//
//

বাউল সঙ্গীত সম্পর্কে আলোচনা কর।

বাউল সঙ্গীত

বাংলার গ্রামীণ-লোক জীবন ও সংস্কৃতির সাথে যারা কম বেশি পরিচিত, ‘বাউল’ শব্দটি শুনলেই তাদের মানসচোখে ভেসে ওঠে সাদা অথবা গেরুয়া কাপড়ে একতারা হাতে গান গেয়ে চলা কোন ব্যক্তির ছবি। বাউল বললেই মনে হয় নির্লিপ্ত আত্মমগ্ন কোন সাধকের কথা যে কিনা বসে আছে কোন এক পরমাত্মার সাথে মিলনের অপেক্ষায়। যে জানে না ‘মিলন হবে কতদিনে’ তার মনের মানুষের সনে: যার সমগ্রজীবনের একমাত্র প্রার্থনা ‘পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে’। এই বাউলদের রূপ বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—

দেখেছি একতারা-হাতে চলেছে গানের ধানা বেয়ে

মনের মানুষের সন্ধান করবার

গভীর নির্জন পথে।

বাউলরা হল সাধনাভিত্তিক এক সম্প্রদায়। ‘‘বাউলরা অজ্ঞাত মর্মের অনুসন্ধান ও উপলব্ধি করিতে গিয়া, হৃদ-বিহারী অচিন পাখিকে ধরিতে চেষ্টা করিয়া অন্তরতম মনের মানুষকে মর্ম দিয়া বুঝিতে চেষ্টা করিয়া, দরদী সাঁই-এর প্রেমময় পরশ লাভ করিতে ইচ্ছা করিয়া যে পথ অবলম্বন করিয়াছে, তাহা বঙ্গীয় চিন্তা জগতের সম্পূর্ণই স্বাধীন পথ। এ পথ বাঙালির নিজস্ব পথ; এপথে চলিতে চলিতে বাংলা মায়ের ভিজা মাটির গন্ধ পাওয়া যায়।’’ বাউলদের মধ্যে দুটো শ্রেণী দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমটি হচ্ছে গৃহত্যাগী বাউল এবং অন্যটি হচ্ছে গৃহী বা সংসারী বাউল। গৃহত্যাগী বাউলেরা গুরুর নিকট ভেক বা খিলাফত-এর দীক্ষা নেয়। এদেরকে ভেকধারী বাউলও বলা হয়। তবে বাউলদের মধ্যে এদেরকে বলা হয় ‘জ্যান্তে মরা’। আর গৃহী বা সংসারী বাউলেরা সাধারণ মানুষের মতই স্ত্রী-পুত্র পরিজনসহ সাধারণ জীবন যাপন করে। এরা নানাবিধ পেশায় নিয়োজিত থাকে। গৃহী বাউলরা ভেকধারী বাউলের কাছ থেকে দীক্ষা নেয়। এদের সম্পর্ক অনেকটা পীর-মুরিদের মতো। বাউলমত গুরুমুখী মতবাদ। বাউলদের ‘ঘর’ বা গুরুধারা একেকজন বাউলগুরুর নামানুসারে নির্দিষ্ট হয়। যেমন: লালনশাহী পাঞ্জু শাহী, পাঁচু শাহী, দেলবর শাহী ইত্যাদি। বাউল ধর্মে কোন লিখিত শাসন নেই। এটা হলো গুরুমুখী বিশ্বাস ও ধর্মাচার। যেখানে গুরুর মৌখিক নির্দেশ এবং গানই একমাত্র অবলম্বন। উল্লেখ্য যে বাউল মত ও দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়নের একটি বড় ভিত্তি হিসাবে বাউল দর্শনের শ্রেষ্ঠ রূপকার বাউল সঙ্গীতকে মূল্যায়ন করা হয়। এ প্রেক্ষিতে বাউল গানকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়—দৈন্যপদ এবং করণ পদ। দৈন্য পদ যেমন—

আর আমারে মারিস নে মা
বলি মা তোর চরণ ধ’রে
ননী চুরি আর করবো না।

দৈন্যপদ সাধারণ গীতিকথা। এখানে কোন গূঢ়তত্ত্ব নেই। বাউল গানের মূল দর্শন বা তত্ত্ব লুকায়িত আছে করণ পদে। করণ পদের উদাহরণ—

আপন ঘরের খবর নে-মা
অনাশে দেখতে পাবি
কোনখানে সাঁইর বারামখানা।

তাই বাউলদর্শন বিশ্লেষণের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে করণ পদের বিশ্লেষণ।

বাউল মত: উদ্ভব, প্রকৃতি ও বাস্তবতা

বাউল ধর্মমতের প্রকৃতি নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। উদ্ভবকাল নিয়ে কিছুটা সংশয়ের পরও নিঃসংকোচেই বলা যায় যে, প্রায় অর্ধ-সহস্রাব্দ সময় জুড়ে বাউলরা বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিতে অস্তিত্বশীল। ষোড়শ শতকের বাংলা সাহিত্যে বহুস্থানে সচেতন ভাবে ‘বাউল’ শব্দের ব্যবহার হতে দেখা যায়। কিন্তু একটি সম্প্রদায় হিসাবে সমাজ কাঠামোয় বাউলদের বিকাশ ঠিক কবে থেকে তা নিয়ে অস্পষ্টতা যেমন আছে গবেষকদের মধ্যে মতভেদও রয়েছে। তবে বর্তমান সমাজকাঠামোয় বাউলদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বহুদিন থেতেই স্বীকৃত। প্রসিদ্ধ একজন গবেষকের ভাষায়, “বাংলার বাউল, বাউল সাধক, বাউল তত্ত্ব ও ধর্মমত, বাউণ গান, বাউল দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে নানা আলোচনা-গবেষণা এ শতাব্দীর শুরু থেকে হয়ে আসছে।…বাউল চর্চার এ গুরুত্ব থেকে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাসে বাউলদের সামাজিক অস্তিত্ব ও গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র্য অবিসংবাদিত রূপে স্বীকৃতি পায়।” অনেকে মনে করেন যে বাউল মত একটি পূর্ণধর্ম। আবার অনেকে মনে করেন যে, বাউল মত একটি লৌকিক মতবাদ এবং ধর্মের বিশিষ্ট এক রূপ- পূর্ণাঙ্গ কোন ধর্মমত নয়। ঊপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন যে—“আনুমানিক ১৬২৫ খৃষ্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিয়া ১৬৭৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে বাংলার বাউল ধর্ম এক পূর্ণরূপ লইয়া আবির্ভূত হয়।” আবুল আহসান চৌধুরীও বাউল ধর্মের স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু এর বিকাশ সম্পর্কে অন্য একটি কাছাকাছি অনুমানকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন। তিনি মনে করেন—“বিভিন্ন পরিবর্তনশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে এসে চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) মৃত্যুর পর বাউলধর্ম তার নিজস্ব রূপ পরিগ্রহ করে।” অন্যদিকে প্রকৃতি আলোচনা প্রসঙ্গে বাউল মতকে ভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করে ওয়াকিল আহমেদ বলেন—“বাউল ধর্মমতে ও দর্শনে হিন্দুতান্ত্রিক, নাথযোগী, সুফী, বৈষ্ণব প্রভৃতি শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রভাব রয়েছে। এতদাসত্ত্বেও বাউল মূলত লৌকিক ধর্মমত।” ঊপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও প্রায় একই মত প্রকাশ করে বলেন,—“এই ধর্ম (বাউল ধর্ম) নিতান্ত লোকের ধর্ম-গণধর্ম এবং ইহার পশ্চাতে যে একটি বিশিষ্ট রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক পটভূমিকা ছিল, তাহারও যথেষ্ট ইঙ্গিত দিয়াছি।” তবে বাউলমতের প্রকৃতি নিয়ে এই মূল্যায়নগুলোর কোনটিই সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে গৃহীত হয়নি।

স্পষ্টত বাউলমতের উদ্ভব ও বিকাশ সামাজিক বাস্তবতায়। বিগত প্রায় অর্ধসহস্রাব্দের নানাবিধ ধর্মমতের—বৌদ্ধধর্ম, হিন্দু তান্ত্রিকতা, নাথযোগ, সুফিবাদ ইত্যদির এক সমন্বিত প্রকাশ বাউল মত। বাউল মতের এই উদ্ভব ও বিকাশ বিবেচনায় সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কেউ কেউ বাউল মতকে ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। কেননা সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্ম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং এখানে ধর্মকে প্রত্যাদেশের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয় না।

এই সকল কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাউল মতবাদকে একটি স্বতন্ত্র মতবাদ বলে বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। কেননা বাউলদের যেমন নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস রয়েছে একইভাবে স্বতন্ত্র আচার-রীতি ও অভিজ্ঞতাও রয়েছে এবং সর্বোপরি একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসাবে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বহুদিন থেকে স্বীকৃত। তবে এই সকল বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব দিয়ে বাউলমতের প্রকৃতি নির্ধারণ যৌক্তিক নয়। এর জন্য বাউলমতের বিশ্বাস ও আচারকে আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করতে হবে। সমাজবিজ্ঞানে ধর্মের একটি সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস ও আচারের এমন প্রক্রিয়া যা পবিত্রতার সাথে যুক্ত। ধর্মের ধারণার সাথে এখানে অতীন্দ্রিয় শক্তির যোগাযোগ কল্পনা করা হয়।

কিন্তু বাউল ধর্মে ঐশ্বরিক বিশ্বাসের অস্তিত্ব থাকলেও সেখানে পবিত্রতা-অপবিত্রতা বেং মৌলিক বিশ্বাস ও আচারের কোন সুনির্দিষ্টতা নেই। স্বতন্ত্র বিশ্বাস ও আচারের পরিবর্তে বাউল ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস এবং আচার নিয়ে। যে কারণে বাউল গানে আছে—

আমার নাহি মন্দির কি মসজিদ
পূজা কি বকরিদ
ওরে তিলে তিলে মোর মক্কা কাশী
পলে পলে সুদিনা।

বাউল মতবাদ বিকশিত হয়েছে দেহকেন্দ্রিক সাধন-দর্শনকে কেন্দ্র করে। বাউলদের এই দেহভিত্তিক সাধন দর্শন বৈষ্ণব সহজিয়া মতেরই এক গীতিরূপ বিশেষ। বৈষ্ণব সহজিয়াদের “বৃহৎ দেহ নির্ণয়”-এর মধ্যে এই সাদৃশ্য দেখা যায়—

নরদেহে নৈলে কোন তত্ত্ব নাহি জানে
সাধনার মূল এই নরদেহে গনে।

বৈষ্ণব সহজিয়াদের মত বাউলদেরও দেহের বাইরে কোন সাধনা নেই। বলা যায় যে ‘যাহা নাই ভান্ডে, তাহা নাই ব্রহ্মান্ডে’। দেহভান্ড তাদের কাছে একমাত্র বর্তমান। এর বাইরে সকল কিছুই তাদের কাছে কল্পনা এবং মূল্যহীন। লালনের গানে দেখা যায়—

বেদে কি তার মর্ম জানে?
যে রূপ সাঁইর লীলা আছে এই দেহ ভুবনে।

‘বাউলেরা রাগপন্থী’—কামাচার বা মিথুনাত্মক যোগসাধনই বাউল পদ্ধতি। যদিও লালনের একটি গানে আছে-“আগে কপাট মারো কামের ঘরে।” কিন্তু তার এবং বাউল গানের অধিকাংশই সূক্ষ্মভাবে যৌনতাকে সাধনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন লালনের গান থেকে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—

সবাই কি তার মর্ম জানতে পায়
জানে ভজন সাধন করে
যে সাধকে অটল হয়।
অমৃত মেঘেরি বরিষণ,
চাতক ভেবে জানরে আমার মন,
ও তার একবিন্দু পরাশিলে শমন জ্বালা ঘুচে যায়।
যোগেশ্বরীর সঙ্গে যোগযোগ করে
মহাযোগাযোগ সেই জানতে পারে,
ওসে তিন দিনের তিন মর্ম্ম জেনে একদিনেতে সেধে লয়।

এই বাস্তবতায় বাউল মত একটি নিতান্তই লোকদর্শন, আদিম জনসাধারণের অনুরূপ এক জীবন দর্শন। তবে বাউল মতবাদ নিয়ে এই মূল্যায়নকে পূর্ণাঙ্গ বিবেচনা না করে এর প্রকৃতি ও বাস্তবতার সামগ্রিক সমাজতাত্ত্বিক মূল্যায়নের জন্য আমাদের এর উদ্ভব ও বিকাশের সামাজিক বাস্তবতা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রচলিত জীবন ও ধর্ম দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে বাউল মতবাদের উদ্ভব এবং বিকাশ। তবে এই যে জীবনবিমুখতা তা কিন্তু সমাজেরই সৃষ্টি। অরবিন্দ পোদ্দার এ সম্পর্কে বলেছেন— “সমাজের দাবী তারা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছেন।…এই প্রত্যাখ্যানের পশ্চাতে গভীর দুঃখবোধ সামাজিক ভেদ বিচারের নির্মম উৎপীড়ন বর্তমান ছিল, তা বলাই বাহুল্য। যারা উত্তর সাধন রূপে এই ভাবাদার্শ গ্রহন করেছেন এবং সামাজিক কর্ম-সম্পর্কের বাইরে আপনার ঠাঁই খুজে নিয়েছেন। তাদের ক্ষেত্রে না হলেও যারা প্রথম প্রবক্তা তার প্রত্যক্ষ কারন ছাড়া এ পথের পথিক হয়েছেন, এটা ভাবা কঠিন।”

এই বাস্তবতায় বাউলদের বিকাশের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে। প্রাচীন ভারতবর্ষের হিন্দু জাতিভেদ বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ হয় তার একটি অংশ পরবর্তী সহজিয়া বৌদ্ধ ধর্মে রূপ নেয়। এবং এই সহজিয়া বৌদ্ধগন ক্রমান্বয়ে সহজিয়া বৈষ্ণবে পরিণত হন।

একটি বিষয় স্পষ্ট যে বাউল মতের উদ্ভব ও বিকাশের পেছনে যারা প্রথম প্রবক্তা, তারা ছিলেন সমাজকাঠামোর অবহেলিত নিচের দিকের মানুষ। সামাজিক শোষনের বিপরীতে প্রতিবাদ স্বরূপই বাউল মতের প্রবর্তন। সুতরাং বলা যায়, জাতি-বর্ণ প্রথার যে সংকীর্ণতা এবং তৎসংলগ্ন যে আর্থ-সামাজিক শোষণ সেখান থেকেই বাউল দর্শনের মূল চেতনা এসেছে, যাকে প্রচলিত সমাজরীতি ও দর্শন থেকে এক বিচ্যুতি হিসেবে বিবেচনা ব্যাখ্যা করা যায়। তৎকালীন সমাজ কাঠামোর মূল ভিত্তি ছিল ধর্ম। আর এই ধর্মভিত্তিক সমাজকাঠামোয় নীচের দিকের মানুষের জন্য প্রচলিত সমাজ কাঠামো বা প্রাতিষ্ঠানিক উপায় খুবই সংকীর্ণ ছিল। ফলে তাদের পক্ষে সাংস্কৃতিক লক্ষ্য তথা সামাজিক সাফল্য ও মর্যাদা লাভের তেমন কোন সুযোগ ছিল না। সেকারণে নিম্নবর্ণের মানুষেরা প্রচলিত ধর্ম এবং জীবনবোধকে ও জীবনাচারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বাউলরা এই প্রত্যাখ্যানের ধারাবাহিকতায় নতুন মূল্যবোধ প্রসারে সচেষ্ট হন। তাদের এই নব্য মূল্যবোধে প্রচলিত ঈশ্বরের ধারনাকে মানুষের স্বীয় সৃষ্টি বিবেচনা করে সর্বোচ্চ প্রধান্য দেয়া হয় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও সমতাকে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!