বাংলা নাট্যশালার ইতিহাসে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির অবদান লেখ।
অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি ও বাংলা থিয়েটার
বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে অর্ধেন্দুশেখর (জানুয়ারি, ১৮৫০-১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০৮) একটি স্মরণীয় নাম। পিতা শ্যামাচরণ মুস্তাফির অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। বাগবাজারের কালীপ্রসন্ন চক্রবর্তী স্ট্রিটের ১৯ নম্বর বাড়ির পৈতৃক ভদ্রাসনে জন্মগ্রহণ করেন। মাতা মুক্তকেশী দেবী। লেখাপড়াও খুব বেশি করেননি। কিন্তু ব্যক্তিগত চেষ্টায় তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অধিকার অর্জন করেন। আঞ্চলিক ভাষাসমূহও আয়ত্ত করেন। সহজাত প্রতিভা, অনুমান ক্ষমতা এবং কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে বাংলা থিয়েটারে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
অর্ধেন্দুশেখর নাট্যকার ছিলেন না। তিনি ছিলেন সংগঠক, মঞ্চাধ্যক্ষ, অভিনেতা ও নাট্যশিক্ষক। এবং অল্পাংশে থিয়েটারের মালিক। জীবনে প্রথম অভিনয় ভোলানাথ মুখখাপাধ্যায়ের লেখা ‘কিছু কিছু বুঝি’ প্রহসনে; দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা হেমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের জোড়াসাঁকো কয়লাহাটার বাড়িতে, দক্র, মুরাদ আলি ও চন্দনবিলাসের ভূমিকায়। ২ নভেম্বর, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে। ধনী বাড়ির সখের নাট্যশালার অভিনয়ে।
তারপরে বাগবাজারের এমেচার থিয়েটারের সধবার একাদশী অভিনয়ে (১৮৬৮-৭০) সাতবার কেনারামের চরিত্রে অভিনয় করেন। ক্রমেই ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’তে রাজীব মুখুজ্জে’র ভূমিকায় (১৮৭০) এবং শ্যামবাজার নাট্যসমাজের হয়ে ‘লীলাবতী’ নাটকে হরবিলাস ও ঝির চরিত্রাভিনয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন।
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে যে কয়জন যুবক উদ্যোগী হয়ে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামে সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অর্ধেন্দুশেখর ছিলেন তাদের প্রধানতম। সেখানে ‘নীলদর্পণ’ নাটক বাছাই, নাট্য শিক্ষাদান এবং একই সঙ্গে পাঁচটি চরিত্রের অভিনয়ে অংশগ্রহণ তাঁর ক্ষমতার প্রমাণ রাখে। ন্যাশনাল থিয়েটার ভেঙে গেলে হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটারের দল নিয়েও তিনি নানা স্থানে অভিনয় করেন। তারপর বাংলা থিয়েটার পুরোপুরি ব্যবসায়িক ও পেশাদারি থিয়েটার হয়ে গেলে, তিনিও থিয়েটারকে তাঁর জীবন ও জীবিকা হিসেবেই গ্রহণ করেন। কোনোদিন চাকুরি করেননি, থিয়েটারই তাঁর চাকুরি-স্থল। থিয়েটারের জন্য অর্ধেন্দুশেখর প্রভাবশালী আত্মীয়ের বিদ্বেষ উপেক্ষা করেছেন; বাড়িঘর, পরিবার, সন্তান কিছুরই তোয়াক্কা করেননি। গিরিশ লিখছেন—‘‘আহার চলিলেই হইল, তাহার পর যাহা হউক না কেন থিয়েটার লইয়াই আছেন।’’ (বঙ্গীয় নাট্যশালায় নটচূড়ামণি স্বর্গীয় অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি।) থিয়েটার করা ভিন্ন তাঁর জীবনে যে অন্য কোন কাজ আছে, পুত্র-পরিবার আত্মীয়স্বজনের কাছে যে কোনো দায়িত্ব থাকতে পারে, সেকথা তিনি মাথাতেই রাখতেন না।
থিয়েটার-পাগল এই মানুষটির নিজ চরিত্রের মধ্যে কোনো স্থিতধী ভাব ছিল না বলে কোনো থিয়েটারেই তিনি নিজেকে বেশিদিন যুক্ত রাখতে পারেননি। ন্যাশনাল থিয়েটার ভাগ হলে, ভাঙা দল নিয়ে তিনি কিছুদিন চেষ্টা চালান। ক্রমে তিনি মূল ন্যাশনাল থিয়েটারের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। মুল ন্যাশনালের দল গিরিশচন্দ্রের নেতৃত্বে প্রথমে ন্যাশনাল থিয়েটার, তারপরে বিডন স্ট্রিটে স্টার, তারপরে হাতিবাগানের স্টারে স্থিত হয়। অর্ধেন্দুশেখর এই মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে তাঁর অভিনয় জীবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল।
প্রতাপাচাঁদ জহুরির ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার (১৮৮১) পর থেকেই অর্ধেন্দুশেখর প্রায়শই দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তেন। মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতেন, অভিনয় করতেন, অভিনয় শিক্ষা দিতেন, আবার কলকাতা ত্যাগ করে যেতেন। প্রায় একযুগ এই সময়ে তিনি রঙ্গমঞ্চ থেকে প্রায়শই সরে থাকতেন। দর্শকও তাঁর কথা ক্রমশই বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ে তিনি যোগাভ্যাসে মন দিয়েছিলেন। আবার সব ছেড়ে-ছুড়ে মিনার্ভায় এসে গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে যোগ দিলেন ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে। এইখানে পরপর বেশ কিছু অভিনয় করলেন, নাট্যশিক্ষা দিলেন। হঠাৎ মনস্থির করলেন, নিজেই থিয়েটার চালাবেন। তাই এমারেল্ড থিয়েটার ভাড়া নিয়ে ১৮৯৪-এর ২২ সেপ্টেম্বর অতুলকৃষ্ণ মিত্রের ‘মা’ নাটক দিয়ে উদ্বোধন করলেন। তারপরে ‘মান’, ‘রাজা বসন্ত রায়’, ‘আবুহোসেন’ পরপর প্রাযযাজনা করলেন।
থিয়েটার ভালবাসলেও, থিয়েটারের অন্য সব গুণ থাকলেও, কী করে থিয়েটার ব্যবসা চালাতে হয়, সে বুদ্ধি বা ধারণা অর্ধেন্দুশেখরের ছিল না। তিনি মোহের বশে থিয়েটার ব্যবসায় নেমে পড়েন। তাই যখন এমারেল্ড থিয়েটার পতনোন্মুখ তখন এমারেল্ডের দায়িত্ব নেন। দেনায় ডুবে যান। ভরাডুবি অবস্থায় ব্যবসা ছাড়েন—ততদিনে বিষয়সম্পত্তি, বসতবাড়ি সবই বেচে দিতে হয়েছে। গিরিশ লিখছেন—“তিনি অভিনেতা ছিলেন, বিষয়ী ছিলেন না। তিনি শিক্ষা দিতে জানিতেন, কিন্তু কিরূপে সকল দিক সামঞ্জস্য রাখিয়া থিয়েটার চালাইতে হয়, তাহা জানিতেন না।’’
অর্ধেন্দুশেখরের অভিনয় জীবন বহু বিস্তৃত। নানা থিয়েটারে নানাভাবে যুক্ত থেকে তিনি বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
শৌখিন পর্বের কথা আগেই বলেছি। এবারে সাধারণ রঙ্গালয় পর্বে তাঁর কিছু অভিনয়ের পরিচয় নেওয়া যেতে পারে। থিয়েটারগুলিতে তাঁর অবস্থান-কাল, অভিনীত নাটক ও চরিত্রের নির্বাচিত তালিকা—
১. ন্যাশনাল থিয়েটার (১৮৭২-৭৩)
নীলদর্পণ (উড, সাবিত্রী, গোলোক বসু, একজন রায়), সধবার একাদশী (জীবনচন্দ্র), নবীন তপস্বিনী (জলধর), কৃষ্ণকুমারী (ধনদাস)।
২. হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার (১৮৭৩)
শর্মিষ্ঠা (মাধব্য), বিধবাবিবাহ নাটক (কর্তা)।
৩. গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার (১৮৭৪)
প্রণয়পরীক্ষা (নটবর), মৃণালিনী (হৃষিকেশ), কমলেকামিনী (বকেশ্বর)।
৪. প্রতাপচাদ জহুরির ন্যাশনাল থিয়েটার (১৮৮৩)
আনন্দমঠ (মহাপুরুষ), রাজা বসন্ত রায় (রমাই ভাঁড়)।
৫. এমারেল্ড থিয়েটার (১৮৮৭)
পাণ্ডবনির্বাসন (ধৃতরাষ্ট্র)।
৬. আর্যনাট্যসমাজ বীণা থিয়েটার মঞ্চে (১৮৮৮)
নীলদর্পণ (পূর্ববৎ)।
৭. এমারেল্ড থিয়েটার (১৮৮৯)
বকেশ্বর (বকেশ্বর)।
৮, মিনার্ভা থিয়েটার (১৮৯৩-৯৪)
ম্যাকবেথ (দ্বারপাল, বৃদ্ধ, ডাক্তার, ১ম ডাকিনী, ১ম হত্যাকারী), মুকুলমুঞ্জরা (বরুণাদ), আবুহোসেন (আবুহোসেন), জনা (বিদূষক)।
৯. এমারেল্ড থিয়েটার (নিজের মালিকানায়—১৮৯৪-৯৫)
রাজা বসন্ত রায় (প্রতাপাদিত্য)।
১০. মিনার্ভা থিয়েটার (১৯০০)
পলাশীর যুদ্ধ (ক্লাইব), বঙ্গবিজেতা (সুমি কাবুলি)।
১১. অরোরা থিয়েটার, বেঙ্গল থিয়েটার মঞ্চে, (১৯০২)
সধবার একাদশী (নিমচাঁদ), রিজিয়া (ঘাতক), প্রফুল্ল (যোগেশ)।
১২. স্টার থিয়েটার, হাতিবাগান (১৯০৩)
প্রতাপাদিত্য (বিক্রমাদিত্য ও রডা)।
১৩. মিনার্ভা থিয়েটার (১৯০৪-০৮)
নীলদর্পণ (উড ও তোরাপ), বলিদান (রূপাদ ও করুণাময়), রানা প্রতাপ (পৃথ্বিরাজ), সিরাজদৌল্লা (দানশা ও শওকতজঙ্গ), মীরকাশিম (মিঃ ড্রেক, মিঃ শেরাফটন, মুশালা), সংসার (নবখুড়ো), দুর্গেশনন্দিনী (গজপতি), সিরাজদৌল্লা (মীরজাফর), দুর্গেশনন্দিনী (বিদ্যাদিগগজ), প্রফুল্ল (রমেশ), চৈতন্যলীলা (জগাই), মীরকাশিম (হলওয়েল হে, মেজর এডামস), দুর্গাদাস (রাজসিংহ)।
১৪. কোহিনুর থিয়েটার (এমারেল্ড থিয়েটার মঞ্চে, ১৯০৮) জেনানা যুদ্ধ (পদ্মলোচন), সংসার (নবখুড়ো), নীলদর্পণ (তোরাপ), নবীন তপস্বিনী (জলধর)।
শেষ অভিনয়: কোহিনুর থিয়েটারে ৯ আগস্ট, ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে, প্রফুল্ল ও নবীন তপস্বিনী নাটকে যথাক্রমে যোগেশ ও জলধরের ভূমিকায়।
অসামান্য অভিনেতা ছিলেন। একেবারে যাকে বলে ‘বিধাতার হাতে গড়া এ্যাক্টর’। (অমৃতলাল বসু)। নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন। হাস্যরসাত্মক ভূমিকায় তার জুড়ি ছিল না। আবার করুণ রসাত্মক অভিনয়েও নতুন মাত্রা জুড়ে দিতে পারতেন। অভিনয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন, একই ভূমিকা নানাভাবে অভিনয়ের চেষ্টা, একেক রাত্রে করতেন। আবার একই নাটকে একই রাত্রে একই সঙ্গে একাধিক বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতেন, কখনো কখনো নারী চরিত্রেও নেমে পড়তেন। তাঁর অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি তাঁর উপস্থিতি দিয়েই দর্শকদের মাত করে দিতে পারতেন। গিরিশচন্দ্র বলছেন—‘‘দর্শক দেখিতেন অর্ধেন্দু, কি ভূমিকা, তাহা নয়। এইরূপ শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি একক, দর্শকের সম্পূর্ণ প্রীতি জন্মাইতে পারে, দৃশ্যপট, অভিনেতা প্রভৃতির বিশেষ সাহায্য প্রয়োজন হয় না।’’
শিশিরকুমার ভাদুড়ি স্বীকার করেছেন যে, ক্যারেক্টার এ্যাকটিং-য়ে অর্ধেন্দুশেখরের জুড়ি ছিল না। সেদিক থেকে তিনি গিরিশচন্দ্রের থেকেও বড় ছিলেন। একসঙ্গে একাধিক ভূমিকার রূপ, কণ্ঠ, ম্যানারিজম বদলিয়ে যখন অভিনয় করে যেতেন, তখন ধরার উপায় থাকতো না যে একই লোক—সেই অর্ধেন্দুশেখর।
তিনি মঞ্চে ছোট ছোট ভূমিকা (Part) বেছে নিতেন। অন্যেরা যখন বড় এবং পছন্দসই ভূমিকা নিতেন, অর্ধেন্দুশেখর তখন সাধারণ ছোট ভূমিকা নিতেন। এবং নিজের অসামান্য দক্ষতায় সেগুলিকে এমন মূর্ত করে তুলতেন যে, সারা অভিনয়ে লোকে ওই ভূমিকাগুলিরই আলোচনা করতো। সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে শিক্ষিত রুচিশীল দর্শক উভয়েরই প্রশংসা লাভ করতেন। এইভাবে রিজিয়ার ঘাতক, চৈতন্যলীলার জগাই, ম্যাকবেথের ১ম হত্যাকারী ও পোর্টার, নীলদর্পণের রায়ত চাষী, দুর্গেশনন্দিনীর বিদ্যাদিগগজ গজপতি তাঁর অসামান্য চরিত্রাভিনয় কীর্তির স্বাক্ষর হয়ে আছে।
অর্ধেন্দুশেখর নানা ভাষা ও উপভাষায় কথা বলতে পারতেন অনর্গল। ফলে বাংলা হিন্দি ইংরাজি যেমন তাঁর মুখে খইয়ের মত ফুটতো, তেমনি মেদিনীপুর, খুলনা, চট্টগ্রাম, কি ঢাকার উপভাষাও অনর্গল বলতে পারতেন। উড়িয়া, ভোজপুরিতেও তিনি নিপুণ ছিলেন। ফলে একেকদিন বা জায়গা বিশেষে তিনি তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির ভাষা পালটে নিতেন। এইভাবে ছোট ছোট ভূমিকাগুলিকে তিনি ক্রমেই আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য করে তুলতেন।
অভিনয়ে চরিত্র নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে, মানুষের জীবন থেকে উদাহরণ সংগ্রহ করে সেগুলিকে কিভাবে প্রাণবন্ত করা যায়—অর্ধেন্দুশেখর সব সময়েই সে চেষ্টা করতেন। নিজের অভিনয়ে সেই ভাব নিয়ে আসতেন। শিশির ভাদুড়িকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে, অর্ধেন্দুশেখরের এই চরিত্র বিশ্লেষণ ও তার প্রকাশের ক্ষমতা অসাধারণ ছিল।
কৌতুক অভিনয়ের নির্বিশেষ গুণ তাঁর ছিল। অঙ্গভঙ্গি, কণ্ঠস্বর এবং সাজসজ্জার কৌশলে তিনি স্বভাবতই কৌতুকরস পরিবেষণ করতেন। তবে তা কখনোই ভাঁড়ামোর পর্যায়ে চলে যেত না। থিয়েটারের অভিনয়ে তীব্র ব্যঙ্গ, তীক্ষ্ণ শ্লেষ এবং নির্মল রসিকতা অর্ধেন্দুশেখরই প্রথম বাংলা রঙ্গমঞ্চে নিয়ে আসেন। গিরিশচন্দ্র থেকে শুরু করে সেযুগের অন্যান্য বিদগ্ধ সকলেই স্বীকার করেছেন যে, কৌতুকাভিনয়ে অর্ধেন্দুই সেরা এবং অদ্বিতীয়। তার কোনো বিকল্প হওয়া সম্ভব ছিল না।
একই নাটকে একই রাত্রের অভিনয়ে একই মঞ্চে বিভিন্ন ভূমিকায় তিনি অভিনয় করতেন। চার-পাঁচটি ভূমিকাতেও তিনি এইভাবে প্রায়শই নেমেছেন। নীলদর্পণ, ম্যাকবেথ, প্রতাপাদিত্য—প্রভৃতি নাটকে তিনি এইভাবে অভিনয় করেছেন। নারী ভূমিকা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, যুবক নানা ভূমিকায় তিনি অবলীলাক্রমে একই রাতে অভিনয় করে গেছেন। অঙ্গভঙ্গির পরিবর্তন, কণ্ঠস্বরের সামঞ্জস্য এবং সাজসজ্জা দিয়ে তিনি এমনভাবে চরিত্রগুলিকে উপস্থাপন করতেন যে, কোনো দর্শকের পক্ষেই বোঝা সম্ভব ছিল না যে, একই অর্ধেন্দুশেখর বহুরূপে সম্মুখে উপস্থিত। অভিনয়ের এ-এক অলৌকিক ক্ষমতা।
আবার, একই চরিত্রকে বিভিন্ন রাতের অভিনয়ে একেকভাবে উপস্থাপনা করার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। প্রফুল্লর যোগেশকে নিয়ে তিনি পরীক্ষা করেছেন, ‘সংসারে’র নবখুড়ো, ‘নবীন তপস্বিনী’র জলধর, ‘বলিদানে’র করুণাময়, ‘কৃষ্ণকুমারী’র ধনদাস, ‘আবুহোসেনে’র আবুহোসেন—তার উদাহরণ।
মিনার্ভা থিয়েটারে ‘চৈতন্যলীলা’ অভিনয়ে ভগাই চরিত্রে অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। চৈতন্যের ভাববিরোধী জগাই সঙ্কীর্তনের দলকে আক্রমণ করেছেন। অথচ ক্রমে তাঁর মনের পরিবর্তন ঘটছে চৈতন্যের সাক্ষাতে। মনের এই দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব তিনি শরীরের অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলতেন। মুখে মাতালের সংলাপ এবং শরীরের উপরের অঙ্গে মাতলামি, সঙ্গে সঙ্গে শরীরের নীচের অংশে দু’পায়ে চলেছে সঙ্কীর্তনের তালে তালে পা মেলান। ক্রমে নিম্ন থেকে সঙ্কীর্তনের তাল ক্রমে ঊর্ধ্বাঙ্গে উঠে আসছে ক্রমশ সারা শরীরকে মাতিয়ে দিচ্ছে—মাতাল জগাই দু’হাত তুলে সঙ্কীর্তনে গলা মিলিয়ে দিয়েছে—গুণ্ডা, মাতাল ও চৈতন্য ভাব-বিরোধী জগাই ধীরে ধীরে ভক্তপ্রবর জগাইতে রূপান্তরিত হয়ে গেল—সে-যুগে অর্ধেন্দুর অভিনয়ের এই ক্ষমতা যারা দেখেছেন অনেকেই মুক্তকণ্ঠে লিখে রেখে গেছেন সাক্ষ্য হিসেবে। মনে রাখতে হবে মিনার্ভাতে চৈতন্যলীলার অভিনয়ে অর্ধেন্দুর পাশে থাকত মাধাইরূপে গিরিশচন্দ্র-অভিনয়ের ক্ষেত্রে মহাসম্মিলন। সে এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা।
এখানে সে-যুগের আরেক শ্রেষ্ঠ অভিনেতা গিরিশের সঙ্গে অর্ধেন্দুর অভিনয়ের তুলনা করা যেতে পারে। গিরিশচন্দ্র ট্রাজিক চরিত্র অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন। অর্ধেন্দু কমিক এবং সিরিও কমিক চরিত্রাভিনয়ে কুশলতা দেখিয়েছেন। অর্ধেন্দুর স্পষ্ট ও নির্দোষ উচ্চারণ, হ্রস্ব-দীর্ঘ মাত্রা অনুযায়ী উচ্চারণ এবং সুরবর্জিত স্বাভাবিক অভিনয় নিঃসন্দেহে আধুনিক কালের অভিনয়ধারা ও পরিণত রুচির অভিনয়ের পূর্বসূরী বলেই মনে হয়। অন্যদিকে গিরিশ ভাবগম্ভীর সুরেলা, ছন্দোময় অভিনয় করতেন। ছন্দ ও সুর তাঁর সংলাপ উচ্চারণের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এতে ভাব গভীরতা আসে। আবেগ সৃষ্টি হয়। গিরিশ ভাবাবেগ ছড়িয়ে দিতেন। অর্ধেন্দু চরিত্র বিশ্লেষণ করতেন।
শিশির ভাদুড়ির মতে অভিনেতা হিসেবে অর্ধেন্দুশেখর গিরিশের চেয়ে অনেক বড় ছিলেন। কিন্তু গিরিশের ছিল ‘থিওরি’ ও ‘প্র্যাকটিশ’—এই উভয় বিভাগেই জ্ঞান এবং রিয়ালিজম। ছিল দর্শক বিচারের ক্ষমতা। মঞ্চকে বাঁচাবার জন্য গিরিশ তাই কমপ্রোমাইজ-ও করেছেন। অন্যদিকে অর্ধেন্দুর স্পষ্ট ও নির্দোষ উচ্চারণ এবং সুরবর্জিত অভিনয় রীতি ও গদ্য উচ্চারণভঙ্গি ও স্বাভাবিক অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন শিশিরকুমার। তাছাড়া পরিশীলিত অভিনয়ের ধারক রবীন্দ্রনাথসহ ঠাকুর বাড়ির অন্যেরাও অর্ধেন্দুশেখরকে সে-যুগের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বলেছেন। তাঁর স্টেজ-ফ্রি এ্যাকটিংয়ের সবিশেষ গুণের কথাও স্বীকার করেছেন।
অভিনয় যে যুগে নিন্দিত, থিয়েটার ঘৃণার বস্তু সে যুগেও সামাজিক অর্ধেন্দুশেখর দম্ভভরে নিজের পরিচয় দিতেন, আমি অভিনেতা।
অর্ধেন্দুশেখর উচ্চশ্রেণীর অভিনেতা ছিলেন। তেমনি উচ্চশ্রেণীর অভিনয় শিক্ষকও ছিলেন। ন্যাশনাল থিয়েটারের গোড়ার দিকে সব অভিনেতাদের তিনিই হাতে ধরে তৈরি করেছিলেন। তাঁর সমান নাট্যশিক্ষক তাঁর যুগে আর কেউ ছিল না। পরবর্তী অভিনেতা ও পরিচালক অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেছেন যে, অর্ধেন্দুশেখর বঙ্গীয় নাট্যশালার প্রতিদ্বন্দ্বীহীন সুশিক্ষক ছিলেন। ‘অতুলনীয় নাট্যশিক্ষক’—একথা অমৃতলাল বসুও স্বীকার করেছেন। শিশির ভাদুড়িও বলেছেন যে, অর্ধেন্দুশেখর অন্য অভিনেতাদের অভিনয় শেখাবার সময়ে মানুষের জীবন অভিজ্ঞতা থেকে চরিত্র বিশ্লেষণ ও ভাবপ্রকাশ শিক্ষা দিতেন অনবদ্যভাবে। তাঁর মতে, শিক্ষক হিসেবেও অর্ধেন্দুশেখর গিরিশের চেয়ে অধিকতর কৃতকার্য ছিলেন।
একই মঞ্চে গিরিশ ও অর্ধেন্দু যুক্ত থাকলে অভিনয় শিক্ষার দায়িত্ব অর্ধেন্দুই নিতেন। সেকালের সব অভিনেতা-অভিনেত্রীই কোনো-না-কোনো সময়ে অর্ধেন্দুর কাছে অভিনয় শিক্ষা নিয়েছেন। প্রতিটি ছোট ও তুচ্ছ ভূমিকার দিকেও অর্ধেন্দু গভীর মনোযোগ দিতেন এবং নিজের মনোমত না হওয়া পর্যন্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীকে রিহার্সাল দেওয়াতেন। সংলাপ উচ্চারণ শেখান না, অভিনয় সুস্পষ্ট ও সুশ্রাব্য করে তোলা, ছোটখাটো ক্রিয়া ও চরিত্রের প্রকৃতি, ভাব, মেজাজ নিখুঁত করে তোলার জন্য তিনি ধৈর্যসহকারে পরিশ্রম করে যেতেন। অন্য অভিনেতার সঙ্গে সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য রক্ষা করে মঞ্চে অভিনয় কীভাবে করতে হয়, তারও শিক্ষা তিনি হাতে ধরে শেখাতেন।
অর্ধেন্দুশেখর থিয়েটারের মিশনারীরূপে সে যুগে খ্যাতিলাভ করেন। অমৃতলাল বসু লিখেছেন যে—‘‘থিয়েটারের যদি কেহ কখনও মিশনারী হইয়া থাকেন তাহা হইলে একমাত্র অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী ভিন্ন আর কাহারও নাম করা যায় না।’’ তিনি সারাজীবন শুধুমাত্র থিয়েটার ও অভিনয়ের কল্যাণেই ব্যয় করেছেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন নাট্যদল নিয়ে কলকাতার বাইরে নানাস্থানে, এমনকি বাংলার বাইরেও ভারতের নানাস্থানে অভিনয় করে বেড়িয়েছেন। যখন নাট্যদল পাননি, তখন একাই নানা প্রান্তে গিয়ে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে মিশেছেন, নাট্যদল তৈরি করে দিয়ে এসেছেন, নতুবা নাট্যদল থাকলে তাদের উৎসাহ অনুপ্রেরণা এবং অভিনয় শিক্ষা দিয়ে এসেছেন। এতে তার ক্লান্তি বা অবসাদ ছিল না, বরং উৎসাহ ও আগ্রহ ছিল বেশি। হিন্দু ন্যাশনালের দল নিয়ে তখনকার পূর্ববঙ্গে অভিনয় করেছেন। এই ন্যাশনালের দল নিয়ে বাংলার বাইরে অভিনয় করতে গেছেন, মিনার্ভার নাট্যদল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন অভিনয়ে। কলকাতার আশেপাশে মফস্বলে তো কথাই নেই। থিয়েটারের প্রসারে বাংলার (তখন অবিভক্ত বাংলা) এবং ভারতের বাঙালি অধ্যুষিত নানা অঞ্চলে তার এই চেষ্টা সম্মানের সঙ্গেই স্মরণ করা উচিত।
অর্ধেন্দুশেখরের আর একটি গুণ ছিল, তাঁর স্বদেশপ্রেম। নাটকের মাধ্যমে জাতীয়তাবোধ ও স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করার একটা দায়বদ্ধতা তাঁর মধ্যে সবসময়ে কাজ করেছে। সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে সেই নাট্যশালার নাম ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ দেওয়া, সেখানে প্রথমেই দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ নাটক অভিনয়ের ব্যবস্থা করা—প্রভৃতির মধ্যে তাঁর এই জাতীয় ভাবাবেগের প্রকাশ দেখা যায়। অর্ধেন্দুর চেষ্টাতেই ন্যাশনাল থিয়েটারে ‘ভারতমাতা’ অভিনীত হয়েছিল। গিরিশ লিখছেন—‘‘যে সকল পঞ্চরং অভিনীত হইত, তাহাতে বিশেষ রাজনৈতিক কটাক্ষ ছিল এবং তীব্র ব্যঙ্গশক্তিতে ঐ সকল পঞ্চরং রচিত না হইলেও অর্ধেন্দুর অভিনয়ে সেই শ্লেষের পূর্ণ বিকাশ হইত। অর্ধেন্দুর ধারণা ছিল যে, রঙ্গমঞ্চ হইতে অনেক কুরীতির প্রতি দর্শকের ঘৃণার উদ্রেক করা যায়, অনেক কদাচারী দমিত হয়, নীতি শিক্ষা, রাজনৈতিক শিক্ষা রঙ্গমঞ্চ হইতে দেওয়া যায়, রঙ্গমঞ্চের কার্য দেশের কার্য—তাহার জ্ঞান ছিল।’’
অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৮৭৬) পরবর্তীকালেও দেখি, অর্ধেন্দু যখন যে থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন, সেখানেই নীলদর্পণ এবং অন্যান্য জাতীয় ভাবোদ্দীপক নাটকের অভিনয় করেছেন। বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কাল থেকেই তিনি যখনই যে মঞ্চে ছিলেন সেখানেই দেশপ্রেমোন্মাদনার নাটকগুলি অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছেন। এইভাবে স্টার, মিনার্ভা তার আগ্রহে ও উদ্যমেই দেশপ্রেমের নাটকগুলি বাছাই করে অভিনয় করেছে।
স্বদেশ-অনুরাগের প্রসঙ্গেই অর্ধেন্দুশেখরের ‘মুস্তাফি সাহেবকা পাক্কা তামাশা’ প্রসঙ্গটি আলোচনা করা যেতে পারে।
ন্যাশনাল থিয়েটার এবং তার পরবর্তীকালে অর্ধেন্দুশেখর ‘মুস্তাফি সাহেবকা পাক্কা তামাশা’’ নামে এক ধরনের প্যান্টোমাইম অভিনয় করতে থাকেন। তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, এই ধরনের মজাদার ছোট অভিনয়গুলির মধ্যে দিয়ে নাটক অভিনয়ের ফাকে দর্শকদের মাতিয়ে রাখা। এর উৎপত্তিও সেইভাবে হয়েছিল। এক রাতে অভিনয়ের শেষে প্রচণ্ড বৃষ্টির জন্য দর্শকেরা বাইরে বেরুতে পারছিল না। বসে থাকা এই দর্শকদের আনন্দ দেবার জন্য অর্ধেন্দু তাড়াতাড়ি ছেড়া কোট প্যান্ট পরে, মাথায় টুপি হাতে ছাতা নিয়ে ভবঘুরে সাহেবের সাজে মঞ্চে নেমে গেয়ে, নেচে এবং প্যান্টোমাইম করে দর্শকদের প্রভূত আনন্দ দিয়েছিলেন। মুখে মুখে সংলাপ ও সিচুয়েশান তৈরি করে অন্য দু-একজন পাকা অভিনেতা-অভিনেত্রীর সহযোগে অর্ধেন্দু এইভাবে দুই নাটকের ফাঁকে প্রায়শই দর্শকদের আনন্দ দিতে থাকেন। গোড়া থেকেই সাহেবের অভিনয়ে অর্ধেন্দু খুবই পারদর্শিতা ও খ্যাতিলাভ করেন। নীলদর্পণে মিঃ উড, প্রতাপাদিত্যে রড, সিরাজদৌল্লায় মিঃ ড্রেক, পলাশীর যুদ্ধে ক্লাইভ—
এই ধরনের অভিনয় তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং থিয়েটার মহলে তিনি ‘সাহেব’ নামেই পরিচিত হন। ইংরাজি উচ্চারণ ও আদবকায়দায় তিনি পাকা সাহেবের মতো আচরণ করতেন। গিরিশচন্দ্রও স্বীকার করেছেন—“দেখ, ওর মতো সাহেব সাজতে বাঙালী কেউই পারবে না।’’ (ললিতচন্দ্র মিত্র—অর্ধেন্দু কথা)।
‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে রডার ভূমিকা অনেক ছোট ছিল। অর্ধেন্দুশেখর রডা সেজে এমন মাতিয়ে দিলেন যে, নাট্যকার রডার ভূমিকা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রতাপাদিত্যের পর রডা যখন বলে ওঠে—“কি করবে রাজা, তোমার লোক চাকসিরি দিয়ে দুশমনকে এনেছে।’’ তারপরে দুচোখে জল নিয়ে এসে রডার উক্তি—‘‘কুছ করতে পারলে না রাজা, ভেরি সরি।’’
রডার ভূমিকায় সে অভিনয় ভুলতে পারেননি সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (অর্ধেন্দুশেখর, সচিত্র শিশির, চৈত্র, ১৩৬৩); অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (অর্ধেন্দুশেখর, সঙ্কল্প, অগ্রহায়ণ, ১৩২১); হেমেন্দ্রকুমার রায় (যাদের দেখেছি, পৃ. ৮০-৮৫)। তাই সাহেবের পোষাকে সাহেব অর্ধেন্দু মুস্তাফির প্যান্টোমাইম দর্শকের কাছে ‘মুস্তাফি সাহেবকা পাক্কা তামাশা’ নামে পরিচিত হতে দেরি হয়নি। সংবাদপত্রে এই জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে ওই একই নাম ব্যবহার করা হতে থাকে।
এই ‘তামাশা’ সর্বপ্রথম চালু হয় ন্যাশনাল থিয়েটারে, ১৮৭৩-এর ১৫ জানুয়ারি, বুধবারে। সেদিন বিয়ে পাগলা বুড়োর সঙ্গে এই তামাশা অভিনীত হয়েছিল। পরে পরে বিলাতিবাবু, সাবস্ক্রিপসান বুক, প্রাইভেট থিয়েটারের গ্রীণরুম, কুজার অঘটন, মডেল স্কুল (রচয়িতা অমৃতলাল বসু), মুস্তাফি সাহেবকা পাক্কা তামাশা, পরীস্থান, মুস্তাফি সাহেবের বক্তৃতা ইত্যাদি অভিনীত হয়েছে। সবগুলিই অর্ধেন্দুশেখরের উদ্যমেই অভিনীত হয় এবং প্রত্যেকটির প্রধান ভূমিকায় অর্ধেন্দুশেখর।
প্রাথমিক উদ্দেশ্যের অঙ্গে একটি গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল। সেই সময়ে সাহেবদের অপেরা হাউসে (রয়্যাল থিয়েটার) দেবকার্সন নামে একজন ইংরেজ অভিনেতা ভড়দের মতো অভিনয় করে, ‘Variety Theatre’-এর আয়োজন করে পয়সা উপার্জন করতো। দেবকার্সন প্রায়ই নেটিভ বাঙালিদের আচার ও জীবনধারা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতেন। তারই প্রতিক্রিয়ায় অর্ধেন্দুশেখর তাঁর প্যান্টোমাইমগুলিতে তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গের দ্বারা সাহেবিয়ানা, ফিরিঙ্গিদের জীবনযাপন ও তাদের তথাকথিত সভ্যতা—ইত্যাদিকে তীব্র আক্রমণে জর্জরিত করতেন। পরাধীনতার অপমান এবং ইংরেজের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ-এর জবাব অর্ধেন্দুশেখর সেদিন বাঙালির থিয়েটারের মাধ্যমেই দিয়েছিলেন। থিয়েটার করা তাঁর কাছে দেশের কার্য বলেই মনে হয়েছিল। অমৃতলাল বসু তাই অর্ধেন্দুকে ন্যাশনাল প্রপার্টি (নাচঘর, ৫ আশ্বিন, ১৩৩৫) বলেছেন।
দেবকার্সন কাগজে বিজ্ঞাপন দিতেন—‘‘দেবকার্সন সাহেবকা পাক্কা তামাশা।’’ তার মধ্যে দি বেঙ্গলীবাবু, প্রফেসার, দি স্কুল মাস্টার, দেবকার্সন ইন দি পলিশ কোর্ট প্রভৃতি পঞ্চরং সাহেব-ফিরিঙ্গি মহলে খুবই উপভোগ্য ছিল। তার বিদ্রুপের একটি নমুনা—‘‘I am a very Bengalee Baboo / I keep my Shop at Radha Bazar /I live in Calcutta, cat my Dal Vat / And Smoke my Hooka / etc.
উত্তরে অর্ধেন্দুশেখর হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে একটি গান গেয়ে দেবকার্সনকে পাল্টা জবাব দিলেন। সেই ফিরতি জবাবেরই নাম দেওয়া হলো ‘মুস্তাফি সাহেবকা পাক্কা তামাশা’, এই তামাশায় তিনি তিনজন সহ-অভিনেতা নিয়ে কাফ্রীসাহেব সেজে বেহালা বাজাতে বাজাতে গান গেয়ে সাহেবদের বিদ্রুপ করতেন—‘‘হাম বড়া সাহেব হ্যায় ডুনিয়ামে / None can be compared হামারা সাট / Mr. Mustafee name হামারা / চাটগাঁও মেরা আছে বিলাট।…coat forfa Pantaloon forfa, forfa calls trousers / Every two years new suits forfa / Direct from Chandny Bazar / …’’
সাধারণ রঙ্গালয়ে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর নাটক এবং উপন্যাসের নাট্যরূপ অভিনয় করার ক্ষেত্রে প্রধান উদ্যোগী ছিলেন অর্ধেন্দুশেখর। গিরিশ প্রমুখের চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ যখন বারেবারে সাধারণ রঙ্গালয়ে গৃহীত হচ্ছেন না, তখন অর্ধেন্দুশেখর যখন যে রঙ্গালয়ে ছিলেন, সেখানেই বারেবারে রবীন্দ্রনাথের নাটক অভিনয় করেছেন। এইভাবে রাজা বসন্ত রায় (বউ ঠাকুরানীর হাট উপন্যাসের নাট্যরূপ), রাজা ও রানী তিনি বারবার অভিনয় করেছেন। বাংলা থিয়েটারে তিনিই প্রথম সম্যকভাবে বুঝেছিলেন রবীন্দ্র প্রতিভাকে। রবীন্দ্রনাথকে তিনি সম্মান করতেন। রবীন্দ্রনাথও অর্ধেন্দুশেখরের অভিনয়ের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। এক্ষত্রে তাঁর রমাই ভাঁড় ও প্রতাপাদিত্য চরিত্রাভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে।
এইসব মিলিয়েই অর্ধেন্দুশেখর। অর্ধেন্দুশেখরের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে পরের দিন (১৮-৯-১৯০৮) বেঙ্গলী পত্রিকা লিখেছিল—‘‘…Babu Adhendu Sekhar Mustafi, the father and founder of native stage in Bengal as well as the first, foremost and unparalled master of the histrionic art…’’
অর্ধেন্দুশেখরকে তাই বাদ দিয়ে বাংলা থিয়েটারের আলোচনা সম্ভব নয়। তিনি থিয়েটারের অন্যতম প্রধান স্তম্ভস্বরূপ নাট্যব্যক্তিত্ব। গিরিশচন্দ্রের ভাষায়—‘‘যতদিন বাঙ্গালায় রঙ্গালয় থাকিবে, কেহ তাঁহাকে ভুলিবে না। রঙ্গালয়ে অর্ধেন্দুশেখর অমর।’’
Leave a Reply