মনসামঙ্গলের কাহিনি সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা কর।
মনসামঙ্গলের সংক্ষিপ্ত কাহিনি
মনসামঙ্গল কাব্যের নায়ক চাঁদ সদাগর চম্পক নগরের বিত্তশালী বণিক। মনসা চাঁদ সদাগরের মাধ্যমে পূজা প্রচার করতে চান। চাঁদ শৈব, তাই তিনি মনসার পূজা করবেন না। মনসাও নাছোড়বান্দা। তাই চাঁদ ও মনসার দ্বন্দ্ব এবং পরিণামে মনসার জয়—এই হল মূল কাহিনির গঠন।
বণিক চাঁদ সদাগরের ছয় পুত্র, ছয় পুত্রবধূসহ সুখের সংসার। শিবভক্ত চন্দ্রধর শিবের আশিসে মহাজ্ঞান কবচ-এর অধিকারী। অন্যদিকে মনসা দেবী হয়ে দেবসমাজে প্রতিষ্ঠা নেই। শৈশবে বিমাতা চণ্ডীর খোঁচায় চোখ কানা। এমনকি স্বামী জরৎকারুও তাকে ত্যাগ করেছেন। তাই শিব তাঁকে সিজুয়া পর্বতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
সিজুয়া পর্বতে মনসার সহচরী নেতা তাঁর সেবিকা ও সখী। একদিন মনসা স্বর্গের উদ্যানে সর্পসজ্জায় সজ্জিতা ছিলেন। এমন সময়ে চাঁদ শিবপূজার জন্য ফুল তুলতে সেখানে এলেন। চাঁদের ভয়ে সাপেরা পালিয়ে গেল। ফলে মনসা আবরণহীন হয়ে পড়লেন। তিনি ক্রুদ্ধা হয়ে চন্দ্রধরকে মর্তে জন্মগ্রহণ করার অভিশাপ দিলেন। অভিশপ্ত চন্দ্ৰধর মর্ত্যলোকে চম্পক নগরে বিজয় সাধুর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ কলেন। এরপর একই উদ্দেশ্যে স্বর্গের নর্তকী উষা ও তার স্বামী অনিরুদ্ধকেও শাপগ্রস্ত হয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হল। অনিরুদ্ধই জন্ম নিল লখিন্দর এবং উষা জন্ম নিল উজানী নগরে সায়বেনের ঘরে। নাম তার বেহুলা।
মনসা চাঁদ সদাগরকে দিয়ে পূজা প্রচারের সিদ্ধান্তে অটল কিন্তু শিবের ভক্ত চাঁদ সদাগর মনসার পূজা করবেন না। অন্যদিকে চাদের স্ত্রী সনকা লুকিয়ে মনসার পূজা করেন। এতে সদাগর রুষ্ট হন এবং সনকার পূজার ঘট চঁদ সদাগর লাথি মেরে ভেঙে দেন। এবার মনসাদেবীর সঙ্গে চাঁদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হয়। মনসার ক্রোধে চাদের গুয়াবাড়ী নষ্ট হল। চাঁদের ছয় পুত্র সর্পদংশনে প্রাণ হারাল।
এমনকি ব্যবসা বাণিজ্যে গিয়ে নৌকাডুবির ফলে তিনি সর্বস্বান্ত হলেন। পুত্রদের হারিয়ে চাঁদ যখন বাণিজ্য যাত্রা করেন তখন ঝটিকাসংকুল সমুদ্রে মনসা চাঁদ সদাগরকে নানা পরীক্ষার মধ্যে ফেলেন। এমন কি বাণিজ্যতরী ডুবিয়ে চাঁদ সদাগরকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন। সে সময়ে চাঁদের সম্মুখে মনসা একটি পদ্ম নিক্ষেপ করেন কিন্তু মনসার অপর নাম পদ্ম বলে সেই পদ্মকে চঁদ সদাগর প্রত্যাখ্যান করেন।
এভাবে সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে চাঁদ সদাগর কূলে উপস্থিত হন। কূলে এসেও সদাগরকে নানা পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় এবং সব পরীক্ষাতেই একান্ত শিবভক্ত সদাগর দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এভাবে মনসার দ্বারা নিগৃহীত সদাগর পথের সমস্ত দুঃখ লাঞ্ছনা ভোগ করে নিজগৃহে ফিরে আসেন। সনকা তার স্বামীর এরূপ অবস্থা দেখে কেঁদে ওঠেন
কিন্তু এই বিষণ্নতার মাঝে মনসার বরে সনকার কোলে জন্ম নেয় সনকার সপ্তম পুত্র লখিন্দর। নবজাত পুত্রের মুখ দেখে চাঁদ সদাগর সব দুঃখ বিস্মৃত হন। পুত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তিনি তার সঙ্গে সুলক্ষণা কন্যা বেহুলার বিয়ে দিলেন। পাছে মনসা তার এই পুত্রটিকে বিনাশ করেন এই আশংকায় তিনি সাতালি পর্বতে লোহার বাসরঘর নির্মাণ করিয়ে তাঁর পুত্র ও পুত্রবধুকে বাসর যাপন করতে পাঠালেন।
কিন্তু দেবতার সঙ্গে মানুষের বিরোধে দেবতারই জয় হয় কারণ বিশ্বকর্মাকে দিয়ে সেই বাসরঘরে মনসা একটি ছোট্ট ছিদ্র করিয়ে রেখেছিলেন যেখান দিয়ে তিনি কালীয়নাগকে পাঠিয়ে লখিন্দরকে দংশন করিয়ে বেহুলার সিঁদুর কেড়ে নেন। আর্তনাদ করে উঠল লখিন্দর—
জাগ অহে বেহুলা সায়বেনের ঝি।
তোরে পাইল কালনিদ্রা মোরে খাইল কি।
বেহুলার আর্ত ক্রন্দনে চম্পক নগরে সকালের ঘুম ভেঙে গেল। শুরু হল দৈবশক্তির বিরুদ্ধে মানুষের অসহায়তার আর এক নতুন কাহিনি। জেদি চাঁদ চোখের জলে মহাক্রোধে আগুন হয়ে জ্বলতে লাগলেন। এদিকে সতী বেহুলা স্বামীর মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে বদ্ধপরিকর; তাই বেহুলা গাঙ্গুরের জলে কলার মান্দাসে স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে ভেসে চললেন। এভাবে বহুদিন অতিক্রান্ত হল।
পথের নানা প্রলোভন তিনি জয় করলেন। বহু অগ্নিপরীক্ষায় পরিশুদ্ধ হলেন। তার পণ—তিনি স্বর্গে গিয়ে স্বামীর জীবন ফিরিয়ে আনবেন। অবশেষে সফল হল বেহুলার দুঃখের সাধনা। নৃত্যপটিয়সী বেহুলার নৃত্য দেখতে চাইলেন স্বর্গের দেবতারা। নৃত্যে তুষ্ট হয়ে দেবতারা মনসাকে তার স্বামীর জীবন ফিরিয়ে দিতে বলেন।
তবে মনসা বেহুলাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে, ফিরে গিয়ে শ্বশুরকে দিয়ে মনসার পূজা করিয়ে নেবে। বেহুলা এতে সম্মত হয়। তার স্বামী লখিন্দর বেঁচে উঠল। ছয় ভাসুর প্রাণ ফিরে পেল। শ্বশুরের নিমজ্জিত বাণিজ্যের নৌকাও ভেসে উঠল। এভাবে সবাইকে নিয়ে সতীসাধ্বী বেহুলা চম্পকনগরে ফিরে এলেন। শ্বশুরকে দিয়ে মনসার পূজা করাতে চাইলেন। পুরুষকারের জীবন্ত বিগ্রহ চাঁদ ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন—
যে হাতে পূজেছি আমি দেব শূলপাণি।
সে হাতে না পূজিব চেঙমুড়ি কানী।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেহুলার কাছে তিনি পরাজয় স্বীকার করলেন। এ পরাজয় মানুষের কাছে পরাজয়, স্নেহের কাছে পরাজয়। কোনো রকমে তিনি বাম হাতে মনসার পূজা করতে সম্মত হলেন। কারণ তিনি ডান হাতে শিবের পূজা করেন। বাম হাতে পূজা পেয়ে মনসা খুশি হলেন কারণ এর দ্বারাই তিনি উচ্চসমাজে স্থান লাভ করতে পারবেন। বেহুলা লখিন্দরের দ্বারা দেবীর পূজা মর্ত্যধামে প্রচার লাভ করল। এরপর উষা ও অনিরুদ্ধ (বেহুলা-লখিন্দর) শাপের অবসানে স্বর্গে ফিরে গেলেন।
তথ্যসূত্র:
১. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য
৩. বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা: ভূদেব চৌধুরী
৪. বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা: গোপাল হালদার
৫. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন
Leave a Reply