অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন ও বাংলা নাটক
অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন ও বাংলা নাটক
বাংলা নাটক ও নাট্যাভিনয়ের কণ্ঠরোধ করবার জন্য ব্রিটিশ সরকার এদেশে অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন বা Dramatic Performances Control Act. (1976) চালু করে। তদানীন্তন বড়লাট লর্ড নর্থব্রুকের আমলে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর এই আইনটি বিধিবদ্ধ হয়।
ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক এই আইন প্রণয়নের ইতিহাস উল্লেখযোগ্য। ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে নবজাগ্রত বাঙালি মানসে নানান চিন্তা ভাবনার উন্মেষ তার কর্মে, আচরণে ও কথায় প্রকাশ পেতে থাকে। এই ভাবনার জাগৃতিতেই স্বাদেশিকতার প্রেরণা এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন বাঙালিকে ধীরে ধীরে উদ্দীপ্ত করে তোলে। সভাসমিতি করা, বক্তৃতা ও আলোচনা, এসোসিয়েশান গড়ে তোলা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে প্রেরণার কর্মজাত প্রকাশ, এবং কাব্যে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে এর চিন্তার বিকাশ। হিন্দুমেলার জাতীয়তার উদ্বোধন ক্রমে বিকশিত হয়ে ১৮৭২-এর দুটি ঘটনায় দ্বিমুখী প্রকাশ লাভ করল। একদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ; অন্যদিকে জাতীয় রঙ্গালয় বা ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা। বঙ্গদর্শনে তৎকালীন বঙ্গ-মনীষীর মানসিক চিন্তার দাবি এবং রঙ্গালয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানসিকতার উল্লাস। দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ নাটক দিয়েই জাতীয় রঙ্গালয়ের উদ্বোধন ঘটে—একথা স্মরণ রাখতে হবে।
নীলদর্পণের অভিনয় থেকেই ব্রিটিশ সরকার ভীত হচ্ছিল। রঙ্গমঞ্চের মাধ্যমে জাতীয় চেতনা অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে এবং আপামর জনগণের চিত্তবিক্ষোভ রঙ্গমঞ্চ ঘটিয়ে তুলতে পারে—এই আশঙ্কা রঙ্গমঞ্চপ্রিয় ইংরেজ জাতি সহজেই বুঝে নিয়েছিল। সভাসমিতি, আলোচনা শিক্ষিত ভদ্রজনের মধ্যে আবদ্ধ এবং তার সবটাই তখন তত্ত্বগত আবেদন নিবেদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু রঙ্গমঞ্চ যখন ‘নীলদর্পণ’ অভিনয় করলো এবং সাহেবের অত্যাচার, সাহেবের বিরুদ্ধে কৃষকের আক্রমণ মঞ্চে দেখানো হলো, তখন বাঙালি দর্শকবৃন্দের স্বাদেশিক চেতনা যতটা উৎফুল্ল হলো, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্রিটিশের বাড়লো উদ্বেগ। ‘নীলদর্পণ’ গ্রন্থাকারে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশের পরই ব্রিটিশ সরকার মামলা করে (জুলাই, ১৮৬১)। বিচারে শাস্তি হয় প্রকাশক জেমস লঙ-এর একমাস জেল ও এক হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো কারাবাস। এবং নীলদর্পণের বেশ কিছু অংশ মানহানিকর সাব্যস্ত হয়। ১৮৭২-এ ন্যাশনাল থিয়েটার ‘নীলদর্পণ’ অভিনয়ের সময়ে ওই অংশগুলিকে বাদ দিয়েই অভিনয় করে। ‘ইংলিশম্যান’ কাগজে নীলদর্পণের অভিনয় নিয়ে তীব্র আপত্তি তোলা হয়। ন্যাশনাল থিয়েটারের সম্পাদক পত্র মারফৎ ইংলিশম্যান কাগজে (২৩-১২-৭২) জানিয়ে দেন যে, আদালতের নির্দেশ মোতাবেক অভিনয় হচ্ছে। পুলিশের ডেপুটি কমিশনার নিজে অভিনয় দেখতে এসে তা যাচাই করে যান।
ন্যাশনাল থিয়েটার কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে-চুরে আবার গড়ে এবং ভেঙে তৈরি হয়েছে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার। তার আগেই বেঙ্গল থিয়েটার চালু হয়ে গেছে। ১৮৭৬-এর গোড়ার দিকেই কলকাতার বেঙ্গল ও গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার নিয়মিত অভিনয় করে চলেছে। মধুসূদন, দীনবন্ধু, রামনারায়ণ—এঁদের নাটকগুলি, নানা প্রহসন, নক্সা, অপেরা এবং বঙ্কিমের উপন্যাসের নাট্যরূপ এই দুটি রঙ্গালয়ে অভিনীত হচ্ছে। এগুলি নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের মাথাব্যথার কোনো কারণ ছিল না।
রাজরোষ না হলেও সমাজের মাথাওয়ালাদের রোষে কিছু নাটকের অভিনয় প্রচেষ্টা বন্ধ করা হয়েছিল। যেমন মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ এবং ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’। এবং রামনারায়ণের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ অভিনয়ের সময়ে চুঁচুড়ায় গিয়ে হাজির হয়েছিল ভাটপাড়ার ব্রাহ্মণকুলীন সমাজপতির দল, নাটকটি বন্ধ করে দেবার জন্য। এসব হলো সরকারি আইনের বাইরে সমাজ-নেতাদের শক্তি প্রয়োগে কণ্ঠরোধ (Cultural hegemony)। নানাযুগে নানাভাবে সেটা হয়ে চলেছে।
কিন্তু এরই ফাঁকে এই সময়ে গ্রেট ন্যাশনাল ও বেঙ্গল থিয়েটারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরুবিক্রম’, কিরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারতে যবন’, হরলাল রায়ের ‘বঙ্গের সুখাবসান’, ‘হেমলতা’, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গুইকোয়ার’, অমৃতলালের ‘হীরকচূর্ণ’, উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘শরৎ-সরোজিনী’ অভিনয় হয়ে চলেছে। এইসব নাটকের মধ্যে ব্রিটিশ সরকার-বিরোধী মনোভাব নানাভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। ‘হীরকচূর্ণ’ বা ‘গুইকোয়ার’ দুটি নাটকই লেখা হয়েছিল সমসাময়িককালে বরোদা রাজ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে। বিষপানে ওই রাজ্যের ইংরেজ রেসিডেন্ট-এর মৃত্যু হওয়া নিয়ে গোলমাল এবং মহারাজার সিংহাসনচ্যুতি, এইসব ঘটনার মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশের ক্ষমতা বিস্তারের নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে। ভারতমাতা রানী ভিক্টোরিয়ার জয়গাথা থাকলেও, নিরন্ন ভারতীয়ের হাহাকার, ক্ষুধার জন্য চিৎকার এবং ইংরেজ কর্তৃক বিদ্রোহী সন্তানদের পদাঘাত, ব্রিটিশের শাসন-চরিত্রকেই তুলে ধরেছে। শরৎ-সরোজিনীতে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ বিরোধিতা সংলাপে ও চরিত্রের আচরণে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। পুরুবিক্রমে ইতিহাসের পটে ভারতের স্বাধীনতা ও গৌরবের কথাই বলা হয়েছে। ভারতে যবন, বঙ্গের সুখাবসান বা হেমলতা প্রভৃতি নাটকেও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বর্তমান ভারতের দেশাত্মবোধই প্রকাশ পেয়েছে। এইসব নাটক নিয়ে ব্রিটিশ সরকার খুশি ছিল না। বরং উদ্বিগ্ন হয়ে তারা তখন থেকেই এইসব নাটকের অভিনয় বন্ধ করার পরিকল্পনা করতে থাকে।
১৮৭৫ থেকে ১৮৭৬-এর মধ্যে এই দুটি রঙ্গালয়ে ধারাবাহিকভাবে যেসব নাটকের অভিনয় হয়ে চললো এবং নিয়ত দর্শক সম্বর্ধনায় উত্তরোত্তর আবেগ সঞ্চার করে চললো সেগুলি নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের উদ্বেগ আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তার কারণ হলো।
গ্রেট ন্যাশনালে অভিনীত হলো—হীরকচূর্ণ (অমৃতলাল), সুরেন্দ্র-বিনোদিনী (উপেন্দ্রনাথ), শরৎ-সরোজিনী (উপেন্দ্রনাথ), সরোজিনী (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ), গজদানন্দ ও যুবরাজ (উপেন্দ্রনাথ), হনুমান চরিত্র (উপেন্দ্রনাথ) পুলিশ অফ পিগ অ্যান্ড শিপ (উপেন্দ্রনাথ)।
বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনীত হলো—গুইকোয়ার (নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়), সুরেন্দ্র-বিনোদিনী, বীরনারী, ভারতসঙ্গীত, বঙ্গ বিজেতা, পলাশীর যুদ্ধ, বঙ্গের সুখাবসান (হরলাল রায়)।
এই ধরনের জাতীয় ভাবোদ্দীপনার নাটক ওই সময়ে দর্শকের মানসিক ঘূর্তিকে জাগ্রত করেছে। মঞ্চে ইংরেজ চরিত্রের অত্যাচারের দৃশ্য, বাঙালি নায়ক ইংরেজকে আক্রমণ করে আঘাত করছে, নায়িকা গুলি করে অত্যাচারী ইংরেজকে হত্যা করছে—এইসব দৃশ্য স্বভাবতই ইংরেজ সরকারকে উৎকণ্ঠিত করেছে। সেই সময় থেকেই শাসক ইংরেজ চেষ্টা চালিয়ে গেছে কীভাবে ওই ধরনের নাটকের অভিনয় বন্ধ করা যায়।
দুভাবে শাসকশ্রেণী শিল্পসংস্কৃতির প্রচার বন্ধ করতে পারে—১. আইনের বলে। ২. বলপ্রয়োগে। প্রথমে পুলিশ পাঠানো পরে হুমকি দেওয়া—কোনো কিছুতেই যখন এই ধরনের অভিনয় বন্ধ করা যাচ্ছে না, তখনই তাদের আইনের কথা ভাবতে হয়েছে। কেন না, ইংরেজের প্রবর্তিত এমন কোনো আইন ছিল না, যা দিয়ে এই ধরনের নাটকের অভিনয় বন্ধ করা যায়।
এই সময়ে, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে, দক্ষিণারঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের ‘চা-কর-দর্পণ’ নাটক প্রকাশিত হয়েছে। মুদ্রিত গ্রন্থটির মুখপাতে চা-কর সাহেব কর্তৃক কুলী রমণীর নির্যাতনের একটি লিথো ছবি রয়েছে।
এই নাটকটি অভিনীত হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এই বইয়ের বিষয় ও বক্তব্য জেনেছেন। বুঝেছেন যে, যেসব ব্রিটিশ চা-ব্যবসায়ী এদেশে রয়েছে তাদের শোষণের মুখোস নগ্ন করে দিয়েছে এই নাটক। নীলদর্পণের নীলকর সাহেবরা অভিজাত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ছিল না, কিন্তু চা-কর দর্পণের চা-ব্যবসায়ীরা অভিজাত বৃটিশ ব্যবসায়ী। নীলকর সাহেবদের রক্ষা করতে ব্রিটিশের যতটা না উৎসাহ ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি উদ্যম ছিল অভিজাত চা-ব্যবসায়ীদের রক্ষা করা। এই বিষয়টি খুব পরিষ্কার বোঝা যাবে হবহাউসের তৈরি বিলের খসড়াটি খুঁটিয়ে পড়লেই। এই ‘চা-কর দর্পণ’ নাটক যদি একবার পাদপ্রদীপের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে জনসমক্ষে এসে উপস্থিত হতে পারে, তাহলে, হবহাউসের পক্ষে অনুমান করা শক্ত নয় মোটেই যে, চা-এর ব্যবসায়ের ওপর প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়বে! যাতে ব্রিটিশ রাজ-শাসকেরা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত।
বিলের মূল বয়ানটি খুঁটিয়ে পড়লেই বোঝা যায় ব্রিটিশ শাসকের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল। ভারতীয়ের মনে ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠতে দেখে তারা ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হচ্ছিল। তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ কিংবা শোষণের চক্রান্তে কোনোরকম আঘাত আসুক ব্রিটিশ তা চায়নি। নাটকের মাধ্যমে এই কাজ হচ্ছে দেখে তারা আরো বেশি চিন্তিত। কেন না তারা জানে, হবহাউসের বিলের মধ্যেই রয়েছে, সর্বদেশে ও সর্বকালে নাটক ও মঞ্চের প্রচণ্ড প্রভাবের কথা। এবং বাংলা নাটক ও মঞ্চ সেই পথেই এগিয়ে চলেছে। তাই গোড়াতেই তাকে স্তব্ধ করে দিতে হবে, যাতে আর কিছুতেই বাংলা মঞ্চ ও নাটক ব্রিটিশ বিরোধী কিংবা ব্রিটিশরাজ-বিরোধী ভূমিকা পালন না করতে পারে। এটাই ছিল ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ’ বিলের মুখ্য উদ্দেশ্য।
বাংলা নাটক ও মঞ্চ সম্পর্কে যখন ব্রিটিশ সরকার এইভাবে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে, তখন সহযোগী হিসেবে সঙ্গে পেয়ে গেল এদেশের প্রভাবশালী-নীতিবাগীশ শিক্ষিত শ্রেণী ও অভিজাত সম্প্রদায়কে।
একদল নীতিবাগীশ ব্যক্তির আক্রোশ ছিল রঙ্গালয়ের ওপর। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দেই নাট্যাভিনয়ে স্ত্রী চরিত্রের জন্য অভিনেত্রীর আমদানী ঘটেছে মঞ্চে, যারা ভদ্রশিক্ষিত ঘরের মেয়ে ছিল না। সবাই ছিল বারাঙ্গনা। তখনকার সামাজিক প্রেক্ষিতে অভিনয়ের জন্য ঘরের মেয়েদের পাওয়া সম্ভব ছিল না। রঙ্গমঞ্চে এই বারাঙ্গনাদের আগমনে নীতিবাগীশ শ্রেণী ‘গেল গেল’ রব তুলেছিল। ‘সাধারণী’ পত্রিকায় লেখা হলো—‘‘কুক্ষণে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বঙ্গের রঙ্গভূমিতে বারাঙ্গনা প্রবিষ্ট করাইয়া দিয়াছেন। ……ন্যাশনালের প্রমীলা যখন কটিতে কীরিচ আঁটিয়া দুলিতে দুলিতে বলিতে থাকে, আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাখবে?’ তখন মনে হয়, তা বটেত, তোমার বাঁধা হুঁকা, বারেন্দা, কুশলে থাক—তোমার ডর কি?……গোঁফ কামান, দাড়ি কামান, স্বর মোটা, বাপে তাড়ান, এন্ট্রান্স ফেল, প্রমীলা স্বীকার করি শ্লাঘার সামগ্রী নহে। কিন্তু হৃদয় পোড়া, মনপোড়া, লজ্জা পোড়া, ঘর পোড়ানি-মেছোবাজারের প্রমীলার অপেক্ষা লক্ষগুণে ভালো।’’
নীতিবাগীশের দল প্রচণ্ড হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিল রঙ্গমঞ্চের বিরুদ্ধে। দেশ সমাজ সংসার সব রসাতলে গেল এমন সোরগোল উঠল নানা দিকে। অবশ্যই এরা চাইছিলেন যে কোনো প্রকারে নাট্যশালার গতি স্তব্ধ হোক। নাটকের ওপরে সরকারি সমনের মূলে এদের অবদান ছিল অনেকখানি। ইন্ডিয়ান ডেলী নিউজ-এ এক পত্রলেখক লিখেছিল (১৭ মার্চ, ১৮৭৭)— “That the theatre has by introduction of haulots on the stage become the hot-bed of immortality and corruption, none can deny.’’
অথচ সাহিত্য শিল্প ইত্যাদি অন্যক্ষেত্রেও অশ্লীলতা ও নোংরামি বন্ধের জন্য নানাদিক থেকে দাবি উঠতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার সেসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তারা নাটক ও নাট্যাভিনয়কে ভয় পেয়েছে এবং তারই কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে। ইংরেজ বিরোধিতার অবসান ঘটাতে চেয়েছে নাট্যশালা থেকে। তাই এতো উদ্যোগ। নীতিবাগীশের সমাজনীতিকে তারা কাজে লাগিয়েছে মাত্র।
নীতিবাগীশের ইচ্ছার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তৎকালীন অভিজাত বাঙালি সম্প্রদায়ের নাটকশাসনের প্রয়াস। কারণ, অনেক ধনী বাঙালির এবং বড় ঘরের কেচ্ছা প্রায়ই প্রহসন বা রঙ্গনাট্যের বা নক্সার মাধ্যমে প্রকট করা হতো। তার উতর-চাপানও চলত পরস্পর পক্ষের পয়সার মদতে। ড. জয়ন্ত গোস্বামীর ‘প্রহসনের ইতিহাস’ গ্রন্থে এই ধরনের পাঁচ শতাধিক প্রহসনের পরিচয় রয়েছে। প্রহসনগুলি অভিনয়ের দ্বারা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আক্রমণে যাতে পর্যুদস্ত হতে না হয়, সেই উদ্দেশ্যে অনেক বাঙালি সন্তানই নাট্যজগৎ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে শাসকের হাত শক্ত করেছিলেন।
তাছাড়া ঔপনিবেশিক শাসনের প্রক্রিয়াজাত এই নব্য ধনী বাঙালি শ্রেণী ব্রিটিশের শাসনের অনেক কিছুর মতো এই আইনকেও সমর্থন করেছিল। ‘নীলদর্পণ’ ধনী বাঙালির প্রাসাদ-মঞ্চে কোনো দিন অভিনীত হয়নি কেন তার কারণ এখানে পরিষ্কার।
শাসকশ্রেণী নিষ্কণ্টক রাজ্যভোগর উদ্দেশ্যে সামান্যতম জনরোষের উৎসও স্তব্ধ করে দিতে চাইছিলেন। তাই শাসক ব্রিটিশের নিজস্ব তাগিদও কম ছিল না। বাংলা মঞ্চে এই সময়ের অভিনয়ের মধ্যে ইংরেজ বিদ্বেষ, পরাধীনতার বেদনা, ইংরেজের অত্যাচার, সর্বোপরি দেশ স্বাধীন করার বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা মূর্ত হয়ে উঠেছে। নীলদর্পণ থেকে শুরু করে সুরেন্দ্র-বিনোদিনী পর্যন্ত অধিকাংশ নাটকেই ইংরেজ রাজপুরুষদের নানা ধরনের অত্যাচার বিশেষ করে তাদের লাম্পট্যের দৃশ্য দেখানো হতো। উপরন্তু কয়েকটি নাটকে দুষ্কৃতকারী ইংরেজ রাজপুরুষকে হত্যা করার দৃশ্যও দেখানো হয়েছিল। এর ফলে জনমত উত্তেজিত হওয়া স্বাভাবিক। ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। প্রকৃত গণজাগরণ তো এখান থেকেই শুরু হতে পারে। তাই ইংরেজ সরকার আইন করে রঙ্গালয়ে এই ধরনের নাট্যাভিনয়ের প্রচেষ্টা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে চেয়েছে। ইংরেজ শাসন-কৌশলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নীতিবাগীশ দলের সহায়তা এবং অভিজাত শ্রেণীর সমর্থন।
এই তিন প্রচেষ্টার যোগফল অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন। তবে উপলক্ষ হিসাবে দেখা দিল ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ প্রহসনের অভিনয়। যার পশ্চাৎপটে ছিল মহারাণীর ছেলের কীর্তি। এই ঘটনা আইন প্রচলন ত্বরান্বিত করে তোলে।
১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় এলেন মহারাণী ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স অফ ওয়েলস। ইনিই পরে সপ্তম এডওয়ার্ড হন। রাণীর ছেলের নানান খেয়ালের মধ্যে একটি হল, বাঙালি অভিজাত ঘরের অন্দরমহলের জেনানাদের তিনি দেখবেন। তৎকালীন বাঙালি ভদ্রঘরের পক্ষে এটি মারাত্মক প্রস্তাব। ব্রাহ্মরা যদিও মহিলাদের পর্দার বাইরে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু হিন্দুদের সবাই তা মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু মহারাণীর পুত্রের ইচ্ছা পূরণে এগিয়ে এলেন ভবানীপুর নিবাসী হাইকোর্টের উকিল এবং ব্যবস্থাপক সভার সদস্য জগদানন্দ মুখখাপাধ্যায়। তার পুরনারীরা যুবরাজকে উলু দিয়ে বরণ করলেন (৩ জানুয়ারী ১৮৭৬)। এই ঘটনা কলকাতায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করল। এই নিয়ে সংবাদপত্রে প্রচুর লেখালেখি শুরু হয়। হাইকোর্টের অন্যতম উকিল প্রখ্যাত কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের সহকর্মীর এই কাজের জন্য ব্যঙ্গ করে কবিতা লিখলেন বাজীমাৎ—
আমি স্বদেশবাসী আমায় দেখে লজ্জা হোতে পারে।
বিদেশবাসী রাজার ছেলে লজ্জা কিলো তারে।
এই ঘটনাকে নিয়েই নাটক লিখলেন উপেন্দ্রনাথ দাস। তিনি তখন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের সঙ্গে ডিরেক্টর ও নাট্যকার হিসেবে যুক্ত। উপেন্দ্রনাথ হলেন তখনকার হাইকোর্টের আরেক নামী উকিল শ্রীনাথ দাসের পুত্র। নাটকের নাম দিলেন ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সরোজিনী’ নাটকের সঙ্গে এই নাটিকাটিরও অভিনয় হলো। প্রচুর দর্শক এই অভিনয় উপভোগ করলেন। পরের ২৩ তারিখে আবার নাটকটি অভিনীত হলো ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ নাটকের সঙ্গে। এবারে ব্রিটিশ সরকার এগিয়ে এলেন নাটকটির অভিনয় বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। কারণ, ‘গজদানন্দ’ নাটকে রাজভক্ত সম্ভ্রান্ত প্রজাকে বিদ্রুপ করা হয়েছে। কিন্তু গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ এতে দমে গেলেন না। তারা মূল নাটকটি ঠিক রেখে নামটি পালটে দিলেন—‘হনুমান চরিত’ (দ্রঃ ভারতসংস্কারক ৩ মার্চ, ১৮৭৬) এবং অভিনয় করলেন ‘কর্ণাটকুমার’ নাটকের সঙ্গে ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে। ‘হনুমান চরিত্র’-ও নিষিদ্ধ করলো পুলিশ। এবারে অভিনীত হল ‘দি পুলিশ অফ পীগ অ্যান্ড শীপ’। তখনকার পুলিশসুপার মিঃ ল্যাম্ব এবং পুলিশ কমিশনার মিঃ স্টুয়ার্ট হগ—এই দুজনের প্রতি ব্যঙ্গের জন্যই ঐরকম নামকরণ হলো নাটকটির। ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’ (উপেন্দ্রনাথ দাস) নাটকটির সঙ্গে এবার এই ব্যঙ্গ নাটিকাটি অভিনীত হলো, ১লা মার্চ তারিখে। দু রাত্রেই অভিনয়ের শেষে উপেন্দ্রনাথ ইংরেজিতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। [মহাদেবপ্রসাদ সাহা: নাটকদুটির ভূমিকা।]
এর আগে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট, উপেন্দ্রনাথের ‘শরৎ-সরোজিনী’ নাটকে সাহেব ডাকাতকে নায়ক শরৎ হত্যা করেছে সুকুমারীকে গোরাদের হাত থেকে বাঁচাতে এবং খুনের দায়ে ধরা পড়ে দোষ স্বীকার না করে বলেছিল—‘‘উৎপীড়িত স্বদেশীয়দিগকে ধবলমূর্তিদের অত্যাচার হতে রক্ষা করবার জন্য যদি আমার জীবন বিসর্জন দিতে হয়, তাও দেব। এবং সরোজিনী ‘ইংরাজ রাক্ষসের হাত থেকে’ শরৎকে বাঁচাতে আরেকজন গোরাকে গুলি করে মেরেছে। এবং সুরেন্দ্র-বিনোদিনী নাটকে হুগলির ম্যাজিস্ট্রেট ম্যাক্রেন্ডেল সাহেব চরিত্রকে লম্পট করে আঁকা হয়েছে এবং সুরেন্দ্র সাহেবকে পদাঘাত করে উত্তম-মধ্যম দিয়েছে। তাছাড়া জেলের কয়েদিদের ওপর সাহেবের অত্যাচার দেখানো হয়েছে। সাহেবের নারী নির্যাতনের দৃশ্যও রয়েছে নাটকটিতে। এইসব কারণে জেলের ভেতর বন্দি বিদ্রোহও (৫ গর্ভাঙ্ক) দেখানো হয়েছে।
উপেন্দ্রনাথের এই দুটি নাটকের অভিনয়, তার ওপর রাজভক্ত প্রজার প্রতি তীব্র ব্যঙ্গ এবং পুলিশ কর্মচারীদের তীক্ষ কটুক্তি, ইংরেজ সরকারের ক্রোধ উদ্দীপ্ত করে তুলেছে এবং বে-আইনি (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল এ্যাক্টের (১৮৬১) ২৩-তম ধারানুযায়ী] এইসব কার্যকলাপ বন্ধের জন্য তৎপর করে তুলেছে।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ফেব্রুয়ারি, লর্ড নর্থব্রুক এক অর্ডিনান্স জারি করলেন বাংলা নাটকের উদ্দেশ্যে: (Legislative Department Notification: Ordinance No: ৪)—…to empower the Government of Bengal to prohibit certain dramatic performances, which are scandalous, defamatory, seditious, obscene or otherwise prejudicial to the public interest.’’ এবং অর্ডিনান্সের শেষের দিকে বলা হল— ‘‘The ordinance shall remain in force till May next by which time a law will be passed by the Viceregal Council on the subject.’’
এরপর গ্রেট ন্যাশনালকে থেমে যেতে হল এবং ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ এবং ‘উভয়সঙ্কট’ নাটকের অভিনয়ের আয়োজন শুরু হল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ততদিনে রঙ্গমঞ্চের টিনের তলোয়ারকে ভয় পেতে শুরু করেছে। ফলে, ঐ বছরের ৪ মার্চ, ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ অভিনয়ের সময়ে পুলিশ রঙ্গমঞ্চ ঘিরে ফেলে এবং উপেন্দ্রনাথ দাস, অমৃতলাল বসু (ম্যানেজার), মতিলাল সুর, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, রামতারণ সান্যাল, মহেন্দ্রলাল বসু, শিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গোপাল দাস এবং মঞ্চ মালিক ভুবনমোহন নিয়োগীকে গ্রেপ্তার করলো। কারণ দেখানো হল, আগের নাটক সুরেন্দ্র-বিনোদিনী অশ্লীল ও এরা সব তার সঙ্গে যুক্ত।
পুলিশ আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট ডিকেন্সের কাছে বিচার হলো। ৮ মার্চ, বিচারের রায়ে ডিরেক্টর উপেন্দ্রনাথ এবং ম্যানেজার অমৃতলাল—এই দুজনের একমাস করে বিনাশ্রম দণ্ড হলো এবং অন্যেরা ছাড়া পেলেন। পত্র-পত্রিকায় এই বিচার নিয়ে অনেক আলোচনা শুরু হয়। তাছাড়া হাইকোর্টের দোভাষী মিঃ ওয়েন, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ প্রভৃতি তখনকার বিদ্বজ্জনেরা সবাই পরিষ্কারভাবে জানান যে, সুরেন্দ্র-বিনোদিনী নাটকে অশ্লীলতা নেই। তা সত্ত্বেও আদালতে ঐরকম রায় দেওয়া হলো। ৯ মার্চ তারিখেই আদালতে আপীল করা হলো। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন পরবর্তী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বনামখ্যাত গণেশচন্দ্র চন্দ্র হলেন এটনি। তার সাহায্যে মিঃ ব্রানসন, তারক পালিত এবং মনোমোহন ঘোষ আসামীদ্বয়ের সমর্থনে হাইকোর্টে বিচার চালালেন। বিচারপতি ছিলেন মিঃ মার্কবীব এবং মিঃ ফিয়ার। হাইকোর্টের বিচারে পুলিশের আনীত আপত্তি টিকলো না। দুজনে বেকসুর খালাস পেলেন। ২০ মার্চ এই মুক্তির রায় বের হলো।
কিন্তু ইংরেজ সরকার দমলেন না। যে করেই হোক অভিনয়কে সংযত করতে হবে। ওই মার্চ মাসেই ‘Drmatic perfomances control Bill’ নামে আইনের খসড়া কাউন্সিলে পেশ করা হলো। এই বিলের খসড়া তৈরি করে কাউন্সিলে অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ বিল উত্থাপন করেন কাউন্সিলের ল’ মেম্বার মিঃ হব হাউস। সেই বিলের বয়ান দেখলেই বোঝা যায়, বাইরে অশ্লীলতার দায় তুললেও ব্রিটিশ সরকার ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হচ্ছিলেন সরকার-বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠতে দেখে।
এই বিলের বিরুদ্ধে অনেক গণমান্য লোক আপত্তি তুলেছিলেন। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ব্রিটিশ ইন্ডিয়া এসোসিয়েশনের তরফে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার আইন প্রণয়ন করতে বদ্ধপরিকর ছিল। তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড লিটন ছিলেন ইংলন্ডের মঞ্চ ও নাটকের স্বাধীনতার লড়াইয়ের অন্যতম ব্যক্তিত্ব বুলওয়ার লিটনের পুত্র। তারই হাতে বর্তাল অভিনয়নিয়ন্ত্রণ আইন প্রবর্তনের দায়িত্ব। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর, এই বিলটি আইনরূপে স্বীকৃত হলো। সিলেক্ট কমিটিতে ভারতীয় সদস্য রাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণ বাহাদুর এই বিলটি সমর্থন করেন। যদিও তিনি যাত্রাকে এই আইনের বাইরে রাখতে বলেছিলেন, কিন্তু তাও মানা হয়নি।
মনে রাখতে হবে, ব্রিটিশ সরকার এর ১৫ মাস বাদে, আরো দুটি আইন চালু করে— “ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’’ (১৪ মার্চ, ১৮৭৮) এবং তারই সঙ্গে ‘‘আর্মস অ্যাক্ট’’। প্রথমটিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ এবং দ্বিতীয়টিতে এদেশীয়দের নিরস্ত্রীকরণের মতলব কার্যকরী হয়। আর অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন রঙ্গমঞ্চকে শায়েস্তা করতে সরকারের হাত শক্ত করে দিল। বলা হলো—যেসব নাটক বন্ধ করে দেওয়া হবে, তা যদি ‘‘Likely to excite feelings of disaffection to the Government established by law in British India.’’
জাতীয় নাট্যশালার মাধ্যমে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন গোড়াতেই স্তব্ধ করে দেওয়া হল। দেশে স্বাদেশিকতার উন্মেষ এবং পরাধীনতার বেদনা থেকে মুক্তির যে শুভসূচনা রঙ্গালয়ে শুরু হয়েছিল সন্ত্রস্ত ইংরেজ সরকার অঙ্কুরেই তাকে বিনাশ করবার জন্য এই আইনের প্রবর্তন করলো।
প্রথমে এই বিল পাশ হয় কলকাতায়, পরে সমগ্র ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সকল ক্ষেত্রেই এই আইন কার্যকরী হয়।
এই আইনের বলে শাস্তিযোগ্য হবে সব পাবলিক থিয়েটার বা সাধারণ রঙ্গালয়। তার সঙ্গে যে কোনো ভাবে যুক্ত অভিনেতা অভিনেত্রী, নির্দেশক, মঞ্চাধ্যক্ষ, থিয়েটারের মালিক এবং নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যক্তি। তাদের কৈফিয়ৎ তলব করা হবে; বিধিলঙ্ঘন প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার, জরিমানা, জেল প্রভৃতির ব্যবস্থা রইলো এই আইনে। শুধু তাই নয়, বিধিবহির্ভূত নাটকের অভিনয় হলে পুলিশ সেখানে ঢুকে গ্রেপ্তার এবং সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে বলপূর্বক। আইনের একটি মারাত্মক দিক হল, শাস্তিযোগ্য নাটকের অভিনয়ের সময়কালীন উপস্থিত দর্শকেরাও শাস্তিযোগ্য বিবেচিত হবে। ভয়ে এই রকম নাটক দর্শক দেখতে আসবে না এবং বাণিজ্যিক থিয়েটার তো দর্শকের পয়সাতেই চলে। এমন আইন আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বাংলা নাটক, নাট্যাভিনয় ও রঙ্গমঞ্চের ওপর এতবড় একটা আঘাত নেমে এলো, অথচ তেমন তীব্রভাবে কোনো প্রতিবাদ বা আন্দোলন হল না। দু’একটি পত্রিকায় উষ্ণ প্রতিবাদ হলো। কিন্তু কোন দানা বাঁধলো না।
বরং অর্ডিন্যান্স প্রকাশ পাওয়ার পরে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা (১৩১৮৭৬) লর্ড নর্থব্রুককে অভিনন্দন জানিয়ে যা লিখেছিল, তখনকার অনেক বাঙালির মনের কথাও ছিল তাই— ‘‘All honour to Lord North Brook for prompt action taken by him to uphold the cause of public morality and decency.’’
১৮৭৩-এ বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে পাকাপাকিভাবে অভিনেত্রীদের অভিনয় শুরু করলে হৈ চৈ পড়ে যায়। বিশেষ করে এইসব অভিনেত্রী নিষিদ্ধ পল্লী থেকে আসার জন্য ছুঁৎমার্গ বেশি করে দেখা গেল। নোংরা এবং অশ্লীলতায় ভরে গেল থিয়েটার—এমন মনোভাবে অনেক মানুষই এখান থেকে নিজেদের সরিয়ে নিলেন। অথচ এদের অনেকেই এর আগে নাটক ও থিয়েটারের মাধ্যমে জাতীয়মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল। ১৮৭২-এ ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা এবং তার পৃষ্ঠপোষকতা তারই প্রকাশ। উচ্চবিত্ত, ধনী, অভিজাত, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, চিন্তাশীল, রুচিবান সব নানা মানুষের সহযোগিতায় এবং সহযোগ্যতায় বাংলা থিয়েটার সেদিন উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অভিনেত্রী গ্রহণ এবং তাদের ঘিরে সারারাত নাট্যাভিনয় সেদিনকার বেশিরভাগ মানুষই মেনে নিতে পারলেন না। থিয়েটারের ওপর অশ্লীলতার দায়ভাগ চাপিয়ে দেওয়া হলো। তাই দেখি, ১৯ শতকের শিক্ষিত বৃহত্তম অংশ নিশ্চুপ; অভিজাত ধনীরা উদাসীন হয়ে পড়লেন থিয়েটারের ওপর আক্রমণে। বরং থিয়েটারে এবার অশ্লীলতা বন্ধ হবে এমন একটা ধারণায় তারা খুশিই হলেন। এরা তো অনেক আগে থেকেই অশ্লীলতার নানা দিক নিয়ে জেহাদ তুলছিলেন। কবিগান, তরজা, খেউড, পক্ষীরদলের গান, সঙের গান—এইসবের মধ্যে নোংরামি, অশ্লীলতা—এদের অনেককেই ক্ষুব্ধ করেছিল। এগুলি তাদের কাছে কুৎসিত ও অশ্লীল ছিলো।
আবার এইসব গানের মধ্যে দিয়ে যে সামাজিক বিদ্রুপ এবং ব্যক্তি-পরিবারের বিদ্রুপ সোচ্চারিত হতো, তা থেকে সমাজের এই সব মানুষ রেহাই পেত না। রাজকর্মচারী, ইংরেজ শাসক, বাঙালিবাবু, ধনী জমিদার ও মুৎসুদ্দি, ভণ্ড তপস্বী, সমাজ আন্দোলনকারী—কেউই রেহাই পেত না। এরাই তো সব থিয়েটারে অশ্লীলতা নিয়ে হৈচৈ ফেলেছিল। এইসব গানও তাদের পছন্দের ছিল না স্বাভাবিক কারণেই।
এইসব মানুষেরাই উদ্যোগ নিয়ে কলকাতার টাউন হলে ১৮৭৩-এর ২০ সেপ্টেম্বর সভা ডেকে প্রতিষ্ঠা করে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে এক সংগঠন। নাম—society for the Suppression of Public Obscenity. এখানে সর্বধর্ম এবং, সর্বস্তরের মানুষ জড়ো হয়েছিল। বক্তা ছিলেন, উল্লেখযোগ্য, ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেন, খ্রিস্টানযাজক কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দু সমাজপতি রাজা কালীকৃষ্ণ দেব প্রমুখ। এদের উদ্দেশ্য ছিল ‘‘জনসাধারণের স্তব্ধতা রক্ষাকল্পে বিধিবদ্ধ পিনালকোড এবং প্রিন্টিং অ্যাক্ট-এর ধারাগুলি প্রয়োগে সরকারকে সাহায্য করা।’’—এবং এদেরই উদ্যোগে ১৮৭৪-এ চড়কের দিনে সঙের গান বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল।
এর দুই বছরের মধ্যেই ব্রিটিশ তার শাসনক্ষমতা কায়েম রাখার স্বার্থে যে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করলো, তাতে ওই অশ্লীলতা প্রসঙ্গটিকে সামনে রাখলো। এর বীজ রোপিত হয়েছিল টাউন হলের ওই সভায়। আইন চালু হলে সবাই যে চুপ করে রইলেন, তার প্রেক্ষিত বুঝতে অসুবিধে হয় না।
ইংরেজ সুকৌশলে তাদের রাজ্যশাসন মসৃণ করার তাগিদে রঙ্গমঞ্চের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিল। সঙ্গী হিসেবে পেয়ে গেল এদেশের প্রভাবশালী অভিজাত ও বুর্জোয়াদের এবং শিক্ষিত নীতি ও রুচিবাগীশের দলকে। এদের সমর্থনে ইংরেজ নাটকে অশ্লীলতার দোহাই তুলে কূটকৌশলে সমাজনীতিরক্ষার দায় যেন নিজের হাতে তুলে নিয়ে দেশের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে চেয়েছিল। দু’পক্ষই থিয়েটারে দুর্নীতি মুক্ত ও কেচ্ছাকেলেঙ্কারির দায় মুক্তি হলো ভেবে ইংরেজ সরকারকে সাধুবাদ জানালেন। অথচ ইংরেজ বাইরে অশ্লীলতার অজুহাত তুললেও, ভেতরে ভেতরে তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বার্থকেই বড় করে তুলেছিল।
প্রতিবাদ কোনো দিক দিয়েই জোরদার না হওয়াতে, কোন মঞ্চাধ্যক্ষ আর সাহস করলেন না এই ধরনের নাটক অভিনয় করতে। কোন দর্শক আর চাইবে না এই ধরনের নাটক দেখতে। তাছাড়া মঞ্চাভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত যে কোনো ব্যক্তি আতঙ্কিত হয়ে এই ধরনের নাট্যাভিনয় থেকে বিরত রইলেন। বাংলা রঙ্গালয়েও এই নিয়ে আর কোনো আন্দোলন হলো না। প্রথম দিকে, যে সাহসের সঙ্গে এই কর্মপ্রেরণা শুরু হয়েছিল, আইন প্রবর্তনের পর তা স্তিমিত হয়ে গেল। অথচ হিন্দুমেলার অধিবেশন অব্যাহত রয়েছে, জাতীয় আন্দোলন বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হচ্ছে, জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা (১৮৮৫) হতে চলেছে। তার প্রথম সভাপতি যিনি হবেন সেই উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কিন্তু একজন নাট্যামোদী। কিন্তু রঙ্গালয়ের কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন হলো না।
উপেন্দ্রনাথ দাস চলে গেলেন বিলেতে। ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’ মামলায় জড়িত এবং সর্বস্বান্ত থিয়েটারের মালিক ভুবনমোহন নিয়োগী রঙ্গালয়ের সঙ্গে সব সংস্রব ত্যাগ করলেন। ম্যানেজার অমৃতলাল বিলেত যেতে গিয়ে পারিবারিক বাধায় শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন আন্দামানে, অবন্দি বাঙালি হিসেবে। বিহারীলাল চলে গেলেন পোর্টব্লেয়ার, পুলিশের কাজ নিয়ে। অভিনেত্রী সুকুমারী দত্ত থিয়েটার ছেড়ে দিলেন, বিনোদিনী গ্রেট ন্যাশনাল ছেড়ে চলে গেলেন বেঙ্গলে, আর অর্ধেন্দুশেখর বেরিয়ে পড়লেন দেশ ভ্রমণে। অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আদেশে কোন নাট্যাভিনয়কে নিষিদ্ধ করা হবে— Whenever the provincial Government is of opinion that any play, pantomime, or other drama performed or about to perform in a public place is(a) of a scandalous or defamatory in nature, or, (b) likely to excite feeling of disaffection to the Government established by law in British India (or British Burma) or, (c) likely to deprave and corrupt person present at the performances. (Section-3, Dramatic performances Act. 1876)
রঙ্গালয়ের বিরুদ্ধে এই আঘাত বাংলা নাটকের ওপর প্রচণ্ডভাবে প্রভাব ফেলেছে। এবারে নাট্যশালায় আর স্বদেশপ্রেমমূলক কিংবা জাতীয় ভাবোদ্দীপনাপূর্ণ কিংবা ব্রিটিশ-বিরোধী কোনো নাটক অভিনীত হল না। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার আইন প্রবর্তনের পর অভিনয় করল অতুল মিত্রের ‘আদর্শ সতী’ নাটক। সঙ্গে রাধামাধব হালদারের একটি গীতিনাট্য। নাট্যকার গিরিশচন্দ্র এই আইন সম্পর্কে দুঃখ করে বলেছিলেন—“এই দেখ না দেশের কি দুর্ভাগ্য যে নাটকের বিচার কর্তা ও সমালোচক পুলিশ, সাহিত্যিক সম্প্রদায়ের কোনও প্রতিবাদ নেই। পুলিশের নির্দেশমত চরিত্র, dialogue ও scenes বদলাতে হয়।
এই আইনের বলে পুলিশ প্রয়োজনেই বাংলা নাটকের বিচারকর্তা হয়ে উঠল। নাটকটি অভিনয়যোগ্য কিনা, কোন্ দৃশ্যের কতখানি অভিনয় করা যাবে, কোন সংলাপ বা গান বাদ দিতে বা বদলাতে হবে—সবই নির্ধারণ কর্তা পুলিশ। এই ভাবেই নীলদর্পণ নাটকের বিখ্যাত আদালতের দৃশ্য বাদ দিতে হয়েছে, সাহেবের অত্যাচার ও নারী নির্যাতন বাদ দিতে হয়েছে। ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে ‘ফিরিঙ্গি’ শব্দটা উচ্চারণ করা চলবে না। চন্দ্রশেখর উপন্যাসের নাট্যরূপে লরেন্স ফষ্টারের ইংরেজি নামটা পালটে পর্তুগিজ গঞ্জালেস করে দিতে হল। রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকের অনেক শব্দ পরিবর্তন করতে হলো। ‘সংসার’, নাটকের আসামের চাকর সাহেবকে বাংলার গ্রামের ডাক্তারবাবুতে রূপান্তরিত করতে হলো।
ফলতঃ পূর্বের সেই জাতীয় উদ্দীপনা আর রঙ্গমঞ্চে রইলো না। বরং প্রতাপচাদ জন্ত্রী নামে এক অবাঙালি ব্যবসায়ী ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক হয়ে (১৮৮১) নাট্যশালাকে পুরোপুরি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে তুললেন। পরে পরেই আর এক অবাঙালি ব্যবসায়ী গুর্মুখ রায় স্টার থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে (১৮৮৩) সেই বাণিজ্যিক থিয়েটারের ভিত্তিকে মজবুত করে তুললেন। তখন থেকেই ব্যবসায়িক প্রয়োজনে নাট্যশালা রাজনীতি থেকে দূরে সরে থেকেছে। নিরাপদ দূরত্বে থেকে সামাজিক, পৌরাণিক, গীতিনাট্য কিংবা প্রহসনের অভিনয় চালিয়ে গেছে। ভক্তি-ধর্মের কথা, নৃত্য-গীত স্মৃর্তির আমেজ—এসব নিয়েই রাতের পর রাত বাংলা মঞ্চ মেতে উঠেছে—১৯ শতকে আর দেশপ্রেমের বা জাতীয় ভাবোদ্দীপনার কিংবা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সহযোগী সাংস্কৃতিক কর্মে বাংলা রঙ্গমঞ্চ থাকেনি।
সাধারণ নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার (১৮৭২) প্রথম যুগেই একটা জাতীয় ভাবাবেগ কাজ করেছিল। থিয়েটারের নামের মধ্যেই তার প্রমাণ রয়েছে। ন্যাশনাল, গ্রেট ন্যাশনাল, বেঙ্গল, ওরিয়েন্টাল ইত্যাদি। ১৮৭৬-এর পর নতুন থিয়েটারগুলির নাম হলো অন্যরকম, নামকরণেও আর জাতীয় ভাবাবেগ কাজ করলো না—নাম হলো স্টার, মিনার্ভা, এমারেল্ড, ক্লাসিক, ইউনিক, অরোরা প্রভৃতি।
নিষিদ্ধ নাটকের তালিকা—
১. বড়লাট নর্থব্রুকের জারি করা অর্ডিনান্স (২৯-২-১৮৭৬) বলে নিষিদ্ধ নাটক: উপেন্দ্রনাথ দাস—গজদানন্দ ও যুবরাজ, হনুমান চরিত, পুলিশ অফ পীগ অ্যান্ড শীপ, সুরেন্দ্র-বিনোদিনী।
২. অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন বলে (১৬-১২-১৮৭৬) নিষিদ্ধ নাটক: গিরিশচন্দ্র—সিরাজদৌল্লা (২য় ও ৩য় সংস্করণ), মীরকাশিম (১ম সং), ছত্রপতি শিবাজী (১ম ও ২য় সং)। ক্ষীরোদপ্রসাদ—পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত, বাঙ্গলার মসনদ, নন্দকুমার, পদ্মিনী, প্রতাপাদিত্য, দাদা ও দিদি। হারাধন রায়—সুরথ উদ্ধার গীতাভিনয় (২য় সং), মীরা উদ্ধার। মনোমোহন গোস্বামী—কর্মফল, সমাজ, সংসার, শিবাজী। হরিপদ চট্টরাজ—রণজিতের জীবনযজ্ঞ, দুর্গাপুর। কুঞ্জবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়—মাতৃপূজা। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত—আশা কুহকিনী, আহামরি। সুরেশচন্দ্র বসু—হোল কী? মনোমোহন বসু—হরিশ্চন্দ্র নাটক। হরিসাধন মুখোপাধ্যায়—বঙ্গবিক্রম। অমৃতলাল বসু—চন্দ্রশেখর (নাট্যরূপ) [এছাড়া অন্যান্যদের নাট্যরূপ দেওয়া মৃণালিনী, চন্দ্রশেখর, আনন্দমঠ, পথের দাবী (নাট্যরূপ: শচীন সেনগুপ্ত, ১৫-১৯৪০)] ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়: প্যালারামের স্বাদেশিকতা। মন্মথ রায়: কারাগার (১-২-১৯৩১)। শচীন সেনগুপ্ত: নরদেবতা (১৪-১২-১৯৩৫)। যাত্রাপালা: মথুর সাহা—পদ্মিনী, ভরতপুরের দুর্গজয়। ভূষণ দাস—মাতৃপূজা। মুকুন্দ দাস—মাতৃপূজা, পথ, সাথী, সমাজ, পল্লীসেবা, দাদা, জয়পরাজয়, কর্মক্ষেত্র।
বাজেয়াপ্ত বা নিষিদ্ধ নয়—কিন্তু মঞ্চায়নের পক্ষে আপত্তিজনক: দ্বিজেন্দ্রলাল রায়—দুর্গাদাস, মেবারপতন, রাণাপ্রতাপ। মনোমোহন গোস্বামী—পৃথ্বিরাজ, রোশেনারা, শিবাজী। ক্ষীরোদপ্রসাদ—প্রতাপাদিত্য, দাদা ও দিদি। দীনবন্ধু মিত্র—নীলদর্পণ। হরিপদ চট্টোপাধ্যায়—পদ্মিনী। হরনাথ বসু—রাজারাম, বীরপূজা। মন্মথ রায়—মীরকাশিম। মহেন্দ্র গুপ্ত—শতবর্ষ আগে।
স্বাধীন ভারতে নিষিদ্ধ নাটক: দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়—অন্তরাল, তরঙ্গ, মোকাবিলা। সুনীল দত্ত—হরিপদ মাষ্টার। সলিল চৌধুরী—সংকেত। তুলসী লাহিড়ী—বাংলার মাটি। জোছন দস্তিদার—অমর ভিয়েতনাম।
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন ভারতের পুলিশ দপ্তরে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় মোট ১১৩৬টি নাটক পুলিশ দপ্তরে জমা পড়ে। তার মধ্যে তুলসীদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘রত্নাবলী’ নাটক সবচেয়ে পুরনো। রবীন্দ্রনাথের মোট ১৪টি (বিসর্জন সমেত) নাটকও জমা পড়ে। পুলিশ এইসব নাটক বিচার করে আইনানুগ ছাড়পত্র দিত।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ব্রিটিশের এই আইন বলবৎ রইও। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে এই আইনটিকে বলা হয় ‘সংবিধান বহির্ভূত ও লজ্জাকর’।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় গণনাট্য সঙঘ-এর লক্ষ্ণৌ শাখা প্রেমচন্দের ‘ঈদ্গা’ গল্পের নাট্যরূপ পুলিশের বিনা অনুমতিতে মঞ্চস্থ করায় নাটকটির অভিনয় বন্ধ করা হয় এবং সঙ্ঘের চারজন কর্মী-অভিনেতাকে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের কুখ্যাত অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করে। তাদের বিরুদ্ধে চারদফা অভিযোগ দায়ের করা হয়। লক্ষ্ণৌ কোর্ট এই আইনটি চালু থাকা ভারতীয় সংবিধান সম্মত কিনা এই সন্দেহ প্রকাশ করে এবং চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য এলাহাবাদ হাইকোর্টে প্রেরণ করে। বিচারপতি কিদোয়াই এবং ডব্লিউ, এন. মুল্লাকে নিয়ে গঠিত এলাহাবাদ হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ ভারতীয় সংবিধান অনুসারে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন বিধিবহির্ভূত বলে ঘোষণা করে। এই আইনে যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয় তাদেরও বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ মকুব করে তাদের মুক্তি দেওয়া হয় (১৫ মে, ১৯৫৭)।
সংবিধানের ১৯ নং ধারায় বর্ণিত নাগরিক অধিকারের উপর এই আইন অযৌক্তিক বাধা নিষেধ আরোপ করে, এই অভিমত প্রকাশ করে বিচারপতিদ্বয় এই আইনটিকে সংবিধান বহির্ভূত ঘোষণা করে। তাদের মন্তব্য স্মরণযোগ্য—সর্বপ্রকার রাজনৈতিক বিরোধিতাকে দমন করবার জন্য শাসন বিভাগের ভয়াবহ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং এর ফলে জনসাধারণকে দুর্নীতি ও অধঃপতনের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। (স্বাধীনতা—বৃহস্পতিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৩]
তবে, ‘বিধিবহির্ভূত’ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এই আইনটি প্রত্যাহৃত হয়নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনকে নিরঙ্কুশ ও নিষ্কন্টক করবার জন্য রচিত প্রেস আইন, অস্ত্র আইনের মতো এই আইনটিও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কলঙ্কস্বরূপ বিরাজমান।
তাই আবার নানাদিক দিয়ে প্রতিবাদ দেখা দেয়। ভারতীয় গণনাট্য সঙঘ এবং অন্যান্য নাট্যদলের তরফে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান ও প্রতিবাদ সভা সংগঠিত হতে থাকে।
তাসত্ত্বেও ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই আইনটিকে খানিকটা পালটে এবং নতুন কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে পুনরায় চালু করার চেষ্টা করে। নাম দেওয়া হল ‘ওয়েষ্ট বেঙ্গল ড্রামাটিক পারফরম্যান্সেস বিল’ (১৯৬২)। পরিবর্তিত নিয়মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
১৮৭৬-এর আইনে কোনো নাট্যানুষ্ঠানের প্রাক্-অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা ছিল না। বাধ্যতামূলক লাইসেন্স নিতে হত না। সব নিয়মই এক মাত্র প্রকাশ্য স্থানে এবং ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে নাট্যানুষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। ১৯৬২-এর নতুন নিয়মে করা হলো—সব নাট্যানুষ্ঠানই বাধ্যতামূলক। অনুমোদন ছাড়া কোনো অনুষ্ঠানই করা চলবে না। আইনভঙ্গের শাস্তি বাড়িয়ে তিন মাসের জায়গায় ছয় মাস কারাদণ্ড এবং পঁচিশ টাকা জরিমানার জায়গায় এক হাজার টাকা জরিমানা নির্দিষ্ট হলো।
পূর্বের আইনে শুধু নাটক (এবং কিছু ক্ষেত্রে যাত্রা) নিয়মের মধ্যে পড়তো। নতুন নিয়মে মঞ্চনাটক ছাড়াও যাত্রা, নৃত্য, ছায়ানৃত্য, মূকাভিনয়, জলসা, কবিগান, তরজা, কীর্তন, আবৃত্তি এবং সমস্ত রকমের প্রমোদ অনুষ্ঠানই এই আইনের আওতায় এসে গেল। আগের নিয়মে ধর্মানুষ্ঠান পুরো বাদ ছিল, এবারে তারও রেহাই মিলল না।
নতুন আইনের এই খসড়া প্রস্তাব নিয়ে স্বাধীন বাংলায় প্রচণ্ড জনমত গড়ে ওঠে। বিরোধিতায় সামিল হয় সর্বস্তরের সাংস্কৃতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ছাত্র সকলেই। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মে, ইউনিভারসিটি ইন্সটিটিউটে ‘সারা বাংলা নাট্যানুষ্ঠান বিল’ নিয়ে আলোচনা সভা বসে। সভাপতি ছিলেন নাট্যকার মন্মথ রায়। আহ্বায়ক ছিলেন সত্যজিৎ রায়, শম্ভু মিত্র, বিবেকানন্দ মুওপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, কমল মিত্র প্রমুখ।
প্রচণ্ড জনমতের চাপে কংগ্রেস সরকার বিলটিকে পুনর্বিবেচনার জন্য কংগ্রেস সংসদীয় দলের একটি বিশেষ কমিটিতে পাঠায়। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন কমিটি কার্যভার নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় ৮ জুলাই, ১৯৬৩। প্রস্তাবে বলা হলো—‘‘It is not expedient to bring the Bill before the Legislature in its present form.’’
এই প্রস্তাব অনুসারে তদানীন্তন কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন বিলটিকে প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু এই বিলটিকে আইনে পরিণত করতে না পারলেও কংগ্রেসী সরকার ১৮৭৬-এর নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইনের বলেই স্বাধীন দেশে নাটকের কণ্ঠরোধ করতে থাকে। জোছন দস্তিদার পরিচালিত রূপান্তরী নাট্যদলের ‘অমর ভিয়েতনাম’ পুলিস বন্ধ করে দেয় (২৯-১-৬৭)। রবীন্দ্র সদন মঞ্চে উৎপল দত্ত পরিচালিত পি. এল. টি.র ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের অভিনয় করার অনুমতি বাতিল করে দেওয়া হয়।
পরিষ্কার বোঝা যায় যে, স্বাধীন ভারতে ভারতীয় গণনাট্য সঙঘ (প্রতিষ্ঠা: মে, ১৯৪৩) এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলির নাট্যানুষ্ঠান এবং অন্যান্য বিবিধ অনুষ্ঠান স্বাধীন দেশের কংগ্রেসী সরকারকে চিন্তান্বিত করে তুলেছিল। বিশেষ করে কম্যুনিস্ট পার্টি তথা বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির নিয়ত রাজনৈতিক আন্দোলন এবং তার পাশাপাশি এদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির জনমত গঠনের নানা অনুষ্ঠান সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। তাই নতুন করে এই ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধ করার প্রচেষ্টা শুরু করে স্বাধীন সরকার। স্বাধীনতার পরের বছরেই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এক গোপন সার্কুলার পাঠিয়ে সমস্ত জেলার ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশ পাঠান যে, প্রচলিত আইনের সাহায্যে অথবা যে কোনো উপায়েই গণনাট্য সঙ্ঘের নাটক এবং অনুষ্ঠানগুলি যেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার কয়েক বছরের মধ্যেই সরকার ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজিত উনষাটটি নাটকের কপি তলব করে পাঠায় এবং সেগুলির অভিনয় নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর বিধানসভায় কমিউনিস্ট সদস্য জ্যোতি বসু, মণিকুন্তলা সেন এবং মনোরঞ্জন হাজরার প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ রায় এই উনষাটটি নাটকের তালিকা পেশ করেন। সেখানে ডাঃ রায় বলেন—‘‘সব নাট্যদলের কাছেই তালিকা চাওয়া হয়নি। ‘ক্যারেকটার অফ ড্রামা’ প্রসঙ্গে উত্তরে বলেন—‘‘কম্যুনিস্ট পার্টি অভিনয়ের পূর্বে নাটকগুলি অদলবদল করত। তাই তাদের কাছেই তলব পাঠানো হয়। সেখানে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন, আমাদের খবরই এই যে, ভারতীয় গণনাট্য সঙঘ কম্যুনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত।’’ ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২-এর মধ্যে পাণ্ডুলিপি জমা না দিলে তা ‘আইনের লঙঘন’ বলেই গণ্য হবে।
নীলদর্পণ, অরুণোদয়ের পথে, Lest you forget, ভূয়া স্বাধীনতা, অহল্যা, দলিল, ভাঙ্গাবন্দর, পথিক, জবানবন্দী, নবান্ন, গোরা, Till the Day I die, বিসর্জন, চার অধ্যায়, উলুখাগড়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাটক এই তালিকার মধ্যে রয়েছে। তালিকার অনেকগুলি আদৌ নাটকই নয়।
১৯৬৭-তে যুক্তফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে শাসনক্ষমতায় এসে ১৮৭৬-এর নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে। কিন্তু আইনটি বাতিল করা হয়নি। তবে এই বিলের ১০ নম্বর ধারায় যেখানে লাইসেন্স প্রথার কথা বলা হয়েছিল, শুধু সেইটুকু বাতিল করা হয়। এখন অবধি (জানুয়ারি, ২০০৩) এই আইনটি সারা ভারতেই অঘোষিত ভাবে বলবৎ রয়েছে। যে কোনো প্রাদেশিক সরকার কিংবা স্বয়ং কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনে ব্রিটিশ প্রবর্তিত আইনটি ব্যবহার করতে পারে প্রকারান্তরে নানা রূপে ও নানা ছলে।
১৮৭৬-এর অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন পাষাণভারের মতো বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের উপর চেপে বসেছিল। এর হাত থেকে নাটক কখনো আর রেহাই পায়নি। রাষ্ট্রীয় শাসন পরিবর্তনের অবস্থান্তরে কখনো আইন প্রয়োগ হয়েছে কিংবা কখনো হয়নি।
১৮৭২-এর ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মূলে জাতীয়তার প্রেরণা কাজ করেছিল। নামকরণে ‘ন্যাশনাল’ ছাড়াও এদের কর্মোদ্যোগ ও প্রচেষ্টার মধ্যেও জাতীয়তার আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল। প্রথম অভিনয়ের জন্য ‘নীলদর্পণ’ নির্বাচন করার মধ্যেই তার প্রমাণ রয়েছে। তারপরে নানা উদ্যম ও অনুপ্রেরণার মধ্যে দিয়ে বাংলা মঞ্চে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে চলেছিল। কিন্তু ১৮৭৬-এর আইন প্রবর্তনের পর নাট্যানুষ্ঠানের ওপর কুঠারাঘাত পড়ল, এই ধরনের কর্মোদ্যোগ স্তব্ধ হয়ে গেল। নিরাপত্তার কারণে ব্যবসায়িক রঙ্গমঞ্চ এই ধরনের নাটকাভিনয়ের ঝুঁকি নিল না। ফলে, এই সময় থেকেই বাংলা মঞ্চে পৌরাণিক নাটক, সামাজিক নাটক, গীতিনাট্য অপেরা এবং পঞ্চরং প্রহসনের ছড়াছাড়ি পড়ে গেল। গিরিশ থেকে শুরু করে এই সময়কার অন্যসব নাট্যকারই তাদের নাটক রচনার মধ্যে এইসব বিষয়েই ঘুরপাক খেতে লাগলেন—কিন্তু কখনোই কদাপি ব্রিটিশবিরোধী প্রসঙ্গ নাটকে আনলেন না।
তবে পৌরাণিক নাটকের ছড়াছড়ির এটিই একমাত্র কারণ নয়। ধর্মপ্রাণ বাঙালি পুরাণের কাহিনী এবং ধর্মভাব পছন্দ করত বেশি। বেশির ভাগ দর্শক জাতীয়তাবোধের চেয়ে ভক্তিভাবের পৌরাণিক নাটক পছন্দ করত বেশি। ব্যবসায়িক মঞ্চ পৌরাণিক নাটক অভিনয়ের মাধ্যমে নিরাপত্তা এবং ব্যবসা দুটোই চালাতে পেরেছিল। তারই দাবিতে এতো পৌরাণিক নাটক লেখা হতে লাগল।
উল্টোদিক দিয়ে দেখলে, এর একটা বড়ো প্রমাণ পাওয়া যাবে, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের আন্দোলনের সময়কার রঙ্গমঞ্চ ও নাটকের কথা ভাবলে। এই আন্দোলনের সময় বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। এই প্রথম ব্রিটিশের কাজের বিরুদ্ধে আপামর বাঙালি একজোট হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের পথে নেমেছিল। মঞ্চমালিক ও নাট্যকারেরা তার এই প্রাণের স্পন্দনকে রঙ্গমঞ্চে ধরতে চেয়েছিলেন। এই সময়ে নাট্যশালায় তাই আইনের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেও ইতিহাসের কাহিনী অবলম্বনে স্বদেশপ্রেমমূলক ও জাতীয় ভাবোদ্দীপনামূলক নাটক লিখিত ও অভিনীত হয়েছে। যে গিরিশ বিগত ২৫ বছর ধরে আর কোনো ঐতিহাসিক বা দেশপ্রেমমূলক নাটক লেখেননি, তিনিও ১৯০৫-এর উন্মাদনার সময়ে পরপর তিনখানি এই ধরনের নাটক লিখে ফেললেন। পুলিশের রক্তচক্ষু তখন তাঁকে ভীতসন্ত্রস্ত করতে পারেনি। সিরাজদৌল্লা, মীরকাশিম, ছত্রপতি শিবাজী নিষিদ্ধ হয়েছে, গিরিশকে হয়রানি ভোগ করতে হয়েছে, তবুও তিনি পিছপা হননি। আবার যেই ১৯০৫-এর ভাবাবেগ কেটে গেছে, গিরিশও আর এই ধরনের নাটক লেখেননি। গিরিশের কথা উদাহরণ হিসেবে এত করে বলার কারণ, তিনি ছিলেন তার যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, প্রধান অভিনেতা, নাট্যশিক্ষক এবং ম্যানেজার। তাকে রঙ্গমঞ্চের এবং নিজের স্বার্থের কথা ভেবে অনেক দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হতো।
নাট্যমঞ্চ থেকে জনগণকে উত্তেজিত করার বদলে, উত্তেজিত জনতার প্রাণস্পন্দন ধরতে পেরে থিয়েটারে সেই ভাবোদ্দীপনাকে সঞ্চার করে দেওয়ার সহজ সঙ্কল্প নিয়েছিল তখনকার নাট্যশালাগুলি। নাট্যকারেরাও সেই মতো নাটক রচনা করতে লেগে পড়েছিলেন।
বলা যায়, অভিনয়নিয়ন্ত্রণ আইন প্রবর্তনের পেছনে অনেকাংশের জনসমর্থন ছিল। নাটক ও মঞ্চের পক্ষে সেই অর্থে ততোখানি জনসমর্থন মেলেনি। আবার বঙ্গভঙ্গের উত্তাল সময়ে যেই জনসমর্থন পাওয়া গেছে, অমনি মঞ্চ ও নাট্যাকারেরা এগিয়ে এসেছেন। ক্ষীরোদপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল—এঁদের এই জাতীয় সব রচনা এই সময়কার। তবে একথাও ঠিক, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের কারণে আন্দোলন যে নবীন জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি করেছিল, তখন আবার বাংলা নাটক স্বাদেশিকতায় জাগ্রত হয়েছিল। কিন্তু তাতে আর পরিষ্কারভাবে পরাধীনতার কথা, তার বেদনার কথা, স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা কিংবা ইংরেজ বিদ্বেষের কথা প্রকাশিত হলো না। ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে জাতীয় বীর (National hero)-দের গ্রহণ করে তাদের চরিত্র ও ঘটনার মধ্যে দিয়ে জাতীয়তা প্রকাশের চেষ্টা হল। কোথাও হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির কথা বলা হল, দেশ গঠনের ও মনুষ্যত্ব গঠনের কথা বলা হলো, কিংবা জাতীয়তাকে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের মহান আদর্শে সমুন্নত করা হলো।
অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হবার পর, স্বদেশী উত্তেজনার নাটক তত আর অভিনীত হলো না বটে, তবে সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে প্রহসন জাতীয় রচনা কিছু লিখিত ও অভিনীত হয়েছে। ন্যাশনাল থিয়েটারে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি প্রথম থেকে এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। পরে অমৃতলাল বসু এই ধারাতে কয়েকটি প্রহসন রচনা করেন। অর্ধেন্দুশেখরের প্রচেষ্টার মধ্যে গিরিশ স্বদেশানুরাগ লক্ষ করেছেন। রঙ্গমঞ্চের কার্য দেশের কার্য—তাহার জ্ঞান ছিল। ‘মুস্তাফি সাহেবকা পাক্কা তামাশা’ গুলিতে তিনি এই কাজ অনেকাংশে করেছেন। অমৃতলালের সাবাশ আটাশ, নবজীবন, সাবাস বাঙালি—এই তিনটি প্রহসনে ও নক্সায় তৎকালীন রাজনৈতিক চেতনাকে ব্যঙ্গ করতে চেয়েছেন। এইগুলিতে কথায় ও গানে দেশপ্রেম সঞ্চারের চেষ্টা রয়েছে। ‘বাবু’ প্রহসনেও (১৮৯৪) রাজনীতি ও ধর্মের পেছনে যে ভণ্ডামি ও স্বার্থপরতা-ভীরুতা রয়েছে তাকে বিদ্রুপ করেছেন। বাহবা বাতিকে আবেদন নিবেদনের রাজনীতিকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। ১৮৭৫-এ গায়কোয়াড়ের ঘটনার অবলম্বনে যে ‘হীরকচূর্ণ’ নাটক লিখে অমৃতলাল পুরোপুরি ব্রিটিশ-বিরোধী কথা দৃপ্তভাবে বলেছিলেন, এবারে তা স্তিমিত হয়ে প্রহসনের ব্যঙ্গের মাধ্যমে ক্ষীণকণ্ঠ হয়ে পড়ল।
এইভাবে ক্রমে রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাটক যে ব্রিটিশ-বিরোধী প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেল তাই নয়, তার জায়গায় ইংরেজ-প্রশস্তিমূলক নাটক রচিত ও অভিনীত হতে লাগলো। ইংরেজ তোষণের এইসব নাটক যদিও খুবই তুচ্ছ ও অকিঞ্চিকর। গিরিশের গীতিনাট্য অশ্রুধারা (১৯০১) রাণী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু উপলক্ষে লেখা। হীরকজুবিলী (১৮৯৭) লিখেছিলেন মহারাণীর ষাট বৎসর রাজত্বকাল স্মরণে। শাস্তি রূপকনাট্যে সপ্তম এডওয়ার্ডের জয়গান করা হয়েছে। অমৃতলের বৈজয়ম (১৯০০) ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু উপলক্ষে লেখা। অমরেন্দ্রনাথ দত্তের এস যুবরাজ (১৯০৫) ব্রিটিশ যুবরাজের ভারত আগমন স্মরণে লেখা।
জাতীয় নাট্যশালার মাধ্যমে জাতীয়তাবোধের উদ্বোধন ও স্বদেশপ্রেমের উদ্দীপনার পরিণতি মহারাণী কিংবা যুবরাজের প্রশস্তিতে এসে থেমেছে। ব্রিটিশরাজভক্তির চরম পরাকাষ্ঠা এই সময়ে দেখিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার ‘রয়্যাল’ উপাধি লাভ করেছিল। প্রিন্স এলবার্ট ভিক্টরের অভ্যর্থনায় শকুন্তলা নাটকাভিনয় (৭ জানু, ১৮৯০) করে তারা এই উপাধি পায়। অনেকে এই উপাধিকে ‘রয়্যাল’ না বলে ‘লয়্যাল’ (অনুগত) বলতে চেয়েছেন। ১১ জানুয়ারি, ১৮৯০ থেকে বেঙ্গলের নাম হয় ‘রয়্যাল বেঙ্গল থিয়েটার।’
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দেখা যায়, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নাট্যশালার একটি বড় ভূমিকা থাকে। সব দেশেই নাট্যকর্মী ও রঙ্গমঞ্চ তাদের এই জাতীয় দায়িত্ব পালন করে। পরাধীন বাংলাতেও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসের গোড়ার দিকে সে দায়িত্ব পালনে অনেকেই এগিয়ে এসেছিল। ইংরেজরা তাদের দেশের এবং অন্যদেশের ইতিহাস থেকে ভালোভাবেই জানত যে, জাতীয়তা ভাবের উন্মেষে এবং স্বাধীনতার দাবীতে নাট্যশালা কত বড়ো ভূমিকা নিতে পারে। শঙ্কিত ব্রিটিশ রাজশক্তি তাই অতি সত্বর রঙ্গমঞ্চের এই প্রয়াসকে বন্ধ করে দিতে তৎপর হয়েছিল। আইন করে নাট্যশালার সরকার-বিরোধী কাজকর্মকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। কৌশলে অশ্লীলতার দোহাই পেড়ে ভেতরে ভেতরে শক্ত হাতে আইন করে সব দিক দিয়ে নাট্যশালার সব প্রচেষ্টাকে বন্ধ করে দিয়েছিল। তবুও স্বাধীনতার কাল পর্যন্ত এবং পরবর্তী স্বাধীন দেশেও নানাভাবে চেষ্টা হয়েছিল সরকার-বিরোধী কথা বলার। কিন্তু ব্রিটিশের মতো স্বাধীন দেশের সরকারও এই আইন ব্যবহার করে প্রয়োজনে নাটকের ও নাট্যশালার কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে। ব্রিটিশের এই আইন বাংলা মঞ্চের ও নাটকের পেছনে অশুভ ছায়ামূর্তির মতো ঘুরে বেড়িয়েছে। শৃঙ্খলিত বাংলা নাটক শৃঙ্খলমুক্ত হতে পারেনি। বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে এই শৃঙ্খলের দাগ মর্মান্তিকভাবে রয়ে গেছে।
Leave a Reply