কালীপ্রসন্ন সিংহের বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চের অবদান আলোচনা কর।

কালীপ্রসন্ন সিংহের বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ

প্রখ্যাত বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যরসিক জোড়াসাঁকো সিংহ পরিবারের ধনী বাঙালি কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০) তাঁর বাড়িতে এই রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। তার আগে তিনি ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ নামে একটি সাহিত্য সভা গঠন করেন ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ এই বিদ্যোৎসাহিনী সভার সঙ্গেই যুক্ত ছিল।

বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু রঙ্গমঞ্চের উদ্বোধন ও অভিনয় শুরু হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল, শনিবার। প্রথম অভিনীত হয় ভট্টনারায়ণের লেখা সংস্কৃত নাটক ‘বেণীসংহার’-এর বাংলা অনুবাদ। অনুবাদ করেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। অভিনয়ে অংশ নেন স্বয়ং কালীপ্রসন্ন। তাছাড়া মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মহেন্দ্রনাথ ঘোষ, ক্ষেত্রমোহন সিংহ, মণিমোহন সরকার প্রমুখ। দুর্যোধনপত্নী ভানুমতীর ভূমিকায় অভিনয় কুশলতা দেখান মহেন্দ্রনাথ ঘোষ। কেউ কেউ মনে করেন যে, কালীপ্রসন্ন নিজে ভানুমতী সেজেছিলেন। কিন্তু তথ্যপ্রমাণ সে কথা বলে না।

প্রচুর জ্ঞানীগুণী এদেশীয় এবং ইউরোপীয়ানদের উপস্থিতিতে নাট্যাভিনয় হয়। আদর আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি ছিল না। ছোট মঞ্চে এই নাটকের অভিনয় সকলকেই খুশি করেছিল।

‘বেণীসংহার’-এর অভিনয়ে প্রচুর প্রশংসা ও খ্যাতিলাভ করে কালীপ্রসন্ন নাট্যাভিনয়ে ও নাট্যরচনায় উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। এবার তিনি নিজেই কালিদাসের বিক্রমোর্বশী নাটকের বাংলায় অনুবাদ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। এই অনুদিত ‘বিক্রমোর্বশী’ নাটকটি বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ নভেম্বর অভিনয় হয়। সুসজ্জিত নাট্যশালায় শিল্পীদের নৈপুণ্যে ‘বিক্রমোর্বশী’র অভিনয় সাফল্য লাভ করেছিল। বুদ্ধি, সুরুচি, বিলাস ও সম্ভ্রমে পূর্ণ দেশীয় সমাজের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবৃন্দ অভিনয় দেখতে এসেছিলেন। বেশ কিছু ইংরেজ দর্শকও ছিলেন। রাত্রি ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত অভিনয় হয়। এই নাটকে কালীপ্রসন্ন রাজা পুরূরবার ভূমিকায় খুবই সুন্দর অভিনয় করেছিলেন। ব্যারিষ্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (পরবর্তী প্রথম কংগ্রেস সভাপতি) অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চে কালীপ্রসন্নের লেখা ‘সাবিত্রী সত্যবান’ অভিনীত হয়। ‘সাবিত্রী সত্যবান’ কোনো সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ নয়। এটি কালীপ্রসন্নের মৌলিক রচনা। অভিনয়ের পূর্বেই এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তবে ‘সাবিত্রী সত্যবান’ নাটকটি যথা অর্থে অভিনীত হয়নি। সংবাদ প্রভাকরের বিবরণ (৪ জুন, ১৮৫৮) থেকে জানা যায়, নাটকটির ‘আভিনয়িক পাঠ’ হয়েছিল। তার সঙ্গে প্রচুর গীত সংযোজিত হয়ে যন্ত্রের অনুষঙ্গে গান করা হয়েছিল। বিদগ্ধ মহলে শেক্সপীয়রের নাটক যেভাবে পাঠ করা হয়, এও অনেকটা সেইরকম। ডঃ সুকুমার সেন একে ‘নাট্যোচিত আবৃত্তি’ (Dramatic recital) বলে অনুমান করেছেন। ঠিক এই ধরনের প্রথা এদেশে তখনো প্রচলিত ছিল না। বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চেই তার প্রথম প্রচলন হলো। এখানে
‘মালতীমাধব’ নাটকের বাংলা অনুবাদেরও এইরকম পাঠ হয়েছিল ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে।

বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চের অভিনয়ে মঞ্চোপকরণের দিকে খুবই নজর দেওয়া হতো। অভিনয়েও পারদর্শিতা অর্জনের জন্য পরিশ্রম করা হতো। এখানে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ব্যান্ডের দল এনে অর্কেস্ট্রার কাজ করানো হয়েছিল।

কালীপ্রসন্ন বিদ্যোৎসাহিনী সভা প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞানানুশীলনের ব্যবস্থা করেন। পরে এই সভার সংযোগেই বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ তৈরি করেন। প্রথমে অন্যের লেখা নাটক গ্রহণ করলেও, পরে নিজেই নাটক রচনা শুরু করেন। প্রথমে অনুবাদ করেন, পরে নিজেই মৌলিক নাটক রচনা করেন। আবার বিদেশী রঙ্গমঞ্চে যে ধরনের অভিনয় হতো, সেইরকম অভিনয় করেই ক্ষান্ত হননি, নতুন ধরনের ‘আভিনয়িক পাঠ’ চালু করেন।

বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের জন্যই নাট্যকার কালীপ্রসন্নের নাট্যরচনার সূত্রপাত। তিনি একাধারে উদ্যোক্তা, প্রযােজক-পরিচালক এবং অভিনেতা। এবং অবশ্যই অভিনীত প্রথম নাটকটি বাদে পরবর্তী সবগুলির নাট্যকার। হয় অনুবাদ করেছেন নিজে কিংবা মৌলিক নাট্যরচনা করেছেন।

১৮৫৯-এর পরে এখানে আর কোনো অভিনয়ের খবর পাওয়া যায় না। তবে এর অনেকদিন পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর নাট্যাভিনয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যে সঙ্গীত সমাজ গঠন করেন, তার প্রতিষ্ঠা এই বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চেই হয়েছিল। কিন্তু নানা গোলযোগ ও দলাদলির ফলে শেষপর্যন্ত সঙ্গীত সমাজ উঠে গিয়ে ‘ভারত সঙ্গীত সমাজ’ অন্যত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য তারও আগে, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের গোড়ায় দুই তিন মাস ন্যাশনাল থিয়েটার ভাঙার পর অর্ধেন্দুশেখরের নেতৃত্বে যে ‘হিন্দু ন্যাশনাল’ দল তৈরি হয়, তারা কিছুদিন অপেরা হাউসে এবং বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চে নাট্যাভিনয় করেছিলেন। এসব অনেক পরের কথা! সখের নাট্যশালা প্রসঙ্গে সে নাট্যালোচনার প্রয়োজন নেই।

বিদ্যোৎসাহিনী থিয়েটারের সাফল্যই পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ এবং বাবু (পরে মহারাজা ও স্যার) যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রভৃতিকে বেলগাছিয়া নাট্যশালা স্থাপনে প্রণোদিত করে।

অনেক আগে কালীপ্রসন্নের ‘বাবু’ নাটকটি প্রকাশিত হয় (১৮৫৪)। খুবই জনপ্রিয় এই প্রহসনটি এখানে অভিনীত হয়নি এবং সে যুগে অন্য কোনো মঞ্চেও অভিনীত হয়নি। এর ভাগ্যও বোধহয় পরবর্তী মধুসূদনের প্রহসন দুটির মতোই হয়েছিল।

বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চের অবদান

কালীপ্রসন্নের বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হলো—

  • বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ দুই বৎসর স্থায়ী হয়।
  • জ্ঞানানুশীলনের একটি সভার অঙ্গ হিসেবেই এই নাট্যমঞ্চের প্রতিষ্ঠা ও অভিনয়ের সূত্রপাত।
  • মঞ্চ নির্মাণ, অভিনয় কৃতিত্ব এবং নাট্য উৎসাহ সৃজনে এই রঙ্গমঞ্চের অনন্যকীর্তি অবশ্যস্বীকার্য।
  • এখানেই প্রথম সুন্দররূপে ‘ড্রপসীন’ এঁকে ব্যবহার শুরু হয়।
  • এই মঞ্চে ভরত, কালিদাস প্রমুখ প্রাচীন সংস্কৃত যুগের নাট্যব্যক্তিত্বদের মূর্তি ও চিত্র স্থাপন করে ক্লাসিক যুগের আবহাওয়া তৈরি করা হয়েছিল।
  • নাট্যাভিনয় ছাড়াও অভিনয়িক পাঠ’-এর ব্যবস্থা করে নতুন ধারার সৃষ্টি করেন।
  • অভিনয়ে সুরুচি, বৈদগ্ধ্য ও নিষ্ঠার পরিচয় ছিল।
  • এই নাট্যশালার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থেকেই পরবর্তী অনেকে নাট্যশালা নির্মাণ ও অভিনয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন।
  • মৌলিক নাট্যকার হিসেবে কালীপ্রসন্ন সিংহের আবির্ভাব হয় এই নাট্যমঞ্চ থেকেই।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!