//
//

অমিত্রাক্ষর ছন্দ কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্য উদাহরণসহ আলোচনা কর।

অমিত্রাক্ষর ছন্দ

বাংলা ছন্দ যুগে যুগে পালাবদলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। মধ্যযুগের পয়ার ত্রিপদীর সুদৃঢ় অচলায়তন চূর্ণ করে উনিশ শতকের মধ্যভাগে মহাকবি শ্রী মধুসূদন দত্ত প্রথম বাংলা ছন্দকে সমুদ্রাভিমুখী করলেন— বৈচিত্র্যে, বর্ণে, আলিম্পনে। ইউরোপীয় ছন্দ ঘরানার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনিই প্রথম ছন্দবন্ধের মধ্যে ভাবের প্রবাহ সৃষ্টির চেষ্টা করলেন। মূলত পয়ারকে অবলম্বন করে ভাবপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে প্রবহমান পয়ারের নতুন ছন্দ কাঠামো নির্মাণ করলেন তিনি। সেই সঙ্গে অন্ত্যমিলের চিরাচরিত ধারণাকে পাল্টে দিলেন। এই ভাবে প্রবহমান পয়ারের সূত্রে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বাংলায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল।

সাধারণত অক্ষরবৃত্ত ছন্দের (মিশ্ৰকলাবৃত্ত) অন্তর্গত যে প্রবহমান পয়ারে অন্ত্যমিল থাকে তাকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বা Black Verse বলে। ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন মনে করেন অমিত্রাক্ষর নামটি রূঢ়ার্থে গ্রহণ করা কর্তব্য। তিনি এটিকে অমিল প্রবহমান পয়ার রূপে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। তার সংজ্ঞা হল—“যে পয়ারবন্ধে পংক্তি-প্রান্ত্য পূর্ণ যতি স্থাপন আবশ্যিক বলে মানা হয় না অর্থাৎ যে পয়ার বন্ধে ভাব ও ধ্বনির প্রবাহ পূর্ণ যতির বাধা না মেনে এক পংক্তি আরেক বা ততোধিক পঙক্তিতে এগিয়ে চলে তাকেই বলে প্রবহমান পয়ার।” তিনি এর দুটি রূপ দেখিয়েছেন, (এক) সমিল প্রবহমান পয়ার, (দুই) অমিল প্রবহমান পয়ার। প্রথমটিতে পঙক্তির অন্তে মিল থাকে, দ্বিতীয়টিতে থাকে না।এই দ্বিতীয়টিকেই যথার্থ ভাবে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বলা যেতে পারে।

অমিত্রাক্ষর ছন্দের বৈশিষ্ট্য

  • অমিত্রাক্ষরের প্রধান বৈশিষ্ট্য ভাবের প্রবহমানতা অর্থাৎ ছেদ ব্যবহারের স্বাধীনতা। পয়ারে ৮ মাত্রা ও ৬ মাত্রায় ছেদ পড়ে, কিন্তু প্রবহমান পয়ারে ভাবের পরিসমাপ্তিতেই কেবল ছেদ পড়ে, ফলে ভাব প্রয়োজন মতো চরণ থেকে চরণে প্রবাহিত হয়ে যেতে পারে।
  • অমিত্রাক্ষরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল মিলের অভাব। অন্তমিল থাকে না। এই জন্যই অমিত্রাক্ষর পয়ার-রূপবন্ধ হয়েও স্বতন্ত্র।
  • মধুসূদনের অমিত্রাক্ষরে চৌদ্দ মাত্রার চরণ দেখতে পাওয়া যায়।
  • পয়ার ও মহাপয়ারের মতো এই ছন্দেও হ্রস্ব যতি ও দীর্ঘ যতি দেখতে পাওয়া যায়।
  • অমিত্রাক্ষর তথা প্রবহমান পয়ারে ছন্দের লঘু, অর্ধ ও পূর্ণতি স্থাপিত হয় কবির ভাব প্রবাহের ক্ষীণ ও পূর্ণ বিরতি অনুসারে। পয়ারের মত আট মাত্রার পর হ্রস্ব যতি ও চৌদ্দ মাত্রার পর পূর্ণ যতি নাও বসতে পারে।
  • অমিত্রাক্ষরে চরণান্তিক মিল নেই কিন্তু চরণের স্থানে স্থানে মিত্রাক্ষর বা অনুপ্রাস থাকে। তার ফলে ছন্দ শ্রুতিমধুকর হয়।
  • স্তবকের নির্দিষ্ট নিয়ম নেই।।
  • অক্ষরবৃত্তীয় মাত্রা গনণা রীতি এই ছন্দে অনুসৃত হয়। ছান্দসিক অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় বলেছেন মধুসূদনের এই ছন্দের নাম ‘অমিত্রাক্ষর’। সাধারণ ছন্দের নাম ‘মিতাক্ষর’। আসলে এই ছন্দ শিকল ভাঙ ছন্দ।

মধুসুদন নবভাবের প্রয়োজনেই নতুন ছন্দ সৃষ্টি করেছিলেন। সেইজন্য পয়ার ছন্দের নিয়মের বন্ধন ছিন্ন করতে গিয়ে সমস্ত প্রকারের বেড়ি তুলে দিলেন।

রবীন্দ্রনাথ এই ছন্দ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন— “এর ভঙ্গী পদ্যের মতো কিন্তু ব্যবহার গদ্যের চালে”। তিনি আরও বলেছেন— “এই ছেদের বৈচিত্র্য থাকাতেই প্রয়োজন হলে সে (অমিত্রাক্ষর) পদ্য হলেও গদ্যের অবন্ধগতি অনেকটা অনুকরণ করতে পারে। সে গ্রামের মেয়ের মতো; যদিও থাকে অন্তঃপুরে, তবুও হাটে-ঘাটে তার চলাফেরায় বাধা নেই।”

অমিত্রাক্ষর ছন্দ মোটামুটি অক্ষরবৃত্ত বা তানপ্রধান ছন্দের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই এর মাত্রা গণনা পদ্ধতি অক্ষরবৃত্তের মতোই— মুক্তদল এক মাত্রা, শব্দের আদি ও মধ্যস্থিত রুদ্ধদল একমাত্রা, শব্দের অন্ত্যস্থিত একক রুদ্ধ দল দুই মাত্রার হয়।

উদাহরণ

কৌটা খুলি * রক্ষোবধু । যত্নে দিলা ফোটা* ৮+৬

সীমন্তে ** সিন্দুর বিন্দু । শোভিল ললাটে * ৮+৬

গোধূলি ললাটে আহা ।* তারারত্নযথা** ৮+৬

ফোটা দিয়া পদধূলি। *লইলা সরমা** ৮+৬

দৃষ্টান্তটির প্রতিটি চরণ চোদ্দ মাত্রার। চরণের শেষে অন্ত্যমিল নেই। তৃতীয় ও চতুর্থ চরণের শেষে দীর্ঘ ছেদ বসেছে; আবার দ্বিতীয় চরণে প্রথম তিন মাত্রার পরেও দীর্ঘ ছেদ বসেছে। সুতরাং ছেদ ব্যবহারের স্বাধীনতা তথা ভাবের প্রবহমানতা এখানে রয়েছে। হ্রস্ব যতির ও দীর্ঘ যতির স্থানও নির্দিষ্ট। সুতরাং এটি অমিত্রাক্ষর ছন্দের উদাহরণ। (*—চিহ্ন দ্বারা হ্রস্ব ছেদ এবং **—চিহ্ন দ্বারা দীর্ঘ ছেদ দেখানো হয়েছে।)

অমিত্র অক্ষরের প্রয়োগ ঘটে বলে মোহিতলাল এর নাম দিয়েছেন অমিত্র ছন্দ। রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছেন পংক্তি লঙ্ঘক ছন্দ। প্রবোধচন্দ্র সেন নাম দিয়েছেন প্রবহমান পয়ার।

 

মধুসূদনের পরবর্তীকালে হেমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ কবি অমিত্রাক্ষর নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। হেম ও নবীন মিল ও অমিল দু-প্রকারের অমিত্রাক্ষর রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের অমিত্রাক্ষরের বৈশিষ্ট্য হলো প্রধানত মিল যুক্ত প্রবহমানতা এবং চরণের মাত্রা কোথাও চোদ্দ কোথাও আঠারো।

হে আদি জননী সিন্ধু;/বসুন্ধরা সন্তান তোমার, ৮+১০

একমাত্র কন্যা তব/কোলে। তাই তন্দ্রা নাহি আর ৮+১০

চক্ষে তব…………..।

অমিত্রাক্ষরের বৈশিষ্ট্য আলোচনাকালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— “অমিত্রাক্ষরের লাইন ডিঙানো চালে এর (পয়ার) ধ্বনিশ্রেণিকে নানারকমে কুচকাওয়াজ করানো যায়।” (ছন্দ)। মধুসুদন পয়ারবন্ধকে প্রসারিত করেই অমিত্রাক্ষরের প্রচলন করেছিলেন। তার অমিত্রাক্ষরে তাই ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্তীয় চাল। পয়ারে ছন্দ যতি ও অর্থ যতি সমস্থানে পড়ে। কিন্তু অমিত্রাক্ষরে ছন্দযতির দ্বারা ছন্দঃস্পন্দন সঠিক রেখে ছেদচিহ্ন তথা অর্থ-যতিকে চরণের পর চরণ প্রবাহিত করে নিয়ে যান কবি। এক কথায় ভাবানুযায়ী পূর্ণ-যতি পড়ে, তাই চরণ বা পদের নিয়ন্ত্রণ কিছু মাত্র থাকে না। আট-ছয় দ্বিপর্বিক মাত্রা বিভাগ এর ভাবপ্রবাহকে বাধার পরিবর্তে দ্রুততা দেয়। মধুসূদন অপূর্ব বস্তু নির্মাণক্ষম প্রজ্ঞায় তৎসম শব্দের সুমিত প্রয়োগে ধ্রুপদী গাম্ভীর্য ও স্পন্দন সৃষ্টি করে এই ছন্দকে উনিশ শতকের বাংলাদেশের ভাব-দ্বন্দ্বের প্রকৃত বাহন করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!