ইংরেজি সাহিত্যে চার্লস ল্যাম্বের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
চার্লস ল্যাম্ব (১৭৭৫-১৮৩৪)
রোমান্টিক যুগের শ্রেষ্ঠ গদ্যকার ও সমালোচক হিসেবে চার্লস ল্যাম্বের (১৭৭৫-১৮৩৪) কৃতিত্ব যথেষ্ট। ল্যাম্বের সাহিত্যসাধনার মধ্যে শুধু বিচারবুদ্ধির পরিচয় নয়, রয়েছে সামগ্রিক সত্তা দিয়ে অনুভূত সত্তার রসাস্বাদন। ইংরেজ প্রাবন্ধিকদের মধ্যে ল্যাম্বের শ্রেষ্ঠত্ব এই কারণে যে, তাঁর রচনাভঙ্গির বিশিষ্টতা, হিউমারের প্রয়োগ, জীবনের সুস্নিগ্ধ আলোকদীপ্তির অনাবিল প্রবাহ এবং রচনার মধ্যে ব্যঞ্জনা ও গীতিকবিসুলভ সুরেলা ভাবের প্রকাশ অন্য কোন প্রাবন্ধিকের মধ্যে দেখা যায় না। তাই শিল্পী ল্যাম্ব সম্পর্কে কথিত আছে— “Lamb’s essays continue the best tradition of Addision and Steele, our first great essayists; but their sympathies are broader and deeper, and their humour more delicious, than any which preceeded them.”
প্রাবন্ধিক ল্যাম্ব
এলিয়া (ইলাইয়া) ছদ্মনামে ল্যাম্ব অনেক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। হ্যাজলিট-এর প্রেরণায় ল্যাম্ব লণ্ডন ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি এই ম্যাগাজিনে তিন বছর (১৮২০-১৮২৩) ধরে যে সমস্ত প্রবন্ধ লিখেছিলেন তা-ই পুস্তকাকারে ১৮২৩ সালে ‘The Essays of Elia’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। দশ বছর পরে (১৮৩৩) প্রকাশিত হয় আর একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘The Last Essays of Elia’।
ল্যাম্ব ব্যক্তিগত জীবনে তেত্রিশ বছর কেরানীর কাজ করেছেন। সেই জীবনের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ তাঁর প্রবন্ধগুলি। এলিয়া ছদ্মনামে রচিত প্রবন্ধগুলির বিষয় হল সাদারণ মানুষের নানা দিক— যা হাসি-অশ্রু, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার দোলার দোদুল্যমান। অতীত স্মৃতিচারণ সূত্রে তার এই প্রবন্ধগুলি রচিত।
‘ড্রিম চিলড্রেন’ (Dream children) প্রবন্ধ গ্রন্থটিও পাঠকের কাছে উপাদেয়। কেননা বড়দের বিষয় ছোটদের কাছে কীভাবে পরিবেশন করা যায়, তাঁর কৌশল ল্যাম্ব এই গ্রন্থে প্রদর্শন করেছেন। এই প্রবন্ধের বিষয় তাঁর ব্যক্তিগত অকৃতদার জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার করুণ মধুর প্রসঙ্গ। প্রাবন্ধিক এই গ্রন্থে অতীত স্মৃতিচারী কবিমনের স্বরূপকে মেলে ধরেছেন। ব্যক্তিগত প্রবন্ধ যে বর্ণনার কৌশলে শিল্পচেতনার পরিচয়ে আস্বাদ্য হয়ে উঠতে পারে ‘ড্রিম চিলড্রেন’ প্রবন্ধে ল্যাম্ব তাই করে দেখিয়েছেন।
‘ডিসার্টেশান অন রোস্ট পিগ’ (Dissertation on Roast Pig) প্রবন্ধে প্রাবন্ধিকের খেয়ালী কল্পনার অবাধ বিস্তার লক্ষ করা যায়। হাস্যকোতুকের বর্ণচ্ছটায় প্রবন্ধটি উজ্জ্বল।
‘দি সুপার অ্যানুয়েটে ম্যান’ (The super anuated man) প্রবন্ধে তাঁর দীর্ঘ করণিক জীবনের স্মৃতিচারণা ব্যক্তি-হৃদয়ের স্পর্শে অপরূপ রূপলাভ করেছে। ল্যাম্ব যখন করণিক ছিলেন তখন তিনি অবকাশ বলতে রবিবার ও ছুটির দিন, কিন্তু অবসরের পর দীর্ঘ অবকাশে তাঁর সেই কর্মময় জীবনের স্মৃতিচারণা করেছেন। রাতের স্বপ্নে তিনি দেখেছেন তার অতীতের ভুলগুলিকে—যার জন্য তিনি উপরওয়ালার বকুনি খেতেন।
‘দি ডিকে অব বেগারস’ (The Decay of Beggars) প্রবন্ধে সরস রসিকতায় প্রশ্ন রেখেছেন, দয়া দাক্ষিণ্য দেশ থেকে লুপ্ত হয়ে যাবে কি না।
‘মডার্ন গ্যালান্ট্রি’ (Modern Gallantry) প্রবন্ধে আধুনিক শিষ্টাচারের স্বরূপকে তুলে ধরেছেন। প্রকৃত শিষ্টাচার কেমন হওয়া উচিত, এ নিয়েও আলোচনা করেছেন।
‘ওল্ড চায়না’ (Old china) প্রবন্ধেও লেখক তাঁর ব্যক্তিগত কঠোর জীবন, ভাইবোনের কৃচ্ছসাধন-এর কথা উল্লেখ করেছেন। ব্যক্তিগত কথা ও পরিবেশন নৈপুণ্যে শাশ্বত রূপলাভ করেছে।
তাঁর প্রবন্ধগুলিতে হয়ত চাপা বেদনার সুর অনুরণিত হয় একথা ঠিকই, কিন্তু সেই চাপা বেদনার মধ্যেও জীবনরসিক কবির মতো তাঁর শিল্পীসত্তার স্নিগ্ধ উজ্জ্বল রূপ উকি দিয়ে যায়। সেজন্য শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে যথার্থই লিখেছেন—“মানুষের অন্তরে যে বহুরূপী প্রচ্ছন্ন থাকে, তাহা যেন ল্যাম্বের রচনায় বহুত্বের আবরণমুক্ত ঐক্যের পরিচয় দিয়াছে। এই ঐক্য এত প্রাণময়, এত রসোচ্ছল, এত বিচিত্র আবেদনে সর্বসঞ্চারী যে ইহা সাহিত্য প্রকাশের এক অপরূপ নিদর্শন রূপে অমরত্বের অধিকারী হইয়াছে।”
কবি, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার চার্লস ল্যাম্ব
প্রথম জীবনে কবি ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা হল ‘The old Familiar Faces’ এবং ‘To Hesters’। এগুলি রোমান্টিক যুগে রচিত হলেও কবিত্বশক্তির দিক থেকে উল্লেখযোগ্য নয়। তিনি এইসব কবিতায় পরিচিত মানুষদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করেছেন।
কবিতা ছাড়া তিনি একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। একটি কিশোরীর জীবনের করুণ কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে তাঁর ‘এ টেল অব রোজামুন্ড গ্রে’ (A Tale of Rosamunde Gray)
কাব্য ও উপন্যাস ছাড়া তিনি কয়েকটি নাটক রচনা করেছিলেন। ‘মি. এইচ’ (Mr. H.) নাটকটি হাস্যরসাত্মক। ‘জন উডভিল’ (John Woodvil) একটি নাট্যকাব্য। এর বিষয়, চরিত্রচিত্রণ ও নাটকীয়তা উঁচু মানের নয়। ‘দি পনব্রোকার্স ডটার’ (The Pawnbroker’s Daughter) তাঁর একটি হাস্যরসাত্মক প্রবন্ধের নাট্যরূপ।
এছাড়া শেকসপীয়ারের ট্রাজেডি ও কমেডি নাটকের গদ্যরূপ অবলম্বনে গল্প লিখেছেন চার্লস ল্যাম্ব ও মেরী ল্যাম্ব (ভাইবোন)। গ্রন্থের নাম ‘Tales from Shakespeare’। এগুলিতে শিশু সাহিত্যের উপাদান রয়েছে।
চার্লস ল্যাম্ব-এর শিল্পীসত্তার বৈশিষ্ট্য
- ল্যাম্ব ছিলেন জীবনরসিক শিল্পী। তাই দুঃখময় জীবন কাটিয়েও সাহিত্যে সেই দুঃখের প্রকাশে কোথাও অব্যাকুল হয়ে ওঠেননি। অশ্রুর অন্তরালে হাস্যের ছটা যে কোন পাঠকের হৃদয়কে আকর্ষণ করে।
- মানবতাবাদী ল্যাম্ব-এর শিল্পীসত্তা নিয়োজিত ছিল মানুষের কল্যাণে। তাই তাঁর সাহিত্যে মানুষই শেষ কথা। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, শিশুদের প্রতি তার সহানুভূতি ও দরদ তাঁর রচনাগুলিকে দিয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা।
- তাঁর রোমান্টিক সত্তা মানুষের জীবন, পথ-ঘাট, কুটির-প্রাসাদ প্রভৃতির মধ্যে ঘুরে ফিরে বেড়িয়েছে। তার কল্পনাবিলাসী মন অতীতের বিশেষ করে মধ্যযুগের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। এদিক থেকে তিনি বর্তমান বিমুখ ও অতীতচারী। আসলে বর্তমানের যন্ত্রণা তাঁকে নিয়ে গেছে অতীতের ঐতিহ্যময় স্মৃতিভাণ্ডারে।
- ল্যাম্ব-এর সাহিত্যের অন্যতম উপাদান হল হিউমার বা বিশুদ্ধ হাসি। এই হিউমার সম্বন্ধে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—“ল্যাম্বের humour বা মর্মোদ্ভিন্ন রসদৃষ্টির দ্বারাই এই অসাধ্যসাধন সম্ভব হইয়াছে। তিনি জীবন বাদ্যযন্ত্র হইতে লঘু অঙ্গুলি চালনায় যে বিচিত্র সুর-লহরী তুলিয়াছেন তাহা হিউমারের অন্তরশায়ী, সর্বব্যাপী অনুরণনে এক অখণ্ড তাৎর্যময় সঙ্গীত মূর্ছনায় মিলিত হইয়াছে। তাঁহার হেলায় ছড়ান চিন্তা-ভাবনারাশি তাঁহার খেয়ালী মেজাজের নানা বর্ণের আলপনা, তাহার কঠিন বাস্তব দৃশ্য ও তা মধ্যে স্বপ্নসঞ্চরণ—সমস্তই এই জীবন-রসিকতার মধ্যবর্তিতায় এক অপূর্ব জীবনভাষ্যরূপে আমাদের দিকই প্রতিভাত হয়।’’
- প্রাবন্ধিক হিসেবেই ল্যাম্বের কৃতিত্ব সর্বাধিক। তাঁর প্রবন্ধ ব্যক্তিগত প্রবন্ধের তালিকা অনবদ্য সংযোজন। আত্মনিষ্ঠ ভাব ও ভাবনার জন্য তাঁর প্রবন্ধ হয়ে উঠেছে গীতিধর্মী। প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে বাগবৈদগ্ধ্য যা শাণিত তরবারির মতো উজ্জ্বল।
- সমালোচক হিসেবে ল্যাম্ব ছিলেন রসাস্বাদনপন্থী। শিল্পীর কাছে শিল্পের অখণ্ড সত্য ও রস—এই তিন উপাদানই প্রধান বিবেচ্য।
চার্লস ল্যাম্ব ও বাংলা সাহিত্য
ব্যক্তিগত প্রবন্ধের ক্ষেত্রে চার্লস ল্যাম্বের প্রভাব বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে দুর্লক্ষ্য নয়। বিদ্যাসাগরের প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থে ম্যাথু আর্নল্ডের প্রভাব বেশি হলেও চার্লস ল্যাম্বের প্রভাব থাকতে পারে। উভয়ের রচনায় যে প্রসাদগুণ লক্ষ করা যায় তাতে এই প্রভাবের কথা বলা যেতে পারে। বিশেষ করে অতীতচারী মানসিকতা দুই প্রাবন্ধিকের ছিল। ‘শকুন্তলা’ ও ‘সীতার বনবাস’ গ্রন্থে ভাব ও ভাষার ক্ষেত্রে ল্যাম্বের সাদৃশ্য রয়েছে।
প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাচার নক্শা’ গ্রন্থে সাধারণ মানুষের জীবন চিত্রণে যে প্রচ্ছন্ন বেদনার ভাব রয়েছে তার সঙ্গে ল্যাম্বের প্রবন্ধের সাদৃশ্য রয়েছে।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থ যদিও অবিস্মরণীয় সৃষ্টি, তবুও চার্লস ল্যাম্বের আদর্শ তিনি গ্রহণ করে থাকতে পারেন। কেননা ল্যাম্ব ও এলিয়া এবং কমলাকান্ত ও বঙ্কিমচন্দ্র অভিন্ন সত্তারূপে কল্পিত।
মধ্য যুগের অন্যতম কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর স্বভাবধর্মের সঙ্গে ল্যাম্বের মানসিকতার সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। উভয়ে জীবনে দুঃখ পেলেও দুঃখকে বড় করে দেখেননি; বরং দুঃখ-সুখ উত্তীর্ণ এক সামগ্রিক জীবনকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। দুঃখের কথা বলার সময় হয়ত পকেট থেকে রুমাল বের করে তাঁরা চোখের জল মুছছিলেন কিন্তু চোখের জলে তাঁদের কাব্য উপাদান রসা হয়ে ওঠেনি। জীবনরসরসিক শিল্পীর ধর্ম-ই তাই। এদিক থেকে ল্যাম্ব ও মুকুন্দ চক্রবর্তী শিল্পীসত্তায় সমধর্মী। পার্থক্য শুধু মধ্য যুগ ও আধুনিক যুগের মানসিকতায়, তা না হলে কথাবস্তু এক। বৈসাদৃশ্য যেটুকু আছে তা ফর্মে, কন্টেন্টে নয়। ল্যাম্বের ‘ড্রিম চিলড্রেন’ বা ‘দি সুপার অ্যানুয়েটেড ম্যান’। এ যে হিউমার তা কবিকঙ্কণের মধ্যে দুর্লক্ষ্য নয়। তাই ‘পশুদের দুঃখ নিবেদন’ অংশে হিউমারের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে রয়েছে বেদনার অশ্রু—‘চারিপুত্র মৈল মোর মৈল চার ঝি। বুড়াকালে মাগু মৈল জিয়া কাজ কি।’’
তথ্যসূত্র:
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস | Download |
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দার | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকার | Download |
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্য | Download |
Leave a Reply