অপ্রস্তুত-প্রশংসা অলংকারের শ্রেণিবিভাগসহ বিভিন্ন ভাগের বর্ণনা দাও।
অপ্রস্তুত-প্রশংসা
বিশদভাবে বর্ণিত অপ্রস্তুত থেকে যদি ব্যঞ্জনায় প্রস্তুতের প্রতীতি হয়, তাহলে হয় অপ্রস্তুত-প্রশংসা অলংকার।
অপ্রস্তুত-প্রশংসা অলংকারের শ্রেণিবিভাগ
অপ্রস্তুতে প্রস্তুতে যোগসূত্র রচিত হয় পাঁচভাগে— সামান্য-বিশেষভাব, বিশেষ-সামান্যভাব, কার্য-কারণভাব, কারণ-কার্যভাব এবং সাদৃশ্যভাব।
সামান্য-বিশেষভাব
সামান্য অপ্রস্তুত থেকে বিশেষ প্রস্তুতের প্রতীতি—
উদাহরণ:
সাধকের কাছে প্রথমেতে ভ্রান্তি আসে
মনোহর মায়া-কায়া ধরি; তার পরে
সত্য দেখা দেয়, ভূষণ-বিহীন রূপে
আলো করি অন্তর বাহির।
ব্যাখ্যা: চিত্রাঙ্গদার প্রতি অর্জুনের উক্তি। এতে রয়েছে একটি সামান্য সত্যের সুন্দর বর্ণনা। কিন্তু কবির আসল বর্ণনীয় বিষয় এটি নয়, তাই এটি সামান্য অপ্রস্তুত। কবির লক্ষ্য চিত্রাঙ্গদার অনুপম-সৌন্দর্যময়ী বাহ্যসত্তার অন্তস্তলচারিণী স্বরূপ সত্তাটির দিকে— এই বিশেষ সত্যটিই কবির প্রকৃত; তাই এটি বিশেষ প্রস্তুত। কবি সামান্য অপ্রস্তুতের ব্যঞ্জনায় প্রতীত করে তুলেছেন, এই অবর্ণিত বিশেষ প্রস্তুতটিকে। এই কারণে এখানে অলংকার হয়েছে অপ্রস্তুত-প্রশংসা।
বিশেষ-সামান্যভাব
বিশেষ অপ্রস্তুত থেকে সাম্যন্য প্রস্তুতের প্রতীতি—
উদাহরণ:
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়
তা বলে কুকুরে কামড়ানো কি রে মানুষের শোভা পায়?
ব্যাখ্যা: অধমের আচরণ উত্তর অনুসরণ করে না— এই সাধারণ সত্যটি কবির বক্তব্য বিষয়, তাই এটি সামান্য প্রস্তুত। কিন্তু এ বিষয়ে নীরব থেকে কবি অবতারণা করেছেন কুকুরঘটিত বিশেষ ব্যাপারটির। এই বিশেষ অপ্রস্তুত থেকে প্রতীত হচ্ছে সামান্য প্রস্তুতটির। অলংকারটি তাই দ্বিতীয় লক্ষণের অপ্রস্তুত-প্রশংসা।
কার্য-কারণভাব
কার্য অপ্রস্তুত থেকে কারণ প্রস্তুতের প্রতীতি—
উদাহরণ:
প্রেয়সি, বারেক তুমি আসিয়া দাঁড়ালে
লজ্জায় চন্দ্রমা যায় মেঘের আড়ালে
হরিণি পলায় বনে, সরমে কমল
লুকায় সুনীল জলে, স্তব্ধ পিকদল
চলে যায় বনান্তরে, স্বর্ণ ম্লানমুখে
পশে খনিতলে, বিম্ব খসে মনোদুখে।
ব্যাখ্যা: দেখা যাচ্ছে একটি রমণীর আবির্ভাবমাত্র চন্দ্র, হরিণী, কমল, পিকদল, স্বর্ণ, (স্বর্ণ) বিম্ব অর্থাৎ সরসকোমলরক্তবর্ণ পাকা তেলাকুচা ফল সব পালাচ্ছে বা মূর্চ্ছিত হয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। সুন্দর ভাষায় ছন্দে এদের কাজগুলিরই রূপ দিয়েছেন কবি। কিন্তু কার্যাবলীর এই চিত্রায়ণই কবির মুখ্য অভিষ্ট নয়, অভীষ্ট তার ‘প্রেয়সী’র অনুপম রূপসৌন্দর্যের প্রশস্তি। এই প্রশস্তিই হচ্ছে প্রস্তুত এবং কার্যাবলি অপ্রস্তুত। অপ্রস্তুত থেকে প্রস্তুত-প্রতীতি হচ্ছে দুটি স্তরে—প্রথমত চন্দ্রমা, হরিণী, কমল, পিক, স্বর্ণ আর বিম্ব যথাক্রমে ব্যঞ্জিত করছে রমণীর লাবণ্য, নয়ন, আনন, কণ্ঠধ্বনি, দেহবর্ণ আর অধরকে; পরক্ষণেই প্রতীত হচ্ছে এই লাবণ্য, নয়ন প্রভৃতিই চন্দ্রমা, হরিণী প্রভৃতির লজ্জায় দুঃকে পলায়ন, খসে পড়ার কারণ—এত উৎকৃষ্ট এগুলি যে চন্দ্রমা ইত্যাদির এদের সামনে উপমানের গৌরব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। চন্দ্রমাদির কার্য প্রস্তুত থেকে রমণীর লাবণ্যাদির কারণ প্রস্তুতের প্রতীতি হওয়ার অলংকার অপ্রস্তুত প্রত্যাশা।
কারণ-কার্যভাব
কারণ অপ্রস্তুত থেকে কার্য প্রস্তুতের প্রতীতি—
উদাহরণ:
বিদায় মাগিনু যবে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি মোর প্রিয়া
বাষ্পাকুল নেত্রকোণে মোর পানে ক্ষণেক চাহিয়া
কহিল সে তারি স্নেহে বিবর্ধিত মৃগশিশুটিরে
আজ হতে মাতা বলি’ জেনো, বৎস আমার সখীরে!
ব্যাখ্যা: দেশান্তরে না গিয়ে নায়ককে যে গৃহেই অবস্থান করতে হয়েছে এইটেই কবির বক্তব্য বলে প্রকৃত বা প্রস্তুত। কিন্তু এই প্রস্তুত অবস্থানকার্যটি সম্পর্কে নীরব থেকে কবি বললেন অপ্রস্তুত কারণটির কথা— আজি হতে মাতা বলি জেনো, বৎস আমার সখীরে! এই উক্তিটির তাৎপর্য এই যে প্রিয়তমের বিদেশযাত্রার সঙ্গে সঙ্গেই নায়িকার মৃত্যু ঘটবে। প্রিয়ার মুখে এমন কথা শোনার পর কোনো নায়কের পক্ষে বিদেশ যাওয়া সম্ভব?
সাদৃশ্যভাব
অপ্রস্তুত থেকে সদৃশ প্রস্তুতের প্রতীতি—
উদাহরণ:
বিক্রমদেব—নদী ধায়, বায়ু বহে কেমনে কে জানে!
সেই নদী দেশের কল্যাণ-প্রবাহিণী
সেই বায়ু জীবের জীবন
দেবদত্ত—বন্যা আনে
সেই নদী; সেই বায়ু ঝঞ্ঝা নিয়ে আসে।
ব্যাখ্যা: দেবদত্তের উক্তিটিতে অপ্রস্তুতের বর্ণনা। অপ্রস্তুত এই কারণে যে নদীর বন্যা, বায়ুর ঝঞ্ঝা কবির বর্ণিতব্য বিষয় নয়। কবি এই অপ্রস্তুত থেকে প্রতীত করাতে চান নারীর সর্বনাশা রূপের দিকটির। এইটিই প্রস্তুত। অপ্রস্তুতে প্রস্তুতে সাদৃশ্য-সম্পর্কটি এখানে এইরকম— নদী আর বায়ু স্বভাবগত কল্যাণকর হলেও কখনো কখনো বন্যা, ঝঞ্ঝার রূপে এসে চরম অকল্যাণ ঘটায়। তেমনি নারী স্বভাবতঃ পুরুষের পরমাশ্রয় হলেও কখনো কখনো বিশ্বাসঘাতিনীরূপে পুরুষের সর্বনাশ করে। সুতরাং অলংকার এখানে সাদৃশ্যভাবের অপ্রস্তুত-প্রশংসা।
Leave a Reply