রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে আশুতোষ দেবের নাট্যশালার ভূমিকা আলোচনা কর
আশুতোষ দেবের (সাতুবাবুর বাড়ির) নাট্যশালা
নবীন বসুর বাড়ির নাট্যশালায় বাংলা নাটক বিদ্যাসুন্দরের অভিনয়ের (১৮৩৫) পর কুড়ি বছরের অধিককাল বাঙালির নাট্যশালায় আর কোনো বাংলা নাটকের অভিনয়ের খবর পাওয়া যায় না। একদিকে বাংলায় অভিনয়যোগ্য যথার্থ নাটকের অভাব এবং অন্য দিকে দেশীয় লোকের শিক্ষা ও রুচি তখনো সেইভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। ইংরেজি নাটকের অভিনয় স্কুল কলেজ বা ধনী বাড়ির সখের নাট্যশালায় অভিনীত হলেও, তাতে বাঙালির পক্ষে পরিপূর্ণ রসগ্রহণ সম্ভব ছিল না। ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির পক্ষেও তা কষ্টসাধ্য ছিল। থিয়েটারের জাঁকজমক, চমক ও নতুন মজা অনেককেই বিস্মিত ও আকর্ষিত করলেও, সঠিক নাট্যস্পৃহা তাতে পূর্ণ হতে পারেনি।
উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে ধনী বাঙালির প্রাসাদ-মঞ্চগুলিতে নতুন করে নাটকাভিনয় শুরু হলো। এরপর থেকে শুধু ইংরেজি নাট্যাভিনয়ের জন্য আর কেউ উদ্যোগী হননি। বাঙালির তৈরি নাট্যশালায় বাংলা নাটকের অভিনয় পাকাপাকিভাবে শুরু হলো। এই সময় থেকেই বাংলা নাটক ও নাট্যশালার ইতিহাস পরস্পর সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে। নাটকাভিনয়ের সহযোগী হিসেবেই নাট্যকারদের আবির্ভাব এবং নাটক লেখা শুরু হয়ে গেল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ এই দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য বছর। এই বছরেই তিনটি নাট্যশালা বাংলা নাটক অভিনয় শুরু করে। এই ধারা অব্যাহত থেকে যায় এরপর থেকে। এই তিনটি নাট্যশালা হলো—আশুতোষ দেবের নাট্যশালা, জয়রাম বসাকের নাট্যশালা এবং কালীপ্রসন্ন সিংহের বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ। মঞ্চ ও নাটকের ইতিহাস রচয়িতা লিখেছেন— ‘‘The year 1857 marks the beginning of a new epoch in the history of Bengali Drama and the Theatre. In fact, Bengali Drama and the stage have had a continuous history since that memorable year’’ (Probodh Chandra Sen—Bengali Drama and Stage.)
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ প্রসঙ্গে স্বভাবতঃই সিপাহী বিদ্রোহের কথা মনে আসে। কলকাতার ইংরেজরা ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। তাদের নিজস্ব আমোদ-প্রমোদ সব বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে ধনী বাঙালি এবং শিক্ষিত তরুণদের বেশির ভাগের মধ্যেই সিপাহী বিদ্রোহের কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় না। বরং ধনী বাঙালির প্রাসাদ-মঞ্চগুলিতে আমোদ-প্রমোদের ফোয়ারা ছুটেছে, সঙ্গে নাট্যাভিনয়ের উদ্যমও এই সময়ে নজরে পড়ে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ধনী বাঙালিদের বাড়িতে পরপর নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয়ে নাটক অভিনয়ের ধারা অপ্রতিহত বেগে চলেছে। সিপাহী বিদ্রোহের মতো এত বড় ভারতব্যাপী একটা ঘটনার কোনো প্রতিক্রিয়া এদের ওপর পড়ল না। বিষয়টি, আশ্চর্যের হলেও, এই থেকেই ধনী অভিজাত বাঙালির তৎকালীন মানস-পরিচয় পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে।
কলকাতার লক্ষপতি ধনী আশুতোষ দেবের (ইনি সাতুবাবু নামেই সমধিক পরিচিত) বাড়িতে একটি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে। আশুতোষ দেব ও তার ভাই (লাটুবাবু নামে খ্যাত) শুধু লক্ষপতি ছিলেন না, বিলাস-ব্যসনেও প্রমত্ত ছিলেন। নাচগান, কবিগান, আখড়াই গান, বুলবুলির লড়াই, পায়রা ওড়ানো, ঘুড়ি ওড়ানো, বাঈজীনাচ ও খেমটা নাচে প্রচুর অর্থ উড়িয়েছিলেন। মাতার শ্রাদ্ধে, আয়োজনে ও অর্থব্যয়ে কিংবদন্তী তৈরি করেছিলেন। আশুতোষ দেবের মৃত্যুর (২৯ জানুয়ারি, ১৮৫৬) পর তাঁর বাড়িতে স্থাপিত জ্ঞানপ্রদায়িনী সভার সভ্যরা মিলিত হয়ে এই নাট্যশালা নির্মাণ ও অভিনয়ের আয়োজন করেন।
প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সাতুবাবুর দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ ও চারুচন্দ্র ঘোষ। এঁরা দুজনেই ছিলেন সাতুবাবুর বড় কন্যার পুত্র।
বাঙালির রঙ্গালয়ে বাংলা নাটকের অভিনয়ে খুবই আনন্দ প্রকাশ করে ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখেছিল (১৫ জানুয়ারি, ১৮৫৭)—‘‘সম্ভ্রান্ত ও দেশীয় ভদ্রলোকরা বিশুদ্ধ আমোদের জন্য সচরাচর অর্থ ব্যয় করেন না। এই কারণে আমাদের সম্ভ্রান্ত যুবকগণ সাধারণতঃ যে সকল নীচ আমোদ-প্রমোদে মত্ত থাকেন। তাহা হইতে তাহাদিগকে মুক্ত দেখিয়া আমরা নিশ্চিন্ত হইলাম।’’
এই রঙ্গালয়ের উদ্বোধন হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি, সরস্বতী পূজার দিন। নাটক ছিল নন্দকুমার রায়ের লেখা এবং পূর্বেই মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলা’। নাটকটি কালিদাসের বিখ্যাত সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ।
বহুদিন পরে বাঙালির রঙ্গালয়ে বাংলা নাটকের অভিনয়ে বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল। অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন—
শকুন্তলা—শরৎচন্দ্র ঘোষ। দুষ্মন্ত—প্রিয়মাধব মল্লিক। দুর্বাসা—অন্নদা মুখোপাধ্যায়। অনসূয়া—অবিনাশচন্দ্র ঘোষ। প্রিয়ম্বদা—ভুবনচন্দ্র ঘোষ। ঋষিকুমার—মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
উমেশচন্দ্র দত্ত ষ্টেজ-ম্যানেজার ছিলেন। কবিচন্দ্র নামে একজন কবি এই নাটকের জন্য গান বেঁধে দিয়েছিলেন।
এই রঙ্গালয়ে চারশো জনের ওপর দর্শকাসন ছিল। রঙ্গালয় অতি মনোরমভাবে সজ্জিত ছিল। সকলের অভিনয়ই ভালো হয়েছিল। বিশেষ করে শরৎচন্দ্র ঘোষের শকুন্তলা অভিনয় সকলকেই মুগ্ধ করেছিল। শকুন্তলার মনোহারিণী রূপলাবণ্য ও ভাবভঙ্গি এবং সম্ভাষণের মাধুর্য ও বাকচাতুর্যে দর্শকবৃন্দ চমৎকৃত হয়েছিলেন।
এই অভিনয়ে আশ্রমবাসিনী শকুন্তলাবেশী শরৎচন্দ্র ঘোষ সাতুবাবুর বাড়ির মূল্যবান জড়োয়া গয়না পরে মঞ্চে উপস্থিত হয়ে শকুন্তলার রানীবেশ দেখিয়েছিলেন। সাতুবাবুর বাড়ির জড়োয়া গয়না দেখে দর্শকদের চক্ষু স্থির হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে গিরিশচন্দ্র লিখেছেন যে, লোকের মুখে শুধুই গয়নার কথা। নাটকের কথা কেউ বলে না। নাটক অভিনয়ের মহৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে ধনীবাড়ির জৌলুষ দেখাবার গোপন প্রয়াস কাজ করেছিল বৈকি!
বাংলা সংবাদপত্রে এই সম্পর্কে কিছু লেখা হয়নি। কিন্তু ইংরেজি ‘হিন্দু ইনটেলিজেন্স’ পত্রে লেখা হয়েছিল—‘‘To see the simple Shakuntolah clothed in the splendid garments of the richest Hindu girls, and decorated in the most precious jewels brings to our mind a painful sight of the murder of truth and nature.’’
এই মঞ্চে শকুন্তলা নাটকের দ্বিতীয় অভিনয় হয় ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৭। তবে ঐদিন সম্পূর্ণ নাটকটি অভিনীত হয়নি, মাত্র তিন অঙ্ক অভিনীত হয়েছিল। শকুন্তলা নাটকের তৃতীয় অভিনয়ের আয়োজন করা হলেও, সে অভিনয় হয়নি।
‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’ ছাড়া এই মঞ্চে অভিনীত হয় ‘মহাশ্বেতা’ নাটক। বাণভট্টের সংস্কৃত ‘কাদম্বরী’ গ্রন্থ অবলম্বনে এই নাটকটি রচনা করেন মণিমোহন সরকার। তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য অনুদিত ‘কাদম্বরী’ বাংলা গ্রন্থের সাহায্যও এখানে নেওয়া হয়েছে। নাটকটির অভিনয় হয় ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর। অভিনয়ে—
রাজা—অন্নদাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। মহাশ্বেতা—ক্ষেত্রমোহন সিংহ। কাদম্বরী—মহেন্দ্রনাথ ঘোষ। তরলিকা—শরৎচন্দ্র ঘোষ। রানী—ভুবনমোহন ঘোষ। ছত্রধারিণী—মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। কপিঞ্জল—মণিমোহন সরকার (নাট্যকার)। পুণ্ডরীক ও নটী—মহেন্দ্রনাথ মজুমদার।
নাটকটি ভালোভাবে নাট্যবদ্ধ হয়নি। সংলাপ রচনাও ক্রটিপূর্ণ ছিল। অভিনয়ে দু’একজন ছাড়া কারোর অভিনয়ই ভালো হয়নি। তবে মহাশ্বেতা, তরলিকা এবং কাদম্বরীর অভিনয়ে তিনজন পুরুষ অভিনেত্রীই খুব প্রশংসা লাভ করে। সঙ্গীত ও যন্ত্রবাদ্য আশানুরূপ হয়নি।
দীর্ঘদিন বাদে আবার বাঙালির নাট্যশালায় বাংলা নাটকের অভিনয়ে সবাই খুশি হয়েছিল। তবে দুটো নাটকই সংস্কৃত নাটক ও কাহিনীর অনুবাদ। তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষায় রচিত বাঙালির নাটক বাঙালির নাট্যশালায় অভিনীত হয়ে, বাংলা নাট্যাভিনয়ের নতুন ধারার সূত্রপাত করেছিল। এর পরেই নাট্যশালা ও নাটকাভিনয় শুরু হয়ে গেল মহাসমারোহে। এই রঙ্গমঞ্চের প্রধান দুই উদ্যোক্তা শরৎচন্দ্র ঘোষ এবং তার ভাই চারুচন্দ্র ঘোষ—সাতুবাবুর দুই নাতি পরে উদ্যোগী হয়ে বাংলা সাধারণ নাট্যশালার অভিনয়ে এগিয়ে আসেন। তাদের প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল থিয়েটার (১৮৭৩) বাংলায় প্রথম স্থায়ীভাবে তৈরি সাধারণ রঙ্গালয়। বিডন স্ট্রিটে স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে শরৎচন্দ্র ঘোষ ও চারুচন্দ্র ঘোষ বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে উজ্জ্বল আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ভালো অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবেও শরৎচন্দ্র প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে আশুতোষ দেবের নাট্যশালার অবদান
সাতুবাবুর বাড়ির থিয়েটারের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য—
- বাঙালির মঞ্চে ইংরেজি নাটকের অভিনয় বাতিল হলো।
- বাংলা মৌলিক নাটকের অভাবে সংস্কৃত নাটক ও উপাখ্যানের বাংলা নাট্যরূপ অভিনয়ের ব্যবস্থা হলো।
- স্ত্রী চরিত্রে পুরুষেরাই অভিনয় করেছে। যদিও এর আগে নবীনবাবুর থিয়েটারে মেয়েরা অভিনয়ে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু সমাজ মানসিকতার কারণে সাতুবাবুর বা পরবর্তী সখের নাট্যশালায় অভিনেত্রী গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
- বলা যেতে পারে, এই সময় থেকেই (১৮৫৭) বাঙালির তৈরি বিলিতি ধরনের মঞ্চে পুরোপুরি বাংলা নাটকের অভিনয়ের ধারা প্রবর্তিত হলো।
Leave a Reply