অনুরাগ কাকে বলে? এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবির কৃতিত্ব আলোচনা কর।
অনুরাগ
সংজ্ঞা
শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে অনুরাগের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন—
সদানুভূতমপি যঃ কৃর্যান্নবনবং প্রিয়ম্।
রাগো ভবন্নবনবঃ সোহগনুরাগ ইতীর্যতে।।
অর্থাৎ যে রাগ নিত্য নব নবায়মান হয়ে সর্বদা অনুভূত প্রিয়জনকেও নতুন নতুনভাবে অনুভব করিয়ে প্রতি মুহূর্তেই প্রেমকে নবীনতা দান করে, তাকেই অনুরাগ বলা হয়। অনুরাগের ফলে প্রিয়স্বাদ বাসনার তৃপ্তি হয় না কখনো, আর প্রীতিও পরিণতি পায় না। অনুরাগের লক্ষণ চারটি— ১) পরস্পরবশীভাব, ২) প্রেমবৈচিত্ত্য, ৩) অপ্রাণীতেও জন্মলাভের উৎকট লালসা এবং, ৪) বিপ্রলম্ভেও (বিরহ অবস্থাতেও) বিস্ফূর্তি (কৃষ্ণানুভব)। এই অনুরাগের মধ্যে চির অতৃপ্ত এবং চিরব্যাকুলতার প্রকাশ ঘটে।
অনুরাগ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি জ্ঞানদাস
অনুরাগ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে জ্ঞানদাসকেই চিহ্নিত করা হয়। বিশেষ করে রূপানুরাগ পর্যায়ে শ্রীরাধার কৃষ্ণরূপদর্শনের মুগ্ধতা ও উল্লাসকে তার মতো আর কোনও কবিই ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর’ শীর্ষক পদটি এই পর্যায়ের এক অতুলনীয় পদ। শ্রীরাধা বলছেন, শ্রীকৃষ্ণের রূপ ও গুণ তাকে এমন আকৃষ্ট করেছে যে, সে রূপ দেখার বাসনায় তার দু’চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে। আর কৃষ্ণের গুণে তার মন বিহ্বল হয়। কৃষ্ণের প্রতিটি অঙ্গের জন্য রাধার প্রতিটি অঙ্গ কাঁদতে থাকে। তার প্রাণ প্রেমের ধৈর্য ধরতে পারে না। তাই রাধা সখীকে বলছেন, তিনি যা ভেবেছেন তাই-ই করবেন। কৃষ্ণকে দেখে রাধা যে আনন্দলাভ করেন তা অনির্বচনীয়। কৃষ্ণের দর্শন ও স্পর্শ পাওয়ার জন্য শরীর ব্যাকুল হয়।
কৃষ্ণের স্মিতহাস্য রাধার অনুভবে মধুনিষ্যন্দী। কৃষ্ণের কথা শুনলেও তা শরীর আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেই আনন্দকে গোপন করার জন্য রাধা কত চেষ্টা করেন কিন্তু তার দু’চোখের অনর্গল অশ্রুধারায় আর তা গোপন থাকে না। বাড়ির লোকেরা সবাই কানাকানি করে। পদটির প্রথম চার পংক্তি সম্পর্কে অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলেছেন—‘‘অনন্ত বাসনার অনন্ত হাহাকার মাত্র চার ছত্রের মধ্যে যেভাবে ধরা পড়িয়াছে, তেমন মহাবিস্ময় কাব্যেতিহাসে অল্পই ঘটিয়াছে। নিখিল মানবের বেদনা কোনও এক ক্ষুদ্র মানবকণ্ঠে উৎসারিত হওয়া সম্ভব একথা কে বিশ্বাস করিত যদি ঐ অসম্ভব আর্ত কয়েকটি পয়ারছত্র উপস্থিত না থাকিত।” রূপানুরাগের এই পদটিতে জ্ঞানদাসের সিদ্ধির চরমোৎকর্ষই প্রকাশ করছে সমালোচকের এই মন্তব্যটি।
কৃষ্ণরূপমুগ্ধা রাধার গভীর প্রেমানুভূতির প্রকাশে সেই নিবিড়-গভীর অথচ কোমল-মধুর প্রেমের অলংকার-বিরল ভাবতন্ময় বর্ণনায় জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভা মত্ত ময়ূরের মতো শত বরণের ভাবোচ্ছ্বাসকে কলাপ বিকাশ করেছে। বিদ্যাপতির অলংকার-বৈচিত্র্য ও চণ্ডীদাসের ভাবোচ্ছ্বাসকে অতিক্রম করে জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভা মত্ত ময়ূরের মত শত বরণের ভাবোচ্ছ্বাসকে অতিক্রম করে জ্ঞানদাস এখানে ভাবের সংযত রূপকে ভাষায় আয়ত্ত করেছেন। দেহ এবং মন উভয়েই নিবিড় সম্পর্ক রূপলাভ করেছে তার এই পদটিতে। কৃষ্ণের রূপ ও গুণ উভয়েই জ্ঞানদাসের রাধার অনুরাগকে বাড়িয়ে তোলে। পুরুষের রূপদর্শনে নারী-চিত্তের এমন আকুতি, প্রেমের বেদনা-মাধুরীর এত অপূর্ব রূপায়ণ ভারতীয় সাহিত্যে শুধু নয়, বিশ্বসাহিত্যেও দুর্লভ। দেহকে অস্বীকার করে নয়, দেহের দেহলীতে দাঁড়িয়ে রাধার মর্ত্যচারী প্রেম ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতিকে কতখানি উৎকর্য দান করেছে, কত মহিমময় করে তুলেছে, তারই উচ্চারণ এই পংক্তি দুটি— “দেখিতে যে সুখ উঠে কি বলিব তা। দশ পরশ লাগি আউলাইছে গা।”
Leave a Reply