অনুসর্গের শ্রেণিবিভাগ উদাহরণসহ আলোচনা কর।
অনুসর্গ
যে সকল অব্যয়পদ বিশেষ্য বা সর্বনামের পরে কখনো স্বাধীনভাবে আবার কখনো শব্দ বিভক্তির ন্যায় বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে অর্থ প্রকাশ করতে সাহায্য করে, তাদেরকে অনুসর্গ বা কর্মপ্রবচনীয় বলে। যেমন: ‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরি যে দেশ’— এই বাক্যে ‘দিয়ে’ একটি অনুসর্গ।
এখানে, ‘অনু’ অর্থ পরে বা পশ্চাতে এবং ‘সর্গ’ অর্থ সৃষ্টি বা ব্যবহার। অনুসর্গ শব্দের পরে বসে সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে পরবর্তী শব্দের অর্থবোধক সম্পর্ক সৃষ্টি করে। অনুসর্গগুলো অব্যয় পদ এবং এদের নিজস্ব অর্থ আছে। অনুসর্গ দিয়ে কারক চেনা যায় এবং অনুসর্গ বিভক্তির মতো কাজ করে।
অনুসর্গের শ্রেণিবিভাগ
প্রকৃতিগত শ্রেণিবিভাগ
অনুসর্গ কোন পদের পরে বসে বাক্যের সাথে ওই পদকে সম্পর্কিত করতে পারে, তার প্রকৃতি বিচার করে ৩টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—বিশেষ্য অনুসর্গ, সর্বনাম অনুসর্গ, বিশেষণ অনুসর্গ
১. বিশেষ্য অনুসর্গ
এই জাতীয় অনুসর্গ বিশেষ্য পদের পরে বসে। যেমন– প্রাণের চেয়ে প্রিয়। ছাদের উপর খোলা আকাশ।
২. সর্বনাম অনুসর্গ
এই জাতীয় সর্বনাম পদের পরে বসে। যেমন–আমার চেয়ে সে বড়। ওর কাছে বইটি আছে।
৩. বিশেষণ অনুসর্গ
এই জাতীয় বিশেষণ পদের পরে বসে। যেমন– মন্দের চেয়ে একটু ভালো। খারাপের চেয়ে খারাপ।
উৎসগত শ্রেণিবিভাগ
উৎসের বিচারে অনুসর্গ তিন প্রকার— সংস্কৃত অনুসর্গ, সংস্কৃত-বিবর্তিত, বিদেশী অনুসর্গ।
১. সংস্কৃত অনুসর্গ
সংস্কৃত শব্দ সরাসরি বসেছে এমন উপসর্গ। যেমন— অপেক্ষা, অভিমুখে, উপরে, কর্তৃক, ইত্যাদি।
২. সংস্কৃত-বিবর্তিত অনুসর্গ
সংস্কৃত শব্দের ক্রমবিবর্তনের মধ্য আগত কোন শব্দ যখন অনুসর্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন— সংস্কৃত অগ্রে>প্রাকৃত অগ্গে>বাংলা আগে। এরূপ অন্যান্য অনুসর্গ হতে পারে কাছে, ছাড়া, পাশে।
৩. বিদেশী অনুসর্গ
বাংলা, সংস্কৃত, সংস্কৃত থেকে ক্রমবিবর্তিত অপরাপর শব্দ যা অনুসর্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন—ফারসি, দরুন, বদলে,বনাম।
উৎপন্নের বিচারে শ্রেণিবিভাগ
উৎপন্নের বিচারে অনুসর্গ দুই প্রকার— নামজাত অনুসর্গ, ক্রিয়াজাত অনুসর্গ।
১. নামজাত অনুসর্গ
ক্রিয়ামূল থেকে উৎপন্ন অনুসর্গ ছাড়া অন্যান্য অনুসর্গের সাধারণ পরিচয় দেওয়া হয় নামজাত অনুসর্গ বলা হয়। যেমন—উপরে, অপেক্ষা ইত্যাদি।
২. ক্রিয়াজাত অনুসর্গ
কোনো ক্রিয়ামূলের সঙ্গে থেকে উৎপন্ন এমন কিছু শব্দ, যেগুলো অনুসর্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন—√কর্+ইয়া=করিয়া>করে বা ক’রে। [ভালো করে কাজ কর]
বিভক্তির সংযুক্তির বিচারে শ্রেণিবিভাগ
অনুসর্গের সাথে বিভক্তি আছে না নেই, তার উপর ভিত্তি করে, অনুসর্গকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন–বিভক্তিহীন অনুসর্গ, বিভক্তিযুক্ত অনুসর্গ।
১. বিভক্তিহীন অনুসর্গ
এই সকল অনুসর্গের সাথে কোনো বিভক্তি থাকে না বা বিভক্তি যুক্ত করা যায় না। যেমন—দ্বারা, কর্তৃক, নাগাদ ইত্যাদি।
২. বিভক্তিযুক্ত অনুসর্গ
এই সকল অনুসর্গের সাথে বিভক্তি যুক্ত থাকে। নামজাত অনুসর্গে ‘এ’ বিভক্তি যুক্ত থাকে। যেমন—আগ>আগে, উপর>উপরে, কারণ>কারণে ক্রিয়ামূলজাত অনুসর্গে ‘ইয়া’ বিভক্তযুক্ত হয়ে অনুসর্গ তৈরি হয়। যা সাধু রূপে ব্যবহৃত হয়। চলিত রূপে এর সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন—√কর্+ইয়া=করিয়া>করে বা ক’রে; √ধর্+ইয়া=ধরিয়া>ধরে বা ধ’রে।
অনুসর্গের প্রয়োজনীয়তা
১. অনুসর্গ নির্দেশ করে বাক্যের অর্থগত শৃঙ্খলা।
২. অনুসর্গগুলো বাংলা ভাষায় বিভক্তির কাজ করে।
৩. অনুসর্গগুলো বাক্য গঠনে সহায়তা করে।
৪. পাশাপাশি পদসমূহের অন্বয় সাধনে অনুসর্গের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
৫. অনুসর্গ ছাড়া কারকের অর্থ প্রকাশ পায় না।
৬. অভাব, তুলনা ইত্যাদি ভাব প্রকাশ করার জন্য অনুসর্গের প্রয়োজন।
অনুসর্গের প্রয়োগ
১. বিনা / বিনে: তুমি বিনা/বিনে আমার কে আছে? (কর্তৃ কারকের সঙ্গে)
২. বিনি: বিনি সুতায় গাঁথা মালা। (করণ কারকের সঙ্গে)
৩. অবধি: সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করব। (পর্যন্ত অর্থে)
৪. সহিত: শত্রুর সহিত সন্ধি চাই না। (সমসূত্র অর্থে)
৫. সহ: তিনি পুত্রসহ উপস্থিত হলেন। (সহগামিতা অর্থে)
৬. মতো: বেকুবের মতো কাজ করো না। (ন্যায় অর্থে)
৭. দ্বারা: তোমার দ্বারা এমন কাজ কী করে সম্ভব।
৮. প্রতি: ভক্ত নায়কের প্রতি কৃপা কর ভগবতি।
৯. কারণ: পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি।
১০. অপেক্ষা: মনুষ্য জাতি প্রায় সমুদয় জন্তু অপেক্ষা অধিক কাল বাঁচে।
১১. নিকট: তোমার নিকট অভিযোগ নিয়ে এসেছি।
১২. মাঝে: সবহারাদের মাঝে আমি একা।
১৩. বদল: নাকের বদলে নরুন পেলাম।
১৪. বাদ: তিন মাস বাদে ফিরে এলাম।
১৫. সকাশ: গুরুর সকাশে আসি বসে ধীরে ধীরে।
এগুলি ছাড়াও অনুসর্গের আরো প্রয়োগ রয়েছে।
Leave a Reply