অভিসার কাকে বলে? এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবির কৃতিত্ব আলোচনা কর।

অভিসার

সংজ্ঞা

অভিসার শব্দের অর্থ সংকেত-স্থানে গমন। সাধারণভাবে শব্দটি মানুষের উদ্দিষ্ট স্থানের অভিমুখে যাত্রাকেই বোঝাতো। কিন্তু ক্রমশ এটি প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের উদ্দেশ্যে পরস্পরের অভিমুখে যাত্রাকেই বোঝায়। ‘রসকল্পবল্লী’তে অভিসারিকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে—‘‘কান্তার্থিনী তুখা যাতি সংকেতকং অভিসারিকা।’’ অর্থাৎ কান্তের উদ্দেশ্যে যিনি সংকেতস্থানে গমন করেন তিনিই অভিসারিকা। নারায়ণদাস গীতগোবিন্দের ‘সর্বাঙ্গসুন্দরী’ টীকায় অভিসারিকাকে কামনাব্যাকুল নিঃশঙ্ক মনের অধিকারিণী বলেছেন। শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে অভিসারিকার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন—

যাভিসারয়তে কান্তং স্বয়ং ব্যাভিসরত্যপি।

সা জ্যোৎস্নী তামসী যান যোগ্যবেশাভিসারিকা।।

লজ্জয়া স্বাঙ্গলীনের নিঃশব্দাখিলমণ্ডনা।

কৃতাবগুণ্ঠা স্নিগ্ধৈক সখিযুক্তা প্রিয়ং ব্রজেৎ।।

শ্রেণিবিভাগ

পীতাম্বর দাস ‘রসমঞ্জরী’ গ্রন্থে আট ধরনের অভিসারের কথা বলেছেন-জ্যোৎস্নাভিসার, তামসাভিসার, বর্ষাভিসার, দিবাভিসার, কুজ্ঝটিকাভিসার, তীর্থযাত্রাভিসার, উন্মত্তাভিসার এবং সঞ্চরাভিসার। আসলে অভিসারের এই সময় বৈচিত্র্যই বুঝিয়ে দেয় অভিসারের কোনো দিনক্ষণ নেই। প্রাণের আবেগ অসময়কেও সময় করে তোলে। বৈষ্ণব পদাবলীতে শ্রেষ্ঠ অভিসার-বিষয়ক পদগুলিই বর্ষণ-মুখর রাত্রিতে রাধার তিমিরাভিসারের বর্ণনা।

অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি গোবিন্দদাস

অভিসার পর্যায়ে গোবিন্দদাস অবিসংবাদীভাবে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। অভিসারের মধ্যে যে। বিপুল গতির আবেগ, অতন্দ্র নিষ্ঠা ও দুরূহকে, দুর্গৰ্মকে উত্তীর্ণ হওয়ার অভীপ্সা, গোবিন্দদাসের অভিসার-বিষয়ক পদে তাঁর পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যাপতির পদেও আছে। তার মানবী রাধাও প্রেমসাধনার গৌরবে, দুর্গমকে জয় করার অসাধারণ ক্ষমতায় শেষপর্যন্ত সালোকমান্যা। কিন্তু গোবিন্দদাসের মতো এতখানি পরিবেশ বৈচিত্র্য, পারম্পর্যময়, নাটকীয়তা বিদ্যাপতির পদে নেই। আর অন্যান্য কবিগণ এই পর্যায়ের পদে গোবিন্দদাসের কাছাকাছিও আসতে পারেন না।

শ্রীরূপ গোস্বামীর উজ্জ্বলনীলমণি-তে অভিসারের যে বিভিন্ন প্রকার ও প্রকরণ রয়েছে, গোবিন্দদাস তা বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করেছেন। কিন্তু ভক্ত এবং কবি হিসেবে গোবিন্দদাসের সব থেকে বড় কৃতিত্ব সম্ভবত এইখানেই যে অভিসারের কোনও দিনক্ষণ নেই। প্রাণের আবেগ অসময়কেও সময় করে তোলে। এই সাধারণ সত্যকে তিনি সামাজিকের মনেও সঞ্চারিত করতে পেরেছেন। তাঁর রাধা প্রথম যখন অভিসারের পথে নামেন, তখন তিনি রূপে রসে প্রসাধনে অনুপমা। তিনি ‘কুঞ্চিতকেশিনী’, ‘নিরুপমবেশিনী’, ‘রসআবেশিনী। ব্রজরমণীগণের ‘মুকুটমণি’, ‘কুঞ্জরগামিনী’ এই নারীর রূপের জ্যোতিতে যেন বিজলী চমকায়। তিনি শ্যামের ‘হৃদয়বিদারিণী’ আবার ‘অখিল সোহাগিনী’ও বটে। এই রাধা যিনি সৌন্দর্যে ও গুণে সর্বশ্রেষ্ঠা, প্রতিকুল পরিবেশে তাঁরই দুর্গম পথাতিক্রমণের বর্ণনায় কবি গোবিন্দদাস শুধু চিত্র আর ধ্বনি নয়, নাটকীয়তারও সৃষ্টি করেছেন।

গোবিন্দদাসের রাধা কৃষ্ণাভিসারে যাওয়ার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ‘কণ্টকগাড়ী কমলসম পদতল’ শীর্ষক পদটিতে রাধার সেই অতন্দ্র সাধনার চিত্রই ফুটে উঠেছে। তিনি পায়ের নূপুরে কাপড় বেঁধে, কলসের জল ঢেলে, প্রাঙ্গণ পিচ্ছিল করে, পায়ের আঙুল টিপে টিপে দুর্গম পথে চলার অভ্যাস করেন। রাধার অভিসারের পথ অন্ধকার। তাই হাত দিয়ে চোখ আবৃত করে অন্ধকারে পথ চলার অভ্যাস করেন রাধা। পথে সাপের ভয়। তাই নিজের কঙ্কণ মূল্য হিসেবে দিয়ে সাপের মুখ বাঁধার কৌশল শিক্ষা অর্জন করেন। গুরুজনদের কথা তিনি কানে শুনতেই পান না। আর পরিজনদের কথা শুনে বোকার মতো হাসেন। রাধার এই দুশ্চর তপস্যা কুমারসম্ভবের তাপসী উমার কথাই মনে করিয়ে দেয়।

কিন্তু উমার তপস্যা যত দুশ্চরই হোক কেন, তপস্যার শেষে স্বয়ং চন্দ্রশেখরই তার কাছে এসেছিলেন। আর গোবিন্দদাসের রাধাকে দুর্গম পথ অতিক্রম করা যেতে হবে দয়িতের কাছে। গোবিন্দদাসের এই পদটি কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়ের একটি শ্লোকের ভাব অবলম্বন করেছে—“মার্গে পঙ্কিনি তোয়দান্ধতমসে নিঃশব্দসংচারকং গন্তব্য দয়িতস্য মেহদা বসতির্মুগ্ধেতি কৃত্বা মতিম। আজানুকৃত নূপুরা করতলেনাচ্ছাদ্য নেত্রে ভশং কৃচ্ছ্রাল্লবপদস্থিতিঃ স্বভনে পন্থানমভাস্যতি।” পঙ্কিল পথে মেঘান্ধতমসার ভেতর দিয়ে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে আজ আমাকে প্রিয়ের বাসভবনে যেতে হবে। এই ভেবে এক মুগ্ধা রমণী নূপুরকে জানু পর্যন্ত তুলে নয়ন দুটিকে করতলে আবৃত করে অতি কষ্টে পদস্থিতি লাভ করে নিজের ঘরেই পথচলার অভ্যাস করছে। গোবিন্দদাস কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়ের অনুসরণে পদটি রচনা করলেও কিছুটা স্বাতন্ত্র্য গ্রহণ করেছেন।

কারণ কণ্টকাকীর্ণ সর্পময় পথে চলার এমন পূর্বপ্রস্তুতির বর্ণনা মূল শ্লোকে নেই। নারীর সর্বাধিক প্রিয় অলংকারের বিনিময়ে সর্প মুখ বন্ধনশিক্ষাও মূল শ্লোকে নেই। বিদ্যাপতির একটি পদে আছে— ‘‘দেখি ভবনভিতি, লিখল ভুজগপতি/জসু মনে পরম তরাসে।/ সো সুবদনী করে, ঝপইত ফণীমণি/বিহুসি আইলি তুঅ পাশে।” গোবিন্দদাস এই পদটির দ্বারাও কিছুটা প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু রাধার দুর্গম পথযাত্রার বর্ণনায় কবি ঈশ্বর সাধনার দুর্গম পথের ব্যঞ্জনাই ফুটিয়ে তুলেছেন— “ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয়া দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।” রাধার এই সাধনা গীতার অভ্যাস যোগের কথাও মনে করিয়ে দেয়। সর্বোপরি গোটা পদটিতে আছে ছন্দের ও শব্দের হিল্লোলে জীবন্ত হয়ে ওঠা অভিসার প্রস্তুতির নাটকীয় চিত্র। ঐতিহ্যকে অঙ্গীকার করে উজ্জ্বল সিদ্ধি এই পদটিতে গোবিন্দদাসের করায়ত্ত।

বর্ষাভিসারেই অভিসারিকা বাধার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা, প্রকৃতির প্রতিকূলতা তখন সবচেয়ে তীব্র। ‘মন্দির বাহির কঠিন কপাট’ শীর্ষক পদটিতে রাধার সখী বাইরের প্রতিকূলতার সঙ্গে গৃহপরিবেশেরও প্রতিকুলতার উল্লেখ করে দুঃসহ অভিযাত্রা থেকে রাধাকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছেন। সখী বলছেন ঘরের বাইরে সুদৃঢ় কপাট, সুতরাং বাইরে যাওয়া বন্ধ। কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ অত্যন্ত দুর্গম। তার ওপর বৃষ্টি হচ্ছে মুষলধারে। রাধার নীল শাড়ি, এই প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে যাবে। এর মধ্যে তিনি কী করে অভিসার করবেন? কৃষ্ণ আছেন বহুদূরে মানস-গঙ্গার পারে।

চতুর্দিকে ঘন ঘন বজ্রপাতের তুমুল শব্দ। বিদ্যুতের তীব্ৰদীপ্তি চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। এসব জেনেও যদি রাধা অভিসারে বেরিয়ে পড়েন তাহলে বলতে হয়, প্রেমের জন্য তিনি দেহকে উপেক্ষা করবেন। ভণিতায় গোবিন্দদাস সখীকে নয়, শ্রীরাধাকেই সমর্থন করেছেন। জ্যা-নির্গত তীরকে যেমন ফেরানো যায় না, অভিসারসংকল্পা রাধাকেও তেমন নিবৃত্ত করা যাবে না। অভিসারের বর্ষণমুখর পটভূমি রচনায় এক বিদ্যাপিত ছাড়া গোবিন্দদাসের সমতুল্য আর কেউ নেই। রাধার অভিসার তো প্রেম-তপস্যা।

সেই তপস্যার পথ কত দুর্গম, সিদ্ধি কত দুর্লভ, বিঘ্ন-বিপদ ও বাধা কত দুস্তর— তারই পরিচয় এই পদটিতে পাওয়া। রাধার এই প্রেমতপস্যার পথে শুধু সমাজ বা সংস্কারের বাধাই বড় বাধা নয়, বিশ্বপ্রকৃতিও প্রবলভাবে বিমুখ। গোবিন্দদাস এই পদে রাধার অভিসারের সংকল্পকে আরও দৃঢ় করার জন্যইযেন বিরূপ বিশ্বপ্রকৃতির বিরূপ চিত্র এঁকেছেন। বর্ষণমুখর অন্ধকার রাত্রি শব্দ, ধ্বনিতে, ছন্দের হিল্লোলে যেন সজীব প্রাণময় হয়ে উঠেছে। নিজের অভীষ্টকে, ইপ্সিতকে লাভ করার জন্য প্রতিকূল প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক ইতিহাস মানবসভ্যতারই ইতিহাস। সেই প্রকৃতি জড়। আর এখানে, এই পদে প্রকৃতিও একটি জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে। রাধার বিশ্ব প্রেমকে যাচাই করার কষ্টিপাথর সে। আর গোবিন্দদাসের ভণিতাই বলে দিচ্ছে, প্রতি পরীক্ষা যত দুরূহই হোক না কেন, রাধা তাকে অতিক্রম করবেনই।

পরবর্তী বর্ষাভিসারের পদটি সখীর নিষেধে রাধার উত্তর। ‘কুল মরিযাদ কপাট উদঘাটলুঁ’ শীর্ষক এই পদটিতে রাধা বলছেন যে, কুলমর্যাদার দরজা যখন তিনি খুলেই ফেলেছেন, তখন সামান্য কাঠের দরজা আর তাকে কি বাধা দেবে? আত্মসম্মানরূপ সমুদ্র তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন তাই নদীর অগাধ জলও তিনি অনায়াসে অতিক্রম করতে পারবেন। সখী যেন আর তাকে পরীক্ষা না করেন। কৃষ্ণ রাধার জন্য ব্যাকুলভাবে প্রতীক্ষা করে আছেন, একথা ভেবেই রাধার দুচোখ দিয়ে জল পড়ছে। সখী বলেছিলেন, রাধার নীল বসন বৃষ্টিতে ভিজে যাবে। কিন্তু প্রেমের দেবতা যার ওপর কোটি কোটি বাণ বর্ষণ করছেন, মেঘের জল তাকে স্পর্শ করতে পারে না। প্রেমের আগুন যার হৃদয়ে জ্বলছে বজ্রাগ্নি তাকে দগ্ধ করতে পারে না।

তাছাড়া রাধা তো নিজের জীবনই কৃষ্ণের কাছে সমর্পণ করেছেন। তাই কৃষ্ণের জন্য যদি তার শরীরই ত্যাগ করতে হয়, তবে তা রাধার পক্ষে দুঃসাধ্য হবে না। ভণিতায় গোবিন্দদাস রাধাকে অভিসারে উৎসাহিত করে বললেন, এবার সখী রাধার দৃঢ় সঙ্কল্পের কথা বুঝতে পেরেছেন। পদটি গোবিন্দদাসের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ অভিসার পদের অন্যতম। রাধার কৃষ্ণপ্রেম এখানে তাকে প্রবল ও প্রতিকূল প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার প্রেরণা যুগিয়েছে। বাইরের বাধা যত বড়ই হোক কেন, অন্তরের বাধা তার চেয়ে প্রবল। সেই বাধাকে অতিক্রম করতে পারলে অনায়াসেই বাইরের প্রবল বাধাকে অতিক্রম করা যায়। রাধা এই সত্যকেই প্রমাণ করেছেন। তার অন্তরে আছে প্রতীক্ষমাণ প্রেমিক করেন তারই টানে রাধার এই দুর্গম পথযাত্রার সুদৃঢ় ঘোষণা। গোবিন্দদাসের অভিসারের পদে বিঘ্ন-বিজয়িনী রাধারর প্রেম-তপস্যার চূড়ান্ত চিত্রণ এই পদটিতে লক্ষ করা যায়।

শুধুসার অভিসার যাত্রার বর্ণনা নয়, অভিসার যাত্রার সমাপ্তির বর্ণনাতেও গোবিন্দদাস অতুলনীয়। তাঁর ‘আদরে আগুসারি’ শীর্ষক পদটিতে অভিসার যাত্রার সমাপ্তিতে রাধা কষ্ট করে কৃষ্ণের কাছে পৌঁছালে কৃষ্ণের প্রতিক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে। যার জন্য রাধা এত দুর্গম পথ অতিক্রম করে অভিসারে আসেন, সেই প্রেমময় কৃষ্ণও এগিয়ে এসে সাদরে রাধাকে আলিঙ্গন করলেন। রাধার পা ধুইয়ে দিলেন, মুখ মুছিয়ে দিলেন, মিষ্ট সম্ভাষণ করলেন। গোবিন্দদাস ভণিতায় বলছেন, কৃষ্ণের এই সানুরাগ সেবা যেন রাধাকে নিত্যনতুন অমৃতের ধারায় স্নান করাল। এই পদটিতে অভিসারিকা রাধার কৃচ্ছসাধন কৃষ্ণের স্বীকৃতিতে কীভাবে ধন্য হয়েছে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। অভিসার যাত্রার শেষে এই প্রেম-স্নিগ্ধ সেবাময় নায়কের চিত্র  সমগ্র বৈষ্ণব পদ সাহিত্যেই বিরল দৃষ্টান্ত।

গোবিন্দদাসের রাধা কৃষ্ণের জন্য যতটুকু কৃচ্ছসাধন করেছেন, সে জন্য নিজের প্রশংসা নিজে করতে মোটেই কুণ্ঠিত নন। ‘মাধব কি কহব দৈব বিপাক’ শীর্ষক পদটিতে অভিসার যাত্রার শেষে কৃষ্ণর কাছে উপনীতা রাধা নিজের দুর্গম পথ যাত্রার বিবরণ দিয়েছেন। মাধবকে সম্বোধন করে তিনি বলছেন, পথের দুর্দশার কথা তিনি আর কি বলবেন। যদি লক্ষ লক্ষ মুখ হয় তা হলেও পথযাত্রার কথা বলে শেষ করা যাবে না। গৃহবহির্গত রাধা দু-চার পা এগিয়ে যাওয়ার পরই অন্ধকার রাত্রি দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। অন্ধকার এত নিবিড় যে রাধা পথও দেখতে পাচ্ছিলেন না। তার ওপর আবার তার দুটি পায়েই সাপ জড়িয়ে ধরল। রাধা একে কুলনারী অর্থাৎ সাধারণভাবেই পথচলার অভ্যাস তার নেই।

তার ওপর অমাবস্যার ঘন অন্ধকার রাত্রি। গন্তব্যও বহুদূর। এরও সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবল বর্ষণ। অথচ রাধাকে তো যেতে হবে অনেক দূরে। তার পদ্মের মতো কোমল সুন্দর দুটি পা কর্দমলিপ্ত হল। পায়ের কাঁটার আঘাতেও যন্ত্রণা পেল। কিন্তু তীব্র কৃষ্ণদর্শন লালসায় রাধা কিছুই টের পেলেন না। এখন কৃষ্ণের দেখা পেয়ে তার সমস্ত দুঃখই দূর হল। যেদিন রাধার কানে কৃষ্ণের বাঁশির সুর এসে প্রবেশ করেছে, সেদিনই গৃহের সুখ পাওয়ার আশা রাধা ত্যাগ করেছেন। পথের দুঃখ তার কাছে তৃণের চেয়ে তুচ্ছ মনে হয়েছে। পদটির অসাধারণ ভাবগৌরব, শব্দ দিয়ে ছবি আঁকার কুশলতা, নাটকীয় গতিবেগ এবং মহাভাবময়ী রাধার দিব্য অনুভূতির আলোকে সহৃদয়ের মনকে মুহূর্তে অধিকার করে নেয়।

গোবিন্দদাসের অভিসারিকা রাধার এই প্রেম আত্মসমর্পণে ধন্য। কিন্তু নিজের কৃতিত্ব সম্পর্কেও  রাধার প্রবল সচেতনতা পদটিতে সুস্পষ্ট। প্রেমিক কৃষ্ণ রাধার জন্য প্রতীক্ষায় থেকে পথযাত্রার শেষে রাধার সেবা করে তার ভালবাসার প্রকাশ ঘটান। অন্যদিকে অবলা নারী হয়েও রাধাকে কৃষ্ণসান্নিধ্য পাওয়ার জন্য অনেক বেশি কৃচ্ছসাধন করতে হয়। নারী বলেই হয়তো সেই কৃচ্ছসাধনের কৃতিত্ব তিনি বেশি করেই দাবি করেন। এই দাবির পেছনে আছে রাধার মধুর অহংকার। এই অহংকারেরও জনয়িতা কৃষ্ণই।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের বৃন্দাবনবিহারী রাধাপ্রেমিক কৃষ্ণের বীরত্বব্যঞ্জক অসাধারণ কীর্তিগুলির পাশাপাশি নিজের পীতবাস দিয়ে রাধার চরণধুলি মুছে দেওয়ার প্রসঙ্গও যে অসামান্য পৌরুষের দ্যুতি ফুটিয়ে তোলে, রাধার অহংকারের মূলে তাই-ই। প্রেমিকার প্রেমকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য যিনি তাঁর পায়ের ধূলা মুছিয়ে দেন তার জন্যই তো রাধা নিজের পদপঙ্কজকে পঙ্কে বিভূষিত করতে পারেন। কৃষ্ণের উপহাসে বা অবজ্ঞায় এই কৃচ্ছসাধন ব্যর্থ হবে না, স্বীকৃতিতে ধন্য হবে—এটা জেনেই রাধার কণ্ঠে এই মধুর নির্লজ্জ আত্মপ্রশংসা উচ্চারিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!