বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে এমারেল্ড থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।
এমারেল্ড থিয়েটার
৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিট, কলকাতা
উদ্বোধন: ৮ অক্টোবর, ১৮৮৭
স্থায়িত্বকাল: ৮ অক্টোবর, ১৮৮৭ – ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৬
প্রতিষ্ঠাতা: গোপাল লাল শীল
প্রথম নাটক: পাণ্ডব নির্বাসন (কেদার চৌধুরী)
৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটে মুখ রায় স্টার থিয়েটারের যে বাড়ি তৈরি করেন, গুর্মুখ রায় ছেড়ে দেবার পর সেই থিয়েটার পরবর্তী স্বত্বাধিকারীরা ভালোমত চালাতে না পারলে নিলামে ওঠে। ধনকুবের মতিলাল শীলের নাতি গোপাল লাল শীল থিয়েটার করতে সখ হওয়াতে থিয়েটার বাড়িটি কিনে নেন। স্টারের স্বত্বাধিকারীবৃন্দ বাড়িটি বেচলেও ‘স্টার’ নামের ‘গুডউইল’ বেচেননি। তারা ওই নামে হাতিবাগানে নতুন থিয়েটার খোলেন। আর পুরনো স্টার থিয়েটারের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হলো এমারেল্ড থিয়েটার।
গোপাল লাল বাড়িটি কিনে পুরো সংস্কার করান। প্রচুর খরচ করে ডায়নামো বসিয়ে ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা করেন। বাংলা রঙ্গালয়ে তখন গ্যাসের বাতি জ্বলছে। এমারেল্ডেই প্রথম বিজলি আলোর প্রবর্তন করা হয়। আলো ঝলমল চকচকে এই সাজানো গোছানো নাট্যশালার ম্যানেজার হলেন কেদার চৌধুরী। তিনি একাধারে ম্যানেজার, নাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে এখানে কাজ শুরু করেন। অভিনেতৃ দলে রইলেন—অর্ধেন্দুশেখর, ধর্মদাস সুর, রাধামাধব কর, মতিলাল সুর, মহেন্দ্রলাল বসু, ক্ষেত্ৰমণি, বনবিহারিণী, কিরণশশী প্রমুখ।
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ অক্টোবর এমারেল্ডের উদ্বোধন হল, কেদার চৌধুরীর লেখা ‘পাণ্ডব নির্বাসন’ নাটক দিয়ে। দৃশ্যপট ও সাজসজ্জার দায়িত্বে রইলেন জহরলাল ধর এবং সুকুমারী ও শশিভূষণ দেব।
একাধিকবার সাফল্যের সঙ্গে ‘পাণ্ডব নির্বাসন’ অভিনয়ের পর এখানে অভিনীত হল রবীন্দ্রনাথের নাটক। ১৮৮৭র ২৬ অক্টোবর ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘রাজা বসন্ত রায়’। কেদার চৌধুরীর এই নাট্যরূপ এর আগেই ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনয় করানো হয়েছিল (৩-৭-১৮৮৬)। এমারেল্ড কেদার চৌধুরী আবার রবীন্দ্রনাথের কাহিনীর নাট্যরূপটি অভিনয়ের ব্যবস্থা করলেন। মোটমুটি চললো। আবার অভিনীত হল ‘পাণ্ডব নির্বাসন’। তারপর আনন্দকানন, মদনভস্ম প্রভৃতি অভিনয়ের পর দেখা গেল এমারেল্ডের অবস্থা ভালো নয়।
গোপাল শীল তখন কেদার চৌধুরীর পরিবর্তে গিরিশচন্দ্রকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়ে আসার চেষ্টা করলেন। গিরিশ তখন নাট্যপরিচালক ও ম্যানেজার হিসেবে প্রচুর খ্যাতি পেয়েছেন। নাট্যকার হিসেবেও তাঁর নাটকগুলি জনসমাদর পাচ্ছিল। গিরিশকে এনে এমারেল্ডকে নতুন করে চালাবার চেষ্টা করলেন গোপাল লাল। গিরিশ প্রথমে সম্মত না হলেও, পরে স্টারের স্বত্বাধিকারীদের সঙ্গে আলোচনা করেই তিনি এমারেল্ডে যোগ দিলেন। স্টারে তখন অর্থসঙ্কট চলছে। গিরিশ এমারেল্ডে যোগ দিলেন ৫ বছরের চুক্তিতে, ২০ হাজার টাকার বোনাস এবং মাসিক ৩৫০ টাকা বেতন। বোনাসের টাকা থেকে তিনি ১৬ হাজার টাকা স্টারকে বিনাশর্তে দিয়ে দেন নতুন বাড়ি তৈরির জন্য। ১৯ নভেম্বর, ১৮৮৭ থেকে গিরিশ হলেন এমারেল্ডের ম্যানেজার।
‘নীলদর্পণ’ নাটক দিয়ে গিরিশ এখানে কাজ শুরু করলেন। তারপরে সীতার বনবাস। তারপর সীতাহরণ, দীনবন্ধুর নবীন তপস্বিনী, গিরিশের মায়াতরু। শেষের দুটি খুবই জনসমাদর লাভ করলো।
গিরিশ এমারেল্ডে যোগ দিয়েই রবীন্দ্রনাথ এবং কেদার চৌধুরীর পূর্ব অভিনীত নাটকগুলি বন্ধ করে দেন। গিরিশ যোগ দেওয়ার আগে এখানে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা বসন্ত রায়’ অভিনীত হয়েছিল। বেশ কয়েকবার। দায়িত্ব নেওয়ার দিনও (২০ নভেম্বর, ১৮৮৭) ‘রাজা বসন্ত রায়’ অভিনীত হয়েছিল। গিরিশ যতদিন এমারেল্ডে ছিলেন ততো দিন রবীন্দ্রনাথের এই নাট্যরূপটি বা অন্য কোনো নাটক অভিনীত হয়নি। আবার গিরিশ যেই চলে গেলেন (৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৯) তারপরেই ‘রাজা বসন্ত রায়’ এখানে অভিনীত হল (৭ এপ্রিল, ১৮৮৯), ‘রাজা ও রানী’ (৭ জুন, ১৮৯০), খ্যাতির বিড়ম্বনার পরিবর্তিত নাম ‘দোকড়ি দত্ত’ (৬ এপ্রিল, ১৮৯৫) এখানে সমাদরের সঙ্গে অভিনীত হয়। গিরিশ থাকাকালীন এমারেল্ড রবীন্দ্রনাথের কোনো নাটক আর অভিনীত হয়নি।
প্রতাপচাঁদ জহুরির ন্যাশনাল থিয়েটারে গিরিশ ‘দায়ে পড়ে’ নাটক লেখা শুরু করেছিলেন। এমারেল্ডে চাপে পড়ে গিরিশ তার নাট্যব্যক্তিসত্তায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন। নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা ও ম্যানেজারের চতুর্বিধ দায়িত্ব পালনে গিরিশের পেশাদারি কুশলতা তখন তাঁকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গেছে। গিরিশ ছাড়া কোন রঙ্গমঞ্চই তখন ভালোভাবে চলতে পারতো না। আবার গিরিশকে নিলে একজনের মাধ্যমেই মঞ্চে চাররকমের কার্যসমাধা হয়। ফলে সব মালিকই গিরিশকে পেতে আগ্রহী হয়ে পড়েছিল। তাঁকে অমান্য করার সাহস ছিল না।
এখানে গিরিশ ‘সীতার বনবাস’ অভিনয় করালেন। বঙ্কিমের মৃণালিনী উপন্যাসের নাট্যরূপ, এবং মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্যের নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করালেন। তারপর নিজের নাটক ‘পূর্ণচন্দ্র’ করলেন। এমারেল্ডের ভাগ্য ফিরে গেল। জনসমাগমে এমারেল্ড গমগম করতে লাগলো। এই সময়েই গিরিশের সঙ্গে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফিও এখানে যুক্ত হলেন। নবীন তপস্বিনীতে জলধরের ভূমিকায় অর্ধেন্দু আবার দর্শকদের মাতিয়ে দিলেন। মহাসমারোহে গিরিশের নেতৃত্বে এমারেল্ড চলতে লাগলো। দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ ও ‘জামাইবারিক’ ঘুরে ঘুরে অভিনয় হতে লাগল। মধুসূদনের প্রহসন দুটি ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ও ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’ অভিনীত হলো। বঙ্কিমের উপন্যাস আনন্দমঠ, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল—প্রভৃতির নাট্যরূপ অভিনয় করে বাংলা থিয়েটারে নতুন মাত্রা সঞ্চার করা হলো।
এমারেল্ডের এই রমরমা অবস্থার মধ্যেই গোপাল লালের থিয়েটারের শখ মিটে গেল। তিনি থিয়েটার ছেড়ে দিলেন। মতিলাল সুর, পণ্ডিত হরিভূষণ ভট্টাচার্য, পূর্ণচন্দ্র ঘোষ, ব্রজনাথ মিত্রকে থিয়েটার বাড়ি লিজ দিয়ে দিলেন, ৩ ফেব্রুয়ারী, ১৮৮৯।
অর্ধেন্দুশেখর আগেই এমারেল্ড ছেড়ে চলে যান (৩০-৯-১৮৮৮) এবং মতিলাল সুর সহকারী ম্যানেজার হিসেবে গিরিশের সঙ্গে কাজ করছিলেন। গোপাল লাল এই অবস্থায় তার থিয়েটার মতিলাল ও অন্যান্যদের লিজ দিয়ে চলে যান। এর ফলে গিরিশের সঙ্গে গোপাল লালের চুক্তি আর কার্যকরী রইলো না। গিরিশ আবার স্টারে যোগ দিলেন। গিরিশ এমারেন্ডে ছিলেন ১৯ নভেম্বর, ১৮৮৭ থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৯ পর্যন্ত। অর্ধেন্দুশেখর এই সময়ে (মার্চ, ১৮৮৯) আবার এমারেল্ডে যোগ দিয়ে ‘বক্রেশ্বর’ প্রহসনে বক্রেশ্বরের ভূমিকায় অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন।
দেখা গেল, নতুন মালিকেরাও এমারেল্ড ভালোভাবে চালাতে পারলেন না। অবস্থা আবার খারাপ। গোপাল লাল তার তৈরি থিয়েটারের দুরবস্থা সহ্য করতে না পেরে আবার এমারেল্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, ৮ এপ্রিল, ১৮৮৯ এবং ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত এখানে অভিনয় বন্ধ রাখলেন। রঙ্গমঞ্চের ভিতরকার এবং থিয়েটারের আর সব দিকের অবস্থা গুছিয়ে নিয়ে পুনরায় অভিনয় চালু করলেন। পরিচালক হিসেবে এবার যোগ দিলেন প্রবীণ নাট্যকার মনোমোহন বসু, ঐ ২৭ এপ্রিল থেকে। নাট্যকার হিসেবে অতুলকৃষ্ণ মিত্রও এমারেল্ডে যুক্ত ছিলেন। গিরিশের পর অতুলকৃষ্ণই মুখ্যত এমারেল্ডের নাট্যকার ছিলেন। কয়েকদিন বাদে, ৪ মে, কেদার চৌধুরীকে আবার ম্যানেজার করে আনা হলো। তবে কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি (৩ নভেম্বর) কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যান। অতুলকৃষ্ণ এরপর থেকে (১৭ জানুয়ারি, ১৮৯০) বিজনেস ম্যানেজার হিসেবে পাকাপাকিভাবে নিযুক্ত হলেন।
বোঝাই যায়, গিরিশ চলে যাওয়ার পর ছন্নছাড়া এমারেল্ডকে গোছাতে একটু সময় লাগলো। একা গিরিশের বদলে সেখানে নাট্যকার হিসেবে অতুল মিত্র, পরিচালক হিসেবে মনোমোহন এবং ম্যানেজার হিসেবে কেদার চৌধুরীকে রাখতে হলো। এবার পূর্ণোদ্যমে এমারেল্ড আবার চলতে লাগল। এবার গিরিশের বদলে অতুল মিত্রের নাটক ও প্রহসনগুলি অভিনীত হতে থাকলো। নন্দ বিদায়, গাধা ও তুমি, বকেশ্বর, গোপীগোষ্ঠ, ভাগের মা গঙ্গা পায় না প্রভৃতির অভিনয় হলো। তারপর মনোমোহন বসুর ‘রাসলীলা’ দিয়ে নবোদ্যমে এমারেল্ড চলতে লাগলো। ১৮৮৯ ভালভাবেই কেটে গেল এমারেল্ডের।
এমারেল্ডেই রবীন্দ্রনাথের লেখা নাটক ‘রাজা ও রানী’র প্রথম অভিনয় হয় ৭ জুন, ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে। রাজা বসন্ত রায় ও আগেই অভিনীত হয়েছিল। পরে (৬ এপ্রিল, ১৮৯৫) এখানে রবীন্দ্রনাথের প্রহসন খ্যাতির বিড়ম্বনা’র পরিবর্তিত নামে ‘দুকড়ি দত্ত’ বেশ সমাদরের সঙ্গে অভিনীত হয়।
এমারেন্ডে ১৮৮৭ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত অভিনয়ের সংক্ষিপ্ত তালিকা— ১৮৮৭-৮৮: পাণ্ডব নির্বাসন (কেদার চৌধুরী), রাজা বসন্ত রায় (বৌঠাকুরানীর হাট উপন্যাসের নাট্যরূপ: কেদার চৌধুরী), আনন্দকানন (লক্ষ্মীনারায়ণ চক্রবর্তী), সীতার বনবাস, সীতাহরণ, মায়াতরু, পূর্ণচন্দ্র, বিষাদ (সবগুলি গিরিশ), নীলদর্পণ (দীনবন্ধু), নবীন তপস্বিনী (দীনবন্ধু), বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা? (মধুসূদন), তুলসীলীলা, নন্দ বিদায়, গাধা ও তুমি (সবকটি অতুল মিত্র)। ১৮৮৯-৯০: বক্রেশ্বর, ভাগের মা গঙ্গা পায় না, ষণ্ড, বুড়ো বদর (সবগুলি অতুল মিত্র), আনন্দকুমার (পুলিশ এই নাটকটির অভিনয় কয়েক রাত্রির পর বন্ধ করে দেয়), নবীন তপস্বিনী (দীনবন্ধু), রাজা ও রানী (রবীন্দ্রনাথ)। এছাড়া এই কয় বছরে মেঘনাদবধের নাট্যরূপ (: গিরিশ), আনন্দমঠ উপন্যাসের নাট্যরূপ (:গিরিশ), মৃণালিনী উপন্যাসের নাট্যরূপ (: গিরিশ), বিষবৃক্ষ: নাট্যরূপ অতুল মিত্র), কপালকুণ্ডলা (:নাট্যরূপ অতুল মিত্র) এখানে অভিনীত হয়েছিল।
১৮৯০-এর পর থেকে এমারেল্ডের অবস্থা আবার খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পুরনো নাটকগুলির অভিনয়ের মাধ্যমে থিয়েটার আর অভিনয়ের ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়।
১৮৯৩-এর ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে অতুল মিত্র এবং মহেন্দ্রলালবাবু ‘লেসি’ হন। ধারদেনা করে তারাও অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। না পেরে শেষ পর্যন্ত অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফিকে ‘লেসি’ করা হয়। ম্যানেজার হন মতিলাল সুর। অর্ধেন্দুশেখর এবার নিজ মালিকানায় এমারেল্ড থিয়েটার চালাতে থাকেন।
১৮৯৪-এর ২২ সেপ্টেম্বর অতুল মিত্রের ‘মা’ অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই অর্ধেন্দুশেখর তথা এমারেল্ড থিয়েটার নতুনভাবে জেগে ওঠে। অর্ধেন্দুশেখর নিজেই নাট্যশিক্ষক ও অভিনেতা হিসেবে বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। তারই চেষ্টায় মৃতপ্রায় এমারেল্ড আবার জেগে ওঠে। তিনি শক্ত হাতে এই ভেঙ্গে-পড়া থিয়েটারকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা করেন। নিজ স্বত্বাধিকারিত্বে বেশ কয়েকমাস এমারেল্ড চালিয়েছিলেন। ‘মা’ দিয়ে শুরুর পর বৈকুণ্ঠনাথ বসুর ‘মান’ (৪ ডিসেম্বর, ১৮৯৪), রাজা বসন্ত রায় (জানুয়ারি, ১৮৯৫), আবু হোসেন (গিরিশ, জানুয়ারি, ১৮৯৫) এমারেল্ড রমরম করে চলতে থাকে। ‘অনুশীলন’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল—‘‘বাবু অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির প্রশংসা এই, তিনি প্রায় এই নতুন সম্প্রদায়কে এমন সুশিক্ষিত করিয়াছেন যে, কার সাধ্য নবশিক্ষিত সম্প্রদায় বলিয়া কল্পনাতেও আনিতে পারেন।’’
নাটক-পাগল অর্ধেন্দুশেখর নাট্যাভিনয় নিয়ে যত মাথা ঘামাতেন, থিয়েটার ব্যবসা তিনি কিছুই বুঝতেন না। ফলে অভিনয়গুলি প্রচুর দর্শক আকর্ষণ করলেও, শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতার অভাবে কিছুদিনের মধ্যেই এমারেল্ডের আর্থিক অনটন দেখা দিতে শুরু করলো। তখন নিরুপায় হয়ে এমারেল্ড থিয়েটারের মালিকানা হস্তান্তর করা হল বি. ডি. কোম্পানীর মালিক বেনারসী দাসকে। তিনি আর্থিক দায়িত্ব থেকে থিয়েটারকে বাঁচালেন। সেখানে ম্যানেজার ও নাট্যশিক্ষক ও অভিনেতা হয়ে কাজ চালাতে লাগলেন অর্ধেন্দুশেখর।
বেনারসী দাস মালিক হলেন ১০ নভেম্বর, ১৮৯৫ থেকে। সেদিন থেকে ‘কপালকুণ্ডলা’ অভিনয় শুরু হলো। এমারেল্ড আবার নবোদ্যমে চালু হলো। এই বছরে উল্লেখযোগ্য অভিনয় হলো—রমেশচন্দ্র দত্তের উপন্যাস ‘বঙ্গবিজেতা’র নাট্যরূপ (১৪ ডিসেম্বর), রবীন্দ্রনাথের ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’র পরিবর্তিত নাম ‘দুকড়ি দত্ত’, ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘ফুলশয্যা’, কপালকুণ্ডলার নাট্যরূপ ও অতুল মিত্রের পুরনো নাটক ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না’।
এমারেল্ডের শেষ অভিনয়: ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৬। নাটক কপালকুণ্ডলা ও ভাগের মা গঙ্গা পায় না। তারপর থেকেই এমারেল্ড থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। তারপরে এই থিয়েটার বাড়ি ভাড়া নিয়ে এখানে খোলা হয় ‘সিটি সম্প্রদায়’, ২০ জুন থেকে। ১৮৯৭-এর প্রথম দিকে সিটি থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্লাসিক থিয়েটার।
রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে এমারেল্ড থিয়েটারের অবদান
- বাংলা সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার পনেরো বছরের মধ্যেই এমারেল্ড থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। মালিকানাধীন এই থিয়েটার পেশাদার সাধারণ রঙ্গালয় হিসেবেই পরিচালিত হয়েছিল। ছিমছাম সুন্দর রঙ্গালয়, বিজলি আলোর ব্যবস্থা এবং ধারাবাহিক অভিনয়ের সূত্রে এমারেল্ড একটি উল্লেখযোগ্য নাট্যশালারূপে পরিগণিত হয়েছিল।
- যদিও মোটামুটি দশবছর এর আয়ুষ্কাল, তাহলেও এই মঞ্চে নাট্যকার হিসেবে কেদার চৌধুরী, গিরিশচন্দ্র, অতুলকৃষ্ণ মিত্র, মনোমোহন বসু যুক্ত থেকে নাটক রচনা করেছেন।
- এমারেল্ড থেকেই গিরিশচন্দ্র তাঁর অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক সত্তার পূর্ণ আবিষ্কার করেছিলেন। নাট্য রচয়িতা হিসেবেও নিজেকে অনেকখানি তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। ফলত হাতিবাগানের স্টারে ফিরে গিয়ে গিরিশ সম্ভাবনার দিকগুলিকেই পূর্ণ বিকশিত করে তুলতে পেরেছিলেন।
- এমারেল্ড মঞ্চেই বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ ঔপন্যাসিকদের প্রসিদ্ধ উপন্যাসগুলির নাট্যরূপ প্রায়শই অভিনীত হয়ে বাংলা নাটকের বিষয়ের বিস্তার ঘটিয়েছিল।
- এমারেল্ডই প্রথম সাহসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলি অভিনয়ের ব্যবস্থা করে। রাজা ও রানী, রাজা বসন্ত রায়, দুকড়ি দত্ত প্রমুখ নাটকে, নাট্যরূপ ও প্রহসনের অভিনয় বর হয়ে দর্শক রুচিতে ভিন্ন স্বাদের সঞ্চার করেছিল।
- গিরিশচন্দ্র, অর্ধেন্দুশেখর, কেদার চৌধুরী, মতিলাল সুর, মনোমোহন বসু, মহেন্দ্রলাল বসু প্রমুখ প্রথিতযশা অভিনেতা-পরিচালকদের সহযোগিতায় এমারেল্ড থিয়েটারের দশ বছরের অভিনয়ের ধারায় উন্নত মানের সৃষ্টি হয়েছিল।
- মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যের নাট্যরূপ এবং প্রহসন দুটির এখানে যেমন অভিনয় হয়েছিল, তেমনি মধুসূদনের সমাধিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য এই থিয়েটার উদ্যোগী হয়ে ৩ মার্চ, ১৮৮৮, মধুসূদনের বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ এবং গিরিশের মায়াতরু অভিনয় করে। অভিনয়ের বিক্রীত অর্থ সমাধিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য তারা দান করেন।
- দশ বছরের সময়কালে এমারেল্ড নানা ভাবের ও স্বাদের এবং বিভিন্নমুখী বিষয়ের নাটক উপহার দিয়েছে, একাধিক নাট্যকার ও তাদের নাটক রচিত ও অভিনীত হবার দায়িত্ব নিয়েছে। হাল্কা রং তামাশা বা শুধুমাত্র নৃত্যগীতের ফোয়ারা ছুটিয়ে দর্শককে সস্তা খুশিতে ভরিয়ে দেবার চেষ্টা করেনি।
- সেকালের থিয়েটারের তিন প্রধান ব্যক্তিত্ব গিরিশ, অর্ধেন্দুশেখর ও কেদার চৌধুরীর সাহায্য ও সহযোগিতা লাভে এমারেল্ড পরপর এগিয়ে যেতে পেরেছে।
এমারেল্ড তার দশ বছরের বিভিন্নমুখী কার্যাবলীর মাধ্যমে বাংলা রঙ্গালয়ের ইতিহাসে স্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছে। বড়লোকের নাতির শখ-শৌখিনতায় এমারেল্ড হারিয়ে যায়নি।
Leave a Reply