//
//

প্রেমবৈচিত্ত্য কাকে বলে? এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবির কৃতিত্ব আলোচনা কর।

প্রেমবৈচিত্ত্য ও আক্ষেপানুরাগ

সংজ্ঞা

বিপ্রলম্ভের তৃতীয় বিভাগ হল প্রেমবৈচিত্ত্য। ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে প্রেমবৈচিত্ত্যের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—

প্রিয়স্য সন্নিকর্ষোহপি প্রেমোৎকর্ষস্বভাবতঃ।

যা বিশ্লেষণধিয়ার্তিস্তৎ প্রেমবৈচিত্ত্যমুচ্যতে।।

অর্থাৎ প্রেমের উৎকর্ষহেতু প্রিয়তমের নিকটে অবস্থান করেও বিরহ ভয়জাত যে আর্তি তাকে প্রেমবৈচিত্ত্য বলে। মিলনের পরিপূর্ণতার মধ্যেও এই বিরহের অনুভব সূক্ষ মনস্তাত্ত্বিক ও কাব্যিক প্রবৃত্তি। ‘বৈচিত্ত্য’ শব্দের অর্থ হল-চিত্তের অন্যথা ভাব। দীনবন্ধু দাস তাঁর ‘সংকীর্ণামৃত’ গ্রন্থে প্রেমবৈচিত্ত্যকে আটটি ভাগে ভাগ করেছেন—রূপানুরাগ, উল্লাস অনুরাগ, পাঁচ ধরনের আক্ষেপানুরাগ—কৃষ্ণের প্রতি, মুরলীকে, নিজেকে, সখীগণের প্রতি এবং দূতির প্রতি, ও রসোদগার।

আক্ষেপানুরাগে শ্রীমতি রাধার সর্বদাই বিরহ অবস্থার প্রকাশ। প্রায় অকারণ বিরহ কাতরতা, কৃষ্ণ মথুরায় না গেলেও স্বল্পকালীন বিচ্ছেদের অসহনীয় অবস্থায় আক্ষেপই এই পর্যায়ের পদের বৈশিষ্ট্য। আক্ষেপানুরাগ প্রেমবৈচিত্ত্যেরই অংশ। প্রেমবৈচিত্ত্যে রাধাকৃষ্ণ ঘনিষ্ট মিলনের মধ্যেও বিরহ কাতরতা অনুভব করেন। আর আক্ষেপানুরাগে স্থায়ী দুঃখকাতরতা লক্ষ করা যায়। এই দুঃখ যেহেতু শ্রীরাধার অনুভবের ব্যাপার, সেজন্য এর শেষও নেই। প্রকৃতপক্ষে আক্ষেপানুরাগের মধ্যেই মহাভাবস্বরূপিণী রাধার সমাজ-সংস্কার, নিজের অদৃষ্ট, কৃষ্ণের দেওয়া দুঃখ, এমনকি নিজের কাছ থেকে পাওয়া দুঃখের পূর্ণ পরিচয় লাভ করা যায়।

আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস

আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস। অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ভাষায়— “চণ্ডীদাসের সর্বস্ব আক্ষেপানুরাগ এবং আক্ষেপানুরাগের সর্বস্ব চণ্ডীদাস।” এই আক্ষেপানুরাগ পর্যায়েই চণ্ডীদাসের প্রতিভার চরম বিকাশ। কবি হিসেবে তার ব্যক্তিগত প্রবণতা, বাঙলা দেশের গ্রামীণ সমাজ এবং তারই সঙ্গে কবির নিজস্ব ধর্মবোধ— সমস্ত কিছুই রূপায়িত হয়েছে আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ে। পল্লীবাংলার একটি পরিবারের বধূরূপে সমাজ-ভীতি ও সতীত্ববোধের দৃঢ়মূল সংস্কারে বন্দিনী রাধার বেদনা বড় মর্মস্পর্শী। একদিকে অনিবারণীয় কৃষ্ণপ্রেমের বহির্মুখী আকর্ষণ আর অন্যদিকে অন্তঃপুরের পরিজন-ভীতি ও সংস্কার—এই উভয়ের দ্বন্দ্বে ক্ষত বিক্ষত রাধার বেদনায় ফুটে উঠেছে চণ্ডীদাসের আক্ষেপানুরাগের পদে। ‘যত নিবারিয়ে চাই’ শীর্ষক পদটিতেও তারই প্রকাশ। রাধা এখানে নিজের সর্বেন্দ্রিয়গ্রাসী কৃষ্ণপ্রেমের বিরুদ্ধেই আক্ষেপবাণী উচ্চারণ করেছেন।

কৃষ্ণ যেদিকে, সেদিকে তিনি যেতে চান না। কিন্তু পা দুটি তাকে সেই পথেই নিয়ে যায়। জিহ্বায় তিনি কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করতে চান না, কিন্তু সে সর্বদাই কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করে। নাসিকাকে বন্ধ রাখলেও সে শ্যামরে গন্ধ অনুভব করে। কৃষ্ণের কথা রাধা শুনতে চান না। কিন্তু কৃষ্ণ-প্রসঙ্গের দিকে তার কান নিজের থেকেই চলে যায়। তাই রাধা সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সর্বদাই কৃষ্ণ অনুভব করার জন্য ধিক্কার দিয়েছেন। পদটির প্রথম পয়াসে পদযুগল, দ্বিতীয় পয়ারে জিহ্বা, তৃতীয়ে নাসিকা, চতুর্থে কর্ণ, পঞ্চম পয়ারে সর্ব ইন্দ্রিয় ও মা কী করে কানুর বশ হয়েছে, তাই দেখানো হয়েছে।

শুধু চোখ ও হাতের কথা বলা হয়নি। পরবর্তীকালে আমরা দেখি, গোবিন্দদাসের একটি পদে রাধার ইন্দ্রিয় ও মন কৃষ্ণানুরাগে আত্মহারা হওয়ায় তিনি গৌরববোধ করেছেন এবং উল্লসিত হয়েছেন। অন্যদিকে চন্ডীদাসের রাধা এই পদে নিজের ইন্দ্রিয়গুলির অবাধ্যতায় আপাত গ্লানিজর্জর। কৃষ্ণমুখী নিজের সর্বাঙ্গ—জিহ্বা, নাসিকা, কর্ণ, এমনকি প্রাণ ও মনকে নিবারণের চেষ্টায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ রাধা লজ্জিত ও পরাজিত হয়ে আত্মধিক্কারের আক্ষেপে ফেটে পড়েন। সর্বদা কৃষ্ণানুভবের জন্য ইন্দ্রিয়কে তিরস্কার করেন। কিন্তু এই তিরস্কারের ভেতর দিয়েই রাধার পরিপূর্ণ কৃষ্ণানুভবের গোপন আনন্দটি ফুটে ওঠে।

‘কি মোহিনী জান বঁধু’ শীর্ষক পদটি চণ্ডীদাসের এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ পদ। তার সমজাতীয় কুলবধূ বা রাধা কৃষ্ণপ্রেমের নিরুপায় যন্ত্রণাকে আক্ষেপানুরাগের পদগুলিতে প্রকাশ করেছেন। এই পদটিতে কৃষ্ণকে সম্বোধন করে তিনি বলেছেন, কৃষ্ণের মতো করে নারীর মনকে মোহিত করতে পারে এমন আর কেউই নেই। কৃষ্ণকে পাওয়ার জন্য রাধা তার স্বভাব, সংস্কার, আচরণ, এমনকি প্রকৃতির বিধান পর্যন্ত বিপর্যস্ত করে অর্থাৎ দিনকে রাত্রিতে এবং রাত্রিকে দিনে পরিণত করে অসাধ্য সাধন করেছেন। কিন্তু তবুও কৃষ্ণপ্রেমের স্বরূপ তিনি বুঝতে পারেননি।

পদটিকে রাধার অসহায়তা, ক্ষোভ আর অভিমান নিরাভরণ পংক্তিগুলির সাবলীল প্রবাহে যেন নিষ্ঠুর কৃষ্ণকে আন্দোলিত করার ইচ্ছাতেই তরঙ্গ বিস্তার করেছে। রাধা এখন স্রোতের শ্যাওলার মতো ভেসে বেড়ান। এমন কোনও সমব্যথী তার নেই যে বন্ধু বলে তাকে সম্বোধন করবেন। এরপর কৃষ্ণও যদি তার প্রতি নিষ্ঠুর হন, তাহলে তিনি যেন রাধার সামনে এসে দাঁড়ান। তারই সামনে রাধা মৃত্যুবরণ করবেন। প্রিয়তমের জন্য এর চেয়ে কঠিনতম শাস্তি রাধা ভাবতে পারেন না। আসলে মুখে তিনি যতই আক্ষেপের বাণী উচ্চারণ করুন না কেন, কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কে পরিপূর্ণ বিশ্বাস থেকে তিনি যে এতটুকুও স্বলিত হননি, এই উক্তিটিই তার প্রমাণ।

আক্ষেপানুরাগের এই পদে রাধার যে বিমুগ্ধ প্রেমের ও নিবিড় তন্ময়তার ছবি চণ্ডীদাস এঁকেছেন তাতে মনে হয় যেন প্রাণের পরিপূর্ণ অনুভব, সুখ-দুঃখ বোধ ও আনন্দ-বেদনাকে গলিয়ে তিনি রাধার প্রেমময়ী মূর্তি নির্মাণ করেছেন। তাঁর প্রেমিকা রাধার যন্ত্রণা, ভালবেসেও ভালবাসাকে চোরের মায়ের মতো গোপন রাখার চেষ্টা, সমাজ ও পরিবারের শাসন শৃঙ্খলে বন্দিনী এক মধ্যযুগীয় বাঙালি গৃহবধূর প্রেমের আকুতিতেই তুলে ধরেছে। এছাড়াও রাধার নিজের সামাজিক সত্তার সঙ্গে তার অন্তরের গভীর-গহনের প্রেমিকা সত্তার দ্বন্দ্বই ফুটে উঠেছে এইসব পদে। আক্ষেপানুরাগের এই পদগুলি থেকে চণ্ডীদাস-রামীর প্রেম সম্পর্কে কিংবদন্তীর সত্যতাই যেন অনুভব করা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!