//
//

বাংলা কবিতার ইতিহাসে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধায়ের অবদান আলোচনা কর।

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়

ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা কাব্যজগতে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ও মধুসূদন দত্তের মধ্যবর্তীকালীন সময়ে আবির্ভাব হয়েছিল, তিনি হলেন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭)। গুরু ঈশ্বর গুপ্তের সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ বাংলা কাব্যে ঐতিহাসিক কাব্যের সূত্রপাত করলেন। তাই সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন— ‘‘ইংরেজী কাহিনী-কাব্যের রোমান্সরসের যোগান দিয়া রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় নবযুগের দিকে বাঙ্গালা সাহিত্যের মুখ ফিরাইলেন, অবান্তর কাল্পনিক পরিবেশে স্থূল প্রণয়লীলার স্থানে তিনি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় দেশপ্রেমকে কাব্যের বিষয়রূপে গ্রহণ করিলেন।” (‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’, দ্বিতীয় খণ্ড)।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিষ্য রঙ্গলাল প্রথম জীবনে কবিগানের বাঁধনদার হয়েও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারায় ভাবিত হয়ে আধুনিক বাংলা কাব্যে নতুন সুরের প্রবর্তন করেন। বাংলা কাব্যের পুরাতন রীতি তিনি অনুসরণ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু ঐতিহাসিক কাহিনির মধ্যে দিয়ে স্বদেশপ্রেমের আবেগকে তিনি বাংলা কাব্যে সঞ্চার করে দিলেন। তাঁর কাব্যরচনার মূল প্রেরণা দেশাত্মবোধ। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পরাধীনতার গ্লানিকে কেন্দ্র করে যে দেশাত্মবোধের উদ্বোধন ঘটে রঙ্গলাল সেই যুগধর্মকে তাঁর কাব্যে রূপ দিয়েছেন। স্বদেশপ্রেম ও ইতিহাসের পটভূমিকায় বীর রসকে কেন্দ্র করে মানবচেতনাকে উদারতার ক্ষেত্রে মুক্তি দেওয়ার জন্য রঙ্গলাল বাংলা কাব্য জগতে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

পদ্মিনী উপাখ্যান

রঙ্গলালের শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮)। এই আখ্যান কাব্যের বিষয়বস্তু টড রচিত ‘Annals and Antiquities of Rajasthan’-এর কাহিনি অবলম্বনে রচিত। আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণ এবং জহরব্রতে আগুন জ্বালিয়ে পদ্মাবতীর আত্মাহূতির কাহিনি অবলম্বনে এই কাব্য রচিত। এই কাহিনি সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক নয়। রাণা ভীমসিহের পত্নী পদ্মিনীর অলৌকিক সৌন্দর্যই চিতোর ধ্বংসের যে কারণ সে কথাই রঙ্গলাল তাঁর গ্রন্থে ব্যক্ত করেছেন। পদ্মিনী ও রাজপুত রমণীদের অগ্নিকুণ্ডে আত্মবিসর্জনের কাহিনি অনেকখানি নিরুত্তাপ ও আবেগহীন হয়ে পড়েছে। কাহিনি বিন্যাস একঘেয়ে ও নীরস। তবুও এই কাব্যের মাধ্যমে কবি স্বদেশবাসীর মধ্যে যে জাতীয় গৌরব ও ভাবাবেগ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন সে কারণে কাব্যটি উল্লেখযোগ্য হয়ে রয়েছে৷ বিশেষ করে ক্ষত্রিয়দের প্রতি রাজার উৎসাহবাক্য স্মরণীয় হয়ে রয়েছে—

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়।

দাসত্ব শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়?

কবি যে পাশ্চাত্য সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তার প্রমাণ মেলে এই কবিতায় টমাস ম্যুরের ‘Glories of Brien the Brave’ এবং ‘From life without freedom’-এর ছায়াপাত ঘটেছে।

এই কাব্যের কাহিনি, চরিত্র ও রচনারীতি কোনোটিই উল্লেখযোগ্য নয়। তবে স্বাদেশিক রস, বীর রস ও করুণ রসের সমাবেশে গ্রন্থটির রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলা কাব্যে শৌর্যবীর্যের মাধ্যমে রোমান্স সঞ্চারের কৃতিত্ব রঙ্গলালের অবশ্য প্রাপ্য।

কর্মদেবী

মধুসূদনের ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ এবং ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশিত হওয়ার পরে রঙ্গলালের ‘কর্মদেবী’ কাব্য (১৮৬২) প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তুও রাজপুত কাহিনি থেকে নেওয়া এবং তা চার সর্গে বিন্যস্ত। নায়ক-নায়িকার আত্মত্যাগ ও সতীত্ব, মহিমা এবং নারী-প্রেমের রোমান্টিক মাধুর্য এই কাব্যে চিত্রিত হয়েছে। এই কাব্যে আদি ও করুণ রসের উৎসার ঘটেছে। কাহিনি ও চরিত্রচিত্রণে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেনি। সাধুর বীরত্ব-বর্ণনায় স্বদেশপ্রীতি এবং শৌর্যবীর্যের পরিচয় স্পষ্ট। সাধু এই কাব্যের নায়ক। সাধু স্বদেশভক্ত ও সাহসী বীর। সাধুর উক্তিতে তার প্রমাণ মেলে—

কারু প্রতি ক্ষমা নাই, হউক আপন ভাই,

সমুচিত শিক্ষা দিব তারে।

অন্যায় না সহ্য হয়, মিথ্যাবাদ নাহি সয়,

সত্যের পরীক্ষা তরবারে।

এই কাব্যে কবি বাঙালির পৌরুষত্বহীনতা থেকে বাঙালিকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। সুকুমার সেন এই কাব্যের আলোচনা সূত্রে লিখেছেন—“কর্মদেবী পদ্মিনী উপাখ্যান অপেক্ষা বেশি বর্ণনাময়। ভাষা পূর্বের মতোই তবে অলঙ্কারে মধুসূদনের অনুসরণ প্রচেষ্টা বেশ স্পষ্ট।”

শূরসুন্দরী

রঙ্গলালের তৃতীয় কাব্য ‘শূরসুন্দরী’ (১৮৬৮) কাব্যও রাজপুত নারীর শৌর্যগাথা। নারীর সতীত্বরক্ষা এই কাব্যের প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রতীপের শৌর্যবীর্য ও স্বদেশপ্রেম, শক্তিসিংহের ত্রাতৃপ্রেম, পৃথ্বীরাজের দুর্বলতা স্পষ্ট রূপে চিত্রিত। আকবরের সুন্দরী নারীর প্রতি কামনা এই কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। নারীর সতীত্ব রক্ষার কাহিনি ছাড়া কাব্য হিসাবে ‘শূরসুন্দরী’ দুর্বল। এই আখ্যান কাব্যের বর্ণনা মনোরম। আকবরের প্রাসাদের এবং অন্তঃপুরের বর্ণনা কাব্যে প্রাধান্য লাভ করেছে। আকবর সতীত্বের কাছে পরাজিত হয়ে নিজের দোষ স্বীকার করে সতীকে বলেছেন—

ধন্য বীরাঙ্গনা তুমি বীরের নন্দিনী।

বীরগণ অন্তরেতে আনন্দ স্যন্দিনী।।

করিয়াছি অপরাধ মাগি পরিহার

রোষ পরিহার হর দুর্গতি আমার।।

কাঞ্চীকাবেরী

‘কাঞ্চীকাবেরী’ (১৮৭৯) রঙ্গলালের সর্বশেষ আখ্যান কাব্য। উড়িষ্যার ইতিহাসের এক রোমান্টিক কাহিনি এই গ্রন্থের উপজীব্য। এই কাহিনি কবির নিজস্ব নয়। পুরুষোত্তম দাসের প্রাচীন উড়িষ্যা কাব্য তিনি অনুসরণ করেছেন। এর কাহিনি সাত সর্গে বিন্যস্ত। চতুর্থ সর্গ ছাড়া অন্য সর্গগুলিতে কবির কৃতিত্ব সমধিক। সুকুমার সেন এই কাব্যের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন,— ‘‘‘কাঞ্জীকাবেরী’র বিষয় বেশ রোমান্টিক। তাহার উপর ভক্তিরসের প্রবাহ থাকায় অধিকতর হৃদয়গ্রাহী। ভাষা সরলতর এবং ছন্দপ্রবাহ সুললিত।’’ এই কাব্যে রঙ্গলালের ইতিহাসদৃষ্টি অখণ্ডতা লাভ করেছে। প্রেম, ভক্তি ও রোম্যান্স এই কাব্যে রসসৃষ্টির প্রধান উপাদান।

আখ্যান কাব্য ছাড়াও তিনি কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের অনুবাদও করেছিলেন। তিনি যে সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন এই অনুবাদ তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। তবে অনুবাদের ক্ষেত্রে তিনি স্বকীয়তার পরিচয় দিতে পারেননি, আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন।

রঙ্গলাল, টমাস গারনেলের ‘The Battle of the Frogs and Mice’ কাব্য অবলম্বনে “ভেক মুষিকের যুদ্ধ” (১৮৫৮) নামক রঙ্গ-ব্যঙ্গমূলক কাব্য রচনা করেছিলেন। এছাড়া রঙ্গলাল সংস্কৃত থেকে হিতোপদেশপূর্ণ ২০টি শ্লোকের পয়ার ত্রিপদী ছন্দ অনুবাদ করে ‘নীতিকুসুমাঞ্জলি’ নামক নীতিমূলক কবিতা রচনা করেছিলেন। এই ধরনের কবিতাগুলি হল—

(ক) গ্রন্থগত বিদ্যা, পরহস্তগত ধন

নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন।

(খ) অনর্থের মূল বিত্ত মনেতে ধেয়াও নিত্য,

নাহিক তাতেও সুখলেশ।

ধনলোভে পুত্রগণ নানা দ্রোহ-পরায়ণ

নীতিশাস্ত্র বর্ণিত বিশেষ।

সংস্কৃত, ইংরেজি ছাড়াও ওড়িয়া সাহিত্যও কবির জানা ছিল। দীন কৃষ্ণদাসের ‘রসকল্লোল’ থেকে অনুবাদ করে ‘বর্ষাযাপন’ কবিতা রচনা করেছেন। যেমন—

ক্রমে গ্রীষ্ম হলো শেষ আষাড়ের সুপ্রবেশ

করাল কালিমা কাল ছাইল গগনে।

এছাড়া রঙ্গলাল ওমর খয়্যামের কতকগুলি রুবাই বাংলা পয়ারে অনুবাদ করেছিলেন।

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য

রঙ্গলালের কাব্য উঁচুমানের না হলেও নানা কারণে তিনি বাংলা কাব্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলা কাব্যে তাঁর অবদানগুলি হল—

  • বাংলা কাব্যে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের উত্তরসূরি এবং মধুসূদনের পূর্বসূরি।
  • সুকুমার সেন তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন—“বাঙ্গালীর সাহিত্য-ইতিহাসে রঙ্গলালের মূল্য শুধু নূতন কবিতার নান্দী-পাঠক রূপেই নহে। প্রথম সাহিত্য সমালোচক রূপেও তাহার অগ্রগামী কৃতিত্ব স্মরণীয়”
  • ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম আখ্যান কাব্য।
  • বাংলা কাব্যে দেশপ্রেমের উজ্জীবনে এবং দেশপ্রেমমূলক রোমান্স সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।
  • সংস্কৃত, ইংরেজি, ওড়িয়া, ফারসি কবিতার অনুবাদেও তাঁর কৃতিত্ব ধরা পড়েছে।
  • কাব্যপ্রকরণে পুরাতন রীতি গ্রহণ করলেও বিদেশী কবিদের তিনি অনুসরণ করে পাশ্চাত্য ভাবধারাকে বাংলা কাব্যে আনয়ন করেন৷ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কবির কৃতিত্ব সম্পর্কে বলেছেন—“তিনি গীতিউচ্ছ্বাসময় ভাষায় ও শৌর্যদীপ্ত ভঙ্গিতে এই কাব্যগুলি রচনা করিয়া বাংলা কাব্যের মোড় ফিরাইয়া দিলেন ও নূতন বিষয়ের সহিত অভিনব কাব্যরীতির সংযোগে যে গতানুগতিকতার গ্লানিমুক্ত কবিতা রচনা করা যায় তাহা প্রমাণ করিলেন।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!