বাংলা গদ্যের ইতিহাসে রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা কর।
রামমোহন রায়
রামমোহনের (১৭৭২-১৮৩৩) কাল ছিল আত্মসংগঠনের কাল, নির্মোহ মানসিকতা, যুক্তিশীলতার মধ্য দিয়ে যথার্থ আদর্শের অনুধ্যানের সময়। ব্যক্তিজীবনে রামমোহনের জ্ঞাননিষ্ঠা ছিল বিচিত্ৰচারী। তিনি বহুভাষাবিদ ছিলেন সংস্কৃত শাস্ত্র, ইহুদী ধর্মশাস্ত্র, খ্রিস্টিয় ত্রিতত্ত্ববাদ, উপনিষদের রসতত্ত্বে বিশ্বাস, সমাজ সংস্কারের একনিষ্ঠ যোদ্ধা, রাজনৈতিক স্বৈরাচারের ঘোরতর শত্রু। স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি একজন চিন্তানায়ক। অর্থাৎ রামমোহন একাধারে পণ্ডিত, মনীষী, কর্মী, চিন্তানায়ক, সংস্কারক এবং অবহেলিত মানুষের বন্ধু। এমনকি বাংলা সাহিত্যে আধুনিক বিশ্বের বিরাট প্রাঙ্গনে রামমোহনের মানস পরিক্রমা, আবার যুগজিজ্ঞাসার ব্রাহ্মমুহূর্তে তিনি প্রাচ্য-ভুবনের প্রথম জাগ্রত পুরুষ। আত্মপ্রত্যয়, আধুনিক যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং উদার মানবতাবোধ নিয়ে রামমোহন তাঁর সাহিত্যে সমাজ ও জীবনমুখীন তাৎপর্যকে বড় করে তুলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাই রামমোহনের সাহিত্যে কলাকৈবল্যবাদ অনুপস্থিত। সাহিত্যের শিল্পশ্রী, আভিপ্রায়িক চেতনা (ব্যঞ্জনা) বা রসগত পূর্ণতা তাঁর গদ্যে অনুপস্থিত। প্রতিকূল পরিবেশে প্রগতির কারণে যুক্তিপন্থী ক্লাসিক বৈশিষ্ট্যই রামমোহনের গদ্যের স্বাভাবিক মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ রামমোহনকে ‘ভারতপথিক’ আখ্যায় অভিহিত করেছে। এর কারণ রামমোহন প্রথম প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছিলেন। রামমোহনের রচনা বিচার করতে হলে প্রয়োজন স্বচ্ছ ও মুক্ত দৃষ্টিকোণের। কেননা তাঁর রচনায় কোন সারস্বত আবেদন নেই। তার গদ্যে নেই রসবাদী চর্বনা, তাঁর গদ্য রস সাহিত্যও নয়, আছে বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা ও যুক্তিনিরীক্ষার স্পষ্ট প্রত্যয়বোধ। এমনকি রামমোহনের মনোজীবনের যথার্থ পরিচয় নিতে গেলে তার বিপ্লবী মনোজীবনের গদ্য ও প্রবন্ধ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা মনে রাখতে হবে। যেমন—(১) যুক্তিবাদের জয় ঘোষণা, (২) মানবহিতবাদ, (৩) ভৌগোলিক সীমা সম্প্রসারণ ও বিজ্ঞানমনস্কতা, (৪) রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্ম সম্বন্ধে বাস্তব চেতনালব্ধ হিতৈষণা।
১৮১৫ থেকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ এই পনের বছরের মধ্যে রামমোহন অন্তত তিনটি বাংলা পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। বাংলা ব্যতীত ইংরেজি ভাষায় রচিত গ্রন্থ ও প্রচার পুস্তিকার সংখ্যাও সুপ্রচুর। তিনি প্রধানত সমাজ ও ধর্মসংস্কারের উদ্দেশ্যেই পুস্তিকা লিখেছিলেন, প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন, প্রতিপক্ষের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে বিজয়ী হতে গিয়ে ক্ষুরধার মনীষার পরিচয় দিয়েছেন। প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদের মধ্যে ‘বেদান্তগ্রন্থ’ (১৮১৫), ‘বেদান্তসার’ (১৮১৫), বিভিন্ন উপনিষদের অনুবাদ (কেন, ঈশ কঠ, মাণ্ডুক্য, মুণ্ডক) প্রভৃতি ধর্মতত্ত্বকেন্দ্রিক অধ্যাত্মবিশ্লেষণ মূলক রচনা। তিনি এখানে কর্ম ও জ্ঞান, ব্রহ্মের স্বগুণত্ব, নির্গুণত্ব ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন। অনুবাদ কর্মের মধ্যে দিয়ে তিনি সাধারণ লোকের মনকে ব্রহ্মতত্ত্বের দিকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছেন। ফলে এই অনুবাদ কর্মের গদ্যরীতির ভাষা সরল, ব্যাখ্যামূলক এবং সাবলীল হয়ে উঠেছে।
‘বেদান্তগ্রন্থ’ তাঁর প্রথম বাংলা গদ্য রচনা। গ্রন্থের তিনটি অংশ—ভূমিকা, অনুষ্ঠান, মূলসূত্র ও তার অনুবাদ-ভাষ্য। তিনি এই গ্রন্থে বেদান্তের অদ্বৈতবাদী ভাষ্য সম্বন্ধে অবহিত করতে চেয়েছেন। এই গ্রন্থে যে বাগভঙ্গিমা ব্যবহৃত হয়েছে, তা বাংলা গদ্যে পূর্বে ছিল না। যেমন—“সুষুপ্তি সময়ে জীবের শয়নের মুখ্যস্থান পরমাত্মা হয়েন, এই হেতু পরমাত্মা হইতে জীবের প্রবোধ হয় এমত বেদে কহিয়াছে” (তৃতীয় অধ্যায়, দ্বিতীয় পাদ, অষ্টম সূত্র)। অন্যদিকে ‘বেদান্তসার’-এ রামমোহন সরল ভাষায় সূত্রের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেন। বেদ, উপনিষদ ও বেদান্ত অবলম্বনে যুক্তির ক্রম অনুসারে লেখক ‘বেদান্তসার’কে সজ্জিত করেছেন। এর প্রকাশভঙ্গি আরো স্বচ্ছ ও জড়তামুক্ত।
রামমোহন পাঁচটি উপনিষদের অনুবাদ ব্যাখ্যা করেন। পাঁচখানি উপনিষদের প্রথমেই তিনি সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় উপনিষদের মূলতত্ত্ব সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করে লিখেছে— “সর্বপ্রকার দুঃখনিবৃত্তি অর্থাৎ মুক্তির জন্য উপনিষৎ অধ্যয়নের প্রয়োজন হয়। আর উপনিষদের সহিত মুক্তির জন্য জনক ভাবসম্বন্ধ উপনিষদের জ্ঞানের দ্বারা সর্বদুঃখ নিবৃত্তিরূপ যে মুক্তি তাহা হয়।” এ ভাষা তেমন জটিল নয়। উপনিষদের অনুবাদ নিছক অনুবাদ নয়, অনেক ক্ষেত্রে তা বিচার ও বিশ্লেষণ।
রামমোহনের বিতর্কমূলক ধর্মীয় প্রসঙ্গগুলি হল—‘উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার’ (১৮১৬-১৭), ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ (১৮১৭), ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’ (১৮১৮), সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রচিত ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ (১৮১৮), ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ’ (১৮১৯), ‘কবিতাকারের সহিত বিচার’ (১৮২০), ‘সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার’ (১৮২০), ‘ব্রাহ্মণসেবধি’ (১৮২১), ‘কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার’ (১৮২৬), ‘পথ্যপ্রদান’ (১৮২৯) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বেদান্ত ও উপনিষদের উপর ভিত্তি করে ব্রহ্মবাদ প্রচার তার যেমন প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, তেমনি তার সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একাকী লিপিযুদ্ধ করেন এবং প্রতিপক্ষের হাস্যকর অসার যুক্তিকে খণ্ড-বিখণ্ড করে নিজ মত ও জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন। এতে রামমোহন যেন বাংলার নব্যনৈয়ায়িকের বংশধর।
রামমোহনের বাংলা গদ্য রচনাকে যদি দুভাগে ভাগ করা যায়, তাহলে দেখতে পাব, সেগুলির দুটি ধারা। একদিকে ধর্ম ও তত্ত্বমূলক ভালোচনার ধারা অন্যদিকে সামাজিক আচার ও প্রথামূলক রচনার ধারা। দ্বিতীয় ধারায় তিনি রচনা করেছেন নানা বিতর্কমূলক রচনা। এই রচনার প্রয়োজন হয়েছিল রক্ষণশীল হিন্দু সম্প্রদায় ও খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মীয় বিষয়কে যুক্তির দ্বারা খণ্ডন করে ধর্মের মূল ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য। এই বিতর্কমূলক রচনার পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। বাংলা গদ্যভাষা যখন অপরিণত তখন তিনি এ ধরনের বিচার বিতর্কমূলক রচনায় যে যুক্তিবোধ নিয়ে গদ্যরচনায় ব্রতী হয়েছিলেন, তাতে বাংলা গদ্য একটা ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেজন্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সমাজ, মিশনারী সম্প্রদায় তার যুক্তি ও তত্ত্বজ্ঞানের কাছে নতিস্বীকার করেছিলেন। এইসব রচনাতে রয়েছে তাঁর মৌলিক চিন্তার বলিষ্ঠতা, নৈয়ায়িক সুস্পষ্টতা, অনমনীয় দৃঢ়বদ্ধতা। কোন প্রতিপাদ্য বিষয়কে শাণিত যুক্তি ও প্রমাণ সহযোগে সুসংবদ্ধভাবে প্রকাশ করার রীতি রামমোহনই বাংলা গদ্যে প্রবর্তন করেন। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— “রামমোহন বঙ্গ সাহিত্যকে গ্রানিটস্তরের উপর স্থাপন করিয়া নিমজ্জন দশা হইতে উন্নত করিয়া তুলিয়াছিলেন।” (আধুনিক সাহিত্য, বিশ্বভারতী, ১৩৬৩, পৃষ্ঠা-৭)।
তাঁর বিতর্কমূলক ভাষার ঋজুতা ও তীক্ষ্ণতা বিস্ময়কর। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিত মুনশির দল যখন বাংলা গদ্যরীতি সম্বন্ধে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন এবং তাকে কাহিনি ও গালগল্প প্রকাশের বাহন করেছিলেন, তখন রামমোহন তাকে যুক্তিতে, তর্কে, চিন্তায় সজ্জিত করে আধুনিক চিন্তাশীল মনের উপযোগী করে তুললেন। আসলে রামমোহন তখন যুক্তিতর্ক ও প্রবন্ধের স্বচ্ছভাষা সৃষ্টি করেছিলেন। এ সম্পর্কে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মন্তব্য তাৎপর্যবহ—“দেওয়ানজী (অর্থাৎ ডিগবরী দেওয়ান রামমোহন) জলের ন্যায় সহজ ভাষা লিখিতেন, তাহাতে কোন বিচার বা বিবাদঘটিত বিষয় লেখার মনের অভিপ্রায় ও ভাবসকল অতি সহজে স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইত, এজন্য পাঠকেরা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন, কিন্তু সে লেখায় শব্দের বিশেষ পারিপাট্য ও তাদৃশ মিষ্টতা ছিল না।” এ মন্তব্য যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। রামমোহনের গদ্যে সাবলীল প্রাণশক্তির একান্ত অভাবই তাকে বিতর্ক পুস্তিকার লেখকে পরিণত করেছে সাহিত্যিকের গৌরব দিতে পারেনি। বোধহয় তিনি তা কোন দিন কামনাও করেননি। তিনি প্রাচীন ন্যায়শাস্ত্রের পূর্বপক্ষ উত্তরপক্ষের বিতর্করীতি অনুসরণ করে অগ্রসর হয়েছে বলে ভাষা যে পরিমাণে বিতর্কধর্মী হয়ে উঠেছে, সে পরিমাণে আদর্শ গদ্য হয়ে উঠতে পারেনি।
অবশ্য দুই-একটা রচনা যথা—‘পথ্যপ্রদান’ (১৮২৩), ‘পাদরি শিষ্যসম্বাদ’ (১৮২৩) ছাড়া অন্যত্র তাঁর গদ্য কদাচিৎ অর্থগৌরব ছড়িয়ে শিল্পগৌরব লাভ করেছে।
শাস্ত্রীয় বিষয় থেকে রামমোহন যখন সামাজিক বিষয় ভাবনায় ও বিশ্লেষণে আত্মনিয়োগ করেছেন, তখন তার গদ্যরীতি বা ভাবাদর্শ অনেক সরল ও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সামাজিক বিষয়ের ভাষা পরিচিত বস্তুজগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই ভাষা রচনায় রামমোহন জ্ঞানবৃত্তিকেই সক্রিয় করেননি—উপরন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উত্তাপে ও অকৃত্রিম সহানুভূতির স্পর্শে আলোচ্য পর্বের সামাজিক বক্তব্যের গভীরতা ভাবাদর্শের যোগ্য মাধ্যমে সজীব রসপরিণতি লাভ করেছে। তাঁর ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ (১৮১৮-১৯), সহমরণ বিষয়ক (১৮২৩) রচনার মধ্যে গভীর সমাজ বিষয়ক উপাদানকে যুক্তিগ্রাহ্য ও মননধর্মী করে তুললেও প্রত্যুত্তরমূলক বক্তব্যকেও যে কতখানি রসশীল ও তথ্যবিযুক্ত সাহিত্যরসে রূপায়িত করা যায়—তার পরিচয় রামমোহন দিয়েছেন।
এছাড়াও তিনি ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ (বাংলা ভাষার বিশুদ্ধি রক্ষার্থে বহুভাষাভিজ্ঞ রামমোহনের অন্যতম কীর্তি, ১৮৩৩) এবং ‘ব্রহ্মসংগীত’ (১৮২৮) রচনা করেছিলেন।
ব্যাকরণ বইটিতে রামমোহন ধ্বনি, বর্ণ, শব্দ ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে ব্যাকরণগত আলোচনা করেছেন, এছাড়াও এতে বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কতকগুলি উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে মৌলিক মন্তব্য করেছেন। বাংলা ভাষার প্রত্যয়, শব্দগঠন, পদান্বয় ও বাক্যবিন্যাস রীতিরও আলোচনা করেছেন।
রামমোহনের কৃতিত্ব
- বাংলা গদ্যে রামমোহনের অবদান সম্পর্কে সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন— “গীর্জা ও পাঠশালার বাইরে আনিয়া, বিচার বিশ্লেষণে উচ্চতর চিন্তার বাহন হিসাবে প্রথম ব্যবহারে লাগাইয়া, বাঙ্গালা গদ্যকে জাতে তুলিলেন আধুনিককালের পুরোভূমিকায় সবচেয়ে শক্তিশালী ও মনস্বী ব্যক্তি রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), যাহার কর্ম ও চিন্তা, উদ্যম ও মনীষা ভারতবর্ষের ইতিহাসে আধুনিক যুগের দরজা দরাজ খুলিয়া দিয়াছে।” (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৩৮৬, পৃষ্ঠা-১৪)।
- রামমোহন সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যকে অনুবাদ, আলোচনা, বিতর্ক ও মীমাংসার বাহন হিসাবে গড়ে তুললেন। কী করে বাংলা গদ্য শিখতে পড়তে হয় তাও তিনি যেন বাঙালি জাতির হাত ধরে শেখালেন। বাংলা গদ্যকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজগোষ্ঠী কাহিনি ও গালগল্প প্রকাশের বাহন করেছিলেন; আর রামমোহন তাকে যুক্তিতে, তর্কে, চিন্তায় সজ্জিত করে আধুনিক চিন্তাশীল মনের উপযোগী করেন।
- প্রমথ চৌধুরী বলেছেন—“তিনি হচ্ছেন বাংলা গদ্যের প্রথম লেখকদের মধ্যে সৰ্ব্বপ্রধান লেখক।” (প্রবন্ধ সংগ্রহ, পৃ-১৩৮)
- গোপাল হালদার রামমোহনের ভাষার সমালোচনা সূত্রে বলেছেন— “রামমোহনের ভাষার প্রধান গুণ—প্রথমত, বক্তব্যকে সরল করে বলবার জন্যই রামমোহন লেখেন, শব্দ বা বাক্যের লেখা দেখবার ইচ্ছায় নয়। তাই তাঁর ভাষা প্রায়ই সরল, এমনকি, সময়ে সময়ে প্রাঞ্জল। দ্বিতীয়ত, তার্কিক রামমোহন বিপক্ষের বিরুদ্ধে। কটুক্তি প্রয়োগ করেননি, এবং অপরের কটুক্তিকে স্থিরভাবে যুক্তি দ্বারা নিরসন করেছেন। এই আশ্চর্য সংযম তার তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও রুচিবোধের প্রমাণ।”
- একথা সত্য যে রামমোহনের প্রতিপক্ষেরা তাকে অনেক সময় ইতর ভাষায় কটুকাটব্য করেছেন, কিন্তু তিনি বিতর্কের ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক বা ঈর্ষা প্রণোদিত তীক্ষ্ণ বাক্য ব্যবহার করেননি। রামমোহন নিজেও বলেছে—‘‘পরমার্থ বিষয় বিচারে অসাধু ভাষা এবং দুর্বাক্য কখন সর্বদা অযুক্ত হয়।’’
- সমালোচক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও রামমোহনের গদ্য সম্বন্ধে লিখেছে—“বাংলা গদ্য তাঁর হাতে আয়ুধে পরিণত হয়েছিল। সুললিত সাহিত্যিক গদ্য তার ততটা আয়ত্তে না এলেও গুরুতর তত্ত্বালোচনায় গদ্যকে ব্যবহার করে তিনি বিতর্ক ও বিচারের সংযত ভাষা সৃষ্টি করেছিলেন। এইজন্য তিনি বাংলা গদ্যের ইতিহাসে দিক নির্দেশক স্মারকস্তম্ভ রূপে দীর্ঘকাল বিরাজ করবেন।” (রামমোহনের গদ্য রচনা, সমকালীন, আশ্বিন, ১৩৬৮, পৃষ্ঠা-৩৯৮)
- অধীর দে বলেছেন— “রামমোহন বাংলা গদ্য ভাষারও অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিপোষক ছিলেন। তাঁহার পূর্বে বাংলা গদ্যের কেবল সূচনা হইয়াছিল মাত্র; কিন্তু তাহা কোন স্থিতিশীল আদর্শে সুপ্রতিষ্ঠিত হইবার যোগ্যতা অর্জন করে নাই। রামমোহনের রচনা বিচার বিশ্লেষণ করিয়া দেখা যায় যে, তিনি নিজস্ব একটি রীতিসম্মত আদর্শ অনুসরণ করিয়া তাহার রচনাকার্য সম্পন্ন করিয়াছেন।” (আধুনিক বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ধারা, প্রথম খণ্ড, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা-৩৩)।
রামমোহনের গদ্যশৈলীর বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিম্নলিখিত ভাবে সূত্রাকারে তুলে ধরা যায়— (১) তার গদ্যরীতির অনেক পদই অধুনা অপ্রচলিত এবং শব্দ যোজনার ক্ষেত্রে বা বাক্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর রীতি সংস্কৃত ও ইংরেজি বাক্য গঠনরীতির অনুরূপ। (২) রামমোহনের গদ্যশৈলীর মধ্যে জটিলতা অবশ্যই স্বীকার্য—তবে উপযুক্ত বিরতিচিহ্নের প্রয়োগ হলে তাঁর গদ্যরীতির বাক্য ও উপবাক্যের মধ্যে সামঞ্জস্যের পূর্ণতা আসতে পারতো। (৩) রামমোহনের গদ্য মূলত কর্মযোগীর গদ্য—তাই গদ্যরীতির রসসিক্ত রোমান্টিক বিন্যাস কুশলতা থেকে তাঁর গদ্য কিছুটা দূরবর্তী। (৪) রামমোহনের হাতে তার গদ্য সমসাময়িক সামাজিক চৈতন্যের মধ্যে কল্যাণধর্ম প্রতিষ্ঠার কারণেই হয়ে উঠেছে চিন্তাবাহী, মননসমৃদ্ধ, যৌক্তিক পারম্পর্যে বিধৃত। (৫) তাঁর গদ্যে অনেক সময় কর্তা ও ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের প্রলম্বিত গঠন রীতির কারণে সম্পর্কসূত্র কিছুটা শিথিল হয়ে পড়েছে।
রামমোহনের গদ্য তাই ঋজুগতি, তীক্ষ্ণ ও যৌক্তিক পারম্পর্যে সুগঠিত। আধুনিক মনের জটিলতাকে ফুটিয়ে তুলতে হলে, আধুনিক ভাষা বাহন প্রয়োজন। রামমোহন সেই আধুনিক ভাবপ্রকাশক বাংলা গদ্যের স্রষ্টারূপে চিরদিন অম্লান গৌরবে প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। রবীন্দ্রনাথ তাই রামমোহন সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লিখেছিলেন— “কী রাজনীতি, কী বিদ্যাশিক্ষা, কী সমাজ, কী ভাষা, আধুনিক বঙ্গদেশে এমন কিছুই নাই রামমোহন রায় স্বহস্তে যাহার সূত্রপাত করিয়া যান নাই।” ভাষার বিকাশের দিক থেকেও এই উক্তি যথার্থ।
Leave a Reply