সনেট কাকে বলে? সনেটের বৈশিষ্ট্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা কর।
সনেট বা চতুর্দশপদী
“Sonnetto” (ইতালীয় শব্দ)—থেকে SONNET (সনেট) শব্দটি সৃষ্ট; বাংলায় ‘চতুর্দশপদী কবিতা’। সনেট এক ধরনের গীতি কবিতা। ইতালীয় মূল শব্দটির অর্থের মধ্যেই তার ইঙ্গিত রয়েছে—মৃদু সঙ্গীত ধ্বনি। তবে লিরিকের সঙ্গে এর তফাৎ হল কাব্যকায়া নির্মাণে পরিমিতি বোধের সঙ্গে আবেগের মাত্রার, সনেট দৃঢ় পিনদ্ধ শাসনে বদ্ধ, কিন্তু লিরিক অনেকটাই বন্ধনহীন। লিরিকে ভাবোচ্ছ্বাসের তারল্য স্বাভাবিক, কিন্তু সনেটে ভাবগাম্ভীর্য প্রত্যাশিত। সনেটের মূল কথা হচ্ছে এই যে, সনেট চোদ্দ চরণের এক জাতীয় কবিতা, যার মধ্যে ভাবের সংহত প্রকাশ একমাত্র কাম্য। বলা যায় এ যেন মহাসমুদ্রের সমূহ তরঙ্গের উচ্ছাস, এক অঙ্গুলির মধ্যে ধরার প্রয়াস, হৃদয়ের বিপুল অনুভবকে কয়েকটি ছত্রে ছন্দায়িত করা। এর জন্য চাই কবির গভীর অনুভব ও রস-চেতনা। আবেগের প্রবাহের দৃঢ় শৃঙ্খলে বাঁধার জন্য চাই আত্মস্থ কবি কল্পনার পরিমিতি বোধ। সনেটের আটসাঁটো অবয়বের মধ্যে কাব্যের আত্মাকে প্রাণবন্ত করতে চাই সুগভীর ভাব প্রকাশের উপযোগী প্রসাধন কলা। এর জন্য চাই সুনির্বাচিত শব্দ, অলঙ্কার এবং অনিবার্য বাক-রীতির প্রয়োগ। একাজ দুরূহ। তাই বলা হয় সনেট হল ‘moment’s monument’-মুহূর্তের মিনার। সনেটের প্রেরণা নিঃসন্দেহে লিরিক কবি-প্রতিভা; তবে সনেটে কবির লিরিক উচ্ছাস সংহত হয় মাত্র ১৪ টি চরণে।
এ যেন মুকুর তলে ব্রহ্মাণ্ডের ছায়া,
অসীমেরে টেনে আনা সীমার মাঝারে।
(প্রিয়ম্বদা দেবী)
সনেটের বৈশিষ্ট্য
সনেটের লক্ষণগুলি এইরূপ—
- প্রতিটি সনেটে পয়ারবন্ধে চৌদ্দটি পয়ার বা পঙক্তি অর্থাৎ চরণ থাকে।
- প্রতিটি পঙক্তিতে মাত্রা থাকে চৌদ্দটি।
- সনেট গাঢ় বদ্ধ রচনা-ভাতিরেক থাকে না, ভাষা প্রাঞ্জল, কিন্তু শাণিত ও বুদ্ধিদীপ্ত।
- সনেট স্থাপত্য ধর্মী, গথিক রীতিতে আঁকা ছবি।
- ভাবের উদ্দামতা অপেক্ষা সংহতিই সনেটের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
- অক্ষরবৃত্ত/মিশ্রবৃত্তের মাত্রা গণনা রীতি অনুসৃত হয়।
- দুটি স্তবকে সনেটের চৌদ্দটি পংক্তি বিভাজিত হয় ৮+৬ হিসাবে। আটটি পংক্তি সমন্বিত স্তবককে (Octave বা অষ্টক এবং ছ’টি চরণের স্তবককে বলে Sestet বা ষষ্টক।
- পেত্রার্কীয় রীতিতে অষ্টক এবং ষষ্টক দুটি ভাগে বিভক্ত। অষ্টক চার+চার চরণে বিভক্ত হয়; একে বলে চতুস্ক বা Quatrain, এবং ষষ্টক তিন+তিন চরণে বিভক্ত, একে বলে ‘ত্রিপদিকা বা Tercet.
- সনেটে চরণান্তিক মিল-বিন্যাসের তিনটি রীতি আছে—
(১) পেত্রার্কীয় রীতি
অষ্টকের মিল—ক খ খ ক, ক খ খ ক ।
ষষ্টকের মিল—গ, ঘ, গ ঘ, গ ঘ, অথবা গ ঘ ঙ, গ ঘ ঙ।
(২) শেক্সপীয়রীয় রীতি
অষ্টকের মিল—ক খ ক খ, ক খ ক খ
ষষ্টকের মিল—ঙ চ ঙ চ ছ ছ
(৩) ফরাসী সনেটের রীতি
অষ্টকের মিল—ক খ খ ক, ক খ খ ক
ষষ্টকের মিল—গ গ, ঘ ঙ, ঘ ঙ,
- প্রকৃতপক্ষে সনেট এক দুরূহ কাব্যশিল্প। বিশেষ ছন্দরীতি, আঙ্গিক ও মিলবিন্যাসরীতি সনেটের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এখানে কবিকল্পনা, ও ভাবাবেগ কঠিন অনুশাসনের অধীন। একটি মাত্র ভাবের ব্যঞ্জনা ১৪টি পংক্তির মধ্যে ধরে রাখার সুশৃঙ্খল প্রয়াস সনেটের বৈশিষ্ট্য। আবেগের স্বতোস্ফূর্তির স্থান সনেটে নেই। রসেটির ভাষায় সনেট হলো—‘moment’s monument’, ভাবের সংহত পিরামিড হলো সনেট।
- বাংলা সহিত্যে সনেট পশ্চিমী ফসল। মধুসূদনের হাত ধরে চতুর্দশপদী কবিতার যাত্রা শুরু। য়ুরোপে নবজাগরণের উদ্দীপনায় ভেসে প্রবল জীবনপ্রীতি ও মর্ত্যপ্রীতির গভীরে ডুব দিয়ে ও নারীপ্রেমে প্লাবিত হয়ে ইতালীয় কবি পেত্রার্ক (১৩০৪-৭৪) সনেটের দৃঢ়-পিনদ্ধ কায়া রূপের মধ্যে হৃদয়াবেগের সমুদ্রোচ্ছ্বাস ধরে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি সনেটের স্রষ্টা নন। ইতালীয় কবি Giacono da Lentino (1215-33) সম্ভবত সনেটের প্রথম রচয়তা। জার্মান কবি দান্তেকেও (1265-1321) অনেকে সনেটের জনক বলে মনে করেন। ষোড়শ শতকে ইংরেজি সাহিত্যে কবি ওয়াট ও সারে এবং পরে শেক্সপীয়রের হাতে সনেটরূপ পায়। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনই প্রথম সনেট রচয়িতা। তাকে অনুসরণ করে পরবর্তী গলে অনেকেই সনেট লিখেছেন–দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয় কুমার বড়াল, মােহিতলাল, রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে অগ্রণী।
রবীন্দ্রনাথের একটি সনেট
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।
ধরায় প্রাণের খেলা চির তরঙ্গিত,
বিরহ মিলন কত হাসি—অশ্রু ময়,
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সঙ্গীত
যদি গো রচিতে পারি অমর আলয়।
তা যদি না পারি তবে বাঁচি কতকাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সঙ্গীতের কুসুম ফুটাই।
হাসি মুখে নিয়ে ফুল; তারপরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায়।
রবীন্দ্রনাথ অষ্টক— ষষ্টক নিয়ম সর্বত্র মানেননি। সনেটের চতুর্দশপদ ও চতুর্দশমাত্রাকে তিনি প্রায়শই লঙ্ঘন করেছেন।
য়ুরোপীয় সনেট অনুসরণ করেও মধুসূদন বাংলা সনেটকে নতুন মাত্রা দিলেন। একটি দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক—
মধুসূদনের একটি সনেট
যেও না রজনী, আজি লয়ে তারাদলে!
গেলে তুমি দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!—
উদিলে নির্দয় রবি উদয়-অচলে,
নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে!
বার মাস তিতি, সতী, নিত্য অশ্রুজলে,
পেয়েছি উমার আমি! সান্ত্বনা-ভাবে—
তিনটি দিনেতে কহ, লোহ তারা-কুন্তলে,
এই দীর্ঘ বিরহ-জ্বালা এ মন জুড়াবে?
তিন দিন স্বর্ণ দীপ জ্বলিতেছে ঘরে
দূর করি অন্ধকার; শুনিতেছি বাণী—
মিষ্টতম এ সৃষ্টিতে এ কর্ণ-কুহরে!
দ্বিগুণ আঁধারে ঘর হবে, আমি জানি
নিবাও এ দীপ যদি!—কহিলা কাতরে
নবমীর নিশাশেষে গিরীশের রাণী।
বাংলা ভাষায় মধুসূদন পয়ারের বন্ধন ছিন্ন করে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেছিলেন। তিনিই য়ুরোপীয় আদর্শে সনেট রচনায় এগিয়েও সম্পূর্ণ নিজস্ব আদর্শে চতুর্দশপদী রচনা করলেন। আর তাকেই পরবর্তীকালে মহাকবিরা নতুন মাত্রায় নতুন আকার দিয়েছেন। বিশ্ব সনেট আন্দোলন থেকে তার চরিত্র আলাদা হলেও ঐতিহ্যে তা আদৌ কম নয়। বাংলা সনেটের ইতিহাসে আর দুজনের নাম উল্লেখ করতে হয়। একজন প্রমথ চৌধুরী, দ্বিতীয় জন মোহিতলাল। য়ুরোপীয় সনেটের নিখুঁত আদর্শ অনুসরণ করেও স্বকীয়তা দেখিয়েছেন দুজনেই। প্রমথ চৌধুরী ফরাসী সনেটের আদর্শে বেশী অনুপ্রাণিত, অন্যদিকে মোহিতলালে পেত্রার্কীয় এবং শেক্সপীয়রের অনুসৃতি অধিক। একালেও অনেকেই সনেট লিখেছেন বা লিখছেন। বুদ্ধদেব বসু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র, বিষ্ণু দে, গোলাম মোস্তাফার হাত ধরে বাংলা সনেট যুগান্তরের পথে পা বাড়িয়েছে। বর্তমানে তার মধ্যে গদ্যকবিতা ও প্রবহমান পয়ারের ছাঁদ লক্ষ করা যাচ্ছে। অর্থাৎ বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে যে মুক্তির হাওয়া চলছে তার হাওয়া বাংলা সনেটেও লেগেছে। রূপের সংহতি নয়, ভাবের সংহতি এখন সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব লাভ করেছে।
নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সনেট
- সনেট হচ্ছে (Sculpture) স্থাপত্যধর্মী— এর ভেতর উদ্দাম flow (প্রবাহ) নেই। যেটুকু গতি আছে তা সংহত ও সংযত। সনেটের ভেতর এমন কোন তোড় নেই যা পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সনেট প্রতিমাধর্মী।—এর সৌন্দর্য অনেকটা technique-এর ওপর নির্ভর করে।—সনেট, আর্ট নামক গুণই প্রধান লক্ষ করবার জিনিস। আর্ট অনেকটা বন্ধনের সামগ্রী।”—প্রমথ চৌধুরী।
- চৌদ্দ অক্ষরের চৌদ্দটি লাইনে কতটুকু কথাই বা বলা যায়? আমার মনে হয়, আঠারো অক্ষরের ছন্দই বাংলা সনেট রচনার সবচেয়ে উপযোগী।”—বুদ্ধদেব বসু।
- “The Sonnet (diminitive from Italian Sono/Sound) is a short lyrical Poem complete in one Stanza Containing fourteen lines of fix measured verse.” (Prof. Bain)
- “A small poem, in which some lonely feeling is devoloped.’’ —সনেট সম্বন্ধে কবি কোলরিজ।
Leave a Reply