আঞ্চলিক উপন্যাস কাকে বলে? একটি আঞ্চলিক উপন্যাস ব্যাখ্যা কর।
আঞ্চলিক উপন্যাস
উপন্যাসের শ্রেণি হিসেবে আঞ্চলিক উপন্যাস বা Regional novel স্বীকৃতি পেয়েছে মূলত টমাস হার্ডির ‘ওয়েসেক্স নভেত্স’ প্রকাশিত হবার পর। একটি বিশেষ অঞ্চলকে পটভূমি করে উপন্যাস লেখা হলেই যে তা ‘আঞ্চলিক অভিধায় ভূষিত হতে পারে, এমন কিন্তু নয়। অ্যাব্রাম্স্ এই শ্রেণীর উপন্যাসের পরিচয় দিতে গিয়ে মাত্র একটি দীর্ঘ বাক্যে তার স্বরূপ উদঘাটন করেছেন, তিনি বলেছেন— “The regional novel emphasizes the setting, speech, and customs of a particular locality, not merely as local color, but as important conditions affecting the temperament of characters, and their ways of thinking, feeling and acting.”
অর্থাৎ বিশেষ অঞ্চলকে বেছে নিয়ে তার বিশিষ্ট প্রবণতা বা উৎসব দিয়ে উপন্যাসে একটি আঞ্চলিক পটভূমি নির্মাণ করলেই তাকে আমরা আঞ্চলিক উপন্যাস বলতে পারি না। আমাদের দেখতে হবে সেই অঞ্চলেই কোনো আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য আছে কিনা, তার একটা জৈবিক চরিত্র আছে কিনা এবং সেই চরিত্র উপন্যাসের প্রধান পাত্রপাত্রীকে প্রভাবিত করেছে কিনা—অর্থাৎ তাদের আচার-আচরণে এ কথা বোঝা যায় কিনা যে তারা ওই অঞ্চলসম্ভব মানুষ। একটি বিশেষ অঞ্চলের যে বৈশিষ্ট্য আছে তা যদি চরিত্রগুলি আত্মসাৎ করে এবং তারাই যদি উপন্যাসে বিচরণ করে, তাহলে ঔপন্যাসিক চরিত্র আসলে অঞ্চলটিরই প্রতিনিধিত্ব করে, অঞ্চলটিই বিশেষভাবে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে উপন্যাসে। এইভাবেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে হার্ডির উপন্যাসে এগন্ডন হীথের উষর প্রান্তর—এই অঞ্চলের সঙ্গে মানুষগুলিকে আর বিচ্ছিন্ন করে দেখাই সম্ভব হবে না। ঠিক এই ভাবেই একাত্ম হয়ে উঠেছে বীরভূমের রুক্ষ্ম রাঢ় প্রকৃতির সঙ্গে অন্বিত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু চরিত্র—‘বেদেনী’ গল্পের রাধিকাকে যাদের মধ্যে সবচেয়ে আগে আমাদের মনে পড়তে পারে, যার অকারণ নিষ্ঠুরতা আমাদের স্তম্ভিত করে। বাংলা কথাসাহিত্যে তারাশঙ্করের প্রসঙ্গেও তাই আঞ্চলিক উপন্যাসের স্বীকৃতি প্রথম দেওয়া হয়েছে।
আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি দিতে গেলে তাই সেই অঞ্চলের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, রীতিনীতি প্রকাশ পেয়েছে কিনা সে তো দেখতেই হবে, কিন্তু সেই সঙ্গে প্রধান ভাবে দেখতে হবে প্রধান চরিত্রগুলি অঞ্চলসম্পৃক্ত হয়ে উঠতে পেরেছে কিনা। আমরা মনে করি এখানে আরো একটি জিনিস লক্ষ করার দরকার আছে, অন্তত আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে তার শ্রেণীবিভাগ সঠিক কিনা তা বুঝবার জন্য। একটি বিশেষ অঞ্চলই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় শক্তি কিনা, বিশেষ আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যই উপন্যাসটি নিয়ন্ত্রিত করছে কিনা সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবার জন্য সেই অঞ্চলটিকে বর্জন করে এই বিশেষ উপন্যাস লেখা সম্ভব কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। এমন হতে পারে, যে-কোনো অঞ্চলেই এমন একটি ঔপন্যাসিক আখ্যান সংঘটিত হওয়া সম্ভব ছিল, আবার এমনও হতে পারে যে সেই বিশেষ অঞ্চল ছাড়া উপন্যাসটি দাঁড়াতেই পারে না। এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রেই অঞ্চলটির অনিবার্যতা প্রমাণিত হয় এবং উপন্যাসটি আঞ্চলিক বিশেষণে ভূষিত হতে পারে। দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের নাম করতে পারি। দোবরু পান্না, ভানুমতী, যুগলপ্রসাদ, মঞ্চী, গনু মাহাতো, ধাতুরিয়া, ধাওতাল সাহু, রাজু পাঁড়ে প্রভৃতি বিচিত্র উজ্জ্বল চরিত্র একেবারে নিষ্প্রভ এবং তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে এদের ভাগলপুরের সেই বিশেষ অঞ্চল থেকে বার করে আনলে। এ থেকেই বোঝা যায়, সেই আরণ্য প্রকৃতিই এই উপন্যাসের নিয়ামক শক্তি।
একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস
বাংলা আঞ্চলিক উপন্যাসের পথিকৃৎ মনে করা হয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি নিজে এ কথা স্বীকার না করলেও বাংলা আঞ্চলিক উপন্যাসের একটি সমৃদ্ধ ধারা যে তিনি গড়ে তুলেছেন একথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। আমরা তার একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘হাঁসুলীবাকের উপকথা’-কে আঞ্চলিক উপন্যাসের স্বীকৃতি দেওয়া যায় কিনা বিচার করে দেখবো।
হাঁসুলীবাঁকের উপকথা স্পষ্টতই একটি অতিক্ষুদ্র অঞ্চল এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় করে লেখা উপন্যাস। সেই অঞ্চল এবং তার অধিবাসীদের পরিচয় দিয়েই উপন্যাস শুরু হয়েছে— “কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় যে বিখ্যাত বাঁধটার নাম হাঁসুলীবাক—অর্থাৎ যে বাঁধটায় অত্যন্ত অল্প পরিসরের মধ্যে নদী মোড় ফিরেছে, সেখানে নদীর চেহারা হয়েছে ঠিক হাঁসুলী গয়নার মত।…নদীর বেড়ের মধ্যে হাঁসুলী বাঁকে ঘন বাঁশবনে ঘেরা মোটমাট আড়াইশো বিঘা জমি দিয়ে মৌজা বাঁশবাদি লাটু জাঙলের অন্তর্গত। বাঁশবাদির উত্তরেই সামান্য খানিকটা ধান চাষের মাঠ পার হয়ে জাঙল গ্রাম। বাঁশবাদি ছোটগ্রাম; দুটি পুকুরের চারি পাড়ে ঘর তিরিশেক কাহারদের বসতি। জাঙল গ্রামে ভদ্রলোকের সমাজকুমার-সদগোপ, চাষীসদগোপ এবং গন্ধবণিকের বাস, এছাড়া নাপিতকুলও আছে এক ঘর এবং তন্তুবায় দু ঘর। জাঙলের সীমানা বড়।”
জাঙল গ্রামের কথা বলা হলেও আসলে বাঁশবাদি গ্রামের কাহার, বাবুদের পালকি টানাই ছিল যাদের জাত-ব্যবসা, তাদের জীবনকথাই এখানে প্রধান। উপন্যাসে মুখ্য উদ্দেশ্য এই কাহার জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ, তাদের অন্ধ বিশ্বাস, ফিউডাল জীবনযাত্রায় অবিচল আস্থা ইত্যাদিকে ফুটিয়ে তোলা। তবে সেই একই সঙ্গে এসেছে যুদ্ধের অভিঘাত এবং সেই সঙ্গে অনিবার্যভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয়। এর ঢেউ যখন সুদূর ও প্রত্যন্ত গ্রামে এসে পৌঁছয় তখন দেখা দেয় ফিউডাল জীবনযাত্রার সঙ্গে নব্য বুর্জোয়া বা ধনিকতন্ত্রের প্রত্যক্ষ বিরোধ। তারাশঙ্করের উপন্যাসে বার বার এই সংঘর্ষ আমরা দেখতে পেয়েছি। ‘ধাত্রীদেবতায়’ শিবনাথ জমিদারী প্রথার চেয়ে আধুনিক জীবনযাত্রার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছে। ‘গণদেবতা’য় গ্রামীণ সভ্যতা ও অর্থনীতি ভেঙে চুরমার করতে চেয়েছে অনিরুদ্ধ, অনি কামার। ‘কালিন্দী’ উপন্যাসে জমিদার ইরায়ের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধেছে শিল্পপতি বিমল মুখার্জির। এখানেও আমরা দেখি মিথ নির্ভর প্রাচীন ফিউডাল সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বনওয়ারীসহ প্রায় সব চরিত্রের উৎসাহই যখন অতি প্রবল, তখন এই পাড়ারই ছেলে করালীচরণ প্রায় সব কিছুকেই অগ্রাহ্য করতে চায়, নিজে সে অদূরে চন্দনপুরে রেল কারখানায় কাজ নিয়েছে। কাঁচা টাকা হাতে পায়, তাই জন্মসূত্রে শিকড়ের টান সে অগ্রাহ্য করে।
সুতরাং বলা যেতে পারে যুদ্ধের পটভূমিকা বাইরে থেকে উপন্যাসের সংঘর্ষকে জোরদার রলেও চরিত্রের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই এ উপন্যাসের প্রাণ এবং সেদিক থেকে দেখতে গেলে মুনিষখাটা কাহারদের মাতব্বর বনওয়ারীর সঙ্গে এ লড়াই বুর্জোয়া তন্ত্রের অন্তর্গত শ্রমিক যুবক করালীচরণের লড়াই। প্রথম থেকেই যাতে এ সংঘর্ষ জমে ওঠে সেই কারণে কাহারদের দেবস্থানের কাছে একটি রহস্যময় আওয়াজ দিয়েই উপন্যাসের সূচনা—“হাঁসুলীবাঁকের ঘন জঙ্গলের মধ্যে রাত্রে কেউ শিস দিচ্ছে। দেবতা কি যক্ষ কি রক্ষ বোঝা যাচ্ছে না, সকলে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কাহারেরা। অনতিকাল পরেই অবশ্য করালীচরণ এই রহস্য ভেদ করে দেয় যখন প্রকাণ্ড এক চন্দ্ৰবোড়া সাপ সে হত্যা করে। প্রমাণ হয়ে যায় হাঁসুলী বাঁকের দেবতা কত্তাবাবা’ নয়, তুচ্ছ একটি সাপই এই কাণ্ড ঘটাচ্ছিল। এটা অবশ্য সূত্রপাত, তারপর দীর্ঘদিন ধরে চলে দেবতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং তাকে উৎখাতের সংগ্রাম। দ্বিতীয় পক্ষই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে বলতে হবে, কারণ যে জন্যই ওক, হাঁসুলীবাঁকের মিথ-আশ্রয়ী সেই সামন্ততান্ত্রিক জীবন একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। দেবভূমিও বিনষ্ট হয়।
আঞ্চলিক উপন্যাসের আপাতবৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করতে হলে একথা অস্বীকার করার কোনাে কারণ থাকে না যে একটি বিশেষ অঞ্চলের স্বাদ এ উপন্যাসে অনেকটাই রক্ষিত হয়েছে। তার প্রধান কারণ অবশ্যই এই যে, লেখক স্বয়ং সচেতন ভাবে এ কথা বার বার আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে এটি একটি বিশেষ অঞ্চলেরই উপন্যাস। প্রথম থেকেই অঞ্চলটির বর্ণনা দিয়েছেন। নদীর ধারে বাস, ভাবনা বারো মাস’—এই বিশিষ্ট প্রবচনটি যে কেবল বাংলাদেশের এই অঞ্চলটাতেই খাটেনা কেন, তার কারণ বুঝিয়ে বলেছেন। এও বলেছেন—“এ দেশের নদীর চেয়ে মানুষের লড়াই বেশি। খরা অর্থাৎ প্রখর গ্রীষ্ম উঠলে নদী শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায়, ধু ধু করে বালি—এক পাশে মাত্র এক হাঁটু গভীর জল কোন মতে বয়ে যায়….মাটি গরম হয়ে ওঠে আগুনে-পোড়ো লোহার মত; কোদাল কি টামনায় কাটে,..গাঁইতির মত যে যন্ত্র সে দিয়ে কোপ দিলে তবে খানিকটা কাটে কিন্তু প্রতি কোপে। আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়ে। খাল বিল পুকুর দীঘি চৌচির হয়ে ফেটে যায়। তখন নদীই রাখে মানুষকে বাঁচিয়ে; জল দেয় ওই নদী।”
এখানকার নদীতে মাঝে মাঝে কুমীর আসে, সেখানকার লোকে যাকে বলে ঘড়িয়াল’, সে কথা লেখক বলেছেন, বাঘ বা ভাল্লুক এলে অথবা শুয়োরের উৎপাত হলে কীভাবে বীরত্বের সঙ্গে তা প্রতিহত করে কাহাররা সে কথাও বলেছেন; আর বলেছেন এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে জড়িত ঠাকুর কালারুদ্দি বা কত্তা বাবার কথা। তিনি থাকেন বাঁশবনে, কাহারদের জীবনে যা ঘটে চলেছে, যা ঘটবে ঝড়-জল-দাবানল-যুদ্ধ-মহামারী, সবই তিনি ঠিক করে দেন। তার পূজায় কোনো বিঘ্ন ঘটলে তিনি তা সহ্য করেন না। এই বাবার আবির্ভাব নাকি গাঁয়ের বাবু চৌধুরীদের তিন পুরুষ আগে। কোপাইয়ে সেবার এসেছিল এক প্রলয় বান—সব ডুবে যেতে নীলকুঠির সাহেব-মেম চড়েছিল গাছে। রাত্রি তিন প্রহরে দেখা গেল ‘আলোয় আলোকীন্নী’ করে এক নৌকা আসছে। সাহেব ঝাপিয়ে পড়ল নৌকা ধরতে, তখনই আবির্ভাব এই দেবতার—এই ন্যাড়ামাথা, ধবধব করছে রঙ, গলায় রুদ্দাক্ষি, এই পৈতে, পরনে লাল কাপড়, পায়ে খড়ম। এই দেবতার নিষেধ না শুনেই সাহেব-মেম মারা যায় এবং চৌধুরীদের কত্তাবাবা দয়া করেন, এই লোকবিশ্বাস। এই বিশেষ অঞ্চলের লোককথা শোনাবার জন্যই বস্তুত দুটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন লেখক-রহস্যময় পাগলবাবা এবং উভয়লিঙ্গ মানুষ নসুবালা। নসুবালা গেয়েছে—‘বেলতলায় বাবা ঠাকুর কাহার কুলের পিতা বাঁশতলাতে থাকতো বাহন অজগরো চিতা পরাণ-ভ্রমরে সে থাকত আগুলি (ও হায়) তারে দাহন করে মারল করালী! পাগল শেষে গান ধরে—
জল ফেলিতে নাই চোখে জল ফেলিতে নাই
বিধাতা বুড়োর খেলা দেখে যারে ভাই।
আঞ্চলিক কিছু অনুষ্ঠান, যেমন কথায় কথায় মদ্যপানের মহোৎসব এবং চড়কের সময় বিশেষ উৎসব তো আছেই, তবু উপন্যাসটিকে আঞ্চলিক আস্বাদ দিতে আরো সাহায্য করেছে। লেখকের এই বিশেষ অঞ্চলের ভাষা সম্বন্ধে সুচারু জ্ঞান এবং তার নিপুণ প্রয়োগ। এখানকার লোকের কথা বলার বৈশিষ্ট্য কী সেটা লেখক নিজে শুনিয়ে দিয়েছেন, তারপর প্রায় প্রত্যেকটি চরিত্রের মুখেই দিয়েছেন আঞ্চলিক ভাষা, যেমন সুচাদ— “আর একটা পাঁঠা তু দে পানু। আর পাড়া-ঘরে উঁদা তুলে বাবার থানে পূজো হোক একদিন। জাঙলের লোক যদি রবহেলা করে আমরা আপনাদের কত্তব্য করি।”
বনওয়ারী— “বোঝলাম, সব বোঝলাম। কিন্তু তবু অল্যায় হয়েছে। নিশ্চয় অল্যায় হয়েছে। ওগা মানুষটা যদি মরে যেত! মুখ একে বাক্য আর ঠাই একে মার—পিতিপুরুষে বলে যেয়েছেনই কথা।”
করালীচরণ—“এই দিকে—এই দিকে। আয়। আয়। আয়। ডাক্ সব পাড়ার নোককে। দেখে যা তোদের কত্তা পুড়ছে। দেখে যা।”
লেখক এই বিশেষ অঞ্চলকে যে একটি প্রধান চরিত্র করে তুলেছেন তা বোঝা যায় লেখকের বর্ণনাভঙ্গি থেকে এবং সমগ্র অঞ্চলটিকে জীবন্ত করে তোলার প্রয়াস থেকে। চরিত্রের ওপর অঞ্চলের প্রভাব সম্বন্ধে নির্দ্বিধায় বলা যায়, প্রায় প্রত্যেকটি চরিত্রই হাঁসুলীবাঁকের লোকসংস্কৃতি ও লোকবিশ্বাসপুষ্ট। বনওয়ারী, সুদ, নসুবালা, পাগলবাবা, গোলাপীবালা, কালোশশী—কোনো চরিত্রই এই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। একমাত্র করালীচরণ তার অঞ্চলের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ভিন্ন ধরনের জীবনযাপন করেছে, ভিন্ন মনের মানুষ হয়ে উঠেছে, দেবদ্বিজে ভক্তি এবং ধর্মে মতি সে রাখতে পারেনি। কিন্তু এখানে তিনটি কথা বিচার্য। প্রথমত, দুটি জীবনাচরণ-ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব দেখাবার জন্যই এই উপন্যাস লেখা, সুতরাং করালীকে ‘গণদেবতা’-র অনি কামারের মতো একটি প্রতিবাদী চরিত্র করা ছাড়া লেখকের আর কোনো উপায় ছিল না। দ্বিতীয়ত, করালীচরণের অন্যান্য সব আচার আচরণ কিন্তু কাহারদের মতোই, কেবল ধর্ম সম্বন্ধে অলৌকিক বিশ্বাস তার নেই। নইলে পূজা উপলক্ষে মদে চুর হয়ে থাকা, গ্রামের আনন্দ-অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, যৌবনবতী মেয়ের সঙ্গে ‘অঙ’ করা, আবার অন্য মেয়েকে মনে ধরলে সেই মেয়েকে অবজ্ঞা করা—এ সবই করালীচরণের মধ্যে আছে। তৃতীয়ত, এবং এইটেই সবচেয়ে লক্ষ্য করার মতো, করালীচরণ অর্থে ও ক্ষমতায় বনওয়ারীর চেয়ে হয়তো কিছু বড়ো হয়েও প্রথমদিকে তার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চায়নি, এমনকি সাপের দেহ পোড়ানো সম্বন্ধে তার বিধান শুনে বলেছিল, এই না হলে মুরুব্বি বলবে কেন?”
পরে অবশ্য সে বনওয়ারীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং সেই সংঘর্ষের জেরেই বনওয়ারীকে দীর্ঘদিনের জন্য শয্যা নিতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা দেখি করালীচরণ এতো ‘ডাকাবুকো’, এতো ধর্মজ্ঞানহীন বা সংস্কারহীন হয়েও নিজের শেকড় উচ্ছেদ করতে পারেনি। সে যে হাঁসুলীবাঁকেরই একজন, কাহারপাড়ারই মানুষ, সে কথা বোঝা যায় তার প্রত্যাবর্তন দেখে। ঝড়ে তার ভিটে উড়ে গেছে, করালী এর মায়া ত্যাগ করে অন্যত্র থাকতে পারতো। বস্তুত তাই-ই ছিল করালীর কাছে প্রত্যাশিত। কিন্তু উপন্যাসের শেষ বাক্যগুলির কয়েকটি আমরা স্মরণ করতে পারি যেখান থেকে বোঝা যায় করালী হাঁসুলীবাঁকের সঙ্গেই গভীরভাবে যুক্ত— “হাঁসুলীবাঁকে করালী ফিরছে। সবল হাতে গাঁইতি চালাচ্ছে, বালি কাটছে, বালি কাটছে আর মাটি খুঁজছে।”
করালীচরণের এই নতুন করে মাটি খোঁজার দৃশ্য দেখে বোঝা যায়, এ উপন্যাস সেই মাটিরই উপন্যাস যে মাটিতে প্রত্যেকটি চরিত্রের শিকড় প্রোথিত রয়েছে। সেই কারণেই ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’-কে আঞ্চলিক উপন্যাস বলতে আমাদের সম্ভবত কোনো দ্বিধা থাকে না।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদার | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply