//
//

আদি-মধ্য বাংলার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা কর।

আদি-মধ্য বাংলার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

আদিমধ্য যুগের (আনুমানিক ১৩৫০ খ্রিঃ থেকে ১৫০০ খ্রিঃ) বাংলা ভাষার একমাত্র প্রামাণিক নিদর্শন বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। এটি ছাড়া মোটামুটি ভাবে কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’, মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ এবং কয়েকটি মঙ্গলকাব্য এই পর্বের রচনা বলে ধরা হয়। কিন্তু এগুলির অধিকাংশই এই পর্বের শেষের দিকের রচনা এবং এগুলির ভাষা পরবর্তীকালে এত বেশি পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয়েছিল যে এগুলিকে আদিমধ্য যুগের বাংলা ভাষার প্রামাণিক নিদর্শনরূপে গণ্য করা যায় না। তাই শুধু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের উপরে নির্ভর করে এই পর্বের বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলি নির্ণয় করা হয়।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

(ক) আ-কারের পরস্থিত ই-কার ও উ-কার ধ্বনির ক্ষীণতা এই যুগের বাংলার অন্যতম ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন।

(খ) কোনো কোনো ভাষাতত্ত্ববিদের মতে নাসিক্য ব্যঞ্জনের সংযোগে গঠিত সংযুক্ত ব্যঞ্জনের ‘সরলীভবন’ আদি-মধ্যযুগের বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য। যেমন— কান্তি > কাঁতি, ঝম্প > ঝাঁপ। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যটিও সর্বক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় না।এর বহুল ব্যতিক্রম চোখে পড়ে। যেমন— চন্দ্রাবলী, কুম্ভার, আশ্মি, ব্রহ্মা, কান্দো, নন্দন, নিন্দ ইত্যাদি।

(গ) তেমনি আবার ‘মহাপ্রাণ নাসিক্যের মহাপ্রাণতার লোপ অথবা ক্ষীণতা’ আদি-মধ্য যুগের বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য, এমন সিদ্ধান্ত করেছেন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠিত ভাষাবিজ্ঞানী। অর্থাৎ হ-কার-যুক্ত নাসিক্য ব্যঞ্জন থেকে হকার লোপ পেয়েছে। যেমন— হ্ন (ন্‌হ) স এবং হ্ম (ম্‌হ) > ম। যেমন কাহ্ন > কানু, আহ্মি > আমি। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যটিকেও এ যুগের বাংলা ভাষার সাধারণ বৈশিষ্ট্য রূপে গ্রহণ করতে পারি না। কারণ ‘কানু’ ও ‘আমি’ শব্দের চেয়ে বরং ‘কাহ্ন’ ও ‘আহ্মি’ শব্দের প্রয়োগই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বেশি এবং ‘হ্ন’, ‘হ্ম’ প্রভৃতি ধ্বনিসংযোগ ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

(ক) কর্তৃকারকে শূন্যবিভক্তি (বিভক্তিহীনতা) প্রথম লক্ষণীয় রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। উদাহরণ— শীতল মনোহর বাঁশি কে না বাএ।

(খ) আদি মধ্যযুগে মুখ্য কর্মেও বিভক্তিহীনতা দেখা যায়। যেমন—‘অরেরে বাহিহি কাহ্ন নাব ছছাড়ি ডগমগ কুগই ন দেহি। উঁহ এখনই সন্তার দেই জো চাহসি সো লেহি।’

(গ) গৌণকর্মে ও সম্প্রদানে ক, কে, রে বিভক্তি পাওয়া যায়। যেমন— কংসকে বুলিয়ে কন্যা আঁকাসে থাঁকিয়া’, ‘হাণ পাঁচ বাণে তাক না করিহ দয়া’।

(ঘ) পঞ্চমী বিভক্তির বদলে, ‘হৈতে’ অনুসর্গের সাহায্যে অপাদানের অর্থ প্রকাশ করা হত। যেমন— ‘গোঠে হৈতে আসি আহ্মি বুঢ়ী গোআলিনী’।

(ঙ) সম্বন্ধ পদের অর্থ প্রকাশের জন্যে ষষ্ঠী বিভক্তির চিহ্ন ছিল— এর, র, ক, কের। যেমন— ‘বারে বারে কাহ্ন সে কাম করে। যে কামে হএ কুলের খাঁখারে।’

(চ) অধিকরণে সপ্তমী বিভক্তি রূপে ব্যবহৃত হত— তে, এ। যেমন— রাধার হিআত মাইল সুদৃঢ় সন্ধান।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!