বাংলা ভাষার উৎস, ইতিহাস ও যুগবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা কর।
বাংলা ভাষার উৎস, ইতিহাস ও যুগবিভাগ
সারা পৃথিবীর প্রায় চার হাজার ভাষাকে তাদের মূলীভূত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে প্রধানত তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের পদ্ধতির সাহায্যে এই ক’টি ভাষাবংশে (Language Families) বর্গীকৃত করা হয়েছে— (১) ইন্দো-ইউরোপীয় বা আর্য (Indo-European or Aryan), (২) সেমীয় হামীয় (Semito-Hamitic), (৩) বান্টু (Bantu), (৪) ফিন্নো-উগ্ৰীয় (Finno-Ugrian), (৫) তুর্ক-মোঙ্গোল-মাঞ্চু (Turk-Mongol-Manchu, (৬) ককেশীয় (Caucasian), (৭) দ্রাবিড় (Dravidian), (৮) অস্ট্রিক (Austric), (৯) ভোটচীনীয় (Sino-Tibetan), (১০) উত্তর-পূর্ব সীমান্তীয় (Hyperborean), (১১) এসকিমো (Esquimo), (১২) আমেরিকার আদিম ভাষাগুলি (American Indian Languages) ইত্যাদি।
এইসব ভাষাবংশের মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয় বা মূল আর্য ভাষাবংশটি নানা কারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এই ভাষাবংশ থেকে জাত আধুনিক ভাষাগুলি পৃথিবীর বহু অঞ্চলে— দুই বিশাল মহাদেশ ইউরোপ ও এশিয়ার অনেকাংশে প্রচলিত আছে। দ্বিতীয়ত শুধু ভৌগোলিক বিস্তারে নয়, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে এই ভাষাবংশ থেকে জাত প্রাচীন ও আধুনিক ভাষাগুলি পৃথিবীতে প্রাধান্য লাভ করেছে। এই বংশের প্রাচীন ভাষা সংস্কৃত, গ্রীক ও লাতিন পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রাচীন ভাষা। বৈদিক সংহিতার সূক্তগুলি সংস্কৃতের মহাকবি ব্যাস বাল্মীকির মহাভারত রামায়ণ, কালিদাসের কাব্যনাটকাদি, গ্রীকের মহাকবি হোমারের ইলিয়দ-অদিসি, লাতিন কবি ভার্জিলের ইনিদ ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের প্রাচীন সাহিত্যকীর্তি। এই বংশের আধুনিক ভাষাগুলির মধ্যে ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, ইতালীয়, বাংলা প্রভৃতি ভাষা সাহিত্যসৃষ্টিতে এত বেশি সমৃদ্ধ যে ইংরেজ কবি-নাট্যকার শেক্সপীয়র, জার্মান কবি-নাট্যকার গ্যেটে, শীলার, কবি রিলকে, ফরাসি সাহিত্যিক ভলতেয়র, মলেয়র, মালার্মে, ভালেরি, ইতালীয় কবি পেত্রার্ক, দান্তে, নন্দনতত্ত্ববিদ ক্রোচে আর বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথের অবদান এখন কোনো ভাষাবিশেষের বা ভাষাবংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যেরই সম্পদ রূপে বিবেচিত। বাংলা ভাষার গর্ব এই যে, বাংলা ভাষা এই সমৃদ্ধ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশেরই একটি ভাষা।
ইন্দো-ইউরোপীয় বা মূল আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী তাদের আদি বাসস্থান দক্ষিণ রাশিয়ার উরাল পর্বতের পাদদেশ থেকে আনুমানিক ২৫০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের কাছাকাছি সময় থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে। এই বিস্তারের পরে তাদের ভাষায় ক্রমশ আঞ্চলিক পার্থক্য বৃদ্ধির ফলে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে প্রথমে দশটি প্রাচীন ভাষা বা প্রাচীন শাখার জন্ম হয়। এগুলি হল— (১) ইন্দো-ইরানীয় (Indo-Iranian), (২) বান্তো-স্লাবিক (Balto-Slavic), (৩) আলবানীয় (Albanian), (৪) আর্মেনীয় (Armenian), (৫) গ্রীক (Greek), (৬) ইতালিক বা লাতিন (Italic/ Latin), (৭) টিউটনিক বা জার্মানিক (Teutonic/Germanic), (৮) কেলতিক (Celtic), (৯) তোখারীয় (Tokharian) এবং (১০) হিত্তীয় (Hittite)।
সতমগুচ্ছের শাখাগুলির মধ্যে প্রাচীন সাহিত্যে বিশেষ সমৃদ্ধ হল ইন্দো-ইরানীয় শাখা। মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার যে শাখাটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ভারতবর্ষ ও ইরানে প্রবেশ করে সেই শাখাটিকেই ইন্দো-ইরানীয় শাখা বলা হয়। এই শাখার লোকেরা নিজেদের ‘আর্য’ বলে গর্ব করতেন। ‘আর্য’ শব্দটি সংকীর্ণ অর্থে এই শাখাটিকে বোঝাবার জন্যে কখনো কখনো ব্যবহৃত হয় কিন্তু ব্যাপক অর্থে ‘আর্য’ শব্দে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা ও ইন্দো-ইউরোপীয় জাতিকেই বোঝায়)।
ইন্দো-ইরানীয় শাখাটি দুটি উপশাখায় বিভক্ত হয়ে যায়— ইরানীয় (Iranian) ও ভারতীয় আর্য (Indo-Aryan)। ইরানীয় উপশাখাটি ইরান-পারস্যে চলে যায়। তার প্রাচীনতম সাহিত্যকীর্তি হল ‘আবেস্তা’ (Avesta) নামক ধর্মগ্রন্থ (৮০০ খ্রিঃপূঃ)। আর ভারতীয় আর্য উপশাখাটি ভারতে প্রবেশ করে আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে। সেদিন থেকে ভারতীয় আর্যভাষার ইতিহাসের সূচনা এবং আজ পর্যন্ত এই আর্যভাষা নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে বিকাশ লাভ করে চলেছে। যীশুখ্রীস্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে থেকে যীশুখ্রীস্টের জন্মের পরে প্রায় দু’হাজার বছর পর্যন্ত ভারতীয় আর্য ভাষার এই প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাসকে বিবর্তনের স্তরভেদে প্রধানত তিনটি যুগে ভাগ করা যায়। যেমন—
(১) প্রাচীন ভারতীয় আর্য (Old Indo-Aryan = OIA):
আনুমানিক ১৫০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ৬০০ খ্রিঃ পূঃ পর্যন্ত। এ যুগের আর্যভাষার নাম দিতে পারি—বৈদিক ভাষা বা ব্যাপক অর্থে সংস্কৃত ভাষা। এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ঋগ্বেদ সংহিতা।
(২) মধ্য ভারতীয় আর্য (Middle Indo-Aryan = MIA):
আনুমানিক ৬০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ যুগের আর্যভাষার নাম পালি প্রাকৃত-অপভ্রংশ। অশোকের শিলালিপির প্রাকৃত, সংস্কৃত নাটকে ব্যবহৃত প্রাকৃত, জৈন ধর্মগ্রন্থে ও কিছু স্বতন্ত্র রচনায় ব্যবহৃত প্রাকৃত, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে ব্যবহৃত পালি এ যুগের ভাষার নিদর্শন।
(৩) নব্য ভারতীয় আর্য (New Indo-Aryan = NIA):
আনুমানিক ৯০০ খ্রস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। বিভিন্ন নব্য ভারতীয় আর্যভাষার নাম— বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, পঞ্জাবি, অবধী ইত্যাদি। নানা সাহিত্যগ্রন্থ ও আধুনিক ভারতীয় আর্যদের মুখের ভাষাই এর নিদর্শন।
প্রাচীন ভারতীয় আর্যের দুটি রূপ ছিল— সাহিত্যিক (বৈদিক ভাষা বা ছান্দস ভাষা) ও কথ্য। কথ্য রূপটির চারটি আঞ্চলিক উপভাষা ছিল—প্রাচ্য, উদীচ্য, মধ্যদেশীয় ও দাক্ষিণাত্য। এই কথ্য উপভাষাগুলি লোকমুখে স্বাভাবিক পরিবর্তন লাভ করে যখন প্রাকৃত ভাষার রূপ নিল তখন মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার যুগ সূচিত হল। প্রাকৃতের প্রথম স্তরে তার চারটি আঞ্চলিক কথ্য উপভাষা ছিল। প্রাচীন ভারতীয় আর্যের কথ্য রূপগুলি থেকে প্রাকৃতের এই কথ্য উপভাষাগুলির জন্ম এইভাবে অনুমান করতে পারি—প্রাচ্য থেকে প্রাচ্যা (Eastern) প্রাকৃত ও প্রাচ্য-মধ্যা (East-Central) প্রাকৃত, উদীচ্য থেকে উত্তর-পশ্চিমা (North-Western) প্রাকৃত এবং মধ্যদেশীয় ও দাক্ষিণাত্য থেকে পশ্চিমা বা দক্ষিণ-পশ্চিমা (South-Western) প্রাকৃত। প্রাকৃত ভাষা বিবর্তনের দ্বিতীয় স্তরে যখন পদার্পণ করল তখন মূলত এই চার রকমের মৌখিক প্রাকৃত থেকে পাঁচ রকমের সাহিত্যিক প্রাকৃতের জন্ম হল। যেমন—উত্তর-পশ্চিমা থেকে পৈশাচী, পশ্চিমা বা দক্ষিণ-পশ্চিমা থেকে শৌরসেনী ও মাহারাষ্ট্রী, প্রাচ্যমধ্যা থেকে অর্ধ-মাগধী এবং প্রাচ্যা থেকে মাগধী। পৈশাচী, মাহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, অর্ধ-মাগধী ও মাগধী ছিল শুধু সাহিত্যে ব্যবহৃত প্রাকৃত। প্রাকৃতের বিবর্তনের তৃতীয় স্তরে এইসব সাহিত্যিক প্রাকৃতের ভিত্তিস্থানীয় তাদের কথ্যরূপগুলি থেকে অপভ্রংশের জন্ম হল এবং অপভ্রংশের শেষ স্তরে পেলাম অবহটঠ। প্রত্যেক শ্রেণীর প্রাকৃত থেকে সেই শ্রেণীর অপভ্রংশ-অবহট্ঠের জন্ম হয়েছিল। যেমন-পৈশাচী প্রাকৃত > পৈশাচী অপভ্রংশ-অবহটঠ, মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃত > মাহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ-অবহটঠ, শৌরসেনী প্রাকৃত > শৌরসেনী অপভ্রংশ অবহটঠ, অর্ধমাগধী প্রাকৃত > অর্ধমাগধী অপভ্রংশ-অবহটঠ, এবং মাগধী প্রাকৃত > মাগধী অপভ্রংশ-অবহটঠ। মধ্য ভারতীয় আর্যের শেষ স্তরে যে পাঁচ রকমের অপভ্রংশ-অবহটঠ অনুমিত হয়েছে, তাদের মধ্যে সবগুলির লিখিত নিদর্শন পাওয়া যায়নি, শুধু শৌরসেনী অপভ্রংশের সমৃদ্ধ সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া গেছে।
অপভ্রংশ-অবহটঠের পরে ভারতীয় আর্যভাষা তৃতীয় যুগে পদার্পণ করল (আঃ ৯০০ খ্রিঃ)। তখন এক-একটি অপভ্রংশ-অবহট্ঠ থেকে একাধিক নব্য ভারতীয় আর্যভাষা জন্ম লাভ করল। যেমন—পৈশাচী অপভ্রংশ-অবহটঠ থেকে পঞ্জাবি ইত্যাদি; মাহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ-অবহটঠ থেকে মারাঠি ইত্যাদি, শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহটঠ থেকে হিন্দি ইত্যাদি, অর্ধমাগধী অপভ্রংশ-অবহটঠ থেকে অবধী ইত্যাদি এবং মাগধী অপভ্রংশ-অবহটঠ থেকে বাংলা ইত্যাদি ভাষার জন্ম হল।
আনুমানিক ৯০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাগধী অপভ্রংশ-অবহটঠ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয় এবং একটি নব্য ভারতীয় আর্যভাষারূপে বাংলা ভাষা এখনো জীবন্ত রয়েছে। আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষার বিবর্তনের প্রায় এক হাজার বছরের ইতিহাসকে আমরা মোটামুটিভাবে এই তিনটি যুগে ভাগ করতে পারি—
(১) প্রাচীন বাংলা (Old Bengali = OB)
আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই পর্বের বাংলা ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের রচিত চর্যাগীতিতে, ‘অমরকোষে’র সর্বানন্দ রচিত টীকায় প্রদত্ত চার শতাধিক বাংলা প্রতিশব্দে, বৌদ্ধ কবি ধর্মদাস রচিত ‘বিদগ্ধ মুখমণ্ডন’ গ্রন্থে উৎকলিত দু’চারটি বাংলা কবিতায় এবং ‘সেক-শুভোদয়া’য় উদ্ধৃত গানে ও ছড়ায়। এ যুগের বাংলা ভাষার প্রধান বিশেষত্ব ক্ষতিপূরণ দীর্ঘীভবন (ধর্ম > ধম্ম > ধাম), পদান্তিক স্বরধ্বনির স্থিতি (ভণতি > ভণই), য়-শ্রুতি ও ব-শ্রুতি (নিকটে > নিয়ড্ডী) প্রভৃতি।
সঠিক বিচারে বলা যায় প্রাচীন বাংলার বিস্তৃতিকাল আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আর ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালপর্বের মধ্যে রচিত বাংলা ভাষার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি; সেইজন্যে এই পর্বটিকে অনুর্বর পর্ব বা অন্ধকারাচ্ছন্ন পর্ব বলা যায়। এই পর্বটিকে প্রাচীন যুগ না মধ্যযুগের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ কোনো নিদর্শন না পাওয়ার ফলে এই পর্বের বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য আমরা নির্ণয় করতে পারি না।
(২) মধ্য বাংলা (Middle Bengali = MB)
আনুমানিক ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। বাংলা ভাষার এই মধ্যপর্বের বিস্তার সুদীর্ঘ প্রায় চার শ’ বছর। এই চার শ’ বছরের দীর্ঘ পর্বটিকে দুটি উপ-পর্বে ভাগ করা হয়— (ক) আদিমধ্য (Early Middle Bengali): আনুমানিক ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র রচনাকাল বিতর্কিত হলেও মোটামুটিভাবে এই রচনাটিকেই আদিমধ্য পর্বের বাংলা ভাষার একমাত্র নিদর্শন রূপে ধরা হয়। এই পর্বের বাংলা ভাষার প্রধান বিশেষত্ব আকারের পরবর্তী ইউ ধ্বনির ক্ষীণতা (বড়াই > বড়াই), সর্বনামের কর্তৃকারকের বচনে ‘রা’ বিভক্তি (আহ্মারা = আমরা), ‘ইল’ যোগে অতীত কালের ও ‘ইব’ যোগে ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়ারূপ (শুনিলোঁ, করিবোঁ), আছ ধাতু যোগে যৌগিক কালের পদ (লই + (আ)ছে > লইছে), পাদাকুলক-পঙ্কুটিকা ছন্দ থেকে বহুপ্রচলিত পয়ার ছন্দের সৃষ্টি, ইত্যাদি। (খ) অন্ত্যমধ্য বাংলা (Late Middle Bengali): আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ। এই উপপর্বের ভাষার সমৃদ্ধ নিদর্শন মঙ্গলকাব্যের বিভিন্ন ধারা, বৈষ্ণব সাহিত্য রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবতের অনুবাদ ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। এই সময়ের বাংলা ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য একক ব্যঞ্জনের পরবর্তী পদান্তিক স্বরধ্বনির লোপ-প্রবণতা (রাম > রাম্), মধ্যস্বরের লোপের ফলে। দ্বিমাত্রিকতা (ভাবনা > ভাবনা, গামাোছা > গামছা), অপিনিহিতি (কালি > কাইল, করিয়া > কইর্যা), বিশেষ্যের কর্তৃকারকের বহুবচনে ‘রা’ বিভক্তি, নামধাতুর ব্যবহার (নমস্কার > নমস্কারিলা), আরবি-ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ও বৈষ্ণব কবিতায় ব্রজবুলি ভাষার ব্যবহার ইত্যাদি।
(৩) আধুনিক বাংলা (New Bengali = NB)
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। বাঙালির মুখের বাংলা ভাষাই এই পর্বের বাংলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এই পর্বের বাংলার নিদর্শন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকবৃন্দের ও খ্রিস্টান মিশনারীদের রচিত বাংলা গ্রন্থ, রামমোহন-বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র-মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র প্রভৃতি সাহিত্যিকের রচনায় পাওয়া যায়। কিন্তু এইসব সাহিত্যিকের রচনায় বাংলার জনসাধারণের মুখের ভাষার নিদর্শন সর্বক্ষেত্রে পাওয়া যায় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা সাহিত্যিক ভাষামাত্র। আধুনিক কালের বাঙালির মুখের ভাষার প্রধান পাঁচটি আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষাগুচ্ছ আছে। সেগুলি হল— মধ্য পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা ‘রাঢ়ী’, দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তবঙ্গের (ও অংশত বিহারের) উপভাষা ‘ঝাড়খণ্ডী’, উত্তরবঙ্গের উপভাষা ‘বরেন্দ্রী’, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের উপভাষা ‘বঙ্গালী’ এবং উত্তর-পূর্ব বঙ্গের উপভাষা ‘কামরূপী’ বা ‘রাজবংশী’। এগুলির মধ্যে গঙ্গাতীরবর্তী তথা কলকাতার নিকটবর্তী পশ্চিম বাংলার রাঢ়ী উপভাষার উপরে ভিত্তি করে এখন শিক্ষিত জনের সর্বজনীন আদর্শ চলিত বাংলার (Standard Colloquial Bengali) রূপ গড়ে উঠেছে। আধুনিক বাংলা ভাষার দুটি প্রধান বিশেষত্ব হল সাহিত্যে ব্যবহৃত সাধুভাষা থেকে চলিত ভাষার স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সাহিত্যে গদ্যরীতির ব্যাপক ব্যবহার। এ যুগের চলিত বাংলার প্রধান বিশেষত্ব হল— অভিশ্রুতি (করিয়া > কইর্যা > করে), স্বরসঙ্গতি (দেশী > দিশি), বহুপদী ক্রিয়া রূপ (গান করা, জিজ্ঞাসা করা), ফারসি ‘ব’ (wa) থেকে আগত ‘ও’-এর সংযোজক অব্যয়রূপে ব্যবহার (রাম ও শ্যাম), বহু ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ (চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি), নতুন নতুন ছন্দোরীতি এবং গদ্যচ্ছন্দের সাম্প্রতিক প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।
Leave a Reply