল্পকথা (বেতাল পঞ্চবিংশতি, হিতোপদেশ, কথাসরিৎসাগর, পঞ্চতন্ত্র ইত্যাদি)। এছাড়া ঈশপের গল্প, নানা দেশী-বিদেশী উপাখ্যান, উপকথা, ছড়া, প্রবাদপ্রবচন, লোকোক্তি, পুরাতন বাংলা সাহিত্য প্রভৃতি থেকে অনেক আখ্যানের উপাদান সংগৃহীত হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোকসাহিত্য ও উপকথার সঙ্গে কোন কোন গল্পের সামান্য সাদৃশ্য রয়েছে।

‘ইতিহাসমালা’র গল্পে মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা যেমন আছে, তেমনি আছে কাম, ক্রোধ, লোভ, কোনো গল্পে স্ত্রীলোকের বিশ্বাসঘাতকতা, কোথাও নারীর নির্জজ্জ কামাচার, মানুষের নীচতা, খল স্বভাব, বঞ্চনা, খুন-জখম-ডাকাতির প্রসঙ্গ। জীবজন্তুর গল্পে মানবেতর প্রাণীরা মানুষের ব্যবহার গ্রহণ করেছে। গ্রন্থটি একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ—(ক) ‘ইতিহাসমালা’র গল্পগুলিতে ছোটগল্পের আমেজ আছে। (খ) এর রচনাভঙ্গিমার পেছনে বাঙালি লেখকদের অবদান যথেষ্ট। (গ) গল্পের সংগ্রাহক হিসাবে কেরীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। (ঘ) লোকযানের কোন কোন ‘মোটিফ্’ এই গ্রন্থে অনুসন্ধান করা দুরূহ নয়। (ঙ) প্রথম বাংলা আখ্যানগ্রন্থ হিসাবে এর গুরুত্ব সমধিক। (চ) সর্বোপরি এগার বছরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গদ্য সৃষ্টি যে কতটা অগ্রসর হতে পেরেছিল ‘ইতিহাসমালা’ তার একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

কেরীর মতো একজন বিদেশী কি অনায়াস পরিশ্রমে ও অনুরাগে বাংলা গদ্যের চর্চায় ব্রতী হয়েছিলেন, তা ভাবলে অবাক লাগে। ‘কথোপকথন’ ও ‘ইতিহাসমালা’ সবটা তার রচনা না হলেও এমন দুটি গ্রন্থ রচনার প্রয়াসের দিক থেকে এবং সেই প্রয়াসকে বাস্তবে রূপদান করার ক্ষেত্রে ধৈর্য, শ্রম ও সর্বোপরি নিষ্ঠা সাংগঠনিক শক্তির প্রশংসা করতেই হয়।

রামরাম বসু (১৭৫৭-১৮১৩)

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অন্যতম পণ্ডিত রামরাম বসু বাংলা গদ্যের উদ্ভবপর্বের বিশিষ্ট রচয়িতা হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। কায়স্থ সন্তান রামরাম বসু কেরীর অন্তরঙ্গ সহচর ছিলেন। তাঁর লেখা ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং এটিই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের জন্য প্রকাশিত প্রথম পাঠ্যপুস্তক। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি হল ‘হরকরা’, ‘জ্ঞানোদয়’, ‘খ্রিস্টসঙ্গীত’, ‘খ্রিস্টবিবরণামৃত, ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’, ‘লিপিমালা’।

রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র

এটি রামরাম বসু রচিত প্রথম মুদ্রিত গদ্যগ্রন্থ (১৮০১)। গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম মৌলিক গ্রন্থ। এতে ইতিহাস, কল্পনা ও জনশ্রুতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এর মূল কাহিনি ইতিহাস আশ্রিত। সমালোচক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন— ‘‘বাঙালির লেখা ইতিহাস সংক্রান্ত প্রথম গদ্যকাহিনি ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ নানা কারণে বাংলা গদ্য ও ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে বিশেষ গুরুত্বসহ আলোচনাযোগ্য।’’

প্রতাপাদিত্য ছিলেন ধূমঘাটের এক প্রবল প্রতাপান্বিত ভূস্বামী। প্রতাপের পূর্বপুরুষ রামচন্দ্র রায় থেকে প্রতাপের পিতা বিক্রমাদিত্য, পিতৃব্য বসন্ত রায় ও প্রতাপের জন্মমৃত্যুর কাহিনি এই নাটকে স্থান পেয়েছে। রামরামের উদ্দেশ্য ছিল প্রতাপাদিত্যের চরিত্রবর্ণনা। রামরাম বিভিন্নভাবে কাহিনির উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। গ্রন্থটি একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ—(ক) গ্রন্থটি প্রথম বর্ণনামূলক গদ্যরচনা। যেমন—“এক সময় রাজা বসন্ত রায় মহারাজা বিক্রমাদিত্যের সম্মুখে কৃতাঞ্জলি করিয়া নিবেদন করিতেছেন, ঠাকুরদাদা মহাশয়, অবধান করুন। আমরা এখানে সর্ববিষয়েই সুখি হইয়াছি।” (খ) আরবি-ফারসি শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার। যেমন—“আপনারদের মধ্যে আত্মকলহ হইয়া বিস্তর বিস্তর ঝকড়া লড়াই কাজিয়া উপস্থিত”। (গ) তৎসম শব্দপ্রধান স্বচ্ছদ সাধু বাংলাগদ্যের রীতি বেশ প্রশংসনীয়। যেমন—‘‘প্রতাপাদিত্য মহারাজা হইলেন। তাহার রাণী মহারাণী। বঙ্গভূমি অধিকার সমস্তই করতলে। এই মত বৈভবে কতকাল গত হয়। রাজা প্রতাপাদিত্য মনে বিচার করেন—আমি একচ্ছত্রী রাজা হইব এদেশের মধ্যে।” (ঘ) এই গ্রন্থে ভাষার ঠাট পুরোপুরি সাধুভাষা, চলিত ও সাধুর মিশ্রণ নেই বললেই চলে। যেমন—“তোমরা কি সকলে পাগল হইয়াছ। মহারাণী কহিলেন ও কি সমাচার। আমার কোন কন্যা অদ্য বিদায় লইতে যায় নাই। রাজা কহিলেন, এই বটে। এই আমার সর্বনাশের সময়।” (ঙ) সুশীলকুমার দে এই গ্রহের ভাষার প্রশংসা করে এর ভাষাকে ‘worst specimen’ বলে চিহ্নিত করেছে। অন্বয় রীতিও সংযত নয়। ভাষার মধ্যে মাঝে মাঝে শৃঙ্খলা ও সংহতির অভাব লক্ষ করা যায়। যদিও  গ্রন্থটি দীর্ঘদিন ধরে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে পঠিত হত। ঐতিহাসিক তথ্যের দিক থেকেই এই গ্রন্থের তাৎপর্য বেশি। তাছাড়া এটি বাঙালি রচিত প্রথম মুদ্রিত গদ্যগ্রন্থ।

লিপিমালা

রামরামের ‘লিপিমালা’ প্রকাশিত হয় ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে। গ্রন্থটি পত্ররচনার ঢঙে রচিত হয়েছে। চিঠির আদলে রাজা পরীক্ষিতের কথা, দক্ষযজ্ঞের কথা, নবদ্বীপে চৈতন্যের কথা, গঙ্গাবতরণের কথা প্রভৃতি কাহিনি বিবৃত হয়েছে। তবে পুরোপুরি পত্রলিখনের রীতি এখানে অনুসৃত হয়নি। সরল বাংলায় সাহেবদের ভাষা শেখাবার জন্য পত্রের আকারে নানা কাল্পনিক ব্যাপার, গালগল্প, পুরাণ, উপকথা, আখ্যায়িকা সংগ্রহ করে চল্লিশটি পত্রে তা সন্নিবেশিত হয়েছে “লিপিমালা’য়। পৌরাণিক কাহিনিকে গ্রন্থে স্থান দেওয়ার ক্ষেত্রে লেখক মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। রামরাম খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হলেও হিন্দুর পুরাণ ও অন্যান্য কাহিনির প্রতি যথেষ্ট অনুরক্ত ছিলেন। ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্রে’র থেকে লিপিমালার ভাষারীতি অনেক সংযত। কোন কোন ক্ষেত্রে ভাষা গুরুগম্ভীর ও কেতাবি ধরনের। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের উপযোগী হাল্কা ও স্বাভাবিক গদ্য রচনার নিদর্শনও যথেষ্ট আছে। অন্বয়রীতি পূর্বের গ্রন্থ অপেক্ষা অনেক মসৃণ। সেজন্য সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন—“লিপিমালার গদ্যরীতি আরও সহজ এবং মুখের ভাষার বেশ কাছাকাছি।”

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা গদ্য রচনার প্রয়াস যাঁদের দ্বারা পুষ্টিলাভ করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হলেন রামরাম বসু। বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক রচনায় এবং প্রথম বাঙালির মুদ্রিত গ্রন্থ রচনায় তার কৃতিত্ব বাংলা সাহিত্যে মুদ্রিত হয়ে রয়েছে।

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার (১৭৬২-১৮১৯)

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠীর লেখকমণ্ডলীর মধ্যে যাঁরা পরবর্তী লেখকদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাহেব, পণ্ডিত ও মুনশিদের মধ্যে পাণ্ডিত্য, মনীষা ও ঔদার্যে মৃত্যুঞ্জয় শ্রেষ্ঠ। বিশেষ করে বাংলা গদ্যের উদ্ভব পর্বে তিনি একজন যথার্থ শিল্পী। তার কৃতিত্ব রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের প্রতিভার ছায়ায় ঢাকা না পড়ে গেলে তিনি একজন অসাধারণ শিল্পী ব্যক্তিত্ব হতে পারতেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সকলেই তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের স্পর্শে সঞ্জীবিত হয়েছিলেন।

ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠার সময় মৃত্যুঞ্জয়ের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি দেশে ছড়িয়ে পড়ায় ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে মাসিক দুইশ’ত টাকা বেতনে উইলিয়াম কেরীর অধীনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলার প্রধান পণ্ডিত নিযুক্ত হন। এখানে অবস্থানকালে তাঁর পাঁচখানি গ্রন্থ রচিত হয়— ‘বত্রিশ সিংহাসন’ (১৮০২), ‘হিতোপদেশ’ (১৮০৮), ‘রাজাবলি’ (১৮০৮), ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ (রচনা ১৮১৩, মুদ্রণ ১৮৩৩), ছদ্মনামে প্রকাশিত ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’ (১৮১৭)। মৃত্যুর পর ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রিত হয়।

বত্রিশ সিংহাসন

গ্রন্থটি মৃত্যুঞ্জয়ের আখ্যায়িকাধর্মী রচনা। কেরীর নির্দেশে মৃত্যুঞ্জয় ‘সিংহাসনদ্বাত্রিংশিকা’ অবলম্বনে ‘বত্রিশ সিংহাসন’ রচনা করেন। এটি ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থ হিসাবে প্রকাশিত হয়। গল্পরসের আকর্ষণে এই গ্রন্থের অনেক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। বত্রিশ সিংহাসনের গল্পের মূলে আছে ইতিহাস ও জনশ্রুতি। আদর্শ রাজা বিক্রমাদিত্যের চরিতকথা, ঔদার্য ও মহানুভবতা বর্ণনা এই বত্রিশটি গল্পের উদ্দেশ্য। এই গ্রন্থের গদ্যরীতির মধ্যে স্বচ্ছতা, শব্দচয়নের মধ্যে ভাব অনুযায়ী ভাষা পরিকল্পনা, বিবৃতিধর্মী সরল কথকতার মতো এই গ্রন্থের গদ্যরীতির স্বতঃস্ফূর্ত রসাবেদন লক্ষ করা যায়। গ্রন্থের ভাষা বিচিত্রচারী। সংস্কৃত বাক্যবিন্যাস নীতি দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। অতি দীর্ঘ বাক্য, অতিরিক্ত সংস্কৃত বাহুল্য, বেশি অসমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহার মাঝে মাঝে রসভঙ্গের কারণ হয়েছে। তা সত্তেও সংস্কৃত সাহিত্যের পতনের যুগে এ ধরনের সংস্কৃত আখ্যান ও একযুগের সমাজচিত্রের চিত্রণে গ্রন্থটির তাৎপর্য যথেষ্ট। এক সময়ের ভ্রষ্ট জীবনই গাঢ়তর বর্ণে চিত্রিত হয়েছে। গল্পরস পরিবেশনের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থের তাৎপর্য রয়েছে।

হিতোপদেশ

এটি একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এই গ্রন্থ প্রকাশের পূর্বে গোলোকনাথ শর্মার হিতোপদেশ প্রকাশিত হলেও কেরী মৃত্যুঞ্জয়ের গ্রন্থকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলিকে লেখক অনুবাদ করেছে। নীতি-উপদেশযুক্ত এই আখ্যানগ্রন্থ বিদেশীদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল। এর কাহিনিগুলি বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক। পশুপাখির মুখে অবিকল মানুষের ভাষা বসিয়েছেন তিনি। কোথাও রঙ্গকৌতুক, কোথাও উপদেশ, কোথাও বা নিছক বর্ণনা গ্রন্থটিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। তবে হিতোপদেশের কোথাও কোথাও আদিরস ও অশ্লীলতা স্থান পেয়েছে। হিতোপদেশের ভাষা সংস্কৃত-গন্ধী। ভাষার মধ্যে স্বাভাবিক অন্বয়রীতি থাকলেও ভাষাভঙ্গির মধ্যে রয়েছে গুরুভার। বাংলা সাধু গদ্যরীতিকে তৎসম শব্দযুক্ত প্রসাদগুণ বিশিষ্ট ধীর গম্ভীর অন্বয়ের মধ্যে স্থাপন করেছিলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন, সাধু বাংলা গদ্যের রীতির জন্য সংস্কৃতের আদর্শই অনুসরণ করা উচিত।

রাজাবলি

হিন্দু যুগ, মুসলমান শাসক ও ইংরেজ আমলের ইতিহাস অবলম্বনে ‘রাজাবলি’ রচিত। সজনীকান্ত দাস যথার্থই বলেছেন—“বাংলা ভাষার ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম ধারাবাহিক ইতিহাস তাহাতে সন্দেহ নাই” (বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস)। বাঙালির লেখা ভারতের কোন ধারাবাহিক ইতিহাস না থাকায় সম্ভবত কেরী মৃত্যুঞ্জয়কে দিয়ে এই গ্রন্থ রচনা করিয়েছিলেন। মৃত্যুঞ্জয় ‘রাজাবলি’র প্রথমেই ভারতীয় পুরাণ অনুসারী ইতিহাসের যুগবিভাগ করেছেন ও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও ভূগোলের পরিচয় দিয়েছেন। মুসলমান শাসনের যেমন আকবর, জাহাঙ্গীর, নূরজাহান ও সাজাহানের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই গ্রন্থে ইতিহাসের উপাদান যতটা তার চেয়ে বেশি রয়েছে জনশ্রুতি। ‘রাজাবলি’র ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি সহজ এবং জটিলতা বর্জিত। তবে সংস্কৃত বাক্যরীতি অনুসরণের জন্য ভাষা অনেকটা গুরুভার। লেখক যথাসাধ্য আভিধানিক ও অপ্রচলিত শব্দ বর্জন করেছেন। ভাষা বিবরণধর্মী বলে বেশি সহজবোধ্য হতে পেরেছে। ‘রাজাবলি’র বিষয়বস্তুই চিত্তাকর্ষক নয়, তার পরিচ্ছন্ন গদ্যভাষা বেশ হৃদয়গ্রাহী।

প্রবোধচন্দ্রিকা

‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ মৃত্যুঞ্জয়ের অন্যতম রচনা। গ্রন্থটি মূলত সংকলন গ্রন্থ। সংস্কৃত ব্যাকরণ, অলঙ্কার, নীতিশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণ প্রভৃতি থেকে মৃত্যুঞ্জয় নানা ধরনের উপাখ্যান ও রচনারীতি সংগ্রহ করেছে। সেইসঙ্গে লৌকিক কাহিনিও সন্নিবেশ করেছে। গ্রন্থটিতে লেখকের ভাষাজ্ঞান, রচনারীতি, উন্নত মানসিকতা, দার্শনিকতা ও সহজ সরল কৌতুকের পরিচয় রয়েছে। গ্রন্থটি তিনি লিখেছিলেন উত্তম গৌড়ীয় ভাষাতে সাহেবদের শিক্ষা দিতে।

‘বেদান্তচন্দ্রিকা’ ও ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’ মৃত্যুঞ্জয়ের স্বাধীন রচনা। রামমোহনের ‘বেদান্তগ্রন্থ’, ‘বেদান্তসার’ প্রকাশিত হওয়ার দু’বছর পরে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত। রামমোহনের উক্ত দুটি গ্রন্থ পণ্ডিত সমাজে আলোড়ন তোলায় তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুঞ্জুয় ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’ রচনা করেন এবং রামমোহন তার উত্তরও দেন।

সজনীকান্ত দাস মৃত্যুঞ্জয়কে একজন যথার্থ শিল্পী বলে অভিহিত করলেও রামগতি ন্যায়রত্ন ও দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ মৃত্যুঞ্জয়ের গদ্যের সমালোচনা করেছেন। মৃত্যুঞ্জয়ের গদ্যরীতির বিশ্লেষণ করলে আমরা তার মধ্যে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করি—(এক) সংস্কৃতানুসারী গুরুগম্ভীর মন্থর শব্দসজ্জা ও অন্বয় তাঁর গদ্যরীতির প্রথম পর্বে আছে। (দুই) পরিচ্ছন্ন সাধু গদ্য রীতি যেটি আধুনিক বাংলা গদ্যের মূল ভিত্তিরূপে সে সময়ে পরিচিত ছিল সেই সাধু গদ্যরীতির পরিচ্ছন্নতাও মৃত্যুঞ্জয়ের বৈশিষ্ট্য। (তিন) লঘু-কৌতুকপ্রবণ গ্রাম্য ভাষা ভঙ্গিমাকেন্দ্রিক বাক্য প্রয়োগ মৃত্যুঞ্জয়ের বাস্তব জীবননিষ্ঠা ও ভাষাকে জীবনানুগ করার পরিচয় বহন করে। (চার) গদ্যরীতির মধ্যে নাটকীয় শৈলী প্রয়োগ করে তিনি বলিষ্ঠ প্রাণচেতনার পরিচয় দিয়েছেন।

গোলোকনাথ শর্মা

কেরী, রামরাম, মৃত্যুঞ্জয় ছাড়া ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকগোষ্ঠীতে অনেক লেখক ছিলেন। এই লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথমে যার নাম করতে, তিনি হলেন গোলোকনাথ শর্মা। ইনি মূলত অনুবাদক ছিলেন। তাঁর অনুদিত ‘হিতোপদেশ’ ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। মৃত্যুঞ্জয়ের উক্ত গ্রন্থের থেকে গোলোকনাথের এই গ্রন্থটি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। হিতোপদেশের চারটি উপদেশ— মিত্রলাভ, মিত্রভেদ, সন্ধি, বিগ্রহ তিনি সংক্ষেপে অনুবাদ করেন। রামরাম ও মৃত্যুঞ্জয়ের তুলনায় গোলোকনাথের অনুবাদের ভাষা সহজবোধ্য সরল বাংলায় লেখা।

তারিণীচরণ মিত্র

তারিণীচরণ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হিন্দি বিভাগের মুনশি ছিলেন। তারিণীচরণ মিত্র ঈশপের গল্পের অনুবাদক এবং ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির পাঠ্যগ্রন্থের লেখকরূপে বেশি পরিচিত ছিলেন। তাঁর বাংলা, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। তাঁর রোমক হরফে ভারতীয় ছয়টি ভাষায় অনুবাদ গ্রন্থ ‘দি ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট’ উল্লেখযোগ্য। বিষয়বস্তু ছিল ঈশপের ও অন্যান্য গল্পের। আলোচ্য গ্রন্থটি বাংলা, ফরাসি ও হিন্দুস্থানী ভাষায় অনুদিত হয়। এই গ্রন্থ অনুদিত হলে কলেজের শ্বেতাঙ্গ ছাত্রদের সুবিধা হয়েছিল। বাংলা ভাষাতে তারিণীচরণের যথেষ্ট দক্ষতা ছিল, ইংরেজি থেকে তিনি যেভাবে অনুবাদ করেছেন তাতে প্রায় কোথাও বাংলার স্বাভাবিকতা ক্ষুণ্ন হয়নি।

চণ্ডীচরণ মুনশি

১৮০১ খ্রিস্টাব্দে চণ্ডীচরণ মুনশি কলেজে যোগদান করেন। তোতা ইতিহাস অনুবাদের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন। এটি ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ‘তোতা ইতিহাস’ ফারসি গল্প গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ। চণ্ডীচরণ ফারসি ‘তুতিনামা’র বাংলা অনুবাদ করেন। তাঁর এই গ্রন্থটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। এমনকি লন্ডন থেকেও এর সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আলিফ-লায়লার অনুকরণে এটি লেখা। এর ভাষা পরিচ্ছন্ন ও স্বাভাবিক। এর ভাষায় গ্রাম্যতা ও আদি রস নেই। ‘তোতা ইতিহাস’ শুকসপ্ততি জাতীয় গল্প সংকলন হলেও, নারী-পুরুষের গোপন কথা এতে থাকলেও তার মধ্যে কোথাও অশ্লীলতা নেই।

রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়

রাজীবলোচন এই কলেজের পণ্ডিত ছিলেন। মাসিক চল্লিশ টাকা বেতনে তিনি কেরীর বাংলা বিভাগে সহকারী পণ্ডিতরূপে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে নিযুক্ত হন। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র চরিত্রং’ প্রকাশিত হয়। ভারতচন্দ্রের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে আদর্শ পুরুষ চিত্রিত করেছেন। গঠনভঙ্গির দিক থেকে তাঁর গদ্যরচনা সে যুগের অন্যান্য রচনার তুলনায় সরল, আর সেই কারণেই মনে হয় বাক্য গঠনেও তিনি বিশুদ্ধতা আনতে পেরেছে।

রপ্রসাদ রায়

হরপ্রসাদের ‘পুরুষপরীক্ষা’ ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বিদ্যাপতির ১৪১০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে সংস্কৃত গদ্যে যে পুরুষপরীক্ষা’ রচনা করেছিলেন, কেরীর নির্দেশে তিনি তা অনুবাদ করেন। ভাষার ক্ষেত্রে তিনি রক্ষণশীল ছিলেন না। তাঁর রচনার ঢঙ একটু গম্ভীর ও ভারী হলেও বাংলা স্বাভাবিক গদ্য ভাষার সঙ্গে তাঁর ভাষা অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গেছে।

কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন

আড়িয়াদহ গ্রামনিবাসী কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন ১৮১৩ থেকে ১৮২৪ পর্যন্ত এই কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি হল—‘পাষণ্ড পীড়ন’—রামমোহনের বিরুদ্ধে বাদ-প্রতিবাদের উত্তর (১৮২৩), ‘পদার্থকৌমুদী’ (১৮২১), ‘আত্মতত্ত্বকৌমুদী’ (১৮২২), সাধুসন্তোষিণী’ (১৮২৬), শ্যামাসন্তোষিণী (১৮৩৪-৪৫) ইত্যাদি।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের আওতায় আরো নানা পুস্তক প্রকাশিত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। সে যাই হোক, কেরী, রামরাম ও মৃত্যুঞ্জয় এঁরা ছিলেন এই কলেজের প্রধান তিন স্তম্ভ। কেরীর দূরদর্শিতা, রামরামের স্বকীয়তা, মৃত্যুঞ্জয়ের পাণ্ডিত্য বাংলা গদ্যের উদ্ভবপর্বে গদ্য রচনার পথকে যেভাবে সুগম করেছিল তার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠীর অবদান বাংলা গদ্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!