মঙ্গলকাব্যের ধারায় শিবায়ন কাব্যের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যগুলি লেখ।
শিবায়ন কাব্যের বৈশিষ্ট্য
প্রথমত: শিবায়ন যেহেতু মঙ্গলকাব্যের ধারায় অন্তর্ভুক্ত, তাই শিবায়ন কাব্যও মঙ্গলকাব্য।
দ্বিতীয়ত: দেবমাহাত্ম প্রচার যদি মঙ্গলকাব্যের বিষয় হয় তাহলে শিবায়নে শিবের মাহাত্ম প্রচারের বিষয় রয়েছে।
তৃতীয়ত: অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনির সংমিশ্রণ ঘটেছে এই কাব্যে।
চতুর্থত: অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো এই কাব্যের ভোক্তারা হলেন সাধারণ মানুষ।
পঞ্চমত: বর্ণনাভঙ্গীর দিক থেকে শিবায়নের কবিরা অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের কবিদের অনেকটাই অনুসরণ করেছেন। যেমন— কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য, মুকুন্দরাম বা কেতকাদাসের মতো মঙ্গলকাব্যের দেবখণ্ডের অনুসরণে পৌরাণিক শিবের আখ্যান বিন্যস্ত করেছেন। সেজন্য দক্ষযজ্ঞ নাশ, শিবের তপস্যা, সমুদ্রমন্থন, শিবের বিষপান প্রভৃতি ঘটনা শিবায়নে আছে। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে বর্ণিত দেবদেবীর বর্ণনা, বিবাহ বর্ণনা, বিবাহ উপলক্ষে বরের রূপ ও ঐশ্বর্য দেখে নারীদের পতিনিন্দার অনুরূপ ঘটনা রামেশ্বরের কাব্যে রয়েছে। সেখানে প্রবীণা গৃহিণীরা নিজেদের জামাইদের নিন্দা করেছেন।
শিবায়ন কাব্যের স্বাতন্ত্র্য
প্রথমত: মঙ্গলকাব্যের গঠনরীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এর চারটি ভাগ— ১) বন্দনা, (২) গ্রন্থোৎপত্তির কারণ, (৩) দেবখণ্ড এবং (৪) নরখণ্ড। শিবায়ন কাব্যে এই প্রচলিত আঙ্গিক রীতির সন্ধান মেলে না।
দ্বিতীয়ত: কাব্যের নামকরণের মধ্যেও রয়েছে ভিন্নতা। শিবের জীবনচক্র বা শিব চরিত্রের বিবর্তনের কথা মনে রেখে এই ভিন্ন ধরনের নামকরণ। বরং রামায়ণের সাদৃশ্যে এই নামকরণ, মঙ্গলকাব্যের সাদৃশ্যে নয়।
তৃতীয়ত: মঙ্গলকাব্যের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কোন শাপভ্রষ্ট দেবদেবীর কাহিনি এই শিবায়ন নয়।
চতুর্থত: দেব পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের থেকে এই কাব্যের পার্থক্য। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের দেবতার মতো শিবের মাহাত্ম্য প্রচার শিবায়নের উদ্দেশ্য হলেও এই কাব্যে কোন শাপভ্রষ্ট দেবতাকে মর্ত্যে এসে পূজা প্রচার করতে হয় না। শিবায়ন কৃষক শিবের লৌকিক জীবন কাহিনি। কোন অনিচ্ছুক ব্যক্তিকে শিবঠাকুর ভয় ও প্রলোভন দেখিয়ে ভক্ত করে তোলেননি। সুতরাং দেব পরিকল্পনার দিক থেকে প্রচলিত মঙ্গলকাব্যের সঙ্গে শিবায়নের পার্থক্য।
পঞ্চমত: কাব্যের কায়াগঠনেও রয়েহে শিবায়নের স্বাতন্ত্র্য। চণ্ডী ও মনসামঙ্গলে দেবখণ্ড ও নরখণ্ড আছে। শিবায়নে এ ধরনের বিভাগ নাই। প্রথমাংশে শিব সম্বন্ধীয় পৌরাণিক নানা ধরনের আখ্যান এবং শেষাংশে কৃষক শিবের দাম্পত্য জীবনের চিত্র। এমনকি কোনো নর কাহিনিতে প্রবেশ করে শিবের মহিমাখ্যাপনের কোন চেষ্টা করেনি। শিবের ভিখারী জীবন, কৃষিকার্যে আত্মনিয়োগ, বাগ্দিনীর সঙ্গে অবৈধ প্রণয় প্রচেষ্টা, দাম্পত্য কলহ, শাখা পরার পর কলহের অবসান ইত্যাদির মধ্যে দেবমাহাত্ম্য যেমন কিছু নাই তেমনি পূজা প্রচারেরও কোন বিবরণ নাই। সুতরাং মৃগলুব্ধ কাহিনিতে শিবের মাহাত্ম্য বা পূজা প্রচারের দিক থাকলেও শিবায়নে তা নাই।
ষষ্ঠত: অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের প্রতিভাবান কবির আবির্ভাব ঘটলেও এই কাব্যে তার একান্ত অভাব। ব্যতিক্রম মাত্র—রামকৃষ্ণ ও রামেশ্বর।
সপ্তমত: শিবের গার্হস্থ্য জীবনের কৌতূহল ও পৌরাণিক মহিমা চণ্ডী ও মনসামঙ্গলের দেখণ্ডে বর্ণিত হয়েছিল বলে এ সম্বন্ধে সাধারণের কৌতুহল প্রায় ছিল না। তাই শিবায়ন প্রথম শ্রেণির মঙ্গলকাব্য রূপে বিবেচিত হয়নি।
অষ্টমত: কাহিনিগত ও শিল্পগত মূল্য— এই উভয় বিচারেই শিবায়ন অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের তুলনায় নিকৃষ্ট। শিব আখ্যানে হাস্যরসের উচ্ছলতা, লঘুতরল কৌতুক এবং আদিরসের উদ্দামতা বেশি ছিল বলে রসোত্তীর্ণ কাব্যের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি।
তথ্যসূত্র:
১. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন
Leave a Reply