শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে প্রতিফলিত সমাজ-ভাবনা আলোচনা কর।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সমাজ-ভাবনা

চর্যাগানে তৎকালীন প্রাচীন বাংলা ও সমাজ জীবনের অপ্রতুল নয়। চর্যা-পরবর্তী কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে তৎকালীন দেশ কাল সমাজের ছবি যেমন আছে তেমনি মানব হৃদয়ের বিচিত্র লীলাময়তা ধরা পড়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সমকালীন গ্রাম্য জীবন ধারার সঙ্গে শিথিল যৌন জীবনের চিত্র পাই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ধর্মাশ্রয়ী কাব্য হলেও বড়ু চণ্ডীদাসের হাতে উত্তর ভারতের গোপ সম্প্রদায়ের ও বাংলাদেশের পারিবারিক ও সামাজিক দিকটি উঠে এসেছে। রাধিকার বিবাহ হয়েছে বয়জ্যেষ্ঠ আইহনের সঙ্গে। তখন রাধিকা বালিকা মাত্র। বয়সের দিকে তাকালে বোঝা যায় সে যুগে বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল। সে সময়ে গৃহবধূর যত্রতত্র একাকী ঘুরে বেড়ানোর অধিকার ছিল না। স্বামী শ্বশুর, শাশুড়ীর বিশেষ অনুমোদনের সঙ্গে বিশ্বস্থ কোন আপন জনের প্রয়োজন হত। গোয়ালা জাতির মহিলাদের দুধ-দইয়ের পসরা নিয়ে হাটে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। সচরাচর ঘরের বাইরে না বেরোলেও জীবিকার প্রয়োজনে দলবেঁধে তাদের পসরা সাজিয়ে হাটে যাওয়ার বিষয় কাব্যে পাওয়া যায়। একসঙ্গে কলসী নিয়ে পুকুর বা নদীতে জল নিয়ে আসার কথা পাওয়া যাচ্ছে কাব্যে। যেমন—

শোভন কলসী       করে ধরিআঁ

পারিলোঁ যমুনা নীরে।

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে শুধু গোপ সম্প্রদায় নয়—তেলী, কুমোর, নাপিত, ভারী, পাটনী নানান বৃত্তিজীবির পরিচয় পাই। তেল বিক্রির সূত্রে তেলীর প্রসঙ্গ—

‘কান্ধে করুআ লআঁ তেলী আগে জাএ।

কুমোরের প্রসঙ্গ বার বার উঠে এসেছে। কুমোরের বিষয় কবি বড়ু চণ্ডীদাস হৃদয়-ঘটিত ব্যাপারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে এঁকেছেন—

‘মোর মন পোড়ে যেন কুম্ভারের পণী।’

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ‘ভারখণ্ডে’ ‘মজুরিআঁ’ বা ‘ভারী’ প্রসঙ্গের অবতারণা—

‘এক মজুরিআ আন বহু দধিভার।’

এই ভার বাহকের কথা শুধু উত্তর ভারত নয়, গ্রাম বাংলায় তাদের দেখা মেলে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা পারাপারের জন্য পাটনী বা ঘাটোয়ালের প্রসঙ্গও যাচ্ছে।

রন্ধনশালার দিকে তাকালে খাদ্যরসিক বাঙালির খাদ্যাভাসের যে তালিকা তার বিবরণ চোখে পড়ে। প্রধান আহার ছিল ভাত, এরসঙ্গে শাক, নিমঝোল, পটল ভাজা, অম্বলের কথা আছে। ভাতের সঙ্গে লেবু এবং সবশেষে গুয়া প্রদানের প্রসঙ্গ অতিথি বৎসল বাঙালী পরিচয় তুলে ধরেছে। ‘বংশীখণ্ডে’ রন্ধন প্রণালীর উল্লেখ রয়েছে—

‘আম্বল ব্যঞ্জনে মো বেশোআর দিলোঁ।

সাকে দিলোঁ কানাআঁ পাণী।।

তা সুনিআঁ ঘৃতে সো পরলা বুলিআঁ।

ভজিলোঁ এ কাবা গুআঁ’।।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে নারী সমাজের বিশেষ রীতি নীতির উদাহরণ দেখতে পাই। মঙ্গল-ঘট পেতে কামনা-বাসনা পূর্ণ করার প্রসঙ্গ সে যুগে ছিল। কৃষ্ণকে পাওয়ার জন্য রাধা যমুনার তীরে কদম্বতলে মঙ্গল ঘট স্থাপন করেছে—

যমুনার তীরে বড়াই কদমে তলে।

পূর্ণঘট পাতী বড়ায়ি চাহিত মঙ্গলে।।

এছাড়া আরো কিছু গ্রামীণ সংস্কার আমরা দেখতে পাই। যেমন হাঁচি, টিকটিকি বিষয়ক—

কোন অসুভ খণে পাঅ বাঢ়ায়িলোঁ।

হাঁছী-জিঠী আয়র উঝঁট না মানিলোঁ।।

শুন কলসী লই সখি আগে জাএ।

বাঞর শিআল মোর ডাহিনেঁ জাএ।।

বড়ু চণ্ডীদাস যে সামাজিক রীতি-নীতি বা লোকবিশ্বাস ও সংস্কারের প্রয়োগে সচেতন তা বোঝা যায়। সে কালে দিন-ক্ষণ, তিথি-নক্ষত্রের বাছবিচার ছিল। যেমন—

শুভ তিথি বার শুভক্ষণে।

আল অতিশয় উল্লাশিত মনে।।

ল বড়ায়ি বন্দিআঁ সব দেবগণে।

আল বড়ায়ি শ্রীরাম চরণে।।

এছাড়া মন্ত্র-তন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, তুক্‌তাক্ প্রভৃতি বিশ্বাসের কথা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে স্থান পেয়েছে—

নিন্দাউলী মন্ত্রে যাক (তাক) নিন্দাইব আহ্মি।

তবে তার বাঁশী লআঁ ঘর জাইহ তুহ্মি।।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে গ্রাম্য কথাবার্তা, মেয়েলি সমাজের ভাষাসহ গ্রাম্য গালিগালাজ, অশ্লীল উক্তি ও স্থূলরসের পরিচয় মেলে। যেমন—

ক) নাটকী গোয়ালী ছিনারী পদমরী।

সত্ত্যে ভাষ নাহিঁ তোরে।

খ)   যবে মো চুরি কৈলোঁ হআঁ নারীসতী।

তবেঁ কাল সাপ খাই এ আজিকার রাতী।।

রাধা-কৃষ্ণ লীলাবিষয়ক কাব্য হওয়া সত্ত্বেও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ থেকে আমরা তৎকালীন সমাজের যে খণ্ড খণ্ড চিত্র পাই তা পমিাণে বেশি না হলেও তার মূল্য কম নয়। এরই মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালি মনের ছাপটি অনুভব করা যয়। মধ্যযুগের কাব্যসমাজের চালচিত্র তুলে ধরার অভীষ্টে রচিত না হলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেই বাঙালির ভাবচেতনা ও জীবনরস বোধের প্রথম প্রকাশ ঘটেছে বলা যায়।

তথ্যসূত্র: