রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হিন্দু থিয়েটারের অবদান লেখ।

প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হিন্দু থিয়েটার

বাঙালির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম নাট্যশালা। প্রতিষ্ঠাতা প্রসন্নকুমার ঠাকুর তাঁর নারকেলডাঙ্গার বাড়িতে রঙ্গালয়টি তৈরি করেন। থিয়েটারের পরিচালন কর্মসমিতিতে ছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত, গঙ্গানারায়ণ সেন, মাধব মল্লিক, হরচন্দ্র ঘোষ, তারাচাদ চক্রবর্তী প্রমুখ ধনী অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত বাঙালিরা। ‘সমাচার দর্পণ’ (১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৩১) পত্রিকা থেকে জানা যায় যে—‘‘ঐ নর্তনশালা ইংলণ্ডীয়দের রীত্যানুসারে প্রস্তুত হইবেক এবং তন্মধ্যে যে সকল নাটকের ক্রীড়া হইবে সকলি ইংলণ্ডীয় ভাষায়।’’

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এই নাট্যশালাটি প্রস্তুত হয়। প্রথম নাটক অভিনীত হয় ভবভূতির ‘উত্তরারামচরিত’ সংস্কৃত নাটকের ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদ করেন সংস্কৃতজ্ঞ ইংরেজ পণ্ডিত এইচ. এইচ. উইলসন। একই রাত্রে এই নাটকের সঙ্গে অভিনীত হয় শেক্সপীয়ারের ‘জুলিয়াস সীজার’ নাটকের পঞ্চম অঙ্কটি, মূল ইংরেজিতেই। অভিনয়ের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর, ১৮৩১। উইলসন শুধু নাট্যানুবাদ করেননি, তিনি এই নাট্যশালার উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং নিজে অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি অভিনয়ের নাট্যশিক্ষকও ছিলেন। মনে রাখতে হবে, সাহেবদের চৌরঙ্গী থিয়েটারের তিনি উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং নব্য তরুণ বাঙালির শিক্ষক ছিলেন।

এখানে আরেকটি নাটকের অভিনয়ের সংবাদ পাওয়া যায়। সেটিও ইংরেজি ভাষাতেই অভিনয় হয়েছিল। প্রহসন নাটকটির নাম ‘নাথিং সুপারফ্লয়াস’। অভিনয়ের তারিখ ২৯ মার্চ, ১৮৩২। অভিনয়ে দৃশ্যপটাদি রুচিসম্মত এবং পাত্রপাত্রীদের সাজসজ্জা ও বেশভূষা চমৎকার হয়েছিল। ‘নাথিং সুপারফ্লুয়াস’ নাটকের প্রধান চরিত্র সুলতান, সালিন গফর, সাদি ও সুন্দরী গুলনেয়ার। গুলনেয়ারের অভিনয় খুব ভালো হয়েছিল। কোনো পুরুষ অভিনেতা এই চরিত্রে পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন এবং স্ত্রীচরিত্রের ধারণা ও ভাব খুব রুচিসম্মতভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সেই অভিনেতার নাম জানা যায়নি।

বহু সম্ভ্রান্ত ইউরোপীয় ও দেশীয় ভদ্রলোক নাট্যানুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ‘উত্তররামচরিত’কে তৎকাল প্রচলিত ‘রামযাত্রা’ মনে করে দর্শকের মধ্যে কোলাহল হয়েছিল। এই খবর দিয়ে ‘সমাচার দর্পণ’ লিখেছিল যে, বড়লোকদের এই নাটকাভিনয় প্রচলিত কালীয়দমন, রামযাত্ৰা বা চণ্ডীযাত্রার মতো ছিল না। ইংরেজি শিক্ষার জন্য এদের অভিনয় অনেকগুণ শ্রেষ্ঠ ছিল।

বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে হিন্দু থিয়েটারের অবদান

হিন্দু থিয়েটারের নাট্যাভিনয় ইতিহাসগত দিক দিয়ে কয়েকটি কারণে উল্লেখযোগ্য—

  • হিন্দু থিয়েটার বাঙালির প্রতিষ্ঠিত প্রথম থিয়েটার।
  • বাঙালির থিয়েটারে ইংরেজি মডেলে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল।
  • প্রথম মঞ্চে বাংলা নাটকের বদলে ইংরেজি ভাষায় নাটকের অভিনয় হয়েছিল।
  • একটি শেক্সপীয়রের নাটকের মূল ইংরেজি অংশ এবং অন্যটি সংস্কৃত নাটকের ইংরেজি অনুবাদ ও একটি মজাদার প্রহসন ইংরেজিতে হয়েছিল।
  • নাট্যশিক্ষা দিয়েছিলেন একজন ইংরেজ-উইলসন সাহেব।
  • দৃশ্যসজ্জা ও সাজসজ্জা অতি সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।
  • এই থিয়েটারে বাঙালি ও ইংরেজ উভয়শ্রেণীর দর্শকই উপস্থিত ছিল।
  • হিন্দু থিয়েটারের অভিনয় প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস) মন্তব্য—‘‘বঙ্গীয় নাট্যশালা ও নাটকের উৎপত্তি ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালিদের দ্বারা বিদেশী আদর্শে। একথাটি ভাল করিয়া স্মরণ রাখা উচিত।’’
  • এই থিয়েটারের নাট্যাভিনয় তৎকাল প্রচলিত লোকনাট্য যাত্রার তুলনায় অনেক উন্নত মান ও রুচির পরিচয় দিয়েছিল।
  • বিদেশী অনুকরণে থিয়েটার হয়েছে, কিন্তু তখন বাংলায় নাটক রচনা শুরু হয়নি।
  • বাঙালিকে বাঙালির প্রাসাদমঞ্চে বসে ইংরেজি মডেলের থিয়েটারে ইংরেজি নাট্যাভিনয় দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!