শিবায়ন কাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

রামেশ্বর ভট্টাচার্য

শিবায়ন কাব্যধারার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য। সমালোচক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন— “পাণ্ডিত্য, শাস্ত্রজ্ঞান, বাস্তবতা, দৈনন্দিন জীবন, চিত্রাঙ্কন, হাস্য পরিহাস, কাব্যকলার সচেতন অনুশীলন, ভূয়োদর্শন— ইত্যাদি বিষয় বিচার করিলে তাহাকে প্রায় মুকুন্দরাম ও ভারতচন্দ্রের সমকক্ষ কবি বলিতে হইবে।’

কবির নিবাস পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটালের অন্তর্গত বরদা পরগনার যদুপুর গ্রামে— ‘সাকিন বরদাপাটি যদুপুর গ্রাম।’ কবির কৌলিক পদবী চক্রবর্তী। কিন্তু যজন-যাজনের জন্য ‘ভট্টাচার্য’ পদবী গ্রহণ করেন। কবির পিতামহ বেদজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর পিতামহের নাম গোবিন্দ চক্রবর্তী। পিতা লক্ষ্মণ, মাতা রূপবতী এবং দুই পত্নীরা হলেন সুমিত্রা ও পরমেশ্বরী। কবি নিঃসন্তান ছিলেন। কবির ব্যক্তিজীবন সম্বন্ধে এই সব তথ্য পাওয়া যায়— রামেশ্বরের শিবায়নের ‘বঙ্গবাসী’ সংস্করণের সম্পাদক অধ্যাপক শ্রীযুক্ত যোগিলাল হালদার (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্করণ, শিবসংকীর্তন বা শিবায়ন, ১৯৫৭) এবং পঞ্চানন চক্রবর্তী (সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত সংস্করণ) প্রভৃতিদের সম্পাদকীয় ভূমিকায়।

রামেশ্বর শিবায়নের নানা স্থানে রাজা রামসিংহ ও তার পুত্র যশোবন্ত সিংহের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন—

রাজা রামসিংহ সুত       যশোমন্ত নরনাথ

তস্য পোষ্য দ্বিজ রামেশ্বর।।

রামেশ্বরের জীবন কাহিনি বৈচিত্র্যপূর্ণ। ইনিও মুকুন্দরামের মতো ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ইতিহাস-খ্যাত দুর্দান্ত সামন্তরাজ শোভাসিংহের ভাই হেমন্ত সিংহ কোন কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে কবিকে যদুপুরের বাড়ি থেকে উৎখাত করে। কবি তখন কর্ণগড়ের সামন্তরাজ রামসিংহের কাছে আশ্রয় লাভ করেন। কর্ণগড়ের নিকটবর্তী অযোধ্যানগরে কবির নূতন বাসস্থান নির্মিত হয়। এই স্থানেই কবি ব্যক্তিজীবন সাহিত্য চর্চায় অতিবাহিত করেন। আত্মপরিচয়ে কবি বলেছেন—

পূর্ববাস যদুপুরে          হেমৎ সিং ভাঙ্গে যারে

রাজা রামসিংহ কৈল প্রীত।

স্থাপিয়া কৌশিকী তটে    বসিয়া পুরাণ পাঠে

রচাইল মধুর সঙ্গীত।।

এই কৌশিকী তটই ভৌগোলিক পরিচয়ে অযোধ্যানগর। এই স্থানে রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় শিবসংকীর্তন কাব্যটি রচনা করেন কবি রামেশ্বর।

বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী জানা যায় যে, রামেশ্বর ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে ‘শিব সংকীর্তন’ কাব্য রচনা করেছিলেন। ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে কবির তিরোধান ঘটে।

শিবায়ন ছাড়া রামেশ্বরের ‘সত্যপীরের ব্রতকথা’ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। পঞ্চানন চক্রবর্তী রামেশ্বরের ‘সত্যপীরের ব্রতকথা’ সম্পাদনা করেন।

রামেশ্বর ভট্টাচার্যের কবি-কৃতিত্ব

রামেশ্বর তাঁর শিবায়ন কাব্যের বহুস্থানে ভণিতা প্রসঙ্গে বলেছেন— “চন্দ্রচূড় চরণ। চাওয়া নিরন্তর।/ভব-ভাব্য-ভদ্রকাব্য ভণে রামেশ্বর।” অবক্ষয়ের যুগে বসে যুগোপযোগী কাব্য নির্মাণ করলেও রামেশ্বরের পরিশীলিত কাব্যরস ও ভদ্রচেতনার যে যার তার কাব্যে রয়েছে, তাতে তাঁর এ ধরনের ভণিতা প্রয়োগ যে সার্থক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কবির বিবিধ শাস্ত্রজ্ঞান, লোকব্যবহার বিষয়ে অভিজ্ঞতা কবির কাব্যের অখণ্ড রসনির্মাণের সহায়ক হয়েছিল। আলংকারিক দণ্ডী বলেছেন— “নৈসর্গিকী চ প্রতিভাতঞ্চবহুনির্মলম।/ অমন্দাশ্চাধিযোগোহস্য কারণং কাব্যসম্পদঃ৷” রামেশ্বরের মধ্যেও ঠিক এভাবে সহজাত কবিপ্রতিভার সঙ্গে শাস্ত্রজ্ঞান ও বহু শাস্ত্রাধ্যয়নের পরিচয় আছে।

রামেশ্বরের শিবায়ন কাব্যের প্রেক্ষাপট সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। এই যুগটি ছিল অবক্ষয়ের যুগ। সামাজিক জীবনে নীতিগত শিথিলতা, বিলাসপরায়ণতা, ভোগবাদ প্রভৃতি দেখা যায়। ঈর্ষা, বিদ্বেষ, রিরংসা, স্বার্থপরতা সমাজ জীবনের প্রাণস্পন্দনকে কলুষিত করেছিল। ফলে সমাজের বাহ্যিক জীবনে দেখা দিয়েছিল আদিরসের প্রাবল্য। যখন জীবনবোধের গভীরতা বিনষ্ট হয়, রুচিবোধে যখন উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেয়, তখন ভক্তির স্থান অধিকার করে সংশয় ও ভাঁড়ামি। সেই প্রেক্ষাপটে রামেশ্বর তাঁর কাব্যে পরিশীলিত রুচিবোধ ও ভদ্রতার একটি পরিবেশ রচনা করেছেন।

কবি যুগের কাব্যকলার সীমার মধ্যে থেকেও স্বকীয় কবিত্ব গুণে জনমনোরঞ্জনের উপায় উদ্ভাবন করে ‘ভব-ভাব্য’ অর্থাৎ শিবসম্বন্ধীয় কাব্য রচনা করতে পেরেছেন। বহুশ্রুতকেও রামেশ্বর অপূর্ব মৌলিকতা দান করে স্বয়ং প্রদীপ্ত করে তুলেছেন। তাঁর শিবায়ন কাব্য তাই শৈবধর্মের জয়গান নয়। কিম্বা তার কাব্যে শিব কোন ভক্তকে যেমন কৃপা করেননি তেমনি কোন অভক্তকে আক্রোশবশত বিনষ্ট করার চেষ্টা করেননি। বিশেষ মতের প্রতিষ্ঠা বা তত্ত্বের প্রতিপাদনে তাঁর কাব্য নিয়োজিত নয় বলেই কবির প্রতিভার স্বাতন্ত্রের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ সম্ভব হয়েছে।

রামেশ্বরের কাব্যের জনপ্রিয়তার কারণ তাঁর অসাধারণ কবিত্বশক্তি। একদিকে বাস্তবতাবোধ অন্যদিকে আলংকারিক কলাকৌশলের প্রয়োগ—এই উভয় দিক থেকে কবি তাঁর কাব্যকে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। প্রথমেই আসা যাক কাহিনিবয়নের আলোচনায়। পুরাণখণ্ডে তাঁর কাব্যে বিশেষ বৈচিত্র্য নেই—পুনরাবৃত্তি মাত্র। লৌকিক খণ্ডের কাহিনি বর্ণনায় কবি গার্হস্থ্য জীবনের বাস্তব রস পরিবেশন করেছেন।

এই পরিবেশনে গ্রামীণ জীবন মূর্ত হয়ে উঠেছে। গ্রামের চাষ, চাষী, ধান, চেঁকি, মশা, জোঁক, উঁশ, শাঁখারি, কামার, কুচনী, বান্দিনী ইত্যাদি নানা চরিত্র ও প্রসঙ্গ তার বাস্তবতাবোধকে পরিস্ফুট করে। যেমন, শিব চাষের কাজে গিয়ে কুচনীদের মোহে পড়েছেন। নারদের পরামর্শে শিবকে কৈলাসে আনার জন্য পার্বতী মশকবাহিনী পাঠালেন। বর্ণনাটি বাস্তব রসের কৌতুকচিত্র—

কানে কানে আসিয়া কুনু কুনু করিয়া পৃষ্ঠে বসিয়া খায়।

চাপড়ের চটচাট্‌ হ্যালার হুটপাট স স নাড়িছে পুচ্ছ।।

এইরূপ মর্দন মশার কর্দম এক হাত হৈল উচ্চ।

মশার পন পন শুনিয়ে ঘন ঘন চক্ষের ঘুচিল ঘুম।

উষ ঘাস করি জড় শঙ্কর জালে খড় দরবর লাগাল্য ধুম।।

শিবের লৌকিক কাহিনি পরিকল্পনায় রামেশ্বর সরস কবিচিত্তের পরিচয় যেমন দিয়েছেন, তেমনি স্বকীয় মৌলিকত্বের মধ্যে দিয়ে চরিত্রটিকে বাস্তব করে তুলেছেন। ফলে এই চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে কাব্যমধ্যে গার্হস্থ্যরস ও মানবরসের সমীকরণ কবি বৈদগ্ধ্যের পরিচয় দিয়েছেন। ভিক্ষাযাত্রার সময় বেনেনীর প্রতি শিবের কৈলাসে হর-গৌরীর কোন্দল, শিব ও বান্দিনীর কথোপকথন, হিমালয়ে গৌরীর শঙ্খ পরিধান, শিবের চাষ ইত্যাদি প্রসঙ্গের মধ্যে বাস্তবতার পরিবেষ্টনীতে মানবরসের কাম্য রসসিদ্ধি ঘটেছে।

হাস্যরস বা কৌতুকরসের মার্জিত প্রয়োগ ঘটিয়েও রামেশ্বর পরিশীলিত ভদ্ররুচির পরিচয় দিয়েছেন। তবে কৌতুকের অন্তরালে এই হাস্যরস অনেক সময় বিষাদ-করুণ। গম্ভীর রূপলাভ করে মানবচিত্তের বেদনামথিত করুণ রূপটিকেও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। হাস্যরসের লঘু বর্ণনাধর্মী আস্বাদ্য রস পরিণাম মাঝে মাঝে হিউমারের মহনীয় রূপ লাভ করেছে। যেমন শিবের রন্ধনগৃহের চিত্র—

তিন ব্যক্তি ভোক্তা একা অন্ন দেন সতী।

দুটি সুতে সপ্তমুখ পঞ্চমুখ পতি।

তিন জন একুনে বদন হৈল বার।

দুটি হাতে গুটি গুটি যত দিনে পার।

তিনজনে একেবারে বারো মুখে খায়।

এই দিতে এই নাই হাঁড়ি পানে চায়।।

শিব-দুর্গার দাম্পত্য কলহের চিত্র যেমন বাস্তব, তেমন কৌতুকোজ্জ্বল। পিতাকে ঘরে ফিরতে দেখে ছেলেরা ছুটে এসেছে। পার্বতী কড়া গলায় বললেন—

তোর বাপ বাগ্দী হয়্যাছে ছাড়্যা মোকে।

তার ঠাঁই যাও নাই, ছুঁইও না তাকে।।

স্বামীর দিকে তির্যক দৃষ্টিতে চেয়ে পরোক্ষ উক্তিতে বলেছে—

বাঙ্গীর লাজ নাই ঘরে ঢোকে মোর।

ছাল্যাপুল্যা ছুঁইলে ছুতুক হবে ঘোর।।

ভাল যদি চায় তো এখান হৈতে যাউক।

যেখানে রাখিয়া আইল বাগ্দিনী মাউগ।।

চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে শিবায়ন কাব্যের শিব চরিত্রটি মুখ্য। তবুও শিব চরিত্রকে উজ্জ্বল করে তুলবার জন্য গৌরী চরিত্র এবং পারিপার্শ্বিক আর কয়েকটি চরিত্রের মাধ্যমে গার্হস্থ্যরসের পরিবেশন করেছেন কবি। গৌরীর বাল্যখেলা, গৃহস্থালির বর্ণনা, ছদ্মবেশিনী বান্দিনীরূপী লীলা, ভগবতীর শঙ্খ পরিধান প্রভৃতি প্রসঙ্গের মধ্য দিয়ে গৌরী চরিত্রটি কাব্যের মূল কাব্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। শঙ্খ পরিধান অংশটির মধ্যে কবি নিম্নবিত্ত সমাজের মূল প্রাণস্পন্দনটিকে উদ্‌ঘাটিত করেছেন।

রামেশ্বর তাঁর কাব্যে উল্লেখ করেছে— ‘রচে রাম অক্ষরে অক্ষরে মধু।’ এদিক থেকে কাব্যরচনায় ভাষার মাধুর্যের দিকটি বিচার্য। কেননা ভাষায় সুললিত মাধুর্য প্রতিটি পংক্তিকে যেমন সুন্দর ধ্বনিস্পন্দন দান করেছে তেমনি ‘ভব-ভাব্য’ কাব্যটিকে ভদ্রজনের যোগ্য করে তুলেছেন। তাঁর কাব্যে ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের তিনটি দিক লক্ষ করা যায়) সংস্কৃত রীতি, (২) কথ্য, লোকায়ত ভঙ্গি, (৩) আরবি-ফারসি রীতি। প্রথম রীতিটি সংস্কৃত শব্দবহুল মঙ্গলকাব্যের ঐশ্বর্যপর্বের ভাষা। দ্বিতীয় রীতিটি হল প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক কথ্যভাষার অনুসরণবাগবিধি ও প্রবচন সমেত। তৃতীয় রীতিটি হল পরিশীলিত দরবারি ফারসি ও উর্দু ভাষার ব্যবহার। রামেশ্বরের শব্দ ব্যবহারের বিশেষ সক দিকটির পরিচয় রয়েছে পৌরাণিক কাহিনির বয়নের ক্ষেত্রে। যেমন ফারসি শব্দের প্রয়োগ—

কপটে করুণাময় দ্বিজে কয় বাওয়া।

মোঞে ভুখা ফকির হেয় লেগা মেরা দোয়া।।

প্রবাদ-প্রবচনের প্রয়োগ—

(ক) জলহীন যেন মীন শিবহীন শিবা।

(খ) দারিদ্র্য দোষের পর দোষ নাই আর।

(গ) হাঁড়ির মুখের মতো মিলি গেল সরা।

(ঘ) বিষয়ীর বচনে বিশ্বাস বিধি নয়।

অনুপ্রাসের শোভন ও সংযত ব্যবহার কাব্যের উৎকর্ষ সাধন করেছে। যেমন—

ইন্দুমুখে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম বিন্দু সাজে।

মৌক্তিকের পংক্তি যেন বিদ্যুতের মাঝে।

কবি উপমা প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রাচীন কবিদের কুন্দ, তিলফুল, কদলী তরু, খগচঞ্চু, বিশ্ব, দাড়িম্ব প্রভৃতি উপমা সমাবেশের মধ্যে দিয়ে অনির্বচনীয় ভাবসমারোহ সৃষ্টি করেছেন। যেমন—“চক্ষুদুটি স্রবে যেন শ্রাবণের মেঘ।” পয়ার, ত্রিপদী, ভঙ্গ ত্রিপদী, লঘু ত্রিপদী, একাবলী, মালঝাপ প্রভৃতি ছন্দ ব্যবহারে কবির কৃতিত্ব প্রশংসনীয়। যেমন পয়ার ছন্দ—

শাঁখারি সুন্দর কহ/শাখারী সুন্দর ৮ + ৬

কি নাম তোমার কহ/কোন গ্রামে ঘর। ৮ + ৬

রামেশ্বরের কবি প্রতিভার আর একটি বৈশিষ্ট্য তাঁর ভণিতা প্রয়োগের স্বাতন্ত্র্য। ভণিতায় তিনি শুধু আত্মপরিচয় দিয়েই ক্ষান্ত হননি। পদাবলির মহাজনীয় রীতি অনুসারে ভণিতার মধ্যে দিয়ে উপদেশ দিয়েছেন, তিরস্কার করেছেন, শ্লেষে-ব্যঙ্গে মুখর হয়ে উঠেছেন। কখনো তিনি ভব, কখনো ভবানীর অন্তরঙ্গতায় কখনো তাদের উপদেশ দেন, আবার কখনো বা তাদের মধ্যে বিবাদ বাধিয়ে আনন্দ উপভোগ করেন। কাব্যের ভণিতায় দ্ব্যর্থবোধক শব্দপ্রয়োগ করে কাব্যের বিশেষ ভাবব্যঞ্জনাকেও কবি সমৃদ্ধ করে তোলেন। নারদ যখন দক্ষকে উপদেশ দেন— “তোমার যজ্ঞে শিবকে আমন্ত্রণ নাহি করো” —তখন ভণিতায় কবি শিবের মহিমাকেই একমাত্র সত্য হিসাবে ব্যাজস্তুতির মাধ্যমে প্রয়োগ করেছেন।

রামেশ্বরের কাব্যে বেদ-পুরাণাশ্রয়ী নিষ্ঠাবান একজন পণ্ডিতের উপস্থিতি লক্ষ করি। দেশের শাস্ত্র পুরাণের সঙ্গে লোকাচারের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে লোকসংস্কারের পূর্ণ চিত্ৰচয়নে রামেশ্বর তাঁর কাব্যে সার্থকতা দেখিয়েছেন। আবার এইভাবেই তাঁর কাব্যে বাঙালির ধর্মের, সমাজের তথা গার্হস্থ্য জীবনের বাস্তব রসসমৃদ্ধ ছবি উত্থাপিত হয়েছে। তাই নব বিবাহিতা পার্বতীর প্রথম পতিগৃহে যাত্রা বর্ণনায় বাস্তবরসের সরসতা আছে। মেনকা চোখের জলে মেয়েকে বিদায় দিতে গিয়ে জামাতাকে বলেছে—

কুলীনের পোকে আর কি বলিব আমি।

বাছার অশেষ দোষ ক্ষমা কইরো তুমি।।

হাঁটু ঢাকা বস্ত্র দিও পেট ভরা ভাত।

প্রীতি করিও যেন জানকী রঘুনাথ।।

এই চিত্রের মধ্যে পারিবারিক জীবনের যে নিত্যকালের স্নিগ্ধ মাধুর্য প্রকাশিত হয়েছে। তা তাঁর কবিত্ব শক্তির পরিচায়ক।

তথ্যসূত্র:

১. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য

২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

৩. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!