উপনিবেশবাদ সম্পর্কে আলোচনা কর।
উপনিবেশবাদ (Colonialism)
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আর একটু নির্দিষ্ট করে বলতে হলে ১৮৭০ সাল থেকে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের (১৯১৪) অন্তর্বতী সময়ে পশ্চিমের ধনতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য এক তীব্র রেষারেষি লক্ষ করা যায়। অল্প সময়ের মধ্যেই আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার তখন পর্যন্ত অনধিকৃত স্বাধীন দেশে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের আধিপত্য স্থাপিত হয়। এ যুগের উপনিবেশ বিস্তারকে উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ আখ্যা দেওয়া হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় এই উপনিবেশবাদ সাম্রাজ্যবাদ।
উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ কথা দুটি সমার্থক। একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। উপনিবেশের (প্রান্ত periphery) দিক থেকে যা উপনিবেশবাদ, ওপনিবেশিক দেশের (মাতৃভূমি, metropolis, Centre, core) দিক থেকে তাই সাম্রাজ্যবাদ। আমাদের আলোচনায় উপনিবেশবাদ কথাটিই বেশি করে ব্যবহার করা হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদ সম্বন্ধে সাধারণ ধারণাগুলিকে ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন চমৎকার করে ব্যাখ্যা করেছেন (David Thompson, Europe since Napoleon। তিনি বলেছেন যে ১৮১৫ সালের আগে প্রায় চারশত বছর পৃথিবী নিরবচ্ছিন ইউরোগায় সাম্রাজ্যবাদকে প্রত্যক্ষ করেছে। এই সাম্রাজ্যবাদের অর্থ হল অন্যান্য মহাদেশগুলির ওপর ইউরাগীয় শক্তিগুলির ক্রম সন্প্রসারণশীল বিস্তার। এই বাহ্যিক বিস্তারই সান্রাজাবাদ। স্পেনীয়, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসী ও ব্রিটিশ ওপনিবেশিক সাম্রাজ্য একটার পর একটা চার শতাব্দী ধরে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই যে অ-ইউরোপীয় দেশের মাটিতে ইউরোগীয় শক্তিগুলির দখল ও নিয়ন্ত্রণ তার নানা রূপ ছিল—ব্যাবসা-বাণিজ্য, ধর্মপ্রচার, আ্যাডভেথ্গার বসতিবিস্তার, লুটতরাজ, জাতীয় অহংকার জনিত তাড়না, রাজ্যজয়, যুদ্ধ ইত্যাদি (এর সঙ্গে আমরা যোগ করতে পারি দাসব্যবসা—মানুষকে দাসত্বে বীধবার আকাঙ্ক্ষা)। ওপরে যে দেশের তালিকা দেওয়া হল তার দ্বারা সামুদ্রিক শক্তিগুলির সন্প্রসারণশীলতার অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার বিষয়টি জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর দ্বারা এ বোঝায় না যে যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হতে হলে শুধু সমুদ্রই পার হতে হবে। স্থলভাগ অতিক্রম করলে চলবে না। হ্যাপসবুর্গ ও অটোম্যান তুর্কীদের বিরাট বংশভিত্তিক সাম্রাজ্য (dynastic empires),জার্মানদের বসতি ও বাণিজ্যের খোঁজে পূর্বদিকে বিস্তারের প্রথাগত অভ্যাস, নেপোলিয়নের মহাদেশীয় সান্রাজ্য, উনিশ শতকে রাশিয়ার দ্রুত দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় বিস্তার। এমনকি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম দিকে বিস্তার সমুদ্র পার না হয়েও মহাদেশীয় স্থলপথে সান্রাজ্য বিস্তারের নজির। অতএব ১৮৭০ সালে (বা তার আগে পরে সামান্য সময়ে) ইউরোপীয় শক্তিগুলির পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল দখলের প্রচেষ্টার মধ্যে কোন অভিনবত্ব ছিল না। তা সত্ত্বেও “সাম্রাজ্যবাদ” (imperialism) কথাটা উনিশ শতকের মধ্যভাগেই অবিকৃত হয়েছিল। ১৮৭০ সালের পরবতী প্রজন্মের সময়কালকেই “সাম্রাজ্যবাদের যুগ” (‘Age of Imperialism’) বলা হয়।
উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের একটি অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দেন দাদাভাই নৌরজী, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ ভারতীয় মনীষীগণ। তারা দেখিয়েছেন ভারতীয় উপনিবেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ইংলন্ডে রপ্তানি হয় অথচ পরিবর্তে ভারতবর্ষের সমানুপাতিক কোন ফললাভ হয় না। ভারত শাসনের জন্য ইংলন্ডে ব্যায়, ব্রিটিশ কর্মচারিদের ভাতা ও পেনসন, ভারতে নিয়োজিত ব্রিটিশ মূলধনের মুনাফা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ সম্পদ ভারতবর্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত
হয়ে ইংলন্ডে সঞ্চিত হত। সামাজিক উদ্ৃত্ত উপনিবেশের উন্নয়নে বিনিয়োগ না করে মাতৃভূমিতে (metropolis) সঞ্চিত হত অথবা বিনিয়োগ করা হত। একে তারা বলেছেন সম্পদের বহির্নিষ্কাষণ (Drain of wealth)। এটি সাম্রাজ্যবাদের একটি অর্থনৈতিক ফল।
মার্কস এঙ্গেলস উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সবিস্তারে ভাষ্য সম্বলিত কোন তত লিখে যান নি, যদিও তাদের লেখায় ইংলান্ডের উপনিবেশ, আয়ারল্যান্ডের শোষণের উল্লেখ আছে। মার্কস্ এর মূলধনীতত্তের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে জে. এ. হবসন, লেনিন প্রভৃতি চিন্তাবিদরা সাম্রাজ্যবাদের তত্ব খাড়া করেছেন। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ হবসন (J. A. Hobson) তার ১৯০২ সালে প্রকাশিত ‘Imperialism: A study’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে সাম্রাজ্যবাদের উদ্তবের জন্যা ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অন্যান্য যে কারণই থাক না কেন মূল প্রেরণা এসেছিল পশ্চিমের উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলির উদৃত্ত পুঁজির বিনিয়োগের তাগিদ থেকে। মার্কসের ব্যাখ্যা অনুসরণ করে তিনি দেখিয়েছেন পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে অতিরক্ত মুনাফার জন্য বিনিয়োগ করা। বেশী বেশী মুনাফার জন্য পুঁজিপতিদের চাহিদা ছিল সস্তায় কাচামাল সংগ্রহ, শিল্পজাত পণ্যের বাজার ও মূলধন ল্মী করার নতুন নতুন ক্ষেত্র। উপনিবেশ বিস্তারের দ্বারাই এই সব চাহিদা মেটানো সম্ভব। এইভাবে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব।
হবসনের তত্ত্বকেই আরও সম্প্রসারিত করে লেনিন ১৯১৬ সালে ‘Imperialism: The Highest Stage of Capitalism’ নামক পুস্তিকা প্রকাশ করেন। হবসনের মতই তিনিও ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলির বহির্বিশ্বে মূলধন বিনিয়োগের তাগিদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পুঁজিবাদী শ্রেণী কখনই তাদের উদ্বৃত্ত মলধন নিজের দেশের সাধারণ লোকের মান উন্নয়নের জন্য ব্যয় করে না—সেক্ষেত্রে তাদের মুনাফা কমে যাবে। অন্যদিকে সাধারণ লোকের ক্রয় ক্ষমতা যথেষ্ট না থাক (কৃষির আয়ের স্বল্পতার জন্য) নিজের দেশেও বিক্রি করতে পারে না। উনিশ শতকের শেষ পর্বে ইউরোপের অন্য দেশেও শিল্প বিপ্লবের অগ্রগতির জন্য শিল্পপণ্যের বাজার এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে এসেছিল। ফলে যথেষ্ট মুনাফা সঞ্চয়ের তাগিদে অনুন্নত দেশে পুঁজি বিনিয়োগের তাগিদ দেখা দেয়। এইভাবে উপনিবেশের বিস্তার ঘটে। লেনিন শিল্পে নিযুক্ত পুঁজির বদলে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে মূলধনী পুঁজির ওপর। তার প্রতিপাদ্য বিষয় হল পুঁজিবাদই চূড়ান্ত রূপ পায় সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে। মূলধনীরা উদৃত্ত মূল্যের বুনিয়াদ রক্ষা করতে উদৃত্তমূল্যের ভগ্নাংশ খরচ করে নিজের দেশের শ্রমিকদের মধ্যে একটা অভিজাত শ্রেণী গড়ে তোলে এবং তাদের দিয়ে শ্রমিকদের বাকী অংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এইভাবে শ্রমিক শ্রেণীকেও উপনিবেশ বিস্তারের শরিক করে নেয়।
উপনিবেশবাদের বৈশিষ্ট্য
ওপরের আলোচনায় উপনিবেশবাদের যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গেছে তাকে নিম্নলিখিত যুক্তিনির্ভর সোপানে সাজানো যায়—
প্রথমত, উপনিবেশগুলি বিশ্ব ধনতান্ত্রিকক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। অবশ্য বিশ্ব ধনতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হলেও উপনিবেশের অর্থনীতি ও সমাজ মাতৃভূমির (metropolis) অর্থনীতি সমাজের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। অর্থাৎ মাতৃভূমির স্বার্থেই উপনিবেশের অর্থনীতি ও সমাজ নিয়ন্ত্রিত হত। মাতৃভূমির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উপবিবেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন হয়।
দ্বিতীয়ত, উপনিবেশিক দেশ (metropolis) এর স্বার্থেই উপনিবেশ কৃষি ও খনিজ দ্রব্য উৎপাদন করা হয়। নিজের দেশে শিল্পের সঙ্গে এই সব প্রাথমিক দ্রব্যের কোন যোগ ছিল না।
তৃতীয়ত, উপনিবেশ এবং উপনিবেশিক দেশের মধ্যে বাণিজ্য সব সময়ই অসম ছিল এবং মাতৃভূমির (metropolis) অনুকূলে ছিল। এই ভাবে প্রচুর সম্পদ উপনিবেশ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে মাতৃভূমিতে চলে আসত।
চতুর্থত, উপনিবেশগুলির ওপর উপনিবেশিক রাষ্ট্র বা মাতৃভূমির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকত।
উপনিবেশ বিস্তারের বিভিন্ন পর্যায়: উপনিবেশ বিস্তারের ইতিহাসকে সাধারণভাবে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। পর্যায়গুলি কালানুক্রমিক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে একাধিক পর্যায়ের সহাবস্থান লক্ষ করা যায়। আবার কোথাও কোথাও সব পর্যায়ের অবস্থান নাও থাকতে পারে। মাতৃভূমির নিজন্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর ওপর পরিবর্তনের পর্যায় নির্ভর করে। উপনিবেশের নিজস্ব ঐতিহাসিক অবস্থান ও পর্যায় নির্দিষ্ট করে।
(ক) প্রথম পর্যায়:- এই সময়ে উপনিবেশ থেকে পণ্য কিনে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করা হত। অন্য ইউরোপীয় কোম্পানীগুলিকে প্রতিযোগিতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই সময়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। উপনিবেশের বাজারে ইউরোপীয় পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা না থাকায় এবং সে যুগের বাণিজ্যিক তত্ত্ব অনুসারে বিদেশে সোনা রূপো রপ্তানিতে অনিচ্ছা থাকায় উপনিবেশেই রাজস্ব ও কর সংগ্রহ করে উপনিবেশের পণ্য কেনা হত। এই পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সুযোগ নিয়ে উপনিবেশে উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করা হত। প্রাথমিক পর্যায়ে উপনিবেশের রাষ্ট্র কাঠামো বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা ও ধর্মে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন দেখা দেয়নি। ব্যাবসার মাধ্যমে সামাজিক উদ্বৃত্ত আহরণের জন্য এই ধরণের হস্তক্ষেপের দরকার ছিল না।
(খ) দ্বিতীয় পর্যায়:- উপনিবেশকদের দ্বিতীয় পর্যায় হল অবাধ বাণিজ্যের যুগ। উনিশ শতকের শুরুতে ব্রিটেনে বাণিজ্যিক পুঁজি শিল্পপুঁজিতে উত্তরণ ঘটে। নতুন শিল্প পুঁজিবাদীরা উপনিবেশ থেকে বেশি করে কর বা শুল্ক আদায় করে অথবা লুষ্ঠন করে বাণিজ্যিক সুবিধাভোগের বিরোধী ছিল। তারা চাইত মাতৃভূমির শিল্পজাত দ্রব্য উপনিবেশে বিক্রি করতে এবং সেখান থেকে সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে। বাণিজ্যের ওপর বাধা নিষেধ (Tariff) উঠে গেলে তাদের পক্ষে শিল্পজাত পণ্য সস্তায় উপনিবেশে বিক্রি করা সহজ হবে। কেননা উপনিবেশের কুটির শিল্পজাত দ্রব্যপণ্য কখনই তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দীড়াতে পারতো না। এইভাবেই ভারত বস্ত্র রপ্তানিকারী দেশ থেকে উনিশ শতকে বস্ত্র আমদানিকারী দেশে পরিণত হয়। ভারতে অবশিল্পায়ন (deindustrialization) ঘটে। কারিগররা হয় জমিতে ফিরে গিয়ে কৃষি নির্ভর হয়ে পড়ে নতুবা কাজের ও খাদ্যের অভাবে মারা যায়। ভারতের প্রধান প্রধান শিল্পকেন্দ্রগুলির যেমন ঢাকা, সুরাট, মুর্শিদাবাদের দ্রুত অবক্ষয় হয়। কাঁচামালের জন্য অন্য কোন দেশের ওপর নির্ভর করতে না হয়। এই সময়ে কৃষিতে বাণিজ্যিক পণ্যে যেমন নীল, আফিম ইত্যাদিতে এবং আরও বিশেষ করে বাগিচা শিল্পে চা, কফি, রবার, ইত্যাদি পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়। শাসনব্যবস্থা, বিচারবিভাগ, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটানো হয়। মাতৃভূমিতে উৎপন্ন শিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদা বাড়াতে আধুনিকীকরণ ও পাশ্চাত্যকরণের উপর জোর দেওয়া হয়। দূর দূর অঞ্চল থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে ও শিল্পজাত দ্রব্য পৌছে দিতে রেললাইনের প্রবর্তন করা হয়। এ যুগের মূল মন্ত্র ছিল উদারনৈতিক সান্রাজাবাদ। পুরানো শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হতে থাকে। এমন কথাও বলা হতে থাকে যে ভবিষ্যতে উপনিবেশগুলি স্বাধীনতা পাবে এবং পূর্বাতন উপনিবেশ ও উপনিবেশিক রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক লাভজনক বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
(গ) তৃতীয় পর্যায়:- উনিশ শতকের শেষ পর্বে বিশ্ব ধনতন্ত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে দ্রুত শিল্পায়ন ঘটে। পৃথিবীর বাজারে ব্রিটেনের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান হয়। ইউরোপে শিল্পজাত পণ্যের বাজারের সঙ্কোচন হয়। অন্যদিকে ধনতান্ত্রিক পুঁজিপতিদের হাতে প্রচুর বিনিয়োগযোগ্য মূলধন সঞ্চিত হয়। ফলে নতুন নতুন একচেটিয়া বিনিয়োগ ক্ষেত্র ও তৎসংলগ্ন প্রভাব মণ্ডল (deindustrialization) খুঁজে বার করার চেষ্টা হয়।
উপনিবেশগুলির ওপর এই সময় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কঠোর করা হয়। আমলাতন্ত্র কর্তৃত্ব দৃঢ় করা হয় যাতে মাতৃভূমির পুঁজি বিনিয়োগের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায়। স্বায়ত্ত শাসনের কথা আর শোনা যায় না। বরং প্রজ্ঞহিতৈষী স্বৈরাচারের কথা বলা হয়। উপনিবেশের অধিবাসীরা যেন মাতৃভূমি রাষ্ট্রের সন্তান—তাদের সুখ দুঃখ দেখার দায়িত্ব মাতৃভূমির রাষ্ট্রেরই হাতে।
উপনিবেশবাদীর ক্রয় ক্ষমতা সীমিত থাকায় সেখানে শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগের বিশেষ সম্ভাবনা ছিল না। কোন মৌল শিল্পে লগ্বীকরণ করা হয়নি—কেবল সেই সব শিল্পের বিকাশ হয় সেগুলির বিদেশে বাজার ছিল। ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ও রাজনৈতিক দমনের মুখে উপনিবেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন দানা বাধতে থাকে।
উপনিবেশবাদের প্রকারভেদ
১. প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদ
প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদ সেইসব উপনিবেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেখানে উপনিবেশিক রাষ্ট্রের (metropolis) পুরোপুরি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইংলন্ড, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল-এর পুরানো উপনিবেশগুলি উনিশ শতকে স্থাপিত আফ্রিকায় উপনিবেশগুলি এবং ফ্রান্স অধিকৃত ইন্দোচীন এবং ওলন্দাজ অধিকৃত ইন্দোনেশিয়া প্রত্যক্ষ উপনিবেশের উদাহরণ। সব চাইতে ভাল উদাহরণ ভারতবর্ষ। এখানে উপনিবেশবাদের সব বৈশিষ্ট্য ও পর্যায়গুলিই উপস্থিত ছিল। প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদের ব্যতিক্রমী উদাহরণ মিশর। আপাত দৃষ্টিতে মিশর ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ। এখানকার শাসক ছিলেন খেদিভ। কিন্তু খেদিভের ওপর ইংল্যন্ডের পুরোপুরি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। সুয়েজখাল আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের জন্য খুলে দিলে (১৮৬৯) এবং উনিশ শতকে ছয়ের দশকে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে মিশরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দুটি উৎস তুলো চাষ ও সুয়েজখালের রাজস্ব ইংল্যান্ডের পুঁজিপতিবাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৮৮২ সালে মিশরকে ইংল্যন্ডের অধীন রাজ্য (protectorate) বলে যোষণা করা হয়।
২. পরোক্ষ উপনিবেশবাদ
পরোক্ষ উপনিবেশে স্থানীয় শাসকদের রাজনৈতিক অধিকার বজায় থকে, কিন্তু অর্থনৈতিক অধিকার উপনিবেশিক দেশের হাতে চলে যায়। সান্রাজ্যবাদীরা অনেক সময় এসব দেশে নিজেদের “একচেটিয়া প্রভাব এলাকা স্থাপন করে স্বদেশের পুঁজিপতিদের পরিবহন, শিল্প, খনি, বাগিচা অথবা ব্যাঙ্কিং এ মূলধন বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়। পরোক্ষ উপনিবেশ স্থানীয় শাসকরা যত দুর্বল ও অপদার্থ ই হোক না কেন তাদের শাসন টিকিয়ে রাখা হয় কারণ পরোক্ষ উপনিবেশে প্রত্যক্ষ উপনিবেশের চেয়ে ব্যয় সাশ্রয়কারী (Cost effective)। পরোক্ষ উপনিবেশবাদ প্রধানত পৃথিবীর চারটি দেশে কায়েম হতে দেখা যায়—চীন, অটোমান সাম্রাজ্য, ল্যাটিন আমেরিকা ও ইয়ানে। চীন ও অটোমান সাম্রাজ্যের কথা একটু পরে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আপনি ল্যাটিন আমেরিকা ও ইরানের কথা সংক্ষেপে জেনে নিন।
মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশ নিয়ে ল্যাটিন আমেরিকা। উনিশ শতকের প্রথম দুই দশকে স্পেন ৰা পর্তুগালের কাছ থেকে এরা স্বাধীনতা লাভ করে। তখন দেশগুলির সংখ্যা ছিল নয়। পরে সীমান্ত পরিবর্তন করে এদের সংখ্যা হয় কুড়ি। ইতিহাসের পরিহাস যে এরা যে মুহূর্তে স্বাধীনতা লাভ করেছিল সে মুহূর্ত থেকেই নতুন সাম্রাজ্যবাদ এদের ওপর জগদ্দলের মত চেপে বসে। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে কাছের শিল্পোনত দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই মনরো নীতির (১৮২৩) দ্বারা ঘোষণা করে যে সে আমেরিকা মহাদেশে ইউরোগীয় দেশগুলির নতুন করে সান্রাজ্যবিস্তারে বাধা দেবে। আমেরিকা নিজেই কিছুদিন আগে (১৭৭৬) ইংলন্ডের উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল। ফলে তার পক্ষে অল্প সময়ের ব্যবধানে অন্যদেশে প্রত্যক্ষ উপনিবেশ স্থাপন করা দৃষ্টিকটু হত। ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি ছিল খনিজ (সোনা, লোহা, ফসফেট, প্লাটিনাম, তেজস্ক্রিয় advocative ধাতু ইত্যাদি) এবং কৃষিজ (আখ, কফি ইত্যাদি) সম্পদে সমৃদ্ধ। কিছু স্থানীয় সহযোগী ব্যক্তির সাহায্যে (Compradors)মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূলধনী শ্রেণী দক্ষিণ আমেরিকার খনি ও কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং রেলপথ স্থাপন করে এ সমস্ত সম্পদ আহরণ করতে থাকে। এইভাবে ল্যাটিন আমেরিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ উপনিবেশ স্থাপিত হয়।
উপনিবেশ বিস্তারের ধারা
আপনারা হবসন ও লেনিনের দেওয়া উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে পড়েছেন। এসব অভিমাত গুরুত্বপূর্ণ হলেও উপনিবেশ বিস্তারের সম্পূর্ণ কারণ বলে অনেকেই মনে করেন না। শিল্পের জন্য কীচামাল সংগ্রহ, শিল্পজাত পণ্যের বাজার বা উদ্বৃত্ত পুঁজির বিনিয়োগের তাগিদই যদি উপনিবেশ বিস্তারের কারণ হয় মনোভাব পোষণ করত। এ শতকের একটু আগে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আ্যাডাম স্মিথ আমেরিকার তেরোটি উপনিবেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তীর যুক্তি হল তথাকথিত সুবিধার চেয়ে উপনিবেশের বোঝা অনেক ভারী। বেস্থাম ফ্রান্সকে তার উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা দেবার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। কবডেন অবাধ বাণিজ্য ও সব বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধার অবসান চেয়েছিলেন। ১৮৬১ সালে ফ্রান্স অবাধ বাণিজ্যের জন্য তার উপনিবেশের সব দরজা খুলে দিয়েছিলেন। গ্লাডস্টোন আশা করেছিলেন ইংলন্ড তার উপনিবেশগুলিকে অচিরেই স্বাধীনতা দেবে। ডিসরেলিও অনেকদিন পর্যন্ত এইমত সমর্থন করেন। হবসন লেনিন ধনতান্ত্রিক উদৃত্ত মূলধনের যে যুক্তি দেখিয়েছেন, ডেভিড টমসন যাকে খণ্ডন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন ফ্রান্স, ইংলন্ড তাদের উদৃত্ত পুঁজি উপনিবেশে বিনিয়োগ না করে সিংহভাগই ইউরোপে বা আমেরিকায় বিনিয়োগ করেছে। ফ্রান্স রাশিয়াতে যে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল তার পরিমাণ ছিল অন্যান্য সমস্ত উপনিবেশে বিনিয়োগের তুলনায় দ্বিগুণ। ডেভিড টমসন তাই বলেছেন উপনিবেশ বিস্তারের পিছনে অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণের সহাবস্থান ছিল।
উনিশ শতকে সাতের দশক থেকে ইউরোপের অনেক দেশে বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ, দেশপ্রেমিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদরা ছোট ছোট গোষ্ঠী করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করার জন্য কোনো দেশ সাম্রাজ্যবাদী হবে কি না হবে আনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করত এসব গোষ্ঠীর তৎপরতার ওপর । এসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক ছিল না। বেলজিয়মে উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্বয়ং সেখানকার রাজা দ্বিতীয় লিয়পোল্ড। ইংলন্ডও জার্মানিতে রক্ষণশীল দল সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী ছিল। ইংলন্ডে চরমপন্থী মতাদর্শী যোশেফ চেম্বারলেন ও উদারপন্থী লর্ড রোজবেরী রক্ষণশীলদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন। ফ্রান্সের জুল ফেরী (Jules Ferry) এবং লিয় গামবেটার (Leon Gambetta)মত চরমপন্থী প্রজাতন্ত্রীরা সান্রাজ্য বিস্তারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ইটালিতে এসেছিলেন উদারপন্থী নেতা ডেপ্রেটিস (Depretis) এবং ফ্রান্সসেসকো ক্রিসপি (Francesco Crispi। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব নিয়েছিল সামরিক নেতা ও আমলা শ্রেণী।
উপনিবেশ বিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন স্কটল্যান্ডের অধিবাসী ডেভিড লিভিংস্টোন। লন্ডন মিশনারি সোসাইটি তাকে আফ্রিকা পাঠিয়েছিল। কিন্তু ধর্মপ্রচারের চেয়েও তার বেশি আগ্রহ ছিল বাণিজ্য বিস্তারে ও দুঃসাহসিক অভিযানে। নীল নদের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে তিনি কিছুদিনের জন্য পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন তাকে খুঁজে বার করতে পাঠানো হয়েছিল স্ট্যানলিকে। স্ট্যানলি তাকে ট্যাঙ্গানাইকা হুদের উপকূলে খুঁজে পান। ধর্মপ্রচারে ইংলন্ডের চেয়েও এগিয়ে ছিল ফ্রান্স। তৃতীয় প্রজাতন্ত্র সময় প্রায় চল্লিশ হাজার ফরাসি মিশনারি আফ্রিকা ও পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। তারা ধর্মপ্রচার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে উপনিবেশ বিস্তারেও সাহায্য করে। ফরাসি মিশনারী কার্ডিনাল লাভেজারী (Cardinal Lavegeri)আলজেরিয়ায় Society of African Mission গঠন করেন এবং আলজেরিয়া থেকে টিউনিসিয়ায় তার কর্মক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করেন। টিউনিসিয়ার ফরাসী আধিপত্য স্থাপনে তার ভূমিকা খুবই গুরুত্তপূর্ণ। চীনে দুজন জার্মান জেসুইট ধর্মপ্রচারক নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে জার্মানি ১৮৯৭ সালে কিয়াওচাও বন্দর দখল করে নেয়।
ইউরোপে উনিশ শতকের শেষ অর্ধে সামরিক সংঘাতের প্রবল সম্ভাবনা ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নৌরাটি স্থাপন করে সামরিক সুবিধা লাভের জন্যও উপনিবেশ বিস্তার প্রয়োজনীয় ছিল। তা ছাড়া উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার চাপ এড়াতে জার্মানি ও ইটালির ক্ষেত্রে) অথবা জনসংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য (ফ্রান্সের ক্ষেত্রে) বিভিন্ন দেশ উপনিবেশ বিস্তারে সক্রিয় হয়।
সব শেষে উপনিবেশ বিস্তারে দক্ষ প্রশাসন ও সৈনিকদের ভূমিকার উল্লেখ করতে হয়। তীরা আফ্রিকার বহুদেশে জটপাকানো প্রশাসনিক অবস্থা থেকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে মিশরে লর্ড ক্লোমার, দক্ষিণ আফ্রিকার লর্ড মিলনার এবং জার্মান পূর্ব আফ্রিকায় লর্ড পিটার্সের নাম উল্লেখযোগ্য। এই ধরনের মানুষ ছাড়া আফ্রিকায় ইউরোগীয় উপনিবেশগুলি সংহত করা অসম্ভব ছিল।
ওপরের আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে উনিশ শতকের শেষ অর্ধে উপনিবেশ বিস্তারের প্রেরণার উৎস ভিন্ন ভিন্ন রূপে বর্তমান ছিল। অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বা অন্য কোন একটি কারণে উপনিবেশ স্থাপিত হয়নি।
উপনিবেশ স্থাপনের নতুন প্রচেষ্টা
আপনার জানেন পনেরো শতকের শেষে ভৌগোলিক আবিষ্কারের পর (কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার, ১৪৯২, ভাস্কো-দা-গামার জলপথে ভারত আগমন, ১৪৯৮) বহির্বিশ্বে ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের সূচনা হয়। স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, ইংলম্ত, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ উপনিবেশ বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। এই সব উপনিবেশ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে প্রায় তিনশ বছর ধরে বিরোধ চলে। আঠারো শতকের শেষভাগে ইংলন্ড আমেরিকায় তার তেরোটি উপনিবেশ হারায়, ১৮১৫ সালে পর্তুগাল ব্রাজিল হারায়। এই সব ঘটনাকে ইউরোপীয় চিন্তাবিদরা অনেক ক্ষেত্রেই স্বাগত জানিয়েছিলেন। আপনারা ইতিমধ্যেই আ্যাডাম স্মিথ বা বেস্থামের মতামত জেনেছেন। আপনারা এও পড়েছেন যে উনিশ শতকের শেষ পর্বে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে ইউরোপের শিল্পোননত দেশগুলির মধ্যে উপনিবেশ বিস্তারের এক বিশেষ তাড়না দেখা যায়। ইতিহাসে এই সময়ের উপনিবেশ বিস্তারই উপনিবেশবাদ বা সান্রাজ্যবাদ নামে চিহিতি হয়েছে। এই সময় প্রধানত দুটি মহাদেশে এশিয়া ও আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। নীচে এই দুই অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপনের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল।
১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ার যুদ্ধে ফ্রান্স আলসেস লোরেন হারালে বিসমার্ক ফ্রান্সকে আলসেস লোরেন হারানোর ব্যথা ভুলানোর জন্য আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনে উপস্থাপিত করেন। ফ্রান্স আলজিরিয়া দখল করে এবং বিসমার্কের প্ররোচনায় টিউনিসিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ কমাতে এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বাড়াতে ইটালিও আফ্রিকার উত্তর উপকূলে উপনিবেশ স্থাপন করতে চেয়েছিল। সিসিলি থেকে টিউনিসিয়ার দূরত্ব ১০০ মাইলেরও কম। টিউনিসিয়ার ফ্রান্সের উপনিবেশ সম্প্রসারিত হলে ফ্রান্স ও ইটালির মধ্যে বিরোধ বাধে।
বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে অভ্যতন্তর অন্বেষণের জন্য একটি সমিতি গঠন করেন (International African Association) এবং স্ট্যানলিকে H. M. Stanley) কঙ্গো অঞ্চল অনুসন্ধানের জন্য পাঠান। কয়েক বছর অভিযান চালিয়ে স্ট্যানলি কঙ্গোর স্থানীয় শাসকদের সঙ্গে চুক্তি করে এ অঞ্চলের বিরাট এলাকায় বেলজিয়ামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। পনের শতক থেকেই কঙ্গো নদীর মোহনার কাছে আঙ্গোলায় পর্তুগালের একটা উপনিবেশ ছিল। পর্তুগাল ইংলন্ডের সহয়তায় বেলজিয়ামের উপনিবেশ বিস্তারের বিরোধিতা করে। ফ্রান্স কঙ্গো নদীর উত্তরে ত্রান্তীয় অঞ্চলে উপনিবেশ বিস্তারে আগ্রহী ছিল। জার্মানি চাইছিল আর একটু উত্তরে ক্যামেরুনে উপনিবেশ গড়তে। এই অবস্থায় লিওপোল্ড কঙ্গো সমস্যার সমাধানের জন্য জার্মানি ও ফ্রান্সের সহায়তা প্রার্থনা করেন। বিসমার্ক ও জুলেফেরীর ফ্রোনসের প্রধানমন্ত্রী) চেষ্টায় ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্লিনে ইউরোপের সবকটি প্রধান প্রধান দেশ এক আন্তর্জাতিক সমাবেশে মিলিত হয়। ১৮৮৫ সালে স্বাক্ষরিত বার্লিন চুক্তিতে লিওপোল্ডকে কঙ্গোয় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে ঘোষণা করা হয়। বার্লিন চুক্তি কেবল কঙ্গো সমস্যার সমাধানই নয়, ভবিষ্যতে আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্য কয়েকটি নীতি ঘোষণা করে। স্থির হয় ভবিষ্যতে ইউরোপের একটি রাষ্ট্র আফ্রিকার কোন অঞ্চল দখল করলে তা যথাযথভাবে অন্য রাষ্ট্রকে জানিয়ে দিতে হবে এবং সেই অঞ্চলটি তার প্রভাবাধীন এলাকা বলে স্বীকৃত হবে। বার্লিন সমাবেশে যে নীতি গৃহীত হয় তাতে আফ্রিকাকে শান্তিপূর্ণভাবে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রুলির মধ্যে বন্টন করে নেওয়ার সুযোগ এনে দেয়।
১৮৮৫ সালের পরের দশকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি আফ্রিকার অভ্যন্তর অনুসন্ধানের জন্য এবং সেখানকার সম্পদ আহরণের জন্য বেলজিয়ামের অনুকরণে চার্টার্ড কোম্পানি গঠন করে। কোম্পানিগুলি আফ্রিকার উপনিবেশ বিস্তারে পথিকৃৎ ছিল। জার্মানি দ্রুত টোগোল্যান্ড, ক্যামেরুণ, জার্মান দক্ষিণ আফ্রিকা ও জার্মান পূর্ব আফ্রিকা দখল করে দৃঢ়ভাবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ফ্রাস ইতিপূর্বেই আলজিরিয়া ও টিউনিসিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এখন ডাহোমি দখল করে এবং আলজিরিয়া থেকে অগ্রসর হয়ে সেনেগাল, সিনি, আইভরিকোষ্ট প্রভৃতি স্থান দখল করে পশ্চিম আফ্রিকায় এক বিরাট অখণ্ড সাম্রাজ্য গঠন করতে সক্ষম হয়। তাছাড়া কঙ্গোর উত্তরদিকে ফ্রান্স ফরাসী ক্রান্তীয় আফ্রিকা নামে উপনিবেশ স্থাপন করে। ১৮৮৬ সালে পূর্ব উপকূলে মাদাগাস্কার তার অধিকারে আসে এবং সোমালিল্যান্ডের এক অংশেও তার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৮১৫ সালে ভিয়েনা চুক্তিতে ব্রিটেন হল্যান্ডের কাছ থেকে আফ্রিকার কেপ অঞ্চল অধিকার করেছিল। এখন কেপ থেকে ধীরে ধীরে উত্তরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বেচুয়ানাল্যান্ড (১৮৮৫), রোডেসিয়া (১৮৮৯) এবং নিয়াদাল্যান্ড-এ (১৮৯৩) উপনিবেশ স্থাপন করে। এই ভাবে ভবিষ্যতে জার্মান পশ্চিম আফ্রিকা ও জার্মান পূর্ব-আফ্রিকার মিলনে বাধা সৃষ্টি করে। কেপ থেকে সিলি রোডসের ব্যক্তিগত চেষ্টায় ব্রিটেনের এই প্রসার সম্ভব হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় তখন ওলন্দাজ (ডোচ) উপনিবেশকারীদের বংশধর ‘বুয়ান’রা অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট এবং ট্রান্সভ্যাল এ দুটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তুলেছিল। ১৮৯৯ সালের বুয়ার্স যুদ্ধে ব্রিটেন বুয়ার্সদের হারিয়ে দিয়ে এই রাজ্য দুটি দখল করে। এছাড়া ব্রিটেন পশ্চিম উপকূলে নাইজেরিয়া এবং ব্রিটিশ পূর্ব আফ্রিকা ও উগান্ডা নামে দুটি উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।
ইতালির উপনিবেশ স্থাপনের আকাঙ্ক্ষার কথা আপনারা আগেই জেনেছেন। টিউনিসিয়া দখল করে নিয়ে ফ্রান্স ইতালির আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করেছিল। এখন ইটালি ইরিট্রিয়া দখল করে এবং এর সঙ্গে আনমারা যুক্ত করে ইতালীয় পূর্ব আফ্রিকা নামে এক বিশাল উপনিবেশ স্থাপন করে। তাছাড়া পূর্ব উপকূলে সোমালিল্যান্ডের এক অংশে তার দখলে এসেছিল। স্বাধীন আবিসিনিয়ার ওপরও ইটালি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৮৯৬ সালে আবিসিনিয়া ইতালিকে পরাজিত করলে ইটালি এই কর্তৃত্ব ত্যাগ করে।
১৮৭৫ সালে আফ্রিকার এক দশমাংশ অঞ্চলে ইউরোপীয় দেশগুলি উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। দুই দশক পরে ১৮৯৫ সালে আফ্রিকার কেবল এক দশমাংশ উপনিবেশ এলাকার বাইরে থাকে। আফ্রিকার বন্টন এত দ্রুত সম্পন্ন হয়েছিলযে উনিশ শতকের শেষে আফ্রিকায় মাত্র দুটি দেশ—আবিসিনিয়া ও লাইবেরিয়া স্বাধীনতা বজায় রাখতে পেরেছিল। আর তিনটি দেশ মরকৌ, লিবিয়া ও মিশর সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার শিকার হয়ে কোনভাবে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করে চলছিল।
ইউরোপের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ষোল শতকে। চীন পর্তুগীজ বণিকদের ম্যাকাও ছীপে বাণিজ্য করে অনুমতি দেয়। কিন্তু চীনের মাঞ্চুরাজারা বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য একেবারে পছন্দ করতেন না। তারা বলতেন বিশাল চীনদেশে পাওয়া যায় না এমন কিছুই নেই। চীনাদের বাইরের কোন দ্রব্যের প্রয়োজন নেই। মাঞ্চুরাজারা বৈদেশিক বাণিজ্যের পথে নানা প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করতেন। বিদেশের বাজারে টীনের সিক্ক, চা, কাগজ, সীমিত-বাণিজ্যের অধিকার দিয়েছিল। কিন্তু এই বাণিজ্য চীনা বণিকদের সঙ্গে স্থলপথে হত। শুল্ক ফাঁকি দেবে ভয়ে জলপথে নয়। চীনা রাজকর্মচারীরাও সরাসরি যুক্ত হতে পারতেন না। সম্রাটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে বিদেশীদের চৈনিক কায়দায় হাটু গেড়ে, মাটিতে কপাল স্পর্শ করে আবেদন জানাতে হত।
চীনের বিশালায়াতন বাজারের দিকে শিল্প বিপ্লুবোত্তর ইংলন্ডের স্বভাবতই লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। বাণিজ্যিক পুঁজিপতি ও শিল্প পুঁজিপতি উভয় ধরনের লোকের কাছেই চীনের রপ্তানী দ্রব্যের চাহিদা ছিল। কিন্তু চীনের কাছে বিদেশী দ্রব্যের কদর না থাকায় বিদেশী বণিকদের চীনা দ্রব্যের সোনা-রুপো দিয়ে দাম মেটাতে হত। ইংল্যান্ডের পক্ষে এত সোনা রুপো পাঠানো সম্ভব ছিল না। তাই ইংলন্ড ভারতে আফিম উৎপন্ন করে গোপনে চীনের বাজারে বিক্রি শুরু করে। ধীরে ধীরে চীনারা আফিম খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং প্রচুর আফিম চোরা পথে চীনে প্রবেশ করে। এবারে বিনিময়ে চীন থেকে প্রচুর রুপো ক্রমাগত বিদেশে চলে যেতে থাকে। চীনের আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয়। চীনা সম্রাট রাজকর্মচারী লিনকে বে-আইনি ব্যাবসা বন্ধ করার জন্য কান্টনে পাঠান (১৮৩৯)। লিন বন্দরের জাহাজের সব আফিম ধ্বংস করে ইংলন্ডের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে দেন ও ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সব কর্মচারীকে চীন থেকে তাড়িয়ে দেন। এই সময় ইংলন্ডের সরকার তাদের দেশের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখতে এগিয়ে আসে এবং চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ইতিহাসে এই যুদ্ধ প্রথম আফিম যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে চীন পরাজিত হলে নানকিং-এর সন্ধি (১৮৪২) স্বাক্ষরিত হয়। সন্ধির শর্ত অনুসারে চীন ইংরেজদের পাঁচটি বন্দরে ব্যাবসা করার অধিকার দেয় এবং হংকং ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। উপরন্ত মোটা আক্ষের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। ইংরেজদের দেখাদেখি ফ্রান্স ও আমেরিকা বাণিজ্যের সুবিধা দাবি করে। চীন ভয় পেয়ে নতুন করে বিরোধ এড়াতে ফ্রান্স ও আমেরিকাকে ইংলন্ডের অনুরূপ বাণিজ্যিক সুবিধা দেয়। চুক্তিতে বলা হয়েছিল শুক্কের হার পাঁচ শতাংশ হারে হবে এবং ভবিষ্যতে বাড়ানো যাবে না। চুক্তিগুলি অসম চুক্তি (unequal treaties)নামে পরিচিত। কেননা বিদেশীরা বাণিজ্য ছাড়াও অনেক বাড়তি সুবিধা পেয়েছিল। চীনের মাটিতে অপরাধ করলে বিদেশীদের চীনের আইন অনুসারে বা চীনের আদালতে বিচার হবে না। বিচার হবে অপরাধকারীর দেশের আইন অনুসারে এগুলি অতিরাষ্ট্রিক অধিকার extra-territorial rights)।চীনের সার্বভৌম ক্ষমতা খর্বিত হল। আফিম ব্যবসা বে আইনি ঘোষিত হলেও আফিম পাচার বন্ধ হয় নি। শুন্কহার নির্দিষ্ট হওয়ায় চীনের বাজার বিদেশী শিল্পপণ্যে ছেয়ে গেল। চীনের কুটির শিল্প ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকল এবং চীন আধা উপনিবেশে পরিণত হতে চলল।
চীনে আফিম আমদানি বে-আইনি ঘোষিত হলেও অস্ত্রসজ্জিত জাহাজে আফিম আমদানি হতেই থাকে। চীন ইংলন্ড ও ফ্রান্সের বাণিজ্যতরীকে বিশেষ নদীপথ ব্যবহার করতে বাধ্য করতে চাইলে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ শুরু হয় (১৮৫৮)। এক ফরাসী ক্যাথলিক পাদরী চীন বিরোধী কাজ করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ফ্রান্স এর প্রতিবাদ করে এবং ইংলন্ডের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করে। তিয়েনমিনের সন্ধিতে (১৮৬০) যুদ্ধ শেষ হলে চীন বিদেশীদের আরও এগারোটি বন্দর বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে, আমদানি করা বিদেশী দ্রব্যের ওপর শতকরা আড়াই (২৪৪) ভাগের বেশি শুল্ক বসবে না প্রতিশ্রুতি দেয় এবং বিদেশীরা চীনে অবাধ চলাফেরার অধিকার পায়। তাছাড়া চীনের ওপর ক্ষতিপূরণের বিরাট বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়।
মাঞ্চুরাজারা বুঝতে পেরেছিল রাজতন্ত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ এবং পশ্চিমী শিক্ষা ও প্রযুক্তি কৌশল আয়ন্তের প্রয়োজন আছে। তারা প্রশাসনিক সংস্কারে হাত দিল এবং পশ্চিমী শিক্ষার বিস্তার এবং আধুনিক শিল্প স্থাপন শুরু করল। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশীরাই শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করে। পুঁজিবাদী দেশগুলো বুঝতে পেরেছিল যে চীনের মত বিরাট দেশে প্রত্যক্ষ উপনিবেশ স্থাপনের চেয়ে দুর্বল রাজতন্ত্বকে টিকিয়ে রাখাই বেশী লাভজনক। ইংলন্ড, ফ্রান্সের পর রাশিয়া জার্মানি জাপান চীনে নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্যের এলাকা (sphere of influence)দখল করল। এইভাবে উনিশ শতকের শেষ দশকগুলিতে চীনা তরমুজ ভাগ করে নেওয়ার সময় এল। চীন পুঁজিবাদী দেশের পরোক্ষ উপনিবেশে পরিণত হল।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় কারণেই রাশিয়া সা্রাজ্য বিস্তারের পথ বেছে নেয়। বহির্বিশ্বে পৌছানোর জন্য রাশিয়ার চিরাচরিত নীতি ছিল দুর্বল তুরস্ক সাম্রাজ্যের কৃষ্ণসাগর তীরবততী রাজ্যগ্রাস করা। কিন্তু এই নীতি বাধাপ্রাপ্ত হয় ত্রিমিয়ার যুদ্ধে পরাজয়ে (১৮৫৬)। এরপর থেকে রাশিয়া মধ্য এশিয়া ও দুরপ্রাচ্যে রাজ্য বিস্তারে মন দেয়।
মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্তান নামেমাত্র চীন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তুর্কিস্তান থেকে যাযাবর দস্যুরা প্রায়ই রাশিয়ার সীমান্তবতী প্রদেশে লুটপাট করতে আসত। এদের শায়েস্তা করার জন্য রাশিয়া ১৮৬৪ সালে তাসখন্দ দখল করে। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সমরখন্দ ও খিভা দখল করে। এইভাবে সমস্ত তুর্কীস্তান রাশিয়ার অধিকারে চলে আসে (১৮৭৩)। মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার সাম্রাজ্য পারস্য ও আফগানিস্তানের সীমান্তে পৌছেযায়। ফলে ইংলন্ড ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।
আফিম যুদ্ধের পর পশ্চিমী দেশগুলি যখন পুব দিক থেকে চীনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছিল তখন রাশিয়া উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে চীনকে গ্রাস করতে এগিয়ে যায়। আমুর নদী বরাবর অগ্রসর হয়ে ১৮৬০ সালে রাশিয়া জাপান সাগর উপকূলে ভ্রাডিভস্টক দখল করে। নয়ের দশকেট্রান্সসাইবেরিয়ান রেলপথের নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে এ রেলপথ ভ্লাডিভস্টক পর্যন্ত সম্প্রসারিত করাহয়। ভ্লাডিভস্টক দূর প্রাচ্যে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে পরিণত হয়।
চীন-জাপান যুদ্ধে (১৮৯৪-৯৫) চীনকে পরাজিত করে জাপান একতরফাভাবে চীনের রাজ্য গ্রাস করতে থাকলে রাশিয়া ও ইংলন্ড যৌথভাবে প্রতিবাদ জানায় এবং রাশিয়া জাপানকে বঞ্চিত করে লিয়াওটাঙ উপদ্বীপ দখল করে। এখানকার বন্দর পেটি আর্থার নৌ-ঘাঁটি হিসাবে গড়ে ওঠে। লিয়াওটাঙ ছিনিয়ে নেওয়ায় এবং কোরিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় শঙ্কিত হয়ে জাপান রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। রুশ-জাপান যুদ্ধে (১৯০৫) রাশিয়া পরাজিত হয় এবং লিয়াওটাঙ উপদ্ধীপ জাপানকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। রাশিয়ার এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার এখানেই থেমে যায়। এশিয়ার বাইরে রাশিয়ার সাম্রাজ্য ছিল না। এশিয়ায় অধিকৃত অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাজার রাশিয়ার শিল্প বিকাশের সহায়ক হয়েছিল।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply