মাথুর কাকে বলে? এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবির কৃতিত্ব আলোচনা কর।
প্রবাস বা মাথুর
সংজ্ঞা
বিপ্রলম্ভের চতুর্থ বা শেষ পর্যায়ের নাম প্রবাস। এই পর্যায়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শ্রীরূপ গোস্বামী বলেছেন—
পূর্বসঙ্গতয়োর্যূনোর্ভবেদ্দেশান্তরাদিভিঃ।
ব্যবদানস্তু যৎপ্রাজ্ঞৈঃ স প্রবাস ইতির্যতে।।
অর্থাৎ পূর্বে মিলিত নায়ক-নায়িকার মধ্যে দেশান্তরে গমনবশত ব্যবধানকে প্রবাস বলে।
শ্রেণিবিভাগ
প্রবাস দুই রকম— বুদ্ধিপূর্বক এবং অবুদ্ধিপূর্বক। কার্যানুরোধে দূরে গমনকে বুদ্ধিপূর্বক প্রবাস বলে। বুদ্ধিপূর্বক প্রবাস দুই রকমের— নিকট প্রবাস, দূর প্রবাস। কালীয়দমনে, গোচারণে, কার্যানুরোধে, স্থানান্তর গমনে এবং রাসের অন্তর্ধানে— এই পাঁচ প্রকার নিকট প্রবাস হয়। দূর প্রবাস তিন প্রকার-ভাবী, ভবন ও ভূত বা মথুরা প্রবাস। অদূর ভব্যিষ্যতে যে বিরহ ঘটবে তাকে বলে ভাবী বিরহ। যেমন একটি রথ এসেছে দেকে আশঙ্কা হয়, কৃষ্ণ বুঝি ঐ রথে চড়ে চলে যাবেন।
যে বিরহ ঘটতে চলেছে তাকে বলে ভবন বিরহ। যেমন— শ্রীকৃষ্ণ চলে যাচ্ছেন। যে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়ে গেছে তাকে বলে ভূত প্রবাস। যেমন শ্রীকৃষ্ণ আসবেন বলে চলে গেছেন, কিন্তু নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও তিনি এলেন না। এই অবস্থার নাম ভূত প্রবাস। এই অবস্থায় নায়িকার যে দশ দশা হয় শ্রীরূপ গোস্বামী তার বিভিন্ন নাম দিয়েছেন— সঞ্চারীভাব-লালসা, উদ্বেগ, জাগরণ, তানব (কৃশতা), জড়িমা, বৈয়গ্র (ব্যগ্রতা), ব্যাধি, উন্মাদ, মোহ এবং মৃত্যু।
মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতি
চণ্ডীদাসের পদাবলীতে আদ্যন্তই বিরহের বিষণ্নতা। কৃষ্ণকে কাছে পাওয়ার উচ্ছল আনন্দ রাধার মধ্যে কোথাও নেই। তাকে পেয়ে হারানোর বেদনায় তিনি সর্বদাই ম্লান। তাই আলাদা করে চণ্ডীদাসের বিরহের পদে নতুন কোনও মাত্রা যোগ হয়নি। মিলনের আনন্দ যদি উচ্ছ্বল হয়, মিলনের মধ্যে যদি ব্যাপ্ত হয় পরিপূর্ণ সুখ, তবেই তো পরিণামে বিরহ-অনুভবে দেখা দেয় তীব্রতা। চণ্ডীদাসের রাধা প্রিয়কে কখণো নিবিড় করে পাননি। তাই তার পূর্বরাগ থেকে আরম্ভ করে মাথুর পর্যন্ত সব অবস্থাই একাকার হয়ে গেছে।
কিন্তু রাজসভার কবি বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণ ফেনিলোচ্ছল যৌবন সুরার মাদকতাকে মিলনের আনন্দের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করেছেন। তাই তাঁর রাধার বিরহের হাহাকার সেই পূর্ব মিলনের মধুস্মৃতিবিজড়িত আর্তনাদ। আর তাই বিদ্যাপতির রাধার বিরহ সমালোচকের ভাষায় হয়েছে—সৃষ্টির আগুন জ্বালা বিরহ।
‘অব মথুরাপুর মাধব গেল’ শীর্ষক পদটি বিদ্যাপতির ভূত-বিরহ পর্যায়ের পদ। এখানেও বিরহিণী রাধার বেদনার্ত স্মৃতিচারণ। রাধা তাঁর ব্যক্তিগত দুঃখের সঙ্গে মিলিয়ে কৃষ্ণশূন্য বৃন্দাবনের বিষণ্ন পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন। রাধার কাছে এখন ‘নন্দপুর চন্দ্রহীন বৃন্দাবন অন্ধকার মনে হয়েছে। স্মৃতিভারপীড়িত বেদনাবিদীর্ণ সত্তার আর্ত-হাহাকার বেজে উঠেছে ‘গোকুল মাণিক কো হরি লেল।’ শূন্য নগরীতে, শূন্য ঘরে বসে রাধা ভাবেন কী করে তিনি যমুনার তীরে যাবেন।
কৃষ্ণবিহীন কুঞ্জকুটীরের দিকে দৃষ্টিপাত করার কল্পনাও তার পক্ষে কষ্টকর। কৃষ্ণের সঙ্গে সঙ্গে রাধার চোখের নিদ্রা, মুখের হাসিও বিদায় নিয়েছে। সহচরীর সঙ্গে মিলে যেখানে তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে একদিন ফুলখেলা খেলেছেন, সেদিক তাকিয়ে রাধা যেন বাঁচতেই চান না। পূর্ব-মিলনের সুখস্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলি আজ বিরহিণী রাধার বেদনাকে জাগিয়ে তুলেছে। নিরূপায়ভাবে এই বেদনাদনকে বহন করেন যে রাধা, তিনি আমাদের পরিচিত সংসারেরই যে সংসারে প্রতি মুহূর্তে প্রিয়জনের অনাকাঙিক্ষত বিচ্ছেদের পর স্মৃতিভার নিয়ে পড়া থাকা মানুষ শুধু সারা জীবন হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের কথা ভেবে চোখের জল ফেলে। এই রাধাকে যেন কোনও দেশ-কালের পরিধিতে আবদ্ধ করা যায় না। এর বিরহ বেদনাও তাই হয়ে ওঠে সব মানুষেরই বিরহ বেদনা।
‘চির চন্দন উরে হার না দেলা’ শীর্ষক পদটিতে রাধার বিরহ বেদনা আরও মর্মস্পর্শী এটিও ভূত-বিরহের পদ। এতেও বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। দুঃখের ঘনগৌরব এখানে রাধার কণ্ঠে যেন ধ্বনিময় হয়ে উঠেছে। তার দীর্ণ চিত্তের হাহাকার মর্মস্পর্শী, ক্রন্দন তীব্র। নিবিড় আলিঙ্গনের ঘনিষ্ঠতম মুহূর্তেও ভূষণ-প্রসাধন যার একদা বাধা হয়ে উঠেছিল, আজ নদী গিরির পরপারবর্তী তাঁরই কথা ভেবে রাধা অন্তরের গভীর ক্ষতচিহ্নটিকে উন্মোচিত করেছেন। অন্যকে ভালবেসে তার প্রেমিক অন্যদেশে চলে গেছে। তাকে ছাড়া রাধার বক্ষপঞ্জর আজ বেদনাবিদীর্ণ। প্রিয়জনকে হারানোর সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণের অন্য নারীর প্রতি আসক্তির জন্য ঈর্ষা এবং বেদনাও এখানে প্রকাশ পেয়েছে।
পরবর্তী পর্যায়ে রাধা বলেছেন, প্রিয়তমের গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে তিনি সবাইকে তুচ্ছ করেছেন। আজ প্রিয়বিহীন রাধাকে কে কী না বলছে। প্রেমই রাধার জীবনে সর্বস্ব। তাঁর গৌরবও বটে। প্রিয়তমে অনুপস্থিতিতে গৌরবভ্রষ্টা রাধার বেদনাই এখানে অনুরণিত। ভণিতায় কবি বিদ্যাপতি নারীশ্রেষ্ঠ নারীকে বলেছেন, ধৈর্যধারণ করলে ভবিষ্যতে মুরারিকে অর্থাৎ কৃষ্ণকে পাওয়া যাবে। পদটিতে অলঙ্কার প্রায় নেই, শুধু আক্ষেপ আর আর্তির বিস্তার। একদা রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের আশ্লেষ মধুর নৈকট্য কত নিবিড় ছিল, আর আজকের দূরত্ব কত বিপুল। প্রথম দুটি পংক্তিতে তার নিরাভরণ অথচ মর্মস্পর্শী প্রকাশ এই পদটিকেও চিরকালের বিরহের কবিতা করে তুলেছে। তবে এক্ষেত্রে বিদ্যাপতি সম্পূর্ণ মৌলিকতার দাবি করতে পারেন না। কারণ, মহানটিকে বিরহীর কণ্ঠে একই ধরনের হাহাকার উচ্চারিত—“হারো নারোপিতঃ কণ্ঠে মা বিশ্লেষভীরুণা। ইদানীমাবয়োমধ্যে সরিৎ-সাগর-ভূধরাঃ।’’ কিন্তু বিদ্যাপতি ঋণ গ্রহণ করেও এখানে সেই ঋণকে সম্পূর্ণ আত্মস্থ করতে পেরেছেন। ঐতিহ্যের প্রতিভাদীপ্ত অঙ্গীকারে তার এই পদটি ঋদ্ধ।
বর্ষার পটভূমিতে রচিত আর একটি পদ হল ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর’। বিদ্যাপতির কিছু কিছু বিরহের পদে বেদনার যে রাজসিক ঐশ্বর্যময় রূপ প্রকাশিত হয়েছে, এই পদটি তার এক নিদর্শন। রাধার বিরহবেদনা এখানে যেন প্রকৃতিরও সহমর্মিতা লাভ করেছে। ভাদ্র মাসের বর্ষণমুখর রাত্রিতে সারা পৃথিবী যখন প্রবল বর্ষণে প্লাবিত, মেঘগর্জনে মুখরিত, তখনই রাধার বিশেষ করে প্রবাসী কান্তের কথা মনে পড়ছে। প্রেমের দেবতা মদন যেন তীক্ষ্ণশর রাধার হৃদয়ে বিদ্ধ করে তার বেদনাকে বাড়িয়ে তুলেছেন।
অজস্র বজ্রপাতের মাঝখানে ময়ূরের নৃত্য, আনন্দমত্ত ভেকের কলরব, ডাহুকীর ডাক ঐকতান রচনা করেছে। নিবিড় ঘন অন্ধকার রাত্রি বুকে মুহুর্মুহু বিদ্যুতের আলো যেন প্রবল অধীরতায় নিজেকে উদ্ভাসিত করছে। বর্ষণ মুখরিত আনন্দমত্ত এই প্রকৃতির পরিবেশে নিঃসঙ্গ রাধার হৃদয় বেদনা আরও প্রবল হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির এই আনন্দে প্রিয়সঙ্গসৌভাগ্যবতী হয়ে রাধা যোগ দিতে পারছেন না। তাই তার বুক ফেটে যাচ্ছে। রাধার বিরহবেদনাকে চরম ঐশ্বর্যরূপ দান করার জন্যই যেন কবি এই মত্ত বর্ষাদিনের আয়োজন করেছেন।
এই বর্ষাপ্রকৃতির মধ্যে বিষণ্ণতা নেই। অভিসারিকা রাধার মিলনে বাধা সৃষ্টির জন্য বর্ষা প্রকৃতি যে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে, তারও আভাস মাত্র নেই। বজ্রপাত এখানে ময়ূরকে নাচায়, ডাহুকীকে সরব করে। কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের বিরহী যক্ষ বর্ষার মেঘকে দেখেই তার বিরহের তীব্রতা অনুভব করেছে। রবীন্দ্রনাথ যক্ষের এই বিরহ সম্পর্কে বলেছেন— ‘‘মেঘদূতের যে বিরহ, সে ঘরে বসে থাকার বিরহ নয়, সে উড়ে চলে। নয়ার বিরহ। তাই তাতে দুঃখের ভার নেই বললেই হয়, এমনকি তাতে মুক্তির আনন্দ আছে। মিলনের দিনে মনের সামনে এত বড় বিচিত্র পৃথিবীর ভূমিকা ছিল না। ছোট তার বাসকক্ষ, নিভৃত, কিন্তু বিচ্ছেদ পেয়েছে ছাড়া নদী, গিরি, অরণ্যশ্রেণীর মধ্যে। মেঘদূতে তাই কান্না নেই, উল্লাস।”
এখানেও রাধা মেঘদুতের যক্ষের মতোই সারা বিশ্বপ্রকৃতির মাঝখানেই নিজের বিরহ বেদনাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাই পদটি গভীরতম, বেদনার বাণীবহ নয়। রাধার দুঃখ ঐশ্বর্যের প্রবলতম ঘোষণা। প্রাকৃতপৈঙ্গলের একটি সংক্ষিপ্ত কবিতাতেও আসন্ন বর্ষার প্রবাসী প্রিয়তমের স্মৃতিতে আতুর বিরহিণীর বেদনাকে রূপ দেওয়া হয়েছে—“সো মহ কন্তা/দূর দিগন্তা।/পাউস আএ/চে দুলাএ।” পদটিকে কেউ কেউ রায়শেখরের বলে মনে করেন। তাদের যুক্তি হল— এই পদটি বেশ কয়েকখানি পদ সংকলনে শেখরের পদ হিসেবে উদ্ধৃত হয়েছে।
ভণিতায় যে রাত্রির কথা বলা হয়েছে তা পদটির আদ্যন্ত বক্তব্যের সঙ্গে মেলে। কিন্তু বিদ্যাপতির ভণিতাযুক্ত এই পদে সময়ের কথা বলা হয়েছে ‘দিনরাতিয়া’ যা সমগ্র পদটির সঙ্গে সঙ্গতি সূচক নয়। কিন্তু এই কারণেই পদটিকে বিদ্যাপতির রচনা থেকে খারিজ করাও সঙ্গত নয়। এই বৃহৎ আয়ত ও বিস্ফারিত ধ্বনি একমাত্র বিদ্যাপতির পদেই মেলে। আবার রাধার দুঃখ বর্ণনা করতে গিয়ে কবি তাতে ব্যক্তির শোকাশ্রু মিশিয়ে দেন। এই পদটিতেও তার ব্যতিক্রম নেই। এছাড়া যিনি ‘কি কহবরে সখি আনন্দ ওর’ পংক্তির রচয়িতা, তাঁকে দুখের ওর’-এর রচনাকার হিসেবে বাতিল করার অধিকার আমাদের নেই।
‘অঙ্কুর তপন তাপে’ শীর্ষক পদটিও বিদ্যাপতির মাথুর পর্যায়ের একটি পদ। মাথুর পর্যায়ে বিদ্যাপতির প্রতিভার শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদী। এই পদটিতেও কবির সেই খ্যাতি অক্ষুণ্ন। সমগ্র পদটি বিরহিণী রাধার উক্তি। কৃষ্ণের সঙ্গে তার মিলনের স্মৃতি বহন করেই নবযৌবন বিরহে যাপন করতে হবে ভেবে রাধা বেদনায় অধীর হয়ে উঠেছেন। তিনি বলছেন, যদি প্রখর বিরহরূপ সূর্যকিরণে তাঁর নববিকশিত প্রেমাঙ্কুরই শুকিয়ে যায়, তারপর বারিবর্ষণে আর কি ফল? সমুদ্রের কাছেই যদি কণ্ঠ শুকিয়ে যায় তবে কে আর পিপাসা দূর করবে? রাধার প্রতি কৃষ্ণের এই বিমুখতা যেন চন্দন তরুর সৌরভত্যাগ, চাঁদের অগ্নিবর্ষণ আর চিন্তামণি রত্নের নিজ বৈশিষ্ট্য ত্যাগ।
এখানেও রাধার প্রেম দেহ-নির্ভর। এখানে কৃষ্ণপ্রেমের যে মধুর গম্ভীর রূপ কতকগুলি উপমার সাহায্যে ফুটে উঠেছে, তাতে রাধার কৃষ্ণপ্রেমানুভূতির স্বরূপও প্রকাশিত। কৃষ্ণের প্রেমে সমুদ্রের মতোই গভীরতা ও বিপুলতা। অন্যদিকে এই কৃষ্ণপ্রেমেই আছে স্নিগ্ধ চন্দনের সৌরভ, চন্দ্রকিরণের মধুর উজ্জ্বল লাবণ্য। চিন্তামণির মতোই এই প্রেম অভীষ্ট বস্তুদায়ী, শ্রাবণ মেঘের মতো সুপ্রচুর বর্ষণকারী, কল্পতরুর মতো বাঞ্ছিত বস্তুদানে সক্ষম। কিন্তু রাধার পক্ষে এই প্রেম বিপরীত হল। রাধার প্রেমে এখানে দেহকামনার স্পর্শ আছে সত্য, কিন্তু কৃষ্ণপ্রেমের প্রকৃত উপলব্ধি তাতে দেহাতীত লাবণ্য সঞ্চার করেছে। রাধার কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্তির অপরিমেয় লাবণ্য আর সেই প্রেমকে হারানোর তীব্র বেদনাও এই উপমাগুলির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
Leave a Reply